এক মুঠো রোদ .
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্বঃ ৪৮
৮৪.
ঘড়ির কাটা বারোর ঘরে পড়েছে মাত্র। বাইরে থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। “কার্ডিওলজিস্ট স্পেশালাইজ হসপিটাল” এর তিন তলায় নিজের কেবিনে বসে পেশেন্টের পরিবারের সাথে কথা বলছে রাফিন। সামনে বসে আছে ২২/২৩ বছরের একটি মেয়ে আর তার বাবা। কেবিনে এসি চলছে।রাত থেকে বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশটিও বেশ ঠান্ডা। এই ঠান্ডা পরিবেশেও মেয়েটির নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। কেবিনের উজ্জ্বল আলোয় ঘামের বিন্দুগুলো মুক্তোর মতো চিকচিক করছে। মেয়েটির চোখে-মুখে অজানা এক ভয়। রাফিন তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েটির দিকে তাকালো। মুহূর্তেই নজর সরিয়ে নিয়ে পাশে বসা মধ্যবয়স্ক লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—” আপাতত কোনো রিস্ক নেই। তবে আপনারা চাইলে অপারেশনটা করিয়ে নিতে পারেন।”
লোকটি ইতস্তত গলায় বললো,
—” অপারেশন না করলে কি চলবে ডক্টর?”
—” চলবে বলতে ছয়মাসের মধ্যে কোনো সমস্যা হবে না। যেহেতু মেডিসিন নিচ্ছেন আর ঠিকঠাকভাবে মেডিসিন নিলে ছয়/সাতমাস ইজিলি কাটিয়ে দিতে পারবেন। এরপর আবারও সমস্যা শুরু হতে পারে। এখন অপারেশনটা করালে রিস্কটা কম থাকবে আর তখন একটু বেশি, এটুকুই!”
লোকটি খানিক ভেবে বললেন,
—” আমরা এখনই অপারেশন করাতে চাই ডক্টর। যেহেতু অপারেশন করতেই হবে তাহলে আর দেরি করে কি লাভ?”
রাফিন সামনে রাখা রিপোর্টগুলোতে চোখ বুলাতে বুলাতে গম্ভীর গলায় বললো,
—” এজ ইউর উইশ। যদি অপারেশন করাতে চান তাহলে কার্ডিওলজিস্ট ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করুন। তারা অপারেশের ব্যয় এবং ডেটটা ঠিক করে দেবে। যদিও….”
রাফিনের কথার মাঝেই হুট করেই কেবিনে ঢুকে এলো কেউ। তাড়াহুড়ো করে দরজা লাগিয়ে সামনের দিকে তাকিয়েই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো আগুন্তক। দরজায় এতো জোরে শব্দ হওয়ায় রিপোর্ট থেকে চোখ তুলে সামনে তাকালো রাফিন। বামহাতে ফাইলটা বন্ধ করে কপাল কুঁচকে বলে উঠলো সে,
—” আরু?”
বাকি দু’জনকেও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো আরু। আগের বার যখন এসেছিলো তখন তো এই লোকগুলো ছিলো না। তাহলে আজ কেন? আরুকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখ ঘুরিয়ে সামনে বসে থাকা মানুষ দুটোর দিকে তাকালো রাফিন। ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
—” আপনারা এখন আসতে পারেন, মিষ্টার.আতিক। বাকি কথাগুলো ডক্টর সারার সাথে সেরে নিবেন। উনি পাশের কেবিনেই আছেন। আপাতত আমি বিজি। সো, প্লিজ?”
ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনেই হতভম্ব। রাফিনের কথায় কিছুটা আঁচ করতে পেরে ফাইল হাতে উঠে দাঁড়ালেন মিষ্টার.আতিক। দরজার কাছাকাছি যেতেই মাথা নিচু করে সরে দাঁড়ালো আরু। আরুকে এক পলক দেখে দরজার লক খুলে বেরিয়ে গেলো দুজনে। সাথে সাথেই ভেতরে ঢুকে রাগী গলায় বলে উঠলো রাফিনের এসিস্ট্যান্ট,
—” এই মেয়ে? বের হও বলছি। সরি স্যার আসলে…”
কথার মাঝপথেই ছেলেটিকে থামিয়ে দিলো রাফিন। চোখের ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললো তাকে। ছেলেটি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে বলে উঠলো রাফিন,
—” বেলাল? ম্যাডামের জন্য ওলওয়েজ আমি ফ্রী সো নেক্সট টাইম উনাকে আটকানোর চেষ্টা করো না। আর নেক্সট একঘন্টা আমায় যেন কেউ ডিস্টার্ব না করে সেদিকেও খেয়াল রেখো, ওকে?”
বেলাল অবাক হলো। সন্দেহী চোখে একবার আরুর দিকে তাকিয়েই বিনাবাক্যে বেরিয়ে গেলো। রাফিন টেবিলে ঠেস দিয়ে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো। আরু দরজার এক কোণায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বেলালকে চলে যেতে দেখেই আড়চোখে রাফিনের দিকে তাকালো সে। রাফিনকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটা ঢোক গিলে নিয়ে ঠোঁটে হাসির রেখে ফুটিয়ে ইতস্তত গলায় বললো,
—” হ্যালো ডক্টর।”
রাফিন বাঁকা হেসে বললো,
—“গ্যাংস্টারের বউয়ের ডক্টরের কাছে কি কাজ? আজও কি ম্যাডাম সার্জারি করতে এসেছেন? মাথার নাকি হার্টের?”
আরু লাজুক হাসলো। রাফিন হাত দিয়ে ইশারা করে বললো,
—“এদিকে এসো।”
আরু ধীর পায়ে রাফিনের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো। রাফিন হেঁচকা টানে নিজের সাথে ল্যাপ্টে নিলো তাকে। কপালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে বললো,
—” ম্যাডামের এখানে কি চাই?”
আরু ভ্রু কুঁচকে তাকালো। স্বতঃস্ফূর্ত গলায় বললো,
—” কি চাই মানে? আমার হাজবেন্ডের হসপিটাল। মন চাইলে আসতে পারি। আপনার কোনো সমস্যা ডাক্তার সাহেব?”
রাফিন হেসে ফেললো,
—” জি না ম্যাডাম। কোনো সমস্যা নেই। এতোবড় দুঃসাহস কি আমার আছে?”
আরু দাঁত বের করে হাসলো। চোখে-মুখে আগের সেই চঞ্চলতাময় হাসি। রাফিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে রাফিনের চেয়ারটাতে বসে পড়লো সে। চেয়ারে বসে চারদিকে ঘুরতে লাগলো। রাফিন হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাকে। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে সামনের একটি চেয়ার টেনে বসলো রাফিন। টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে হালকা কেশে বললো,
—” ম্যাডাম কি ভেবে চিন্তে এসেছেন নাকি পাগলামো করতে করতে চলে এসেছেন? আপনার বর কিন্তু খুব একটা সুবিধার নয়। একবার ছেড়ে যাওয়ার চান্স দিয়েছে বলে বারবার দেবে না।”
আরু কিছু না বলে মিষ্টি করে হাসলো। রাফিন বুকে হাত দিয়ে বললো,
—” আহ্! এবার তো আপনি শেষ ম্যাডাম।
আরু খিলখিল করে হেসে উঠে বললো,
—” কলেজ ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছি। ভাইয়া জানে না। জানলেও অবশ্য কিছু বলতো না। অতোটাও রেগে নেই মনে হয়।”
রাফিন নিঃশব্দে হাসতে লাগলো। মেয়েটার মধ্যে কি রাগ, অভিমানের কোনো সফটওয়্যার নেই? দু’দিন হয় নি বাপের বাড়ি রেখে এসেছে এর মধ্যেই কলেজ ফাঁকি দিয়ে হাজির!
___________________
গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে আরো একবার ঘড়ি দেখলো রোজা —- ১২ঃ৩০। ঠিক একটায় ক্লাস আছে তার অথচ একটা রিক্সা বা সিএনজি কোনো কিছুরই দেখা মিলছে না। শেষ রাত থেকে তুমুল বর্ষন শুরু হয়েছে। যার স্থায়িত্ব থেমে থেমে দুপুর বারোটাই এসে ঠেকেছে। রাস্তাটা নিঘার্ত পানি জমে সমুদ্র হয়ে আছে। এই সমুদ্র পাড়ি দিতে কোনো সিএনজির দেখা মিলবে কিনা কে জানে? রোজার ভাবনার মাঝেই তীক্ষ্ণ হর্ণ কানে এলো। রোজা একটু সরে দাঁড়াতেই গেইট পেরিয়ে বেরিয়ে এলো রাদিব আহমেদের গাড়ি। মেয়ের থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি থামিয়ে মাথা বের করে মেয়েকে ডাকলেন উনি। রোজা একহাতে ছাতা আর অন্যহাতে শাড়ির কুঁচি ধরে বাবার দিকে এগিয়ে গেলো। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলেন রাদিব সাহেব,
—” ভার্সিটি যাচ্ছিস নাকি মা?”
রোজা মাথা নেড়ে বললো,
—” হ্যাঁ বাবা। ক্লাস ছিলো।”
রাদিব সাহেব গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বললেন,
—” চল, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।”
রোজা প্রতিবাদী স্বরে বললো,
—” তোমার অফিস তো অপজিট রোডে বাবা। এমনিতেও হয়তো রাস্তায় পানি জমে নাজেহাল অবস্থা। তোমার দেরি হয়ে যাবে বাবা। তুমি চলে যাও আমি সিএনজি নিয়ে চলে যাবো।”
রাদিব সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন,
—” এই বৃষ্টিতে সিএনজি কোথায় পাবি? ভিজে একাকার হবি। তারচেয়ে বরং আমিই দিয়ে আসি।”
—” ইশশ বাবা। বললাম তো লাগবে না। তাছাড়া আধ ভেজা হয়ে ভার্সিটি যাওয়াটাও দারুন ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। তুমি যাও তো।”
—” হু। পরে জ্বর বাঁধালে তোর মা যে তোর সাথে সাথে আমার কানটাও খাবে, তার কি হবে? তারচেয়ে তুই বাসায় যা । আমি অফিসে পৌঁছে ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিবো। গাড়ি করেই যাস।”
রোজা জেদ ধরা গলায় বললো,
—” প্লিজ বাবা। কিচ্ছু হবে না। একটুও জ্বর হবে না। তুমি যাও তো..”
মেয়েকে বোঝানো অসম্ভব বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাদিব সাহেব। ড্রাইবারকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলে আদুরে গলায় বললেন,
—” সাবধানে যাস আম্মু। “
বাবার কথায় মাথা দুলিয়ে মিষ্টি করে হাসলো রোজা। বাবার গাড়িটা রাস্তার মোড়ে হারিয়ে যেতেই হুট করেই ভার্সিটি না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো রোজা। কেন জানি পড়াশোনায় একদমই মন বসাতে পারছে না সে। বৃষ্টিপ্রেমী কন্যাকে কি এই প্রেমময় বর্ষনে ক্লাসের চার দেয়ালে আটকে রাখা যায়? কক্ষনো না। রোজা ছাতা বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়েই রাস্তা ধরলো। আজ উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়াবে সে। ফুটপাতের বাচ্চাদের সাথে লাফালাফি করবে নয়তো নির্জন নদীর পাড়ে সবুজ নরম ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখবে। কান্নারত আকাশ। পাঁচ/ দশমিনিট হাঁটার পরই একটি সিএনজির দেখা মিললো তার। সিএনজি ভাড়া করে ছুটে চললো দূরন্ত নদীটির দিকে। এই নদীর পাড়েই মিশে আছে হাজারো স্মৃতি। রোজা-মৃন্ময়ের প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা, সেদিনের লজ্জাময় কথা আরো কতো কি! আধঘন্টার মাথায় নদীর পাড়ে এসে পৌঁছালো রোজা। ভাড়া মিটিয়ে নদীর পাড়ের দিকে হাঁটা দিতেই থমকে দাঁড়ালো সে। গাড়ির ডেকে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়। রোজা চোখদুটো বন্ধ করে আবারও মেলে তাকালো। এটা কি কল্পনা নাকি বাস্তব বুঝে উঠতে পারছে না রোজা। মৃন্ময়ের চোখদুটো রোজার উপর পড়তেই পেছন ফিরে হাঁটা দিলো রোজা। মৃন্ময় কিছুক্ষণ হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থেকেই ডেকে উঠলো,
—” রোজা?”
রোজা দাঁড়ালো। চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে ফিরে তাকালো। বাধ্য হয়েই এগিয়ে গেলো। মৃন্ময় হাসিমুখে বললো,
—” হোয়াট আ কুয়েন্সিডেন্স। কেমন আছো,রোজা?”
রোজা জবাব দিলো না। মৃন্ময় খানিক অবাক হলো। শান্ত গলায় বললো,
—” রোজা? ঠিক আছো? আমি তোমাকে কিছু জিগ্যেস করছিলাম।”
রোজা রাগী গলায় বললো,
—” আমায় জিগ্যেস করছেন কেনো? আপনার তো ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। আমি তো আর এমনি এমনি বলি না যে হিরোদের ক্যারেক্টার খারাপ। দেয়ার ইজ আ স্ট্রং রিজন। মেয়ে দেখলেই ফ্লার্টিং শুরু না? মিষ্টি মেয়ে, দুষ্টু মেয়ে আর কি কি আছে ডিকশিনারিতে?”
মৃন্ময় কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো তাকিয়ে থেকে বললো,
—” মানে?”
রোজা নাক ফুলিয়ে বললো,
—” কোনো মানে নেই। আপনার না জীবনেও বিয়ে হবে না।”
মৃন্ময় হেসে বললো,
—” তুমি রাজি না হলে না হওয়ার সম্ভবনাটাই বেশি।”
প্রতিউত্তরে মৃন্ময়ের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো রোজা। মৃন্ময় নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশে। থেকে থেকে মেঘের তীক্ষ্ণ ঘুরঘুর শব্দে মেতে উঠছে আকাশ। নদীর পানিতে বৃষ্টি কন্যার নিরন্তর নৃত্য যেন উদাসী মনকে করে তুলছে প্রেমময়। এই বৃষ্টিভেজা নীরবতা কাটিয়ে সামনে তাকিয়েই বলে উঠলো মৃন্ময়,
—” কিছুদিন পর বুড়ো হয়ে যাবো রোজা। বিয়ের বয়সটা পাড় হলো বলে। চলো না বিয়ে করে নিই।”
রোজা অভিমানী গলায় বললো,
—” রেডিওতে ওই মেয়েটা আপনাকে “ভালোবাসি” বলেছে শুনে মন খারাপ হয়েছে আমার। আমি আপনাকে একটুও ভালোবাসি না। বাসবোও না কখনো।”
মৃন্ময় মৃদু হেসে বললো,
—” এখনো বিয়েই করতে পারলাম না। বাবা যে কবে হবো আল্লাহই জানে।”
রোজা অন্যদিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বললো,
—” আপনি মেয়েটাকে মিষ্টি বলেছেন তাতেও মন খারাপ হয়েছে আমার।”
মৃন্ময় হেসে একহাতে কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
—” নিজে তো ভালোবাসো না অন্যকেউ বাসলেও দোষ?এতো জ্বলে জানতাম না তো!”
রোজা লাজুক হেসে বললো,
—” পাঁচ বছর পর বিয়ে করবো, চলবে?”
মৃন্ময় হেসে ফেললো। দুষ্টু হেসে বললো,
—” ওকে ডান, পাঁচ দিন পর।”
# চলবে…