আরশিযুগল প্রেম পর্ব ১২
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব- ১২
দুপুর সাড়ে বারোটা কি একটা। শহরটাকে রোদের তেজে ঝলসে দিয়ে গর্ব প্রকাশ করতে ব্যস্ত প্রকান্ড সূর্য। এই মাথা ফাঁটা রোদে বাইকে বসে প্রমাদ গুণছে সাদাফ। একটি বিশেষ প্রয়োজনেই বনানী থেকে মিরপুরের দিকে যেতে হচ্ছিলো তাকে। কিন্তু রাস্তার এই বিশাল জ্যামে সেই প্রয়োজনটাও যেন বিষাক্ত হয়ে আসছে ক্রমে ক্রমে। সামনে পেছনে যেখানে চোখ যাচ্ছে সেখানেই শুধু গাড়ির পসরা। হ্যালমেটটা খুলে ঘামে ভেজা শার্টের হাতা দিয়ে কপালটা খানিক মুছে নিয়ে আবারও সামনে পেছনে তাকালো সাদাফ। সামনে এগোনো বা ফিরে যাওয়ার মতো কোনো রাস্তা না পেয়ে হতাশ ভঙ্গিতে মুখ কুঁচকালো সে। তার সেই বিরক্তির মাঝেই কিছুটা দূরে একটা মেয়ের উপর চোখ আটকে গেলো তার। এই প্রথম কোনো মেয়ের দিকে দু’বার চোখ ঘুরিয়ে তাকালো সে। মেয়েটা সাদাফের অপরিচিত। কিন্তু এই বিশাল অপরিচিতির ভীড়ে কোথাও যেন কিছু একটা ভীষন পরিচিত। কিন্তু কি সেই পরিচিতি, তা জানা নেই সাদাফের। সে শুধু জানে কিছু একটা আছে। সেই কিছু একটা’টা ভীষণ প্রিয় তার। ভীষণ প্রিয়। সাদাফের ভাবনার মাঝেই সামনের গাড়িগুলো খানিকটা হেলেদুলে সামনে এগিয়ে আবারও থেমে গেলো। সাদাফও বাইকটা আরো খানিকটা এগিয়ে নিয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটাকে আরেকটু কাছ থেকে দেখতে পেয়েই চমকে উঠলো সে। হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলো, সে শুভ্রতার কথা ভাবছে। এই মেয়েটির মাঝে নিজের অজান্তেই শুভ্রতারই মিল খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। আচ্ছা? শুভ্রতা কি তার অবচেতন মনটা নিয়ে খেলছে? এক ধাঁধাময় খেলায় উম্মাদ করে তুলছে তাকে? সাদাফ আর ভাবতে পারে না। তার আগেই জ্যাম ছুটে বেরিয়ে যায় সব গাড়ি। সেই সাথে বেরিয়ে যায় সাদাফও। আজকাল শুভ্রতাকে একদমই ভাবে না সাদাফ। কিন্তু এই ভাবনাহীন অবসরে যেন ঘুরেফিরে তাকেই ভাবে সে। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে হুট করেই শুভ্রতাকে দেখতে চায় তার মন। কখনো বা তাকে নিয়ে হাজারও ভাবনায় ভাবুক হতে মন চায় তার। কিন্তু কোনো ভাবনায় যেন এই গম্ভীর সাদাফকে পরাস্ত করতে পারে না। দিন শেষে আবারও সেই আগের রুটিনেই পথ চলে সে। শুভ্রতা নামক পিছুটান থাকলেও পিছু ফিরে তাকায় না সে। মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু পেছনে ফেরার আগেই মনে খেলে যায় একটি বাক্যই, “শুভ্রতা যে অন্য কাউকে চায়। তার ফিরে তাকানোটা যে অন্যায়।” ব্যস! এইটুকু ভাবনাতেই আবারও শক্ত হয়ে যায় সাদাফ। এই নরম-শক্তের খেলায় বেশ ভালো ভাবেই কেটে যাচ্ছে তার দিন। মাঝে মাঝে শূন্যতা জাগে কিন্তু সময়টা থেমে যায় না। কেটে যায়… বেলায় অবেলায় কেটে যায় দিন।
___________________
ভার্সিটির বকুলতলায় বসে আছে শুভ্রতা। এই ভরা বসন্তে বেশ ভালো ভাবেই মেতে উঠেছে তাদের আড্ডার আসর। ভার্সিটি ফেমাস মুড়ি-চানাচুরের মাখা, বাদাম, ভূট ভাজা এইসব দিয়েই বেশ কেটে যাচ্ছে তাদের সময়। কিন্তু শুভ্রতার মনটা ভালো নেই। বন্ধুদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র শুভ্রতার আজ কিছুতেই মন টিকছে না এই ভার্সিটি চত্বরে। তার মনটা যেন বানানীর মোড়ে মোড়ে হা-হুতাশ করে মরছে। নিজের এই বাচ্চামোতে নিজেই বিরক্ত হচ্ছে সে। সেই বিরক্তর রেশ ধরে কান্নাও পাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, সাদাফ কেন ওকে গুরুত্ব দেয় না? সে কি খুব খারাপ দেখতে? খুব খারাপ? নিজের এই ভাবনাতেও রাগে রি রি করে উঠছে তার মন। একটা ছেলের সামনে নিজেকে বেহায়ার মতো উপস্থাপন করতে চাইছে সে? ছি! কি নিচ তার মনমানসিকতা। কিন্তু সব শেষে চিন্তাগুলো যেন আবারও সাদাফকে ঘিরেই আটকে যাচ্ছে। এই আত্মসম্মান বিসর্জিত অনুভূতিতে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তার। রাতে ঘুম হচ্ছে না। মুখে খাবার উঠছে না। শুধু চলছে যুদ্ধ। অনুভূতির সাথে যুদ্ধ। শুভ্রতাকে বেখেয়ালি দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো পুষ্পি,
—” কি রে শুভি? কোন দুনিয়ায় আছিস? রাস্তায় কোনো পোলারে দেখে টাশকি খেয়ে গেছিস নাকি?”
শুভ্রতা একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—” কই? না তো। শরীরটা ভালো লাগছে না। আচ্ছা? অর্পন কই রে?”
তনয়া বাদামের খোঁসাগুলো “ফু” দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে বললো,
—” ওর কাজিনের বিয়ে। বিয়ে খেতে যাবে তাই মার্কেটে মার্কেটে ঘুরছে।”
শুভ্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,
—” কাজিনের বিয়ের সাথে মার্কেটে ঘুরার কি সম্পর্ক?”
পুষ্পি ঠোঁট কামড়ে বললো,
—” বুঝিস না? ওই বিয়েতে তো ওর সেই ভাইইইয়য়য়াও আসবে। তার সামনে স্পেশাল দেখানো লাগবে না? তাই এতো ঘুরাঘুরি। কতো কিছু কিনতেছে। একটু আগেই তো ফোন দিয়েছিলো। বললো কি কিনতে জানি বনানী যাবে। আমি জাস্ট মানা করে দিয়েছি। এই রোদে বনানী যাওয়ার কোনো শখ নাই আমার।”
“বনানী” শব্দটা শুনতেই চোখ দুটো চকচক করে উঠলো শুভ্রতার। ঢোক গিলে চোখ পিটপিট করে বললো,
—” বনানী?”
মাখা চানাচুর মুখে পুড়তে পুড়তে জবাব দিলো পুষ্পি,
—” হু।”
শুভ্রতা ঝটপট ওঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা হাতে তুলে নিলো। এতোক্ষণ নিজের সাথে করা শপথটা ভেঙেচুরে দিয়ে চট করে একটা মিথ্যা বলে বসলো সে,
—” দোস্ত? আমার না প্রচন্ড গা গুলাচ্ছে বুঝলি? শরীরটাও খারাপ লাগছে। আমি বাসায় যাবো। তোরা থাক, হ্যাঁ?”
তনয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
—“হঠাৎ করে শরীর খারাপ লাগছে? থাক না কিছুক্ষণ। তুই চলে গেলে ভালো লাগবে না।”
শুভ্রতা ডানহাতে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বললো,
—” অনেক খারাপ লাগছে দোস্ত। থাকতে পারছি না বলেই চলে যাচ্ছি। কাল জমিয়ে আড্ডা দিবো। আজ যাই রে।”
পুষ্পি জামা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
—” নে চল। আমি তোর সাথে যাচ্ছি।”
শুভ্রতা মুখ কাচুমাচু করে বললো,
—” তুই আবার কেনো? আমি একাই পারবো।”
পাশ থেকে কথা পাড়লো প্রমা,
—” বেশি খারাপ লাগলে একা যাবি কিভাবে?”
শুভ্রতা জোর দিয়ে বললো,
—” পারবো। রিকশা নিয়ে চলে যাবো। তোরা আড্ডা দে। সমস্যা নেই।”
তনয়া বললো,
—” তুই সিউর?”
—” হ্যাঁ হ্যাঁ একদম।”
কথাটা বলে একমুহূর্তও দাঁড়ালো না শুভ্রতা। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে দ্রুত গেটের দিকে হাঁটা দিলো। বিশ বিশটা দিন ধরে সাদাফকে দেখার জন্য অযথায় ক্ষেপে মরছে শুভ্রতা। এই দু’দিন আগেও বান্ধবীদের মিথ্যা বলে বনানী মার্কেটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো যে। যেদিকে অফিসের সংখ্যা বেশি সেই এড়িয়ায় রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। আর দিন শেষে নিজের কাছেই লাঞ্চিত হয়ে খাওয়া বাদ দিয়ে নিজেকে শাস্তি দিয়েছে। আর এমন পাগলামো না করার জন্য হাজারও প্রতিজ্ঞা করেছে। কিন্তু সেই তো আবারও ছুটে যাচ্ছে সে। গেইটের বাইরে এসেই অর্পনকে ফোন লাগালো শুভ্রতা,
—” হ্যালো, অর্পন?”
ওপাশ থেকে অর্পন দুঃখী দুঃখী গলায় বললো,
—“শুভি? জানু?”
—” কি হয়েছে?”
—” অনেক কিছু হয়েছে। আমি ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি জানু। ভেবেছিলাম হৃদয় ভাইয়ার জন্য নিজেকে একটু স্পেশালভাবে প্রিপেয়ার করবো। সেজন্য বনানী যাওয়াটা খুব প্রয়োজন। কিন্তু একা একা বনানী যাওয়ার কথা ভাবলেই কেমন ডিপ্রেশন ডিপ্রেশন ফিলিংস হচ্ছে। কেউ ভালোবাসে না আমায়…কেউ ননননননা…”
অর্পনকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়েই মুখ খুললো শুভ্রতা,
—” কথায় কথায় এতো ডিপ্রেশন কই থেকে আসে বুঝি না। আমি তোর সাথে যাবো, হ্যাপি? কই আছিস তুই?”
শুভ্রতার কথায় চেঁচিয়ে উঠলো অর্পন। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললো,
—” সত্যি?”
_____________________
বনানী সুপার মার্কেটের ভেতরের দিকে একটা শাড়ি উল্টেপাল্টে দেখছিলো শুভ্রতা। বেখেয়ালি চোখে সামনের গ্লাসে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো সে। এক হাতে কিছু শপিং ব্যাগ আর অন্যহাতে কানে ফোন ধরে পাশের দোকান থেকেই বের হচ্ছে সাদাফ। গায়ের হালকা আকাশি রঙের শার্টটা ঘেমে গিয়ে সিটিয়ে আছে গায়ে। মৃদুমন্দ ঘামে ল্যাপ্টে আছে কপালে পড়ে থাকা কিছু চুল। ফর্সা গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতেও জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঘেমে নেয়ে অস্থির এই মানুষটাকেও অসম্ভব রকম সুন্দর লাগছে শুভ্রতার। মনে হচ্ছে, কাউকে ভালো লাগার জন্য এই ঘামটাও বড্ড প্রয়োজন। বড্ড বেশিই প্রয়োজন। শুভ্রতা শাড়িটা পাশে রেখে তাড়াহুড়ো করে পেছন ফিরে তাকালো। শুভ্রতা সাদাফকে ডাকবে কি ডাকবে না তা নিয়ে বেশ দু’টানায় পড়ে গেলো। আর ডাকলেও কি বলে ডাকবে তাও যেন বিশাল চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো তার জন্য। শুভ্রতাকে এসব চিন্তামাখা দুটানায় ফেলেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলো সাদাফ। শুভ্রতা দুঃখী মন নিয়ে ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। যার জন্য তার এতো দৌড়াদৌড়ি সেই ব্যক্তিটা এমন নির্মমভাবে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো ভাবতেই একরকম তিক্ততায় বিষিয়ে গেলো তার মন। মাথা নিচু করে এসব ভেবে সাদাফকে হাঁড়ি হাঁড়ি গালি দিতে ব্যস্ত শুভ্রতাকে হঠাৎই ডেকে উঠলো কেউ,
—” আরে? শুভ্রতা?”
শুভ্রতা মাথা উঁচু করে তাকালো। সাদাফকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার মুখ। হাসিমুখে বললো,
—“কেমন আছেন?”
সাদাফ হেসে বললো,
—” আমি সবসময়ই ভালো থাকি। কিন্তু আপনি এখানে?”
শুভ্রতা ডানপাশের চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে বললো,
—” আসলে অর্পনের সাথে এসেছিলাম। ওর কিছু কেনার ছিলো…”
সাদাফ হাসলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘড়ি দেখে নিয়ে বললো,
—” ওহ্ আচ্ছা। তাহলে থাকুন। আমার কাজ আছে। আমি আসছি।”
কথাটা বলে আবারও একটু হেসে দ্রুত পায়ে হারিয়ে গেলো সে। শুভ্রতার বুক চিরে আবারও একটা তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। এই ছেলেটার জন্য এতো এতো পাগলামো করছে সে অথচ তার কোনো হেলদুল নেই? দুটে কথা বলার সময় নেই? শুভ্রতা কেমন আছে সেই খবরটা নেওয়ারও সময় নেই? এতো নিষ্ঠুর কেন এই সাদাফ? এতোটা অনুভূতিহীন কেন? শুভ্রতা ভেতরে ভেতরে চেঁচিয়ে উঠলেও বাইরে বেরিয়ে এলো একরাশ দীর্ঘশ্বাস। আহত বাঘিনীর মতো গোমড়ে ওঠে আবারও প্রতিজ্ঞা করলো, সাদাফের সাথে একদমই কথা বলবে না সে। সাদাফ নিজে থেকে কথা বলতে এলেও বলবে না। কিছুতেই না।
#চলবে…..
(মামানি মার্কেট থেকে এতো এতো খাবার এনেছে যে খাবার নিয়ে আড্ডা দিতে বসে আর লিখতে বসা হয় নি। তাই এতো এতো দেরি। দুঃখিত)