# আরশিযুগল প্রেম .
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
#পর্ব – ৫৫
পাতলা ফিনফিনে ঘুমানোর কাপড়টাতে ভীষণ স্নিগ্ধ আর আবেদনময়ী লাগছে পৃথাকে। ঘাড়ে পড়ে থাকা রেশমি চুলগুলো দমকা বাতাসে থেকে থেকেই শূন্য হাওয়ায় আছড়ে পড়ছে। সারা শরীরময় শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে। তার ঠিক পেছনেই খুব ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রব। চোখে-মুখে প্রেমময় ঘোর। পৃথা একরাশ লজ্জায় মাথা নুয়ালো। নীরব হাসি দিয়ে আদিম খেলার সঙ্গী হতে লাজুক সম্মতি জানালো। সাথে সাথেই শুভ্রবের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো বহু আকাঙ্ক্ষিত তৃপ্তির হাসি। শুভ্রব আরো খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট পোঁড়া ঠোঁট জোড়া এগিয়ে নিলো পৃথার কানের কাছে। মৃদু ফিসফিস শব্দ তুলে বলল,
—-” লজ্জা পেলে তোমায় আরো বেশি আবেদনময়ী লাগে পৃথা।”
পৃথা ধরফর করে উঠে বসলো। সারা শরীরে ঘাম হচ্ছে তার। ডানহাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁট আর নাকের উপরের ঘামটুকু মুছে নিয়ে গাঢ় নিশ্বাস ফেলল সে। দরজার বাইরে থেকে ব্যস্ত কলরব কানে আসছে। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজনের গুঞ্জন সকালটাকে আরো বেশি কর্ম ব্যস্তময় আর উৎসবমুখর করে তুলেছে। পৃথা কম্বল সরিয়ে বিছানা ছাড়লো। হাত-পা ঝিমঝিম করছে তার। ওয়াশরুমে ঢুকে প্রতিদিনকার ব্যবহার করা ব্রাশটা নিতে গিয়েই উপলব্ধি করলো, তার হাতটা মৃদু কাঁপছে। পৃথা দু’হাতের আঁচলা ভরে পানি ছিঁটাল মুখে। শুকনো ঢোক গিলে আয়নার দিকে তাকালো। দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কে চোখদুটোকে ভয়ার্ত হরিণীর মতো দেখাচ্ছে। আচ্ছা? পৃথা কি খুব খারাপ ধরনের মেয়ে? নয়তো এমন বাজে স্বপ্ন কেন দেখবে সে? এতোটা নিকৃষ্ট স্বপ্নও কেউ দেখে? আর ওই অসহ্যকর, অভদ্র মানুষটিকে নিয়েই কেন স্বপ্ন দেখতে হবে তাকে? ওই লোকটা কে তো এক মুহূর্তের জন্যও সহ্য হয় না তার। তাহলে তার সাথেই এমন নিকৃষ্ট স্বপ্ন কেন? পৃথার গা ঘুলাতে লাগল। নিজেকে কেমন সস্তা আর বাজে ধরনের মেয়ে বলে বোধ হতে লাগল। বারবার মনে হতে লাগল, নাহ্, ভালো মেয়েরা তো এমন স্বপ্ন দেখার কথা নয়! তবে কি সে খারাপ ধরনের মেয়ে? একদম নোংরা ধরনের? বেসিনের ওপর দু’হাতে ভর দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালো পৃথা। চোখদুটো বন্ধ করার সাথে সাথেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো স্বপ্নে দেখা সেই দৃশ্যপট। পৃথা তাড়াহুড়ো করে চোখ মেলে তাকালো। এই বিশ্রী দৃশ্যটি আর দেখতে চায় না সে, কিছুতেই না।
_____________________
রান্নাঘরের ছোট্ট জানালাটা ভেদ করে সকালের কমলা রঙের নরম আলো এসে পড়ছে কেবিনেটের ওপর। জানালার পাশে থাকা বিশাল হিমঝুরি গাছ থেকে ফুলের গন্ধ এসে লাগছে নাকে। চুলায় বসানো প্রেসার কুকারে তীক্ষ্ম হিশ হিশ শব্দ উঠছে। পুরো রান্নাঘরটা হিমঝুরি ফুল আর মাংসের সুগন্ধে মৌ মৌ করছে। রান্নাঘরের একপাশে বেশ মনোযোগ দিয়ে রুটি বানাচ্ছিলো শুভ্রতা। মাথার ঘোমটা ঠিক রেখে বেলনা চালাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।কিন্তু, অদ্ভুত এক কারণে রুটিগুলো গোল হচ্ছে না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও এদিক ওদিক কোণা বেরিয়ে পড়ছে। শুভ্রতা কপাল কুঁচকে নতুন রুটিতে হাত দিলো। পাশ থেকে মধ্যবয়স্কা এক মহিলা আফসোসের গলায় বললেন,
—-” ও কি সাহেরা? তোর ছোট পোলার বউ তো দেখি ঠিকঠাক রুটিটাই বেলতে পারে না। বাপের বাড়ি থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠায় নি বুঝি? বউয়ের মা এতো বছর ধরে রুটি বানানোটাও শেখায় নি? কেমন মা বুঝি না বাপু।”
কথাগুলো কানে পৌঁছাতেই বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা করে উঠলো শুভ্রতার। কান্নাগুলো গলার কাছে ধলা পাকিয়ে এলো। শুভ্রতা চোখ বন্ধ করে কথাগুলোকে গিলে ফেলার চেষ্টা চালালো। হাতের বেলনাটা পাশে রেখে হাসিমুখে বলল,
—-” এক মা শেখায় নি তো কি হয়েছে? দ্বিতীয় মা শেখাবে। এক মা না শিখিয়ে দোষ করেছে অন্য মা শিখিয়ে পড়িয়ে মেয়ের দোষ ঢেকে দেবে। আমার তো আর একটা মা না। দুই মায়ের গুণে তাদের মেয়ের দুর্বলতাগুলো ঠিক ঢাকা পড়ে যাবে। তাই না, মা?”
