নিজের আঠারো তম জন্মদিনের উপহার হিসেবে রুহি পেলো, অকথ্যা নির্যাতন। বিছানার ওপর রক্তের ছিঁটেফোঁটা পড়ে আছে। অন্ধকার ঘরটাতে ফ্লোরে এলোমেলো ভঙ্গিতে পরে আছে রুহি। ঠোঁট কেটে রক্ত গড়াচ্ছে, মাথার একপাশে রক্ত জমাট বেঁধে ফুলে গিয়েছে। কয়েক গাছি চুল বিছানায় পড়ে আছে। হাত-পা নড়ানোর শক্তি নেই ওর। বড্ড ব্যথা করছে পুরো শরীর। এভাবে যে কেউ কাউকে আঘাত করতে পারে, সেটা আজ প্রথম জানলো রুহি। সৎ ভাইয়েরা বুঝি এমনই হয়? এতিম হয়ে কী পোড়াকপালির ভাগীদার হয়েছে রুহি? সন্ধ্যায় ওর সৎ ভাই মাহিম এসে জানালো গ্রামের মোড়লের ছেলে সজীবের সঙ্গে নাকি রুহির বিয়ে ঠিক করে এসেছে। ছেলেটা মাতাল, মেয়েদের ত্যক্ত বিরক্ত করে। সেজন্য রুহি মাহিমকে জানালো যে, সজীবকে ও বিয়ে করবেনা। তাছাড়া ওর বয়সও হয়নি। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি হলো মাহিমের সাথে রুহির। যদিও কোনোদিন চোখ তুলে মাহিমের সাথে কথা বলার সাহস হয়নি রুহির। সেই মেয়ের মুখে এই কথা শুনে মাহিম রেগে হাতের কাছে থাকা লাঠি দিয়ে মারতে লাগলো রুহিকে। আধমরা করে ঘরে এনে তালাবদ্ধ করে দিলো এবং জানিয়ে দিলো কালই সজীবের সাথে রুহির বিয়ে। আঠারো বছর বয়স হয়েছে ওর, আর ওকে পালতে পারবেনা কেউ। তাই যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে আপদ বিদেয় করতে চায়। রুহি অবশ্য এর আভাস বেশকিছুদিন ধরেই পাচ্ছিলো। সজীব রাত-বিরেতে বাড়ি এসে বসে থাকে। মাঝেমাঝে মাহিমের সাথে জুয়ার আড্ডা বসায় উঠোনে। রুহিকে দেখলে হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলতো,
‘দিনদিন সুন্দরী হইতাছিস তুই। বহুত রুপ বাড়তেছে তোর। আমিতো তোর এই রুপ দেখবার জন্য মরিয়া হয়ে যাইতেছি। চল তাড়াতাড়ি আমার ঘরে, বিয়া কইরা নিয়া যামু।’
মাতাল সজীবের মুখে এই কথা শুনে সেদিন মাহিমের কাছে রুহি বিচার দিয়েছিলো। কিন্তু মাহিম বিচার না করে বলেছিলো,
‘পোলাপান মানুষ। বড় হইতাছে এসব কইবই। আর সজীব তোরে পছন্দ করে তাই এইগুলাতে সমস্যা নাই। পোলা ভালো।’
রুহি ভাইয়ের সামনে থেকে মাথা নত করে চলে আসলো। ঘরে এসে অনেকক্ষণ কাঁদলো। ওর বাবা-মা কয়েকবছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। প্রথম পক্ষের বউ মারা যাওয়ার পর মাহিমকে লালনপালন করার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করেন সাত্তার পাটোয়ারী। সেই ঘরের সন্তান রুহি। কিন্তু বাবা-মা মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের সংসারে রুহি থাকে। মাহিমের বউ বেতন ছাড়াই কাজের মেয়ে পেয়েছে। দু’বেলা দুমুঠো খেতে দেয় আর সব কাজ রুহিকে দিয়ে করায়। মাঝেমাঝে নির্মমভাবে নির্যাতনও সইতে হয় মাহিমের বউয়ের হাতে। সময়মতো কাজ না শেষ হলে সেদিন রুহির খাওয়া বন্ধ। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ার পর পড়াশোনাও বন্ধ করে দেয় মাহিম। কিন্তু খুব ইচ্ছে হয় পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, কিন্তু সামর্থ্য বা সাহস কিছুই নেই ওর। যাইহোক, বদ্ধ ঘরে রক্তাক্ত রুহি অনেক চেষ্টা করে দাঁড়াতে সক্ষম হলো। হুমড়ি খেয়ে বিছানায় পড়ে গেলো। চোখ দুটো খোলা রাখতে পারছেনা, বুজে আসছে। মৃত্যু মনে হয় এসেই গেলো। পাশের ঘরে মাহিম তার বউয়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছে। সেটা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। আলোচনার এক পর্যায়ে মাহিম তার বউকে বললো,
‘রুহির লগে সজীবের বিয়া দিলে মোড়ল সাহেব কইছে আমাকে একটা দোকান কইরা দিব বাজারে। সাথে পঞ্চাশ হাজার টাকাও দিব। হোক না পোলা মাতাল, তাতে কী! সারাজীবন রাণীর মতো থাকতো পারব। খাওন-দাওনের অভাব হইবো না। এই বিয়া দিলে আমাগোরই লাভ।’
‘কিন্তু তোমার বইনে তো ঢং মারায়, তার নাকি বিয়ার বয়স হয়নাই।’
