# এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -৩৯
৭০.
মৃন্ময়দের গাইড শুইশা খিয়াং এর বাড়ি থুইসাপাড়াতে হওয়ায় তাবু টানিয়ে থাকতে হয়নি তাদের। শুইশার বাড়িতে দুটো ঘর। তার মধ্য থেকেই একটা ঘরের এক কোনে দুটো বিছানা করে একটিতে রোজা আর অন্যটিতে মৃন্ময়-তীর্থকে থাকতে দেওয়া হয়েছে।মৃন্ময়ের চোখে ঘুম নেই। বিছানায় শুয়ে হাসফাস করছে সে। অস্থিরতায় সারাটা বুক ভারি ভারি লাগছে তার। জমিয়ে রাখা আবেগগুলো বড্ড অভিমানী হয়ে উঠেছে আজ। মৃন্ময় উঠে বসে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। বার কয়েক জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সাথে সাথেই উঠে বসে রোজা। পায়ের ব্যাথাটা অসম্ভব রকম বেড়েছে তার। পা নাড়াতেই আঙ্গুলটা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে বলে বোধ হচ্ছে। এতোক্ষণ শুয়ে শুয়ে নিজের ব্যাথার সাথে সাথে মৃন্ময়ের ছটফটানোটাও উপলব্ধি করছিলো সে। খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে সাবধানে উঠে দাঁড়ালো রোজা। সাথে সাথেই সারাটা শরীর ব্যাথাময় শিহরণে ছেয়ে গেলো। ব্যাথাটাকে তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে দরজা পেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো রোজা। আকাশে মস্ত চাঁদ উঠেছে আজ। আঙ্গিনা,গাছের ডাল-পাতা সবকিছুই ছেয়ে আছে চাঁদের সাদা-মলিন আলোয়। রোজা ধীরে ধীরে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। এদিক-ওদিক তাকিয়ে পাহাড়ের এক কোণায় গাছের জমাট অন্ধকারে মানুষের প্রতিকৃতি চোখে পড়লো।
পাহাড়ের ঢালে একটা গাছে ঠেস দিয়ে বসে আছে মৃন্ময়। ঘন জঙ্গলের জমাট অন্ধকারে দৃষ্টি তার। হয়তো এমনই কোনো একটা জঙ্গলে ছটফট করেছে তার বাবা। ইশশ! কি যন্ত্রণা। জঙ্গলের দিকে তাকিয়েই নিজের কথা ভাবে মৃন্ময়। আজ যদি এখানে…এই জঙ্গলটাতেই হারিয়ে যায় মৃন্ময় তাহলে তার খুঁজে কেউ ছুঁটে আসবে না। বাবার শোকে হাসফাস করার জন্য তার মা আর সে থাকলেও তার জন্য কেউ থাকবে না। এই তৃ-ভূবনে তার মতো অসহায় কি কেউ আছে? এই পৃথিবীতে কতো একা সে। কতোটা একা! ১৪ টা বছর ধরে নিজের সাথেই যুদ্ধ করে আসছে মৃন্ময়। আর কত? মৃন্ময়েরও ইচ্ছে হয় একটু হাসতে। প্রাণখুলে বাঁচতে। কারো চিন্তার কারণ হতে। কিন্তু সেই ভাগ্যটা তার নেই। ১২ বছর বয়সে বাবা আর ১৩ বছর বয়সে মাকে হারানোর পর কারো ভালোবাসা তো দূর সামান্য সহানুভূতির দৃষ্টিটিও চোখে পড়ে নি তার। সবার চোখে দেখেছে শুধু লোভ…লোভ আর লোভ। ১৪ বছর আগে শেষ বারের মতো প্রাণ খুলে হেসেছিলো মৃন্ময়। তারপর থেকে হাসিটা তারজন্য হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের অভিনয়। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্যই কঠিন হতে হয়েছে তাকে। ভুলতে হয়েছে হাসি-কান্না সব। মাঠে দৌড়াদৌড়ি করার বয়সে কপাল কুঁচকে নিজের সুরক্ষার কথা ভাবতে হয়েছে তাকে। টাকার লোভ ছাড়া একটা মানুষও দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায় নি। সাহায্যের হাত বাড়ায় নি। কতকাল মৃন্ময়ের মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দেয় নি। জ্বর হলে কপালে পট্টি জড়িয়ে দেয় নি। জ্বরমাখা তেঁতো মুখে খাবার না খাওয়ার বায়না করা হয়নি। কারো একটু ভালোবাসা পাওয়া হয়নি। মৃন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখদুটো কি ভীষণ জ্বলছে তার। হঠাৎই কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে চমকে উঠে মৃন্ময়। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই মিষ্টি হাসে রোজা। মৃন্ময় নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিমুখে বললো,
—” আপনি? ঘুমোন নি এখনও? পায়ে কি বেশি ব্যাথা করছে?”