সাহেরা বেগমের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ফুটলো। শুভ্রতার উচ্ছল মা ডাকটায় ভীষণ সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে তাকে। সাহেরা বেগম জবাবে কিছু বলার আগেই বাচ্চা কোলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো সাদাফের বড় ভাবি সূচনা। বাচ্চার গায়ের পোশাকটা ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
—-” তুমি এখনও রান্না ঘরে কি করছো শুভ্রতা? মা, পার্লার থেকে মেয়েরা এলো বলে। শুভ্রতাকে তৈরি হতে হবে না? ওকে নিয়ে যাই এবার?”
সাহেরা বেগম ব্যস্ত হয়ে বললেন,
—-” হ্যাঁ হ্যাঁ নিয়ে যাও। শুভ্রতা মা? যাও জলদি। কিছুক্ষণ পরই আত্মীয় স্বজনের ভীড় শুরু হবে। রেডি হয়ে দু’মুঠো খেয়ে নাও।”
শুভ্রতা মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। আটা মাখা হাতটা ধুয়ে নিয়ে সূচনার পিছু পিছু নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিলো। শুভ্রতাকে ঘরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বাচ্চার জন্য দূধ আনতে আবারও রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো সূচনা। শুভ্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ভেতরে ঢুকতেই কোথা থেকে ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকলো সাদাফ। সাদাফের এমন আকস্মিক আগমনে চমকে পেছনে তাকালো শুভ্রতা। সাদাফ দরজা লক করে ফিরে তাকাতেই বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো শুভ্রতা,
—-” এভাবে দৌঁড়াচ্ছ কেন?”
—-” দৌঁড়াচ্ছি মানে? দৌঁড়াচ্ছি কোথায়?”
—-” তাহলে এতো তাড়া কিসের?”
সাদাফ দরজা ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। শুভ্রতার হাত টেনে পাশে বসিয়ে দিয়ে বলল,
—-” কেমন আছো?”
শুভ্রতা অবাক হয়ে বলল,
—-” কেমন থাকবো? ভালোই আছি।”
সাদাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—-” কেউ কিছু বলেছে?”
শুভ্রতা হেসে বলল,
—-” কতজন তো কত কিছুই বলে সবই কি শুনতে আছে? গুণহীন বউ বিয়ে করেছো একটু আধটু শুনতে তো হবেই।”
সাদাফ ভ্রু বাঁকালো। ঘাড় ঘুরিয়ে শুভ্রতাকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করে শক্ত গলায় বলল,
—-” কে বলল আমার বউ গুণহীন?”
