#এক কাপ চা
পর্ব ২৬
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(৭৬)
স্নেহার ডান পা অনেকটা ফুলেছে। সাগরিকার নাক দিয়ে বেশ খানিকটা রক্ত ঝরেছে। দুজনে পাশাপাশি একটা খাটে শুয়ে আছে।সাগরিকার মাথার কাছে ইখুম বসে আছে। মেয়েটার অসম্ভব জ্বর এসেছে। ভয় পেয়েই যে জ্বর এসেছে এটা আর বুঝতে কারোর বাকী নেই। পাশের ঘরে সামিনাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। অতিরিক্ত দুর্বলতার কারণে সে উপায় জ্ঞানহীন।
রাশেদ ইখুমের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার কাধে হাত রাখতেই ইখুম দুহাতে শক্ত করে রাশেদের কোমর জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।
কান্নার দমকে তার হেঁচকি উঠেছে।
রাশেদ ইখুমের মাথায় হাত রেখে বলল,
” শান্ত হও, ওরা ঠিক আছে। তোমাদের কাঁদতে দেখলে আরো ভয় পেয়ে যাবে।”
“আমি চাই না আমার পেটের সন্তান মেয়ে হোক।আর যদি মেয়ে হয় তবে যেন মরে যায়। এই জঘন্য পৃথিবীতে আমি তাকে আনতে চাই না।”
ইখুমের এমন কথায় রাশেদ তাকে কিছুটা ধমক দিয়ে বলল,
“কী বলছো এসব?এসব কথা বলতে নেই।”
“স্নেহার পাঁচ বছর হয়নি।ওর শরীরে কামনার কিছুই নেই। ও একটা ছোট্ট পুতুলের মতোন।কেউ কীভাবে ওর দেহকে কামনার বস্তু মনে করতে পারে?ওকে এভাবে আঁচড়ে কামড়ে দিতে পারে?”
“নরপশুরাই পারে। আমরা তো আছি। আমরা থাকতে কেউ কিছুই করতে পারবে না।”
“কই আছি?স্নেহা কতটা সহ্য করেছে?”
আমরা তো এখনো আছি। পেরেছি মেয়েটার কষ্ট লাগব করতে?এইযে ছোটো বেলার ট্রমাটা!এই ট্রমা থেকে বের করে আনতে পারবো তো?”
“পারবো।আমরা সবাই মিলে মেয়েটাকে স্বাভাবিক করে ফেলবো তুমি দেখো।এবার চলো ঘুমাতে যাবে।”
“স্নেহাকে আমি নিয়ে যাই?আমাদের সাথে আজ রাতে থাকুক।”
“আচ্ছা বেশ তবে চলো।”
সাগরিকার গায়ে চাদর টেনে দিয়ে ইখুম উঠে দাঁড়ালো।রাশেদ খুব সাবধানে স্নেহাকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
তাশদীদ রাশেদকে দেখে এগিয়ে এসে বলল,
“সাগরিকা?”
“ঘুমে।”
“একা? “
“হুম,তুই বরং যা। মেঝ ভাবীর কাছে ওর মা।তুই বরঙ ওর কাছে থাক।”
তাশদীদ ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা ধরেছে।
সাগরিকার পাশে বসে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তোর এত সাহস কোথায় থেকে এলোরে?তুই কী নিজের জন্য একটুও ভয় হলো না?”
সাগরিকা পাশ ফিরে তাশদীদের হাতে হাত রেখে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
“আপনি থাকতে আমার ভয় কীসের?আপনি আমার রোগ-শোক, আনন্দ-বিচ্ছেদ সব কিছুর স্থান।তবে আমি কেন ভয় পাবো?”
