#এক কাপ চা
#পর্ব ৪৪
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(২১০)
একটা মৃত্যু, একটি জীবনের শেষ। অথচ মৃত্যুতেই মুক্তি। তবুও মৃত্যু মেনে নিতে আপনজনদের কষ্ট সব থেক্র বেশি হয়।
আপনজনের মৃত্যুতে আমরা কিংবা আমাদের অবচেতন মন বার বার প্রার্থনা করে, আমাদের কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা দান করার জন্য।
সামিনার মৃত্যুর সাত ঘন্টা পর তার ঘর থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। রাতের বেলা সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর সামিনার মৃত্যু হয়। সকালে স্নেহা ঘুম থেকে উঠে তার মা কে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে ভেবেছিল তার মা রাগ করে ফ্লোরে ঘুমিয়েছে। কিন্তু মায়ের কাছে যেতেই দেখতে পেল ফ্লোর লাল হয়ে আছে।
স্নেহার চিৎকারের শব্দ শুনে সাগরিকার মা দ্রুত দৌড়ে এলেন।ফ্লোরে রক্তের ছাপ দেখে আঁতকে উঠেছেন তিনি।ভদ্রমহিলা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী।ঘাবড়ে না গিয়ে স্নেহাকে কোলে তুলে নিলেন।হাত বাড়িয়ে নাকের কাছটায় নিতেই বুঝলেন তার সামনে নিথর দেহে পড়ে রয়েছে সামিনার লাশ।
ততক্ষণে বাড়ির বাকী সবাই চলে এসেছে। তাশদীদ কল করে ডাক্তার ডাকলেন।কিন্তু সামিনাকে স্পর্শ করতে দেয়নি শুভ্র। তার সন্দেহ হচ্ছে, সন্দেহ ধীরে ধীরে গাঢ় বর্ণ ধারণ করছে।সামিনার মৃত্যু অবশ্যই স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না তার।বিশেষ করে গতকাল রাতে সাগরিকার বলা কথা গুলো শুনে তার সন্দেহ আরো বেড়ে চলেছে।
বাড়ির সবার মুখ থমথমে অবস্থা। স্নেহাকে তুলির সাথে তার বান্ধুবীর বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ডাক্তার আসার পূর্বেই শুভ্র তাশদীদ কে বলল,
“পুলিশে খবর দেওয়া উচিৎ। আসলে উচিৎ নয়, বাধ্যতামূলক।”
“এখন পুলিশ মানে ঝামেলা নয়?স্পষ্ট দেখে বুঝা যাচ্ছে যে ওয়াশরুমে যেতে চাচ্ছিলো কিন্তু পারেনি। বমি করেছে, মাথা ফেটে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে এমন হয়েছে।”
“এজন্যই পুলিশ প্রয়োজন।মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। তাছাড়া ডাক্তার আসতে পারলে পুলিশ কেন পারবে না?কল টা কী তুই দিবি? না আমি?”
পুলিশ এসে সামিনার লাশ নিয়ে গেল।পোস্ট মর্টেম
রিপোর্ট আসার পর সামিনার মৃত্যুর কারণ জানা যাবে। পুরো সময় বাড়ির ভিতরে একজন মানুষও প্রবেশ করতে দেয়নি। কিংবা আশেপাশের বাড়ির কেউ জানতে পারেনি মৃত্যুর ব্যাপারে।
পুলিশ আসার পর সামিনার মৃত্যুর খবর বাতাসের বেগে সব দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আশেপাশের মানুষের নানান ধরনের মন্তব্য। কেউ বলছে অসুস্থ ছিল আবার কেউ বলছে আত্মহত্যা।
প্রাথমিক সুর হরতালে পুলিশ জানালেন এটা নিছক দূর্ঘটনা মাত্র।
