নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৭০.
রাতের কালচে আঁধার শুষে নিয়েছে সন্ধ্যা। রাস্তার পাশে জ্বলে উঠেছে হলদে ল্যাম্পপোস্ট। আগ্রাবাদের ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে ট্যা ট্যা করে বাজছে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। নীরা স্থির দাঁড়িয়ে আছে। মন-মেজাজ চূড়ান্ত খারাপ। ফ্লোরের মাঝামাঝি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাপের ভাঙা টুকরো আর দুধ। তার পাশেই মহা আনন্দে হাত-পা ছুড়াছুড়ি করছে দেড় বছরের পুত্র আরশ। হাত-পায়ে দুধ মেখে বিশ্রী অবস্থা। রাগে সারা শরীর জ্বালা করছে নীরার। ছেলেকে তুলে শক্ত দুটো চড় বসাতে ইচ্ছে করছে। নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুই পা এগিয়ে যেতেই লাফালাফি, ছুড়োছুড়ি বেড়ে গেল তার। মাকে কাছে আসতে দেখেই পিছুতে পিছুতে সোফার নিচে ঢুকে যাওয়ার জোগার। কিছুতেই মায়ের হাতে ধরা দেওয়া যাবে না। নীরা হাত বাড়াতেই ছেলের ত্যাঁদড়ামো বেড়ে গেল আরও। ত্যাঁদড়ামোর ফলাফল স্বরূপ সোফায় মাথা লেগে ব্যথা পাওয়াও হয়ে গেল ইন্সট্যান্ট। নীরা অবাক হয়ে খেয়াল করল, ছেলে তার একটুও বিচলিত হচ্ছে না। এতটুকু ব্যথা পেয়েও আগের মতোই চিৎপটাং শুয়ে আছে। তার এক জেদ, মায়ের কোলে সে উঠবে না। ততক্ষণে মাথা ফুলে ঢোল। নীরা রাগ ধরে রাখতে না পেরে সটান এক চড় বসিয়ে দিল ছেলের গালে। এবার তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল আরশ। কান্নার দাপটে হৃষ্টপুষ্ট মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে তার। নীরা তাকে জোরপূর্বক কোলে নিতেই কান্নার আওয়াজ বাড়িয়ে দিল আরশ। হাতের কাছে টেলিভিশনের রিমোট পেয়ে তাই ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। নীরা শান্ত চোখে রিমোটটাকে টুকরো হতে দেখল। ছেলের জেদী মুখের দিকে চেয়ে আরেকটা চড় বসাল গালে। ছেলেটা ঠিক বাবার মতো হয়েছে। গায়ের রং থেকে শুরু করে রাগ,জেদ সবকিছুতেই অন্তুর দূর্দান্ত নকল। এতটুকুন বয়সেই রাগ হলে মাথা ঠিক থাকে না তার। হাতের কাছে যা পায় ছুঁড়ে ফেলে। ফ্লোরে গড়াগড়ির সাথে ভয়াবহ কান্না। বাবার মতো এক হিসেব, চাই মানে চাই। নিষেধ করলেই মাথা নষ্ট। অন্তু ফিরল রাত দশটায়। ছেলে এখনও কাঁদছে। কান্নার দাপটে চোখ-মুখ খিঁচে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ছেলের এমন অবস্থায় আতঙ্কিত নীরাও ফুপিয়ে উঠছে বারবার। বাসায় ফিরে বউ, বাচ্চার এই অবস্থা দেখে বিস্মিত হলো না অন্তু। সপ্তাহে অন্তত দুই-একবার ছেলের এই জেদের মুখোমুখি হতে হয় তাকে। অন্তু অফিস ব্যাগটা রেখে ছেলের সামনে যেতেই দুইহাত বাড়িয়ে দিল আরশ। দীর্ঘসময়ের কান্নাকাটিতে ঘেমে নেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বেচারা। ঘন ঘন হেঁচকি উঠায় নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। অন্তু ছেলেকে দুই হাতে বুকে চেপে ধরতেই ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ল আরশ। ছোট্ট ছোট্ট হাতদুটো দিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে চুপ হয়ে গেল। বাইরের পোশাক পরেই ছেলেকে নিয়ে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করল অন্তু। ক্লান্ত ছেলে ঘুমিয়ে পড়তেই ভয়াবহ রাগ প্রকাশ পেলো তার। আরশের কোমল গালে আঙ্গুলের ছাপ দেখে নীরার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল,
‘ একটা থাপ্পড় দিয়ে চাপার দাঁত ফেলে দেব। তুই আবারও ওকে মেরেছিস। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলার স্বভাব যায়নি এখনও? একটু জেদ ধরলেই মারতে হবে? এই তুই ব্যাগ গোছা। তোকে আজকেই বাপের বাড়ি দিয়ে আসব। আমার ছেলের আশেপাশে থাকার দরকার তোর নেই। এতটুকু বাচ্চাকে কেউ মারে? ইচ্ছে তো করছে…’
নীরা তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে চেয়ে দুনিয়া ভেঙে কান্না আসছে তার। ছেলেটা সন্ধ্যা থেকে কিচ্ছু খায়নি। একটু সহ্য করে নিলেই পারত। কী দরকার ছিল গায়ে হাত তোলার? অন্তুর রাগারাগি এখনও চলছে। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত চলবে। নীরা এবার ফুঁসে উঠে বলল,
‘ আমাকে বকার মানে কী? ছেলের বাবার জন্যই ছেলের আজ এই দশা। রক্ত তো ওই একই।’
অন্তু আকাশসময় বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ এখন আমার দোষ? ছেলেকে ধরে ইচ্ছেমতো পিটাও তুমি আর দোষের বেলা আমি?’
‘ তা নয়ত কী? দেড় বছরের বাচ্চা আমার। এখন অব্দি কথা ফোটেনি মুখে অথচ বাবার মতো তেজ। সন্ধ্যা থেকে জেদ ধরেছে চা খাবে। ঠান্ডা হলে চলবে না গরম চা দিতে হবে। আমি কাপে করে কুসুম গরম দুধ দিলাম। তেজের চোটে সেই কাপ উল্টে কাপ ভাঙল। দুধটুকু নষ্ট করল। রিমোট ভাঙল। এসব কার স্বভাব?’
অন্তু জবাব দিল না। ছেলের স্বভাব চরিত্র আসলেই তার মতো হয়েছে। কিন্তু তাতে তো অন্তুর কোনো দোষ থাকার কথা না। অন্তু নিশ্চয় ছেলেকে তার মতো হতে বলেনি? পুরো ব্যাপারটা ঘটেছে জেনেটিক্যালি। জেনেটিক বিষয়-আশয়ে অন্তুকে টানার মানে কী? অন্তু কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
‘ ছেলে আমার মতো হয়েছে বলেই মারতে হবে? স্বৈরাচারী মহিলা। একটা কাপ ভেঙেছে তো কী হয়েছে? আমার কী কাপ কেনার টাকা নেই? কাল আমি ছেলেকে এক ডজন কাপ এনে দেব। সে যত ইচ্ছে ভাঙবে। আরাম করে বসে, বাপের টাকায় কেনা কাপ ভাঙবে। ছেলের গায়ে হাত তুলবি না খবরদার।’
নীরা স্থির চোখে চেয়ে রইল। কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করল না। কথার পিঠে কথা বলতে গেলেই রেগে যাবে অন্তু। তারপর আবারও সেই একই কাহিনী। একই গল্প। নীরাকে চুপচাপ বেরিয়ে যেতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল অন্তু। গলাটা খানিক উঁচিয়ে বলল,
‘ আশ্চর্য! কথা বলছিস না কেন? আমাকে মানুষ বলে মনে হয় না?’
নীরা উত্তর দিল না। অন্তু ফ্রেশ হয়ে খাবার খাওয়া পর্যন্ত কোনোরূপ কথা বলল না নীরা। খাওয়া শেষে টেলিভিশন অন করতে গিয়েই বিপদে পড়ে গেল অন্তু। ছেলে রিমোট ভেঙে ফেলেছে। টেলিভিশন অন করা যাচ্ছে না। অন্তুর মেজাজ খারাপ লাগছে। বাসায় এত জিনিস থাকতে দেখে দেখে টেলিভিশনের রিমোটটাই ভাঙতে হলো কেন? মায়ের মতোই ষড়যন্ত্রকারী। রাত বারোটার দিকে ভিডিও কলে এলো অয়ন। অন্তু যার-পর-নাই বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ তোর কী আক্কেলজ্ঞান নেই? এই মাঝরাতে কেউ ভিডিও কল দেয়? আর কয়েক মিনিট পরেই তো ঘুমিয়ে পড়তাম।’
অয়ন দাঁত বের করে হেসে বলল,
‘ আজকে ফুটবল ম্যাচ আছে না? ঘুমাবে কেন? নারীপু কই? আর আমাদের ছোটে উস্তাদ কোথায়?’
‘ নীরাপু মানে কী? নীরা তোর আপু হবে কেন?’
‘ ওই একই হলো। ভাবী, আরশ ওরা কই?’