রোজা জবাব না দিয়ে মৃন্ময়ের পাশে বসলো। পা-দুটো সামনের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে নরম গলায় বললো,
—” বাবাকে মনে পড়ছে?”
চাঁদের আলোতে মৃন্ময়ের মুখের একপাশটা দেখতে পাচ্ছে রোজা। মৃন্ময় মুখ ঘুরিয়ে সামনে তাকালো। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক গলায় বললো,
—” বাবা যেহেতু একটু আধটু তো মনে পড়বেই। এনিওয়ে, পায়ের ব্যাথা কেমন এখন? খুব বেশি?”
রোজা হালকা হেসে বললো,
—” আপনার ব্যাথার থেকে বেশি নয়।”
মৃন্ময় চমকে তাকালো। রোজা মৃন্ময়ের চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললো,
—” ছেলেদেরকেও মাঝে মাঝে কাঁদতে হয়, মিষ্টার.হিরো। আপনার চোখের ভাষাটা আজ এতো স্পষ্ট লাগছে কেন বলুন তো। আপনার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। খুব! কেন হচ্ছে এমন?কেন?”
মৃন্ময় হেসে ফেললো। হাসিমুখে বললো,
—” আমার প্রতি হয়তো সহানুভূতি জাগছে আপনার। সেমপ্যাথি!”
রোজা শক্ত কন্ঠে বললো,
—” আমার কিন্তু এমনটা মনে হচ্ছে না। এটা সহানুভূতি নয়…অন্যকিছু!”
মৃন্ময় হেসে বললো,
—” অন্যকিছুটা কি?”
রোজা জবাব দিলো না। মৃন্ময়ের উপর স্থির দৃষ্টি রেখে বললো,
—” আমি যদি আপনাকে জড়িয়ে ধরি আপনি কি রাগ করবেন?”
মৃন্ময় ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,
—” মানে?”
রোজা উত্তর না দিয়ে আচমকাই বামহাত টেনে মাথা রাখলো মৃন্ময়ের বুকে। মৃন্ময়ের হৃদপিণ্ডটা অস্বাভাবিক গতিতে ছুটছে। রোজা মৃদু গলায় বললো,
—” শাইয়াম চাং এর ঘরে আপনার শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো আমার। মনে হচ্ছিলো…যেভাবেই হোক ফিরিয়ে এনে দিই আপনার বাবাকে। নয়তো… নয়তো শাইয়াম চাং কে খুন করে ফেলি আমি। আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো, সব ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো অথচ আপনি শান্ত হয়ে বসে ছিলেন। আমি খুব কষ্ট পেলেও কারো মৃত্যুকামনা করি না কিন্তু আজ….! কেন হচ্ছিলো এমন? এমন সহানুভূতি তো আগে হয় নি আমার। তবে আজকেই কেন?”
