#এক কাপ চা
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ৪৬
(২১৬)
“এত নাটকের প্রয়োজন কী আদৌও ছিল?”
জুলির প্রশ্নে তাশদীদের অধর প্রসারিত হলো।ক্রুর উপহাস ফুটে উঠলো তার অধরে।দাঁড়িয়ে থাকা জুলির সম্মুখে চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা রাখলো।
“আপনি আমার বাসার কাজের মানুষ হলেও আপনাকে কখনো অসম্মান করে কথা বলিনি।কখনো আপনার সম্মুখে পায়ের উপর তুলে বসিনি।কারণ এটাকে আমার পরিবার শিখিয়েছে বেয়াদবি। তবে আজ বসলাম,কেন জানেন?আপনার বুদ্ধিকে টেক্কা দিতে পেরে।”
“অনেক দেরী হয়ে গেলো না?”
“নাহ্, সব সময়ই উপযুক্ত সময়।”
“এসবের পিছনে আমি এর কোনো প্রমাণ আছে?যার কথাটা তুমি বলছো সে মেয়ে আমিই হবো এর নিশ্চয়তা কী?”
“আপনি বড্ড বেশিই অধৈর্য্য। আমাদের বাড়িতে কাজ করা জুলির খালার ভাষা এবং আপনার বচন ভঙ্গি।”
“এটাতেই কিছু প্রমাণ হয় না তাশদীদ।”
“আপনার কী মনে হচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ ছাড়াই পুলিশ কর্মকর্তারা এসেছে?”
জুলি দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।শেষ মুহুর্তে এসে এভাবে তার সব কিছু হারিয়ে যাবে এমনটা চিন্তাও করেনি সে। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী
আগামীকাল সামিনার লাশ দাফনের পর সে স্নেহাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেত। এবার তার সবটা স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।তাশদীদ পুরোটা বেশ পাকাপোক্ত ভাবে প্ল্যান করেই করেছে।সে একদিকে বলেছে সাগরিকা ওরা অন্য কোথাও যাবে অন্য দিকে তার বিরুদ্ধে সাজিয়েছে দাবার শেষ চাল।এবং শেষ চালে সে কিস্তিমাত করেছে। আর জুলির সকল পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
তাশদীদের দাদী এগিয়ে হুইল চেয়ারে করে এগিয়ে এলেন।তাশদীদের হাত ধরে বললেন
“দাদা ভাই কও তো কী হইছে?এই জুলেখা কী করছে?আর ওই মেয়ার লগে ওর কী সম্পর্ক?”
“দাদু তোমার মনে আছে মেঝ কাকার একবার বিয়ের সম্বন্ধ এলো।মেয়ে বাড়ি থেকেই পাঠিয়েছিল।মেয়ের বাবা বিদেশের ডাক্তার। তার মেয়েকে পছন্দ করে বসলো মেঝ কাকা।”
বৃদ্ধা নাতীর দুই হাতে হাত রেখেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তার মনে আছে সব। এখনো দিব্যি চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
বিকেল বেলা গরুর গোয়ালের সামনে খড় বিছিয়ে রাখছিলেন তিনি।গাভীটার প্রসবের সময় এসে পড়েছে। তাশদীদ, তাজবিদ তখনো ছোটো, সাগরিকার বয়স মাত্র চার।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো।গাভী জন্ম দিয়েছিল এক অন্ধ বাছুর। গাভী প্রসবের কিছু সময় পূর্বেই তার মেঝ ছেলে এসে তার আশপাশ দিয়ে ঘুর ঘুর করছিল।ছেলের স্বভাব খুব ভালো করেই জানে। দুই বছর বিদেশ থেকে এবার মাস খানেকের ছুটিতে এসেছে।
মায়ের মন সন্তানের কথার ধরণ বুঝে। কাজ করার সময় সে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
“বাজান, কিছুই কইবা?”
আমতা আমতা করে ছেলে জবাব দিলো,
“মা আমি সাহায্য করি?”
“না, বাজান।আমি পারবো এসব তোমাগো কাম না।তুমি কিছু না কইলে এহেন থেকে যাও, ফ্যানের নিচে বওগা।”
“আসলে আম্মা একটা কথা।”
হাত থেকে খড় ফেলে দিয়ে ভদ্রমহিলা ছেলের দিকে তাকালেন। ছেলের মুখ কোনো কারণে লাল আভা ছড়াচ্ছে। তার কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে দিয়ে তিনি বললেন,
“আমার কাছে কীসের এত দ্বিধা আব্বা?কও কী কইবা।”
“আপনি রাগ করবেন না তো?”
” না গো আব্বা কও তুমি।”
“আম্মা, বিদেশে আমি যে হাসপাতালে চাকরি করি,সেই হাসপাতালের এক ডাক্তার আছে। বাঙ্গালী ডাক্তার, তার পরিবার নিয়ে বিদেশ থাকে। তার দুই মেয়ে, স্ত্রী মারা গেছেন।ছেলে নেই,যা আছে সব বলতে দুই মেয়েই”
“তাতে কী?”
“আম্মা আসলে আমি তার বড় মেয়েরে পছন্দ করি। তার মেয়েও আমারে পছন্দ করে। আর ডাক্তার টা এটা জানতে পারছে। সে আজ আমারে কল দিয়ে সব বলছে।তার কোনো আপত্তি নেই। সে চায় আপনার সাথে কথা বলতে। বিয়ের ব্যাপারে।”
ভদ্রমহিলা কিছু বলার সুযোগ পেলো না।গাভীটি প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছিল।সে ছেলেকে বলল রাতে কথা হবে এই বিষয়ে।গাভীর যন্ত্রণা উপশম করার চিন্তা মাথায় থাকলেও কানে অনবরত বাজছিল ছেলের বলে যাওয়া কথা গুলো।
মিনিট দশেক পর গাভীটি একটা অন্ধ বাছুর জন্ম দিলো।আর রাতে খাওয়ার সময়ের আগেই বাছুরটা মারা গেল।
গ্রামের মানুষ হিসেবে এসব খুব ভালো ভাবে নেয়নি সে। যে মেয়ের কথা জানতেই তার এত বড় ক্ষতি হলো সে মেয়ে ভালো হবে বলে তার মনে হলো না।এই মেয়ে সংসারে অশান্তি আনবে।
ছেলেকে ডাক দিয়ে এনে নিজ মাথায় হাত রাখিয়ে নিয়ে ওয়াদা করিয়েছিলেন।সে আর ওই মেয়ের সাথে যোগাযোগ করবে না।বাধ্য ছেলের মতোন সবটা মেনে নিয়েছিল কায়সার। তার দুই চোখ ছল ছল করতে দেখেছিল তার মা কিন্তু সে জানে ক্ষণিকের কষ্ট পেলেও তার ছেলে সামনে সুখী হবে।কারণ ছেলেকে ছাড়া তার থাকাটা সম্ভব নয় আর ছেলে যদি ওই মেয়ের কাছে থাকে তবে জীবনে কোন না কোন এক সময় আঘাত পাবেই।বিদেশ শহরের উচ্চশিক্ষিত মেয়ে গ্রামের এইট পাস ছেলেকে নিয়ে ঘর করতে চাইলে এটা মাত্র আবেগ ছাড়া কিছুই নয়।
ছুটি শেষ হলেও ফিরে যাওয়া হয়নি কায়সারের।অন্য দেশে ভিসা লাগালেন তার মামা।বিদেশ চলে যাওয়ার জন্য যে দিন বিকেলবেলা কায়সার বাড়ি থেকে বের হলো সেদিন সন্ধ্যে বেলা একটা গাড়ি এসে থামলো তার গেটের সামনে। বাড়ির বাইরে দাঁড়ানো গাড়িটি ছিল বিদেশী ডাক্তারের। বাইরে থেকে ভদ্রলোক অনেক অনুনয় করলেও তার কথা কানে তুলেনি কায়সারের মা।গ্রামের মানুষের মুখে শুনেছিল মেয়েটা না কী পুরো রাত বসেছিল গেটের বাইরে। অপরূপ সুন্দরী ছিল মেয়েটা।যেমন রঙ তার তেমন ঢঙ। পরদিন সকালে গ্রামের লোকের থেকে জানতে পারে কায়সার গতকাল বিদেশে চলে গেছে এরপর তারাও চলে যায়।
এত কিছু তার বাড়ির সামনে হলেও মেয়েটিকে চোখে দেখেনি তাদের বাড়ির কেউ।কারণ তার কড়া আদেশ ছিল কেউ যেন তার ধারে কাছে না যায়।
তাশদীদের দাদীর দুই চোখ ছল ছল করে উঠলো।শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
“জুলেখা?তুই সেই মেয়ে?”
