#এক কাপ চা .
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ৮
(২২)
সামিনাকে এই বাড়িতে রাখা এখন সবার চক্ষু লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।রাশেদ বা সামিনা কেউ তাদের সম্পর্কের সত্যতা প্রকাশ করছে না কিন্তু তাদের ব্যবহার বড্ড বেশি ভয়ংকর।
স্বামীর দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে তাশদীদের মা বলল,
“সামিনার বিষয় নিয়ে আম্মার সাথে কথা বললে কেমন হয়?”
“এছাড়া উপায় দেখছি না।”
“আপনি আরেকটু শক্ত হোন রাশেদের প্রতি।”
“তাশদীদের মা!
রাশেদ এখন যথেষ্ট বয়সের হয়েছে। ওর জীবনে আমাদের হস্তক্ষেপ মেনে নিবে না। কেউ নেয় না।যতটা পেরেছি ভয় দেখিয়েছি।বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছি,ব্যবসা ছাড়তে বলেছি।ও সব ছাড়তে রাজি।এরপর আমি ওকে আর কি দিয়ে আটকাবো?”
“আপনি ওর বড় ভাই।সেই অধিকারে আটকান।”
“যেখানে সন্তান বাবা-মায়ের কথাই পাত্তা দেয় না,আমি তো বড় ভাই।আমি বড়জোর বুঝাতে পারি।কিন্তু কি বলোতো!
ওই ছোটো বৌটার মুখ দেখলে খুব খারাপ লাগে।কতই বা বয়স? আমাদের রুনি বেঁচে থাকলে ওর বয়সের হতো।”
কথাগুলো বলে ভদ্রলোক একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন।তাশদীদের মায়ের চোখ মুখ হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠলো।
তার প্রথম সন্তান তাশদীদ নয়।ছিল তার মেয়ে। তাশদীদ তার সতিনের ছেলে। মেয়েটা বছর চারেক বয়সে পানিতে ডুবে মারা যায়। তখন তাজবীদ পেটে ছিল।কখন পুকুর পাড়ে শাপলা তুলতে গিয়েছিল কে জানে?
মরে ভেসে উঠেছিল মেয়েটা৷পাটের খড়ির মতোন আংগুলগুলো নীলচে কালো হয়েছিল।পেটেও অনেক পানি ঢুকে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল।
মেয়েটাকে সেই যে দাফন করেছিল এরপর অনেক বছর স্বপ্নেও দেখেনি তাকে তার মা।কিন্তু দেখেছিল যেদিন তার শ্বশুর মারা যাবে তার আগের দিন রাতে।
জীর্ণশীর্ণ কাপড়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটি মুখে হাসি নেই।রাগ রাগ চোখে বলল,
“দাদাকে নিতে এসেছি। যেতে দাও।”
পরদিন তার শ্বশুর মারা গেলেন।ঠিক এমন স্বপ্ন সে দেখেছে কায়সার মারা যাওয়ার আগেও। মেয়ে এসে তার কাকার হাত ধরে চলে যাচ্ছে।
হতে পারে কাকতালীয় কিংবা তার মস্তিষ্কের কোনো মিথ্যে কল্পনা তবুও সে তার মেয়ের স্মৃতি মনে করতে ভয় পায়। বড্ড ভয় পায়।
(২৩)
তাশদীদের সামনাসামনি কাকতালীয় ভাবে হলেও আসাটা যেন সাগরিকার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাদ থেকে ফিরে এসেই তার মুখোমুখি সে।
তাশদীদ তখন গোসল সেরে তোয়ালে গলায় ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসছিল।