—-” গুণহীন নয়তো কি? রান্নাবান্নায় তো ঠিকমতো পারে না।”
—-” রান্নাবান্না পারে কিনা, কাপড় ধুতে পারে কিনা এসবকিছু কাজের লোক ঠিক করতে লাগে বিয়ে করতে নয়। এসব লেইম কথাবার্তাগুলো একদম পাত্তা দেবে না শুভ্রা। তুমি যেমন ঠিক তেমনটাই ভালো লাগে আমার। এনিওয়ে, তৈরি হয়ে নাও। একটু পরই হয়তো মেহমান আসা শুরু করবে। এসব সোশ্যাল গেদারিং আমার নিজেরই ভীষণ বিরক্ত লাগে। আজ নয়টায় ট্রেন। ঠিক টাইমে ঢাকা পৌঁছাতে পারলেই স্বস্তি।”
শুভ্রতা হাসলো। মনে মনে সে নিজেও এই স্বস্তিটাই চাইছে। মিনিট পাঁচেকের জন্য হলেও চাইছে।
__________________
রৌদ্রতপ্ত দুপুর গড়িয়ে সদ্য বিকেলের আলোয় চারিদিকটা স্নিগ্ধ লাগছে। কনে পক্ষ থেকে আসা মেহমানদের খাওয়ার পাটও চুকে গিয়েছে সেই অনেকক্ষণ আগে। শুভ্রব প্যানডেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে চার পাঁচ হাত দূরেই হৈ চৈ করছে অর্পণ, রাকিব। খাবার শেষে দৈ সার্ভ করতে গিয়ে নাকি ইচ্ছে করেই পুষ্পির শাড়িতে দৈ এর বাটি উল্টে দিয়েছে রাফাত। প্রেমার হাই হিলগুলোও কে যেন গোবরে মাখামাখি করে যাচ্ছে তাই অবস্থা করেছে। এছাড়াও শোয়ার ঘরের কম্বলে চুলকানি পাউডার তো আছেই। এসব নিয়েই শুরু হয়েছে তুমুল যুদ্ধ। শুভ্রব অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে-মুখে অদ্ভুত নির্লপ্ততা।
সারাদিন শরীরটাকে ভারী শাড়ি, গহনায় মুড়িয়ে মূর্তির মতো বসে থাকার পর সন্ধ্যার পর পর ছাড়া পেলো শুভ্রতা। সন্ধ্যার পর বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ হতেই লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে গায়ে সুতি শাড়ি জড়ালো সে। একটু পরই বাবা-ভাইয়ের সাথে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেবে ভাবতেই থেকে থেকে ভাবনাতীত আনন্দে কাঁটা হয়ে উঠতে লাগলো। মুখে অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতা দেখা দিলো। অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে সন্ধ্যা সাতটার দিকে স্টেশনের জন্য রওনা দিলো তারা। যাওয়ার সময় অনেকটা জোরপূর্বকই পৃথাকে সাথে নিলো শুভ্রতা।
ট্রেনে সামনাসামনি সিটে বসে আছে সাদাফ-শুভ্রতাসহ তার বন্ধুরা। সাথে আছে শুভ্রব আর পৃথা। ট্রেন আপন ছন্দে ছুটছে। সাদাফের বন্ধুরা একের পর এক গলা ফাটিয়ে গান গাইছে। গান গাওয়ার এক পর্যায়ে অনুসন্ধানী গলায় বলে উঠল রাকিব,
—-” ভাবি? আপনি না গান পারেন? বসন্ত উৎসবে গান গেয়েছিলেন না এবার?”
শুভ্রতা মৃদু মাথা নাড়লো। রাকিব উল্লাসিত কন্ঠে বলল,
—-” গুড। এবার তাহলে দেবরদের একটা গান শুনান ভাবি। না বললে চলবে না।”
শুভ্রতা ব্যস্ত হয়ে বলল,
—-” না না ভাইয়া। আজ নয়। অন্য একদিন শুনাবো।”
—-” অন্য একদিন অন্য একদিনেরটা শুনাবেন। আর আজকেরটা আজকে…. শুরু করুন।”
শুভ্রতা মুখ কাঁচুমাচু করে অসম্মতি জানালো। অর্পণ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
—-” আচ্ছা! সবাই মিলে গানের কলি খেললে কেমন হয়? ছেলেরা একদল আর মেয়েরা একদল। তাহলে আপনাদের গানও শোনা হলো আর খেলাও হয়ে গেলো।”
রাকিব মুখ গুজ করে বলল,
—-” আরো কিছু! আপনারা সব বান্ধবীই গানে পারদর্শী আর ছেলেদের মধ্যে কেউ ঠিকঠাকভাবে গানের ‘গ’ টাও জানে না। এই অসম দল নিয়ে খেলা জমে নাকি? বেড আইডিয়া বেয়াইন সাহেবা।”
অর্পণ চোখ বড় বড় করে বলল,
—-” কেন? শুভ্রব ভাইয়া আমাদের সবার থেকে ভালো গান করে। শুভ্রব ভাইয়া আর শুভ্রতা এরা দু’জনই গানের ওস্তাদ। আমাদের তনুও দারুণ গান করতো….”
এটুকু বলেই থেমে গেলো অর্পণ। দাঁত দিয়ে জিব কেটে শুভ্রবের দিকে তাকালো। শুভ্রব মৃদু হেসে বলল,
—-” আপনারা খেলেন ভাই। আমি একটু ওয়াশরুম হয়ে আসছি। চায়ের তৃষ্ণাও পাচ্ছে খুব।”
কথাটা বলেই উঠে গেল শুভ্রব। শুভ্রতা ও তার বান্ধবীদের মধ্যে মন খারাপের কালো মেঘ জমা হতে লাগল। সাদাফের বন্ধুরা ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও কিছু একটা আঁচ করতে পারলো। প্রসঙ্গ পাল্টাতে অতিরিক্ত ব্যস্ততা নিয়ে বলে উঠলো রাফাত,
—-” চলুন খেলা যাক গানের কলি। মেয়েরা যে হারবে তা জানা কথা তবুও এতো আশা করেছে যখন আরেকবার নাহয় হারিয়েই দিই।”
রাফাতের কথায় ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো অর্পণ। পুষ্পি ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
—-” ওক্কে দেখা যাক কে হারে আর কে জেতে! ”
#চলবে….
( প্রচুর স্কিপ করে করে লেখা হয়েছে। তারওপর রি-চেইকও করা হয় নি। নেক্সট পর্বটা গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। )