‘এতো বছর পাইল্লা বড় করছি, আর পারুম না হারামজাদীরে খাওয়াইতে। বিয়া করবোনা, হেতির বাপ করবো।’
‘একটু সুন্দরী দেইখা ভাব দেহায়, যেন রাজপুত্র আইবো ইনারে নিতে।’
মাহিম বউয়ের কথায় বিশ্রি একটা গালি দেয় রুহির উদ্দেশ্যে। তারপর বলে,
‘কালই এরে বাড়ি থেইকা বাইর করমু। বাপের সম্পত্তিতে ভাগ বসাইতে আইলে লাথি মাইরা ঠ্যাং ভাইঙ্গা কবরে দিয়া আসুম।’
রুহি সব কথা শুনতে পায়। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সজীবের মতো অমানুষকে কখনোই ও বিয়ে করতে পারবেনা। তাছাড়া রুহির সুখের কথা চিন্তা না করে মাহিম ওর লাভের চিন্তা করছে। কতোটা নিকৃষ্ট হলে একটা মেয়ের সাথে এরকম অন্যায় করতে পারে কেউ। বাবা-মায়ের কথা মনে হতেই ঢুকরে কেঁদে উঠে রুহি। ওরা বেঁচে থাকলে হয়তো ভাগ্যটা এমন হতোনা ওর। কেন এতো তাড়াতাড়ি প্রিয় মানুষগুলো চলে যায়? পরমুহূর্তেই মাহিমের একটা কথা শুনে গা, হাত-পা হিম হয়ে যায় রুহির। কী বলছে এসব মাহিম? মুহূর্তেই গায়ের ব্যথারা উধাও হয়ে গেলো যেন। বদ্ধ মস্তিষ্কে নিউরনের টি টি শব্দ যেন রুহির কানে জোরালো ভাবে বাজছে। এখান থেকে পালানো দরকার, পালাতে হবে। কিন্তু কী করে? পালানোর কথা মাথায় আসতেই যেন শরীরে বল ফিরে এলো। ঘরের ভেতর কয়েকবার পাক খেলো রুহি। হঠাৎই জানালার দিকে নজর গেলো। শিকহীন ছোট্ট জানালা দিয়ে কষ্ট হলেও বাইরে বেরোনো যাবে। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই অতি সাবধানে, সন্তোপর্ণে ক্লান্ত, অসুস্থ শরীরটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রুহি। একটা ছোট্ট ব্যাগে নিয়ে নিলো নিজের কিছু প্রিয় স্মৃতি! ছাড়তে হবে নিজের বাসস্থান, নিজের গ্রাম, নিজের অস্তিত্ব! রুহি দৌড় লাগালো গ্রামের মেঠোপথ ধরে। অন্ধকারে কুয়াশায় ভেতর নিমিষেই হারিয়ে গেলো রক্তেমাখা রুহির অবয়ব। রেলস্টেশনে পৌঁছে ভাগ্যক্রমে একটা ট্রেন পেয়ে গেলো রুহি। কোনোকিছু বিবেচনা না করেই একটা কামরাতে উঠে গেলো রুহি। গুটিশুটি মেরে একটা সিটে বসে পড়লো। হুইসেল দিয়ে ট্রেন একটু দুলে উঠলো। ট্রেন চলতে শুরু করার একটু পরই রুহি ঘুমিয়ে পড়লো। জানেনা পরবর্তী গন্তব্য কোথায়, ভবিষ্যৎ কী! বেশ কিছুক্ষণ পর ঘুমন্ত রুহি লাফিয়ে উঠলো। চমকে সামনে তাকাতেই সুদর্শন একটা যুবককে দেখতে পেলো।
‘এক্সকিউজ মি ম্যাম। আপনার কপাল দিয়ে রক্ত পড়ছে।’
রুহির হাত কপালে ঠেকালো। আঙুলে কিছুটা রক্ত লেগে গেলো। মাথা ঘুরে উঠলো ওর। সামনে বসে থাকা ছেলেটা বলল,
‘হাত সরান। আমি দেখছি।’
‘আপনি কী ডাক্তার?’
এই প্রথম রুহি অচেনা যুবকটির সাথে কথা বললো। রুহির কথা শুনে ছেলেটি হেসে বললো,
‘ডাক্তার হলে কী করবেন?’
‘ডাক্তার না হলে আমি দেখাবো না।’
‘কেন? ডাক্তাররা কী খুব স্পাইসি হয়?’
‘হুম।’
‘তাহলে তো আপনি আমাকে খেয়ে নিবেন, তাইনা?’
রুহি ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘আপনি সত্যিই ডাক্তার?’
‘আপাতত বলছিনা। শেষে দেখা যাবে আপনি আমাকে গিলে নিয়েছেন।’
রুহি মুখ কালো করে বলল,
‘আমি রাক্ষুসী নই!’
বলতেই মাথাব্যথায় অদ্ভুতভাবে ছটফট করতে লাগলো। হঠাৎ এরকম করাতে ছেলেটি অবাক হয়ে গেলো৷ তারপর রুহিকে ডাকলো,
‘মিস আপনার কী হয়েছে? এরকম করছেন কেন?’
রুহি ঠিকঠাক হয়ে বসলো। গম্ভীর গলায় বলল,
‘কিছুনা।’
‘আপনাকে কেউ মেরেছে? এভাবে কপাল কাটলো কীভাবে?’
রুহির ভাবান্তর হলোনা। একদৃষ্টিতে হা করে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলো। এরকম সুন্দর কোনো মানুষ হয়? সাক্ষাৎ রাজপুত্র। রুহি কী প্রেমে পড়ে গেলো নাকি ছেলেটার! রুহিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ছেলেটি হেসে ফেললো।
‘আপনি কী আমার প্রেমে পড়ে গিয়েছেন মিস রক্তজবা? আমি বিভোর!’
চলবে…
#আঠারো_বছর_বয়স
#পর্ব-১
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া