সাগরিকার নাক ঠেকেছে একদম তাশদীদের বুক বরাবর। এত সর্দি থাকা স্বত্বেও সাগরিকা একটা মিষ্টি সুবাস পেল।গন্ধটা কিসের তার বুঝতে সময় লেগেছে মাত্র কয়েক সেকেন্ড। এটা বেলীফুলের গন্ধ। নিশ্চয়ই তাশদীদের শাওয়ার জেলের স্মেল এটা। আজকেই ওটাকে হাফিস করে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে হবে।অন্তত নামটা জানার জন্য হলেও নিতে হবে। পরে সময় বুঝে ফেরত দিয়ে দিবে। চুরি করা তার স্বভাব নয়। যতই তাকে সবাই খেপাচ্ছে,
“গরু খায় মাঠে ঘাস
সাগরিকা অটোপাশ”
তবুও সে ওসব পাত্তা দিবে না বলেই ঠিক করেছে। এত কিছু কথা সব মনে মনে ভাবছিল সাগরিকা এবং তার মাথা তখনো তাশদীদের উন্মুক্ত বুকে।হঠাৎ তার দুই ঠোঁট স্পর্শ করেছে তাশদীদের উন্মুক্ত শরীরে। এক বার, দুই বার, কয়েক বার এমন হলো।সাগরিকা যেন নিজের মধ্যে নেই।অন্য কোনো এক সত্তা কাজ করছে তার ভিতর।হঠাৎ দুচোখ বেয়ে নামলো এক নোনা স্রোত।
ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে তাশদীদ। পরক্ষণেই মনে হলো,
“যে জ্বর ওর গায়ে, ঠিক আছে তো?”
কাধের দিকটায় হাত রাখতেই মাছের মতোন লাফিয়ে সাগরিকা দূরে সরে গেল।তার নজর তাশদীদের পায়ের দিকে।
“কিছু বলবি?”
রাশভারি গোছের মানুষ তাশদীদ। হিমশীতল কণ্ঠ তার কিন্তু ভয়ংকর কামুকতা উপচে পড়ছে এই কণ্ঠে। মুদিত নয়নে সাগরিকা একবার তাকিয়ে দেখলো তাশদীদের দিকে। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে দিলো ভো দৌড় নিজের ঘরের দিকে।
তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে তাশদীদ আপন মনেই হেসে উঠে বলল,
“নদীর তীরের ছোট্ট সবুজ ঘাসের প্রচন্ড ইচ্ছে থাকে
সে গা ডুবাবে নদীর জলে,
স্পর্শ করবে প্রতিটি জল কণাকে
কিন্তু বর্ষা মৌসুমে যখন জল থৈথৈ
তখন ছোট্ট ঘাস পানির স্রোত তীব্রতায় হারায় নিজের অস্তিত্ব।
হারানো নিশ্চিত জেনেও ভালোবাসার উন্মাদনায় সবাই জড়ায় না।
নদীর এপাড় ভালোবেসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অপর পাড়ের ভালোবাসার আশায়।”
বিকেল বেলা আজ সবাই যাচ্ছে বিয়ের বাজার করতে। ইখুমের ঘর থেকে সাগরিকা দুই বার ফিরে এলো। ইখুম ঘুমিয়েছে। সাগরিকার মা বলল তবে সে থাকবে। আর ইখুমকে জাগানোর প্রয়োজন নেই।সামিনা বাকী সবাইকে নিয়ে তাজবীদ যাচ্ছে।
সামিনা যাচ্ছে বলে কিছুটা নারাজ সাগরিকা আর তুলি।ইদানীং অসহ্য লাগে তাকে। রাশেদ অফিস থেকে সরাসরি যাবে। ওদিক থেকে মৌসুমি আর ওর মা আসবে।
ইখুমের শরীর ভালো না তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