পুরো দিনের ক্লান্তি এবার বিরক্তিতে পরিণত হয়েছে তাশদীদের। কিছু কারণ বশত মৌসুমির এ বাড়িতে আসাটা বন্ধ ছিল। তবে আজ সে সামিনার মৃত্যুর বাহানায় এ বাড়িতে ফিরেছে।তাদের কারোর মন মেজাজ এতটা ভালো ছিল না যে সে তার মায়ের সাথে কেমন ভাবে কথা বলছে এটা দেখবে। পুরো দিন বাসায় কিছুই রান্না হয়নি।সকালের চা -নাস্তাটাও টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে।
সীমার ডাকে সাগরিকা নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো।সামিনাকে দেখা শেষ চেহারাটা সে ভুলতে পারছে না।স্নেহার কি হবে এটা ভেবেই তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিজের মা-বাবা ছাড়া একটা দিন যেখানে কল্পনা করা তার জন্য কষ্টকর সেখানে স্নেহার মা-বাবা কেউ রইল না।বাবা ডাকটা সে ছোটো বেলায় মুখে বুলি ফোটার আগেই হারিয়েছে আজ মা ডাকটাও হারিয়ে গেল তার।
কিন্তু কারোর মৃত্যুতে কিছুই থেমে থাকে না।পরিবারের শোকের সময় দায়িত্ব আরোও বেড়ে যায়। নিজের দুঃখ কে চাপা দিয়ে হলেও এগিয়ে যেতে হয়। এটাই নিয়ম,পৃথিবীর সবথেকে নিকৃষ্ট নিয়ম।
নাস্তার টেবিল পরিষ্কার করে সীমা চুলোয় চা বসিয়ে দিলো।সাগরিকা সকল প্লেট, গ্লাস পরিষ্কার করে অন্য চুলোয় ভাত বসিয়েছে। আগামী তিন দিন তারা মাছ, মাংস খাবে না।এই নিয়ম কেন এটাও তারা জানে না।তবে ছোটো বেলা থেকে দেখে আসছে, কেউ একজন মারা গেলে মৃত বাড়িতে সেদিন ডাল,আলু ভর্তা,করল্লা ভাজি কিংবা শুক্তার পাতা নামক এক ধরনের খাবার দেওয়া হয়।
সীমা রান্না ঘরে ব্যস্ত ঠিক সে সময় সাগরিকা বাইরে সবাইকে চা দিলো।সামিনার জন্য কেউ কাঁদছে না।সবার শুধু একটু মন খারাপ।এই বিষয়টা সাগরিকাকে অল্প বয়সেই অনেক কিছু শিখিয়ে দিলো।আজ সামিনার মা বেঁচে থাকলে হয়তো মেয়ের জন্য কাঁদতেন।
স্নেহা তাশদীদের কোলে ঘুমিয়ে আছে। তার দিকে চা এগিয়ে দিতেই সে বলল,
“রুমে এসো।স্নেহাকে শুইয়ে দিতে হবে।”
নিজ রুমে ফিরে তাশদীদ দেখতে পেলো তাদের বিছানায় মৌসুমি ঘুমিয়ে আছে।মেজাজ খারাপ হলেও তাশদীদ বিষয়টা এড়িয়ে গেল।স্নেহাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।সাগরিকার ঘরে, তার বিছানায় শুইয়ে দিলো।চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সে ইশারা করে বসতে বলল।
” কিছু বলবেন?”
“একবার ভেবে দেখেছিস? যদি সত্যি মেঝ কাকী আত্মহত্যা করে তবে এর দায়ভার কার?পুরোটাই আমাদের।”
“আমাদের কেন?”
“তার প্রতি ইদানীং আমাদের পরিবারের ব্যবহার চিন্তা করেছিস?ডিপ্রেশনটা কী স্বাভাবিক নয়?তার ব্যাংকে টাকা ছিল অথচ টাকা তুলতে হলেও আমাদের লাগতো। নিজের ইচ্ছা, শখ সব ত্যাগ করেছিল কেবল মাত্র স্বামী নেই বলে।”
“হুম।তার করা ভুলগুলো না হয় ভুলে যাই আজ।মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে কটু কথা নাই বা বলি।”
“সাগরিকা এবার তোর নিজের জীবন নিয়ে চিন্তা করা উচিৎ।”
“আমার জীবন মানেই তো আপনি।এই কাজে আমি পারদর্শী।”
“আমি চাই না তোকে কেউ তাশদীদের স্ত্রী কিংবা আমাদের সন্তানের মা বলে জানুক।আমি না থাকলেও তোকে চলতে হবে। জীবনের হাল ছেড়ে দিলে চলবে না।”
সাগরিকা ফ্লোরে বসে তাশদীদের দুই হাত আবদ্ধ করে বলল,
“কী ভাবছেন?”