তাশদীদ কিছুই বললো না, বিনিময়ে ফুটে উঠেছে তার ঠোঁটের কোণে হাসি।সাগরিকার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি সারা জীবন আছি, থাকবো।তোকে আদর করার জন্য, স্নেহ করার জন্য কিংবা তোর অন্যায় আবদার গুলোকে প্রশয় দেওয়ার জন্য। আমি আমার পুরোটা সময় তোকেই নিয়ে ভাবতে চাই। তোর রোগ-শোক নয় তোর সব কিছুই আমাকে ঘিরেই হোক।”
(৭৭)
সাগরিকা তাশদীদের গাড়ি যখন শহরের কাছাকাছি দিকটায় তখন স্নেহা সাগরিকার ফোনে কল দিয়ে কান্নাকাটি করছিল।সাগরিকা কিছু বলার আগেই স্নেহা বলেছিল ওর মা না কী মরে গেছে।
আর ও লুকিয়ে আছে। ও বের হলেই ওর মামাতো ভাই ওর সাথে বর বৌ খেলবে। ওকে খুব ব্যথা দিচ্ছে আজ।
পুরোটা শুনতে পারেনি তাশদীদ। দ্রুত গাড়ি ঘোরাতে বলে।কিন্তু ওরা পুরো উল্টো পথে ছিল।এখান থেকে যেতে হলেও ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। তাশদীদ বা সাগরিকা কারোর বুঝতে বাকী নেই যে স্নেহা কী বুঝাতে চেয়েছে।
এমনটা ভেবে সাগরিকা ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠছে। রাগে তার পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছিলো।
সাগরিকার হাত থেকে ফোন নিয়ে তাশদীদ স্নেহাকে জিগ্যেস করলো,
“তুমি ফোন পেয়েছো কোথায়?”
“মায়ের ফোন।”
“মেঝ কাকী কোথায়?”
“মা জানি না।ভাইয়া বলছে মা মরে গেছে। আর আমি বর বৌ খেলার কথা তোমাদের বললে তোমরা আমাকে আদর করবে না।বাড়িতে নিবে না।ভাইয়া আমি বাড়ি যাবো।তুমি কী আমায় পঁচা বলবে?আমায় নিবে না?”
“সোনা কাঁদে না। তুমি না আমাদের ব্রেভ গার্ল?আমরা আসছি।তুমি বলো তুমি কোথায়?”
“আমি রান্না ঘরে লুকিয়ে আছি।পাতার বস্তার পিছনে।”
“সোনা তুমি ওখানেই থাকবে। ভয় পাবে না।আমি আসছি দ্রুত। ভয় নেই।কাঁদবে না।কেউ ডাকলে বের হবে না।বুঝেছো?”
“তুমি আমায় বকবে না তো?”
“কেন বকবো?”
“এই যে আমি তোমায় বলে দিলাম বর বৌ এর কথা।”
“না আপু।তুমি তো ভালো মেয়ে, লক্ষী মেয়ে তাই তোমাকে বকবো কেন?”
“আসবে তো?”
“এইতো এসে পড়েছি।”
সাগরিকা তাশদীদের হাত থেকে ফোন নিতেই ফোন কেটে গেলো।কেটে যাওয়ার আগে শুধু তারা স্নেহার চিৎকার শুনেছিল।
যাওয়ার পথেই তাশদীদ শুভ্র,রাশেদ, মুনিরকে কল দিয়ে সবটা বলে। ওদের কারোর বুঝতে বাকী থাকে না যে স্নেহা কতটা বিপদে রয়েছে।
রাশেদ সব থেকে ভয় তখন বেশি পায় যখন তাশদীদের সাথে কথা বলার পর স্নেহা তার নাম্বারে কল দিয়ে বলে,
“তার মামাতো ভাইয়ের বন্ধুরাও এসেছে। তাকে সবাই মিলে খুঁজছে।”
সাগরিকা, তাশদীদ যখন পৌঁছেছে তখন জোহরের আজান দিচ্ছে। পুরো বাড়িতে কেউ নেই। এই বিষয়টা তাশদীদের খটকা লাগলো।সাগরিকার হাত ধরার আগেই সে এক ছুটে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেছে। ভিতর বাড়ির উঠোনের সামনে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে উঠলো।