কিন্তু সামিনা হঠাৎ জানালো তার প্রচন্ড পেট ব্যথা করছে এবং বার বার টয়লেটে যাচ্ছে সে। তাই যাবে না।কিন্তু তাশদীদের মায়ের তো ওদিকে সাহায্য প্রয়োজন হবে। অন্য মেয়েরা এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে না।উপায়ন্তর না পেয়ে সাগরিকার মা পুনরায় তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল শপিং এর উদ্দেশ্যে।
সাগরিকা ভেবেছিল তাশদীদ যাচ্ছে না। তাই মনের সুখে গান গাইতে গাইতে বের হচ্ছে। বাড়ির মূল গেট পেরিয়ে যাওয়ার পর দেখতে পেল তাশদীদ দাঁড়িয়ে আছে। হাত দিয়ে ইশারা করতেই গাড়ি থেমে গেল।লক খুলে দিয়ে তাজবীদ বেরিয়ে আসছিল কিন্তু নিষেধ করে সে তুলিকে বলল,
“সাগরিকাকে বল বেরিয়ে আসতে।”
হুকুম দেওয়া শেষ, সে দাঁড়িয়েছে বাইকের সামনে। সাগরিকা বেরিয়ে এলে তার হাত ধরে তাজবীদ কে বলল চলে যেতে। তাকে টেনে নিয়ে এলো দোতলার ঘরে। দরজা বন্ধ করে এক টানে সাগরিকার ওড়নার পিন খুলে নিয়ে গলায় প্যাঁচিয়ে ধরেছে তাশদীদ।
বাঁচার জন্য আকুতি সাগরিকার দুই চোখে।সে জানে চিৎকার করেও লাভ নেই।শাস্তি আরো বাড়বে।তার দিকে তাকিয়ে রক্তচক্ষু তাশদীদ জিজ্ঞেস করলো,
“তোর ওড়না ছাড়া ছবি আমার বন্ধু মিহাদের কাছে কীভাবে?আমার ঘাড়ের উপর কাঁঠাল রেখে কাঁঠাল খাও?একদম মেরে ফেলবো আজ তাকে।”
একরাশ ভয়,অস্বস্তি, যন্ত্রণা নিয়ে সাগরিকা নুইয়ে পড়লো তাশদীদের বিপরীত দিকে।
(২৪)
জুলি ইখুমকে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছে আজকের খাবারে। তার জন্য তাশদীদের মা কাতল মাছ রান্না করেছিল যা আর কেউ খায়নি। সেই খাবারেই মিশিয়েছে। ফলে ইখুম বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
শপিং এ যাওয়ার জন্য যখন সামিনা তৈরী হচ্ছে তখন সে সামিনাকে জানায় সব। আজকেই উপযুক্ত সুযোগ ইখুমের ক্ষতি করার। রাশেদ ইচ্ছে করেও কিছু করবে না,কারণ কে চাইবে তার নিজের সন্তানের ক্ষতি হোক?
সাত পাঁচ না ভেবেই সামিনা জুলির কথায় সায় দিয়েছে। জুলি একজন মালিশ ওয়ালিকে ডেকে এনেছে। যার না কি বিশেষ ক্ষমতা আছে। যে পায়ে মালিশ করে দেয়, সাথে কি করে যার জন্য বাচ্চা মায়ের পেটেও মারা যেতে পারে।তাছাড়া সে টোটকাটুটকিও জানে। সামিনা আর নিষেধ করেনি।সবাই বেরিয়ে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পর মালিশ ওয়ালি এলো।তাকে নিয়ে সামিনা ধীরে ধীরে উঠেছে ইখুমের ঘরে। ইখুম তখনো ঘুমে।
তার পাশে বসে সামিনা বলল,
“আমি দুঃখিত ইখুম।কিন্তু আমি নিয়তি কাছে অসহায়।টিকে থাকতে হলে বাঘকে অবশ্যই তার সন্তানের জন্য যেমন হরিণকে শিকার করতে হয় ঠিক তেমনি আমার স্নেহার ভবিষ্যৎ অন্তত ওর বাবার পরিচয়ের জন্য তোমার সন্তানের ক্ষতি প্রয়োজন। তোমার জীবন অনেক বাকী, তুমি আবার মা হতে পারবে, আমি পারবো না।তাই এটুক ত্যাগ তোমাকে করতেই হবে।”
চলবে …………..