“আজ যদি কাকী স্বাবলম্বী থাকতো, নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে জানতো তবে তার পরিণতি এমন হতো না।”
সাগরিকা নিশ্চুপ রইল।তাশদীদের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো সে। এই মানুষটা ছাড়া সে যে অচল হয়ে যাবে। তবুও এই মানুষের সিদ্ধান্ত মাথা পেতে মেনে নিবে।তাশদীদ উবু হয়ে থুতনি ঠেকালো পিঠে।
তপ্ত শ্বাস এসে পড়লো মেয়েটার দেহে।এরপর সে ফিসফিস করে বলল,
“তুই আমার প্রভাতের এক কাপ চা হয়ে যা, আমি প্রতি চুমুকে না হয় তোকেই চাইবো।”
(২১১)
রাতের সকল কাজ শেষ করে সাগরিকা নিজ রুমে ফিরে দেখতে পেল মৌসুমি কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাশদীদ বিছানায় বসে আছে তবে তার মুখে রাজ্যের বিরক্তি। সাগরিকা কাছাকাছি আসতেই সে বলল,
“ঘুমিয়ে পড়, সকালে কথা হবে।”
বিনাবাক্যে স্নেহার পাশে বসে তার গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠলো সে।পুরো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তাশদীদকে কিছু বলার পূর্বেই স্নেহা ঘুমের মাঝেই বমি করে বিছানা ভাসিয়ে দিলো। তড়িঘড়ি করে তাশদীদ উঠতেই খাটের সাথে পা লেগে বেশ ব্যথা পেলো সে। তবুও স্নেহাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।রাত তখন এগারোটা, হুট করেই থানা থেকে কল আসার কারণে বেরিয়ে যেতে হয়েছে রাশেদ এবং তাজবিদ কে। সাগরিকার বাবার হঠাৎ করে প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল সে ঘুমে। বাধ্য হয়েই তাশদীদ এবং সাগরিকাকেই যেতে হবে হাসপাতালে। ব্যথার কারণে তাশদীদের হাটা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়েই শুভ্রের সাথে যেতে দিতে হলো সাগরিকাকে।স্নেহার অবস্থা দেখে বাড়ির সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিল।সবে মাত্র বাড়িতে একটা মৃত্যু হয়েছে। শুভ্ররা বেরিয়ে যেতেই তাশদীদ ফিরে এলো নিজ রুমে।ব্যথা উপশমের জন্য খাওয়া মেডিসিনের কারণে ঘুম নেমে এলো তার দুই চোখে।
(২১২)
“এই শেষ সময়ে এসে আপু তুমি এত বড় ভুল কী করে করলে? এবার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলে তো সবাই বুঝে যাবে।”
“আমি সামিনাকে কিছু দেইনি।”
জুলির উত্তরে ফোনের অপর পাশ থেকে তার বোন দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।
“আমার মনে হচ্ছে না। তুমি নিশ্চয়ই রাগের বশে এমন করেছো।কারণ দুই দিন পরেই…..”
“আমি দেইনি। আর দিলেও বা কী?আমি চেয়েছি এই পরিবারের সর্বোচ্চ ক্ষতি।”
“পেরেছো কী?আজ থানায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে স্নেহার মামাতো ভাইকে কে ছাড়িয়েছে।শুভ্র নামের একটা ছেলে এসেছিল খোঁজ নিতে। তোমার কী মনে হচ্ছে না এরা দুইয়ে দুইয়ে চার করে ফেলবে?খুব দ্রুত তোমার বিপদ আসবে।অনেক হয়েছে
প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে অন্যায়কারীর ক্ষতিসাধন।আর নয়, আমি টিকিট কেটে রাখছি।তুমি বাবার কাছে ফিরবে।”
“আমি ফিরতে পারবো না রে। আমার শান্ত জীবনটা এই পরিবার নষ্ট করে দিয়েছে। আমি আমার জীবনের পনেরোটা বছর নষ্ট করেছি।এই বাড়ির থালা বাসন ধুয়েছি, সব করেছি।বাবার স্নেহ, আদর, ভালোবাসা আমার জীবনের সফলতা সব ত্যাগ করেছি।তাই এই মুহুর্তে আমি ফিরতে পারবো না।”
“কিন্তু ওরা?”
“সামিনার মৃত্যুকে ঘুরিয়ে দিতে হবে অন্যের শোক দিয়ে। সামিনার মৃত্যু ওদের ওতটা শোক দেয়নি।যতটা অন্যের মৃত্যু দিবে।সাগরিকা,শুভ্র স্নেহা কে নিয়ে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছে।ওদের কিছু হলেই পুরো পরিবার ভেঙ্গে যাবে। সেই সময় ভদ্রমহিলা বুঝতে পারবে, ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু কতটা যন্ত্রণার হয়।”
রান্নাঘরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাশদীদের বাবা শেষের কথা গুলো শুনতে পেলো।কোনো শব্দ না করে বেরিয়ে এলো সন্তর্পণে।
আপাতত তার কাউকে কিছু জানানোর সময় নেই। তাকে খুব দ্রুত পৌঁছাতে হবে তার কলিজার টুকরোদের কাছে।
চলবে ….