অশান্ত জুলি এবার শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।তাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন বৃদ্ধা।
হিসহিসিয়ে বললেন,
“তবে আমি তো ভুল কিছু করিনি।তুই তো আস্ত এক সাপ। আমার কথা সব সত্যি করে দিলি।”
দীর্ঘ সময় চুপ থাকার পর জুলি বলল,
“আপনার ছেলের অনাদর আমি কখনো করিনি।তবে আপনি আমাকে কেন মেনে নেন নি?অনেক খোঁজ করে আপনার ছেলের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম।সে শুধু বলেছিল আমার মা কে রাজি করাও। এরপর আপনার ছেলেকে পাওয়ার লোভে আমি সব ছেড়ে ছুটে এলাম আপনার কাছে।আপনার মতো করে নিজেকে গড়ে নিতে চাইলাম।আমার মতো একজন মেয়ের নখে সামান্য ময়লা সহ্য করতে পারতো না, পেয়াঁজের গন্ধে শ্বাস নিতে কষ্ট হতো অথচ সেই আমি গোবর ফেলেছি, পঁচা পাঁটের আঁশ ছাড়িয়েছি।আপনি কী করলেন? ছেলে বিদেশ থেকে আসার আগেই সামিনার সাথে বিয়ে ঠিক করে ফেললেন।আমার চোখের সামনেই সে বৌ নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।তবুও আমার শান্তি ছিল, তাকে আমি চোখের দেখা দেখতাম।আমি চলে যেতাম কিন্তু রয়ে গেলাম। সামিনার প্রতি আপনার মন নষ্ট করার জন্য। অথচ যার জন্য এসব সে নিজেই তো মরে গেল।
আমার জীবনের সব রঙ নিয়ে সে পুড়ে ছাই হলো।কিন্তু এমন হতো না।যদি আপনি আমাকে মেনে নিতেন আপনার ছেলে এভাবে মরতো না।আজো।বেঁচে থাকতো।তাই আমি থেকে গেলাম আর আমার মন কে শান্ত করার জন্য যখন যা করতে ইচ্ছে করেছে আমি করেছি।আপনার হাতের নিচে থেকে আপনাকে ব্যবহার করেছি।সামিনাকে ব্যবহার করেছি।”
“আর স্নেহা?ও আপনার কী ক্ষতি করেছিল?বাচ্চা মেয়েটাকে ধর্ষণ করার জন্য আপনি টাকা দিয়েছিলেন?”
শুভ্রের প্রশ্নে জুলি ভ্রান্তের মতো হাসলো। এরপর বলল,
“আমি ওর ক্ষতি করতে চাইনি।কিন্তু ও আমার কথা পর পর দুই বার শুনেছিল।আর চেষ্টায় ছিল অন্যদের জানানোর।”
“আপনি আপনার দোষ স্বীকার করছেন তবে?”
“হ্যাঁ। আমিই সব করেছি।আমি স্বীকার করে নিচ্ছি।”
জুলিকে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো।তাকে নিয়ে যেতে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল স্নেহা।তাশদীদের গলা আঁকড়ে ধরে সে বেরিয়ে এলো বাড়ির বাইরের গেটে। পুলিশের গাড়ি চলে যাওয়ার পর পরই তাদের বাড়ির গেটে এসে থামলো লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি।
গাড়িটা দেখে স্নেহা কী বুঝলো কে জানে। তবে তার মা মা বলে চিৎকার করা শব্দে মুহুর্তেই ভারী হয়ে গেল চার পাশের পরিবেশ।
চলবে….