অন্তু বালিশে ঠেস দিয়ে বসল। ঘুমন্ত ছেলের দিকে একবার চেয়ে বলল,
‘ আরশ ঘুমায়। মায়ের হাতে বিশাল মাইর খেয়েছে আজ।তোর ভাবী রান্না ঘরে। আমার সাথে তার ঝগড়ার দ্বিতীয় পর্ব চলছে। কথা-টথা বন্ধ।’
অন্তুর কথার মাঝেই ঘরে এলো নীরা। কোনোরকম কথাবার্তা না বলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসল। অন্তু নীরাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
‘ অয়ু? ফ্রীতে একটা সাজেশন দিই, মনোযোগ দিয়ে শোন। প্রেম করতে হলে, শান্তশিষ্ট, কচি মেয়ে দেখে প্রেম করবি। আমার মতো ভুল করিস না।’
নীরা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। অন্তু কথাটা মজা করে বললেও হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল নীরার। চোখ টলমল করে উঠল, কান্না পাচ্ছে। অয়ন হাসছে। হাসিমুখেই বলল,
‘ আরশকে ঘুম থেকে উঠাও একটু৷ ওর সাথে কথা বলব।’
‘ এখন উঠালে সারারাত জ্বালাবে।’
‘ প্লিজ ভাইয়া। একটু জ্বালালে কিছু হবে না।’
অন্তু আরশের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল। ছেলের ঘুম ঘন। ঘুমুলে জাগানো মুশকিল। অন্তু বহু কসরত করে জাগিয়ে তুলতেই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠার প্রস্তুতি নিল আরশ। মুখের উপর বাবার চেহারা দেখতেই কান্না থেমে চোখ গোলগোল করে তাকাল। অন্তু একটু আদর করতেই হাত-পা ছুড়ে খিলখিল করে হেসে উঠল আরশ। উপর-নিচে ছয়টা দাঁত উঠেছে তার। বাবার গালের উপর কঁচি হাত রেখে বলল,
‘ বা-বা। বাবা।’
‘ হ্যাঁ বাবা। দেখো তো এটা কে?’
আরশ চাইল। মোবাইল স্ক্রিনে অয়নের চেহারা দেখে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে আবারও হেসে উঠল সে। হাত বাড়িয়ে ফোন নিয়ে ঠোঁট কুঁচকে নিজস্ব ভঙ্গিতে বলল,
‘ চাচু।’
অয়নের চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। নীরার যখন প্রথমবার মিসক্যারেজ হলো সেদিন ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল তার। রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছিল পর্যন্ত। বাচ্চাটার জন্য কতকিছু ভেবে রেখেছিল সে। তাদের বাসায় বাবু আসবে ভাবতেই দূর্দমনীয় আনন্দ হতো তার। এতো মায়া, এতো আদর কাটিয়ে হঠাৎ শুনলো বাচ্চাটা আর আসবে না। হি ইজ ডেড। অয়ন ভীষণ আনন্দিত কন্ঠে বলল,
‘ আব্বু? তুমি আসবে না? দাদু আর চাচ্চু তোমার জন্য অনেকগুলো ব্যাট,বল কিনেছে। পু পু গাড়ি কিনেছে…. ‘
নীরাকে আশেপাশে না দেখে বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় উঁকি দিল অন্তু। বারান্দার এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নীরা। দুই হাত চুলে বিনুনি করতে ব্যস্ত। চোখদুটো স্থির হয়ে আছে রাস্তার অন্ধকারে। অন্তু ধীর পায়ে পাশে গিয়ে দাঁড়াল। নীরার হাতে থাকা চুল নিজের হাতে নিয়ে একটু টেনে ধরে বলল,
‘ এটা কোনো বিনুনি হলো? আমি এর থেকে ভালো পারি। আমি করে দিচ্ছি।’
নীরা শান্ত রাগ নিয়ে তাকাল। চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
‘ লাগবে না। শান্তশিষ্ট, কচি মেয়ে বিয়ে করে বিনুনি গেঁথে দে, যা। আমি কচি নই।’
অন্তু বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ ছিঃ হাজবেন্ডের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? ডিরেক্ট তুই? বন্ধুদের মতো তুই তোকারি না করে একটু বউ বউ ভাব নিয়ে কথা বললে কী হয়?’
নীরা অবাক চোখে তাকাল। নিজে সারাদিন এভাবে কথা বলে এখন তার ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে? নীরা মুখ কালো করে বলল,
‘ আমাকে বউ মানছে কে? যে যেভাবে কথা বলে তার সাথে সেভাবেই কথা বলা উচিত। আমি পারি না বলেই আজ আমার এই অবস্থা।’
‘ বলে কী! আচ্ছা যা। হাজবেন্ডের মতোই কথা বলব এবার।’
এটুকু বলেই হঠাৎ নীরার হাত চেপে ধরল অন্তু। আদুরে কন্ঠে বলল,
‘নীরু জান? কাছে এসো৷ তুমি কেন কষ্ট করবে? আমি আছি না? আমি বিনুনি গেঁথে দিব। আহা! কী সুন্দর চুল। এই চুল দেখেই নিশ্চয় কবিতা লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ,
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা… “
অন্তুর ঢং দেখে চোখ গরম করে তাকাল নীরা। অন্তু হেসে ফেলল। সেই হাসির দিকে চেয়েই মন ভালো হয়ে গেল নীরার। ছেলেটা এতো সুন্দর করে হাসে কী করে? আরশের হাসিও সুন্দর। বাবার মতোই ঠোঁট ভেঙে হাসে সে। ছেলের হাসি দেখলেই নিজেকে পাগল পাগল লাগে নীরার। বিশ্বাসই হয় না, এই মিষ্টি হাস্য ছেলেটি তার। অন্তু হাসি নিয়েই বলল,
‘ হাজবেন্ড টাইপ প্রেম আসছে না। তবে তোর জন্য বিরাট একটা সারপ্রাইজ আছে।’
নীরা আড়চোখে তাকাল। মুখ গুমরা করে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করে চুপ করে রইল। অন্তু নীরার আধ বিনুনি করা চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে কাছে টানল। দুইহাতে কোমর জড়িয়ে থুতনি রাখল কাঁধে। ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ বিশ্বাস হচ্ছে না?’
নীরা জবাব দিল না। অন্তু ঘরে গিয়ে দুই মিনিটের মাথায় ফিরে এলো। নীরার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ স্বামীর কথা বিশ্বাস করতে শিখো সুন্দরী।’
নীরা অবাক চোখে খামের দিকে চেয়ে রইল। খামটা উল্টেপাল্টে দেখে বলল,
‘ এটা কী?’
‘ খুলে দেখো।’
অন্তু মিটিমিটি হাসছে। নীরা তার মুখপানে চেয়ে থেকেই খাম খুলল। বাদামী খামের ভেতর থেকে নীল রঙা এক খাম বেরিয়ে এলো আবার। তাতে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা ‘নীল চিরকুট’। নীরা যার-পর-নাই অবাক হয়ে নীল খাম খুললো। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ছয় বন্ধুর হাস্যোজ্বল এক ছবি। তার সাথে ছোট্ট এক চিরকুট,
‘ অভিমানী বন্ধুত্ব এবার জেদ ধরেছে। গিটার আর হাসির সুর টিএসসি, ক্যাফেটেরিয়া আর লাইব্রেরি কোণায় গুমরে মরছে। এবার তারা মুক্ত হোক। হাসুক, বাঁচুক। ব্যস্ততা ভুলে আবার তাদের দেখা হোক। স্বাধীন পাখিদের দুয়ারে তাই নীল চিরকুটের আমন্ত্রণ।’
নীরা হতবিহ্বল চোখ চাইল। টলমল করে উঠল চোখ। ছোট্ট এই জীবনটাতে বহু চড়াই-উতরাই পাড় করতে হয়েছে তাদের। জীবনের প্রতিটি সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে খেয়ে জমেছে হাজারখানেক অভিমান-অভিযোগ। নম্রতার সাথে কথা কাটাকাটির কিছুদিন পরই নিজের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল নীরার। বিভিন্ন টেনশন, ম্যান্টাল প্রেশার আর নম্রতাকে কী বলা যায়? এসবের চিন্তাতেই নম্রতার মুখোমুখি হওয়া হয়নি আর। তারপর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল সে। তারপরের জীবনটা ছিল ভয়াবহ। নীরার চোখ থেকে টপ করে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ কে?’
অন্তু মাথা নেড়ে জানাল, জানে না। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘ হঠাৎ অফিসের ঠিকানায় চিঠি এলো। একই রকম দুটো চিঠি। একটি তোর, অপরটি আমার। খামে প্রেরকের নাম, ধাম কিছু নেই। ওদের মধ্যে থেকেই কেউ হবে নিশ্চয়। আমি অফিসে ছুটির কথা বলে দিয়েছি। তুই স্কুল থেকে সপ্তাহখানেকের ছুটি নিতে পারবি না? আমরা সামনের সপ্তাহেই ঢাকা ফিরছি।’
খুশিতে আত্মহারা নীরা উত্তেজনায় কথা বলতে পারছে না। হাত-পা মৃদু কাঁপছে। নীরা অন্তুর ডানহাতটা চেপে ধরে কাঁধে মাথা রাখল। থেমে থেমে বলল,
‘ ছুটি পাই আর না পাই। চাকরি ছুটে গেলেও পরