#প্রেমাতাল
পর্ব ৩৪
লেখিকাঃ মৌরি মরিয়ম
কাঁদতে কাঁদতে তিতিরের নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল। বার বার মনে একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল যে, মুগ্ধকে আর ও পাবেনা। আর ঠিক তখনই ওর চোখে ভেসে উঠছিল মুগ্ধর সাথে কাটানো দিনগুলো, ওদের সব স্পেশাল মুহূর্তগুলো! কত স্বপ্ন, কত প্ল্যানিং, কত কথা দেয়া নেয়া সব এভাবে শেষ হয়ে যাবে? এসব ভাবনার অবসান ঘটালো একটি ফোনকল। রিংটোন শুনে তাকাতেই তিতির দেখলো স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে, Mugdho is calling..
লাফিয়ে উঠে ফোন ধরলো তিতির। মুগ্ধর গলায় হ্যালো শুনতেই কান্নাটা আরো বেড়ে গেল। মুগ্ধ বলল,
-“আরে পাগলী এত কাঁদছ কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তিতির কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
-“আই লাভ ইউ।”
-“আই লাভ ইউ টু মাই তিতিরপাখি।”
-“তোমার সাথে থাকতে না পারলে আমি মরে যাব। প্লিজ কিছু একটা করো। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
-“হ্যা, অবশ্যই করবো। তুমি আর কান্না করোনা প্লিজ। দেখো সব ঠিক করে দেব।”
-“জানো কতবার তোমাকে ফোন করেছি! কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ ছিল।”
-“হ্য ফোন আছাড় মেরেছিলাম, ভেঙে গেছে, পিউ কুড়িয়ে দিয়েছে অবশ্য কিন্তু অন হচ্ছিল না। অথচ তোমার খোঁজটাও নিতে পারিনি তাই আগের ফোনটা আলমারির চিপা থেকে খুঁজে বের করেছি। যাই হোক তোমার বাসার পরিস্থিতি কি? তান্না তোমাকে স্পিচ দিয়ে দিয়েছে না একটা আমার বিরুদ্ধে?”
-“না, আমি তখনই ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়েছি। কিন্তু তুমি ফোন কেন ভেঙেছো?”
-“আরে ইকরা**টা ফোন করে পিঞ্চ করছিল তোমাদের বাসা থেকে আমাকে রিজেক্ট করেছে সেটা নিয়ে। আমি তো ওর ফোন ধরিনা। তাই আননোন নাম্বার থেকে ফোন করেছে, বোঝো কি পরিমাণ বেয়াদব একটা।”
-“ছিঃ প্লিজ তুমি স্ল্যাং ইউজ করোনা তো।”
-“আমি তো এমনই, খারাপ।”
-“উফ, আজাইরা কথা বলোনা। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না ইকরা আপু এত তাড়াতাড়ি জানলো কি করে?”
-“কিভাবে আবার মা বলেছে। মাঝে মাঝে মা যা করে।”
এতক্ষণে তিতিরের কান্না থেমে এসেছে। বলল,
-“মায়ের উপর কখনো রাগ করোনা। মা তো একটু সহজ সরলই। দুনিয়ার কোন প্যাঁচই বোঝেনা।”
-“না, মায়ের উপর রাগ করিনি।”
-“আচ্ছা, এবার আমাকে বলোতো তোমার আর ভাইয়ার মধ্যে কি হয়েছিল?”