মৃন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—” আপনি ক্লান্ত মিস.রোজা। আপনার ঘুম প্রয়োজন। চলুন ঘুমোবেন চলুন।”
রোজা সোজা হয়ে বসলো। চোখ-মুখ শক্ত করে বললো,
—” আমি যাবো না। এখানেই বসে থাকবো। চলে যান আপনি। আপনার মতো রোবটের সাথে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না।”
মৃন্ময় ক্লান্ত চোখে তাকালো,
—” আপনি বাচ্চামো করছেন মিস.রোজা।”
—” করলে করছি। তাতে আপনার কি? আমি তো তবু বাচ্চামো করছি আপনি তো সেটাও পারেন না।”
মৃন্ময় হেসে বললো,
—” আমি অনেক কিছুই পারি মিস.রোজা শুধু দেখাতেই পারি না। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে নিজেই নিজেকে সামলেছি। যে বয়সে আপনারা শুধু বাচ্চাদের মতো জেদ করেছেন সেখানে আমাকে একজন প্রাপ্তবয়স্কের মতো চিন্তা করতে হয়েছে। আমার বন্ধুদের সংখ্যাও হাতে গুণা কয়েকজন৷ বাচ্চামো করার মতো সময় বা মানুষ পাই নি কখনো। তাই করিও নি। এনিওয়ে, ভেতরে চলুন…প্রায় ১ টা বাজতে চললো।”
রোজা মাথা নেড়ে বললো,
—” বাজুক একটা। দুটো বাজলেও সমস্যা নেই। আপনি যে আজ ঘুমাবেন না তা আমি জানি। সো চুপচাপ বসে থাকুন নয়তো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো নিচে।”
মৃন্ময় হেসে ফেললো,
—” আমি না ঘুমালেও আপনি তো ঘুমাবেন মিস.রোজা। আপনি অসুস্থ। “
—” সেজন্যই তো বসে থাকতে বলছি। বিছানায় শুলেই ব্যাথা শুরু হবে। আপনি পাশে থাকায় ব্যাথাটা ফিল হচ্ছে না।”
—” তাই? কিন্তু কেনো?”
—” তা তো বলতে পারছি না। তবে আপনি বলতে পারেন। আপনার কাছে তো সব প্রশ্নেরই উত্তর থাকে। এই উত্তরটাও দিয়ে দিন না প্লিজ…কেন ফিল হচ্ছে না ব্যাথা? এক্চুয়েলি ফিল হচ্ছে কিন্তু ব্যাথাটাকেও ভীষণ মিষ্টি মিষ্টি লাগছে।”
মৃন্ময় ঠোঁটে হাসি টেনে বললো,
—” আপনি প্রেমে পড়েছেন, মিস.রোজা।”
রোজা চোখ বড় বড় করে তাকালো। মৃন্ময় হঠাৎ করেই বুঝতে পারলো, ভীষণ ভুল কথা বলে ফেলেছে সে। ভীষণ ভুল। অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে ওঠে দাঁড়ালো। অস্বস্তি ভরা কন্ঠে বললো,
—” ভেতরে চলুন। আমি যাচ্ছি…”
কথাটা শেষ করে দ্রুত পা চালালো মৃন্ময়। রোজা কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
—” আমি কি সত্যিই প্রেমে পড়েছি মিষ্টার.হিরো?”
মৃন্ময় জবাব দিলো না। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে নিজের মনেই হেসে উঠলো।
৭১.
সকাল প্রায় সাতটা বাজে। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো রাফিন। আরু বিছানার এক কোণে গুটিশুটি হয়ে ঘুমোচ্ছে। রাফিন ঘাড় ঢলতে ঢলতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। রাতে অস্বস্তি নিয়ে শুয়েছিলো বলেই হয়তো ঘাড় ব্যাথা করছে তার। দাঁতে ব্রাশ চালাতে চালাতে ছক কষতে লাগলো রাফিন। ডক্টরের কথামতো আরুর সুস্থতার জন্য তাকে চায়। অদ্ভুত! রাফিন কি এখন নিজেকে শিলনোড়ায় পিষে আরুকে খাইয়ে দিবে নাকি? যত্তোসব! ফ্রেশ হয়ে গোসল সেরে রুমে গিয়েই আরুর উপর চোখ পড়লো তার। বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হতে বারবার আড়চোখে আরুকে দেখলে লাগলো সে। ভালোবাসতে হবে। আরুকে বুঝাতে হবে রাফিন ভালোবাসে আরুকে। কিন্তু,ভালোবাসা কি দেখানো যায়? রাফিন আরুর কাছাকাছি গিয়ে মৃদু গলায় ডাকলো,
—” আরু? আরু?”
আরু চোখ পিটপিট করে তাকালো। চোখ খুলেই রাফিনকে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো। চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে চুপ করে শুয়ে রইলো। রাফিন কপাল কুঁচকে তাকালো। গালে আলতো হাতে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
—” এই মেয়ে? ওপেন ইউর আইস… তুমি যে জেগে আছো তা কিন্তু আমি জানি। চোখ খুলো…”
আরু চোখ খুললো। রাফিন গম্ভীর গলায় বললো,
—” ঝটপট ওঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। সকাল নয়টা পর্যন্ত ঘুমোনো চলবে না। এখন ফ্রেশ হয়ে আমার সাথে ব্রেকফাস্ট করবে দেন কলেজ যাবে। তোমাকে ড্রপ করে দিয়ে হসপিটাল যাবো। কি হলো? ওঠো!”
রাফিনের ধমকে উঠে বসলো আরু। মুখ কালো করে ওয়াশরুমে গেলো। রাফিন চাইছে আরু ব্যস্ত থাকুক। একা একা বসে না থেকে সবার সাথে কথা বলুক। কিন্তু আরুর মাথায় ঘুরছে উল্টো চিন্তা। রাফিনকে নিয়ে ভালো কিছু ভাবতে পারছে না সে। নিশ্চয় কলেজে পাঠিয়ে খুঁজে খুঁজে দোষ বের করে তাকে শাস্তি দেবে রাফিন। যার ফলাফল হিসেবে বাড়তে থাকলো ভয়। সেই ভয় থেকেই, রাফিন তাকে কলেজে নামিয়ে দেওয়ার পর কলেজে না ঢুকে রিক্সা নিয়ে আবারও বাড়ি ফিরে এলো আরু। প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে আসিফ খোঁজ নিয়ে বললো আরু কলেজে নেই। কথাটা শুনেই পিলে চমকে গেলো রাফিনের। তবে,কোথায় গেলো মেয়েটা?বাড়িতে ফোন দিয়ে বুয়াকে জিজ্ঞেস করতেই বললো আরুকে বাড়িতে আসতে দেখেনি সে। চিন্তাটা কয়েক ধাপ বেড়ে গেলো রাফিনের। নিজেই কলেজে গিয়ে কলেজের সিসিটিভি ফুটেজ চেইক করলো। কলেজের ভেতরের কোনো ক্যামেরাতেই আরুকে চোখে না পড়ায় শেষ আশা হিসেবে গেইটের ফুটেজ চেইক করতে যাবে ঠিক তখনই কল এলো আসিফের। আরু নাকি বাড়িতেই আছে। রাগে শরীরটা জ্বলে উঠলো রাফিনের। হচ্ছেটা কি? ফাজলামো নাকি এসব? ইম্পোর্টেন্ট একটা সার্জারি ফেলে কলেজে ছুটে এসেছে। চিন্তায় রীতিমতো মরে যাচ্ছে আর আরু? এই রাগকে পুঁজি করেই আবারও ভুল করলো রাফিন। বাড়ি ফিরে আরুকে সামনে পেয়েই কষে একটা থাপ্পড় লাগালো আরুর গালে। রাফিন নিজেকে সামলে নিয়ে সাথে সাথে বেরিয়ে গেলেও আরু সামলে উঠতে পারলো না। রাফিনকে নিয়ে ভয়,রাগ, হতাশাটা আরো একধাপ বেড়ে গেলো তার।
# চলবে…
[যতটুকু সম্ভব হয়েছে লিখেছি। দয়া করে ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ]