# এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -১১
২১.
দু’কাপ কফি হাতে রিদের দরজায় উঁকি দিলো রোজা। রিদ টেবিলে মাথা গুঁজে কিছু একটা করছে। রোজা হালকা কেঁশে বলে উঠলো,
— মিষ্টার আইনস্টাইন? কফি খাবি?
রিদ ফিরে তাকালো। মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে বইটা বন্ধ করে রোজার দিকে ঘুরে বসলো। যার অর্থ সে কফি খাবে। কফি খাওয়ার চেয়ে রোজার সাথে গল্প করার ইচ্ছেটায় এখন প্রবল। রিদের ধারনা রোজা বেশ মিষ্টি করে কথা বলে। তার কথার সাথে তার হাসিটাও ভারি মিষ্টি। একদম মন ভালো করে দেওয়ার মতো মিষ্টি। রোজা রুমে ঢুকে একটা কাপ রিদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বিছানায় আরাম করে বসলো। কাপে ছোট্ট চুমুক দিতে দিতে চোখ ঘুরিয়ে রুমের চারপাশটা দেখতে লাগলো। তার চোখে রাজ্যের কৌতূহল। যেন এই প্রথমবার এই ঘরটাকে দেখছে সে। রিদ কাপে ঠোঁট ছোঁয়ালো না। কাপ টা হাতে নিয়ে বসে রইলো। রোজাকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে মুচকি হেসে বলে উঠলো,
— কি দেখছিস আপু?
রোজা রিদের কথার উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
— এই? তুই এতো গোছালো কি করে হলি বল তো? ঘরটাকে তো একদম ঝকমকা করে রেখে দিয়েছিস।
রোজার কথায় হেসে উঠলো রিদ। রোজার বলা সব কথায় তার কাছে ভীষণ মজার মনে হয়। রোজার থেকে বেশ কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দও শেখে সে, যেমন- ঝকমকা। এই শব্দটা এর আগে কখনো শুনেনি রিদ। ঝকমকার জায়গায় শুনেছে ঝকঝকে। রিদ রোজার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে উঠলো,
— জানিস আপু? আজ না ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার ঘটেছে।
— তাই নাকি? কি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার?
— আমি স্কুল থেকে আসছিলাম। তখন দেখি নতুন মার্কেটের ওই মোড়টাতে একটা মেয়ে বসে বসে বমি করছে। গলায় রক্তও লেগে ছিলো।
— তাই নাকি? তারপর?
রোজার আগ্রহে চোখদুটো চিকচিক করে উঠলো রিদের। গলায় গাম্ভীর্য এনে বলে উঠলো,
— আমি মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই বিরবির করে কিসব বলেই জ্ঞান হারালো। আমি তো পড়লাম অথৈ জলে! কি করি? কি করি? ভাবতে ভাবতে একটা সিএনজি ভাড়া করে মেয়েটাকে নিয়ে গেলাম পাশের হসপিটালে। ডক্টর বলেছে বেশি ভয় পাওয়ার কারনেই এভাবে জ্ঞান হারিয়েছিলো মেয়েটি। দু’দুটো স্যালাইন লেগেছিলো, জানিস? প্রায় দু’ঘন্টার মতো অজ্ঞানও ছিলো। আমার ধারনা কি জানিস আপু? উনি হয়তো ওই দাঙ্গার মাঝে ফেঁসে গিয়েছিলেন।
রিদের কথায় ভ্রু কুঁচকালো রোজা। সন্দেহী দৃষ্টিতে বলে উঠলো,
— দাঙ্গা? কিসের দাঙ্গা?
— ওইতো, নতুন বাজারে, রাফিন চৌধুরীর ছেলেপুলেরা মারামারি করছিলো আজ। কি ভীষন রক্তারক্তি কান্ড। আমি তো ভয়ে এক ড্রামের ভেতর লুকিয়ে ছিলাম। আরেকটা কাজ করেছি, লুকিয়ে কিছু ছবিও তুলে নিয়েছি। বাবার যদি প্রয়োজন হয় তো বাবাকে দিয়ে দিবো।
রোজা এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। কফির কাপটা পাশে রেখে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
— স্কুল ফাঁকি দিয়ে মার্কেটে কি করছিলি তুই?
রোজার কথায় চমকে উঠলো রিদ। সে তো স্কুল ফাঁকির কথা বলেই নি। তবে রোজা কি করে বুঝলো? রিদ একটা ঢোক গিলে বললো,
— তোকে কে বলল আমি স্কুল ফাঁকি দিয়েছি? আজগুবি!
— তুই নিজেই বলেছিস।
রিদ অবাক হয়ে বললো,
— কখন?
— এইতো এখনই। নতুন মার্কেটের মোড় আর তোর স্কুল তো একদম অপজিটে। স্কুল ছুটির পর সেই রাস্তায় যাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না। দ্বিতীয়ত তুই মেয়েটাকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিস। মোড় থেকে সিএনজি দিয়ে হসপিটালের দূরত্ব ১৫ মিনিটের মাথায়। এরপর তুই বললি মেয়েটি দু’ঘন্টা অজ্ঞান ছিলো তারমানে তুই সেই দুইঘন্টা সেখানেই ছিলি। তাহলে টোটাল সময় লাগলো দুইঘন্টা পনের মিনিট। তোর স্কুল ছুটি হয় সাড়ে তিনটায়। তোর স্কুল থেকে বাসায় আসতে সময় লাগে আধাঘন্টা। ছুটির পর যদি এতোকিছু ঘটে থাকে তাহলে তোর বাড়ি আসতে আসতে ৬ টা ১৫ কি ৭ টা বেজে যাওয়ার কথা। কিন্তু তুই দেরীতে বাড়ি ফিরেছিস এমন কথা তো মার কাছে শুনলাম না। তারমানে কি বল তো? তারমানেটা হলো তুই ক্লাসগুলো ফাঁকি দিয়েছিস। যার কারণে একদম পার্ফেক্ট টাইমে বাড়ি ফিরেছিস।কি ঠিক বললাম?(ভ্রু নাঁচিয়ে)
রিদ কি বলবে বুঝতে পারছে না। রোজার কথার বেড়াজালে সে যে পেচিয়ে গেছে তা বেশ বুঝা হয়ে গেছে তার। মুখটা কাঁচুমাঁচু করে কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনই কমল দরজায় এসে দাঁড়ালো। ডানহাতটা দরজায় রেখে রোজাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো কমল,
— আপামনি? তীরতো ভাইজান আইছে। অফিসরুমে যায়তে কইলো আপনারে।
কমলের কথায় হাফ ছেড়ে বাঁচলো রিদ। এবার নিশ্চয় রোজার জেরার মুখ থেকে বাঁচবে সে। কমলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে রোজা। তীর্থ নামটাকে কি নির্মমভাবেই খুন করেছে কমল। প্রতিবারই এই কাজটা করে সে। রোজার ধারনা কমলের এই কাজটা সম্পূর্ণই ইচ্ছেকৃত। রোজা তাকে হাজার বার বলেও তীর্থের নামটা সুন্দর করে উচ্চারণ করাতে পারে নি অথচ যতীন্দ্রমোহন তঙ্কালঙ্কারের মতো কঠিন নামও ফট করে উচ্চারণ করে ফেলে সে। তীর্থের নামটা বিকৃত করে কি এমন মজা পায় কমল জানা নেই রোজার। রোজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নরম স্বরে বলে উঠলো,
— এই কমল? তোকে না বলেছি এমন বিশ্রীভাবে কথা বলবি না।