মুগ্ধ কোনো ভনিতা না করে সব বলল। যা ঘটেছিল তার এক বর্ণও চেঞ্জ বা লুকায়নি। উলটো তান্না কি কি বলেছিল আর ও কিভাবে মেরেছিল কি কি গালি দিয়েছিল তার সবটা বলল। মুগ্ধ যতক্ষণ বলছিল তিতির ততক্ষণ একটা কথাও বলেনি। মুগ্ধর বলা শেষ তখনো তিতির চুপ করে রইলো। তারপর মুগ্ধ বলল,
-“তিতির? চুপ করে আছো কেন? কিছু তো বলো।”
তিতির এখন আর মোটেও কাঁদছে না। রাগ হচ্ছে। মুগ্ধর উপরও যেমন রাগ হচ্ছে, ওর ভাইয়ের উপরও রাগ হচ্ছে। বলল,
-“আমাকে ভুলে যাও।”
-“মানে? তিতির আমি জানি আমি যা করেছিলাম ঠিক করিনি কিন্তু তোমার ভাই যেটা করেছিল সেটাও কিন্তু ঠিক করেনি। তুমি এরকম কথা বলোনা তিতির। এতবড় শাস্তি আমাকে দিওনা।”
-“আমি কিছুই করছি না। এতকিছু যখন ঘটে গেছে আমার ফ্যামিলি কখনোই রাজী হবেনা তাই বললাম আমাকে ভুলে যাও।”
-“সব ফ্যামিলি এরকম বলে। আমরা বোঝাব তিতির। দেখো বোঝালে ঠিকই বুঝবে।”
-“কি বুঝবে বলো? তুমি আমার ভাইকে কিসব গালি দিয়েছো চিন্তা করে দেখো একবার।”
-“তিতির রাগ উঠলে যখন মানুষ গালি দেয় তখন এতকিছু মিন করে দেয়না, মুখে যা আসে তাই বলে গালি দেয়।”
-“তুমি আমার ভাইয়ের জন্ম পরিচয় নিয়ে কথা বলেছো। আমার মা কে নিয়ে বাজে কথা বলেছো তোমার মনে হয় এরপরেও আমার বাবা, আমার ভাই তোমার সাথে আমার বিয়ে দেবে?”
-“আমি কি জানতাম তান্না তোমার ভাই? সবসময় তো ভাইয়া ভাইয়া বলেছো। একদিনও নামটা বলেছো?”
-“মারামারি আর গালাগালি তোমার স্বভাব। রাগ কন্ট্রোলের আর যেন কোনো উপায় নেই তোমার। আমি তো আগেও কতবার দেখেছি।”
-“তোমাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে আমার সহ্য হয়না।”
-“বাহ! ভাল তো। কি বীরপুরুষ আমার।”
-“তিতির, তোমার ভাই যে তোমার রেট জিজ্ঞেস করেছে তাতে কি ওর কোনো দোষ নেই? তুমি তো ওর নিজের বোন।”
-“ও যদি এটা বলেও থাকে তো জানতো না যে ও ওর বোনের সম্পর্কে বলছে।”
-“ভাইয়ের বেলায় এখন ‘যদি’ বলছ? তার মানে আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না? আর হবেই বা কিভাবে! তোমার ভাইয়ের যা এক্টিং দেখলাম আজ। বলে কিনা বাচ্চাকাচ্চা আর মুরুব্বিদের সামনে বলতে পারবে না কি হয়েছে! আরে ও তো দুমুখো সাপ ওর মুখ কি সোনা দিয়ে বান্ধানো নাকি! যে ওর মুখ দিয়ে ভাল কথা ছড়াবে! -“মুখটাকে একটু সামলাও।”
-“তোমার ভাই বুচ্ছো বাসার মধ্যে ভেজাবিড়াল হয়ে থাকে। সেটা নিশ্চই ফ্যামিলিতে গুডবয় হয়ে থাকার জন্য?”
-“দেখা তিতির, আমি সত্যি জানতাম না যে ও তোমার ভাই। কিন্তু বিশ্বাস করো ও শুরু না করলে আমিও ওকে কিছুই বলতাম না।”
-“নাইবা জানলে, তুমি না সবসময় সবাইকে বলো একটা মেয়েকে বাজে কথা বলার আগে ভাবা উচিৎ সেও তোমার বোনেরই মত কারো বোন। তাহলে কারো মাকে নিয়ে বলার আগে এটা ভাবলে না সেও কারো মা।”
-“দেখো আমি তো চাইলে তান্নাকে গালাগাল করার ব্যাপারটা তোমার কাছে গোপন করতে পারতাম। আমিতো করিনি তিতির। পুরোটাই বলেছি তোমাকে। আর প্লিজ আল্লাহর দোহাই লাগে তিতির, একটু বোঝো.. কাউকে কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দেয়ার মানে এটা না যে তার মা কুত্তা। মানে হলো গিয়ে সে একটা বাবু কুত্তা। তেমনি অন্য গালিগুলোও অমনই।”
এভাবেই অনেক তর্কাতর্কি হয়েছিল সেদিন। অনেক রাতে ভাইয়া দরজায় নক করলো। অনেকবার নক করার পর তিতির দরজা খুলল। বাবা-মা, ভাইয়া দরজায় দাঁড়িয়ে। ভেতরে ঢুকেই তিতিরের মা বলল,
-“তিতির, ওই ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হওয়া কখনো সম্ভব না। তোমার কি কিছু বলার আছে?”