মানুষ রুপী কয়েকজন জানোয়ার তখন স্নেহাকে নিয়ে নগ্ন করার উল্লাসে ব্যস্ত। স্নেহার গায়ের জামা খুলে ফেলেছে। স্নেহা কান্নায় ভেঙে পড়েছে।তার হাতে, পায়ে কয়েক জায়গায় জানোয়ারগুলোর নখের দাগ বসেছে।
সাগরিকা এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে পাশে থাকা একটা বাঁশ উঠিয়ে নিয়ে সজোরে আঘাত করে একজনের পিঠে৷ বাঁশটা ভেঙ্গে যায়। সাগরিকাকে দেখে চিৎকার করে স্নেহা।স্নেহা
তার কাছে আসতে চাইলে তার মামাতো ভাই বলল,
“ভুল বুঝবেন না।ফুপু বাসায় নেই।মা ওরাও নেই।আমরা সবাই পুকুরে গোসল করতে যাবো।স্নেহাকে নিতে চাইনি।ও যেতে চাচ্ছে, কান্না করছে তাই ওর জামা খুলে দিচ্ছিলাম।”
সাগরিকা সে দিকে পাত্তা না দিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে করতে বলল,
“কুত্তার বাচ্চা। তোর সাহস কী করে হয়। শালা তোদের আজ দেখ কী করি।”
তাশদীদ দৌড়ে এসে দাঁড়িয়ে রইল।সে কাকে ধরবে?স্নেহার পা দেখে তার মনে হচ্ছে ভেঙ্গেছে এদিকে সাগরিকা সবগুলো মারছে।
নিজের ব্যথা ভুলে তাশদীদ এক হাতে স্নেহাকে কোলে তুলে নিয়ে অন্য হাতে সাগরিকাকে সামলানোর চেষ্টা করলো।ততক্ষণে রাশেদ ওরা পৌঁছেছে।
শুভ্র সাথে পুলিশ নিয়ে এসেছে। তিনজনকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছিলো তখন সে কিছুটা ছুটে এসে একটা ইটের টুকরো নিয়ে সাগরিকার দিকে ঢিল ছুড়ে দিলে তা সরাসরি সাগরিকার নাক বরাবর এসে লাগে। সাথে সাথেই রক্ত ঝড়তে থাকে।
তাশদীদ স্নেহাকে শুভ্রর কোলে দিয়ে মুনিরকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পায়,
সামিনা পড়ে আছে ফ্লোরে। তার কোনো হুশ জ্ঞান নেই।পাশেই পড়ে আছে তার বড় ভাই ভাবী।
পুলিশ তাদের দেখে ধারণা করে বলল,
খুব সম্ভবত তাদের চেতনানাশক কিছু একটা খাওয়ানো হয়েছে। কারণ তাদের সামনে রয়েছে আধ খাওয়া শরবতের তিনটে গ্লাস।
(৭৮)
এক ঘুমে রাত পার করে সাগরিকা কেবল উঠে বসেছে। তার পাশেই তাশদীদ ঘুমিয়ে আছে। তাশদীদের কপালে হাত দিয়ে শুয়ে থাকার ধরণটা সাগরিকার খুব ভালো লাগে।
আলতো স্পর্শে সাগরিকা হাত বুলিয়ে দেয় তাশদীদের ভ্রু-যুগলে।
কিছুটা উবু হয়ে তার বুকের দিকটায় হাত রেখে বলল,
“সারা রাত এখানে ঘুমালেন যে?লোকে দেখলে কী বলবে?”
বিছানা ছেড়ে উঠে সাগরিকা বাহিরে আসতেই খেয়াল করলো তার দিকে সবাই কেমন একটা করে তাকাচ্ছে।
শুধু তুলি এসে বলল,
“আপু গোসল কেন করোনি?”
“এই শীতে এত সকালে গোসল কে করে?মাথা খারাপ?আমি তো ভাবছি আজ গোসল করবোই না।”
“বিয়ের রাতের পর ফরজ গোসল করে এটা জানো না?”
“বিয়ে?ফরজ গোসলের জন্য বিয়েটা দরকার।”
“আমি নিশ্চিত আপু তুমি গতকালের সব কথা ভুলে গেছো। তাইনা?”
তুলির কথায় কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে সাগরিকা জিজ্ঞেস করলো,
“মানে কী?”
“মানে এই যে গতকাল রাত ১২ টায় এত্ত ড্রামা করে , নানুকে গালি দিলে, মৌসুমি আপুকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে তাশদীদ ভাইয়ার গলায় ছুড়ি রেখে বিয়ে করলে সব’টা ভুলে গেলে?”
চলবে…