রোজার কথায় কমলের কোনো ভাবাবেগ হলো বলে মনে হচ্ছে না। সে আগের মতোই ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে। রোজা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ওঠে দাঁড়ালো। আপাতত কমলের সাথে কথা বলে মেজাজ খারাপ করতে চাইছে না সে। কমল হলো এই বাড়ির কাজের মেয়ে। বয়স ১২/১৪। ওর আসল নাম কমলা। কেউ তাকে নাম জিগ্যেস করলে সে বলতো, “আমার নাম কমল্যা” কমলা নামের সাথে বাড়তি “য ফলা” কেন ইউজ করে কমল জানা নেই রোজার। তবে নামটা বড্ড বিদঘুটে শোনায় বলেই রিদ আর রোজা মিলে নামের শেষের ” আ-কার” টা কেটে বানিয়ে দিয়েছে “কমল” রোজার কাছে নামটা বেশ লাগে। মনে মনে “কমল” নামটা আওড়াতে আওড়াতে অফিস রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রোজা। তীর্থ চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। গায়ে সাদা টি-শার্ট আর লাল টকটকে থ্রী-কোয়াটার প্যান্ট। রোজা রুমে ঢুকতেই চোখ মেলে তাকালো সে। ক্লান্ত গলায় বললো,
— চাবি বানানো হয়ে গেছে। সকালের মধ্যে পেয়ে যাবো। এবার ঝটপট কোনো প্রুভ পেয়ে গেলেই হলো।
রোজা চেয়ার টেনে বসলো। লাবট্যাবটা প্রজেক্টরের সাথে কানেক্ট করে চোখের ইশারায় তীর্থকে সেদিকে তাকাতে বললো । তীর্থ তাকাতেই উঠে দাঁড়ালো রোজা। দু’হাত চেয়ারের উপর রেখে কিছুটা ঝুঁকে বলে উঠলো সে,
— তালার ছবি গুলো ভালো করে খেয়াল করে দেখ তীর্থ। প্রায় সবগুলো তালাতেই কিছুটা ঝং ধরে আছে। অর্থাৎ তালাগুলো তেমন একটা খোলা হয় না বললেই চলে। কিন্তু এই, এই তালাটা দেখ…(জুম করে) এটা কিন্তু অনেকটায় পরিষ্কার। তো কি বুঝলি?( ভ্রু নাঁচিয়ে)
— তুই বলতে চাইছিস, সবগুলো তালায় ঝং থাকলেও এটাতে নেই। তারমানে এই তালাটা প্রায়ই খোলা হয়। বাকিগুলোর মতো সবসময় বন্ধ থাকে না।
— এক্সাক্টলি। তারমানে এই রুমে এমন কিছু অবশ্যই আছে যার জন্য মৃন্ময় প্রায়ই রুমটাতে ঢুকে। কিন্তু কি?( কপাল কুঁচকে)
— সেটাতো রুমে ঢুকলেই জানা যাবে। তোর কি মনে হয় সবটা এতো ইজি হবে?
— নাহ। মৃন্ময় খুবই চালাক একজন মানুষ। এতো ইজিলি ক্লু দিয়ে দিবে না নিশ্চয়৷ তবে একটা কথা খুব ভাবাচ্ছে আমায়।
— কি কথা?
— মৃন্ময় এত ইন্টেলিজেন্ট পার্সন হওয়া সত্ত্বেও বাবার গুম হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা খুঁজে বের করে নি, তা কিভাবে হতে পারে? তখন নাহয় ছোট ছিলো কিন্তু এখন তো এডাল্ট সে…তাহলে?এমন তো নয় তার বাবার ব্যাপারটা সে নিজেই লুকিয়ে রেখেছে।
— হতে পারে। (চিন্তিত হয়ে) এমনটা হলে কোনো ক্লু পাওয়া আরো বেশি টাফ হয়ে যাবে আমাদের জন্য। মৃন্ময় নিশ্চয় ক্লুগুলো আমাদের জন্য সাজিয়ে বসে নেই। হয় কালেক্ট করে নিয়েছে নয়তো ভ্যানিশ করে দিয়েছে। (তুরি বাজিয়ে)
রোজা আবারও চেয়ার টেনে বসলো। তার কপালে সুক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ। হাতে একটা সুযোগ, লক্ষ্য একটা কিন্তু প্রশ্ন হাজার। এই হাজারটা প্রশ্নের বেড়াজালে দাঁড়িয়ে আছে একটা মানুষ। আর সে হলো মৃন্ময়!
২২.
জানালায় ঠেস দিয়ে বসে আছে আরু। মাথায় হাজারও এলোমেলো চিন্তার মেলা। ভাইয়া-ভাবিকে যা একটা উল্টো পাল্টা বুঝিয়ে পাড় করেছে সে। কিন্তু নিজের মনটাকে বুঝাতে পারছে না কিছুতেই। রাফিনের সেই রূপ, সেই কথাগুলো কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না তার। এমন একটা কিউট ছেলে এতোটা হার্টলেস কি করে হতে পারে? রাফিন কি আরুকে দূরে সরানোর জন্য এমনটা করছে? নাকি ওর বাস্তবতাটায় এমন, বুঝতে পারছে না আরু। কিন্তু প্রথম যুক্তিটাকেই আরুর মনটা মেনে নিতে চাইছে বারবার। ব্রেন আর মনের গড়া এক কৃত্রিম যুদ্ধে মনটায় জিতে গেলো আবারও। ঠোঁটের কোনে ফুঁটে উঠলো হালকা হাসির ঝিলিক। আরু জানে না কেন এতো পাগল সে, কি দেখে এতো পাগল সে, কিসে এতো বিশ্বাস তার? কেন এতো মায়া তার আশেপাশে। সে শুধু জানে ভালোবাসে। ব্যস, ভালোবাসে!! এটুকুই। মনটা খুব ভারি লাগছে আরুর। কেমন একটা একাকীত্ব ভর করেছে সারা শরীর জুড়ে। গলায় কিছুটা কেটে যাওয়ায় এখনও চিনেচিনে ব্যথা করে চলেছে। আরিফ লিনাকে নিয়ে গিয়েছে হসপিটালে। লিনার বাবা স্টোক করেছেন সন্ধ্যায়। পাশের রুমে আরুর বাবা প্রেশারের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে আছেন পরম তৃপ্তিতে। শুধু জেগে আছে আরু। রাত বেশি হয় নি, মাত্র আটটা বাজে। আরুদের বাসা থেকে কিছুটা দূরের একটা পার্কে মেলা হচ্ছে। কিসের মেলা জানে না আরু। জানার ইচ্ছে জাগে নি কখনো। কিন্তু কেনো জানি সেখানে যেতে ইচ্ছে করছে খুব। কি ভেবে উঠে দাঁড়ালো আরু। বিছানা থেকে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো চুপচাপ। অন্ধকার রাস্তাটা রাস্তার ধারের হালকা আলোতে আরো বেশি ভয়ঙ্কর আর নিস্তব্ধ হয়ে উঠেছে। একটা দুটো রিক্সা আপন গতিতে হেলে দুলে আরুকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সাই সাই করে চলে যাচ্ছে কিছু ছোট বড় গাড়ি। আরু ধীর পায়ে হেঁটে চলেছে। রাতের রাস্তায় হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে তার। মেলার কিছুটা কাছাকাছি আসতেই একটা রিক্সাওয়ালা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলে উঠলো,
— আফা? ওই দিকে যায়েন না গেঞ্জাম লাগছে।
আরু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও হাঁটা দিলো। “গেঞ্জাম” শব্দটা ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। রিক্সাচালকটাকে কি করে বোঝাবে সে? যে গেঞ্জামটা তার মনে বেঁধেছে সেই গেঞ্জামের তুলনায় বাইরের এসব গেঞ্জাম তো কিছুই না। কলেজ থেকে বেরিয়ে রাস্তার মাঝ বরাবর “রাফিন” নামক লোকটিকে দেখেই তো গেঞ্জাম বেঁধে গেছে তার মনে। কঠিন গেঞ্জাম! বড্ড কঠিন। মেলার গেইটের কাছে এসেই রাফিনকে চোখে পড়লো তার। একটা গাড়ির উপর বসে সিগারেট টানছে সে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একঝাঁক সাঙ্গপাঙ্গ। তাদের মধ্যে একজন ব্যস্ত হয়ে ঘড়ি দেখে চলেছে বারবার। হয়তো কারো জন্য অপেক্ষা করছে তারা। আরু ধীর পায়ে রাফিনের দিকে এগিয়ে গেলো। পাশে দাঁড়িয়ে কোনো কথা না বলেই রাফিনের বাম হাতটা টেনে ধরলো। সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আরুর মুখ আবেগশূন্য….
# চলবে….