তিতির দেখলো বাবা ওর দিকে তাকাচ্ছে না। রুমে ঢুকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তান্নাও কোনো কথা বলছে না।
-“মা, তোমরা ওকে যেমন ভাবছ ও তেমন নয়। ওই ঘটনাটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। আমি ওকে চার বছর ধরে চিনি। ও আসলে খারাপ না। আমার সম্পর্কে কেউ কোন আজেবাজে কথা বললেই শুধু রেগে যায় ও। তখন রাগারাগি, গালাগালিটা ওর চলে আসে। সবার তো আর ১০০% ভাল দিক থাকে না।”
মা অবাক হয়ে বলল,
-“এতকিছুর পরেও একথা বলছিস? মা, ভাইয়ের সম্মানের কোন দাম নেই তোর কাছে?”
তান্না বলল,
-“তোর মতামত জানতে চেয়েছিলাম।”
তিতির বলল,
-“আমি মুগ্ধকেই বিয়ে করবো। ও ভাল খারাপ যেমনই হোক না কেন ওর সাথে আমি হ্যাপি থাকবো।”
এতক্ষণে বাবা বলল,
-“তিতির তুমি যদি মনে করো তুমি এডাল্ট, তোমার নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত তুমি নিজেই নিতে পারবে তাহলে জেনে রাখো আমরা তোমার বাবা-মা, তোমাকে জন্ম দিয়েছি, লালনপালন করেছি, যত্ন করেছি, ভালবাসা দিয়েছি তাই তোমার উপর আমাদের অধিকার আছে। আমরা কোনোভাবেই তোমাকে আগুনে ফেলে দিতে পারব না। যাই হোক, আমরা কখনো এই ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দেব না। তারপরেও যদি করতে চাও তাহলে এ বাড়ি ছেড়ে চিরতরে চলে যাও। কখনো আর ফিরে আসবে না। তুমি ভুলে যেও তোমার বাবা মা আছে। আমরাও ভুলে যাব আমাদের একটা মেয়ে ছিল। সব সম্পর্ক সেদিনই শেষ হয়ে যাবে যেদিন তুমি ওর সাথে নতুন সম্পর্কে বাধা পড়বে।”
একথা বলে বাবা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। তান্নাও বলল,
-“রক্তের সম্পর্কের প্রতিদান, ছোটবোনকে ঘুম পাড়ানোর জন্য রাতের পর রাত জেগে কাধে নিয়ে হাটার প্রতিদান, অসুস্থ বোনের বিছানার পাশে বসে কাঁদার প্রতিদান, বোনের আবদার পূরণ করার জন্য দিনরাত এক করে বাবা-মাকে রাজী করানোর প্রতিদান, বোনের পরীক্ষার সময় অযথা জেগে থেকে বোনকে সঙ্গ দেয়ার প্রতিদান! সব প্রতিদানগুলো এতসুন্দর করে পাব ভাবিওনি কোনদিন। থ্যাংকস।”
একথা বলে ভাইয়া বের হয়ে গেল। ভাইয়ার চোখে পানি দেখে মা বলল,
-“আগে যদি জানতাম, তুই জন্মানোর পরই তোর মুখে বালিশচাপা দিয়ে মেরে ফেলতাম।”
তারপর মাও ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তিতির ফ্লোরে বসে পড়ে অঝর ধারায় কাঁদতে লাগলো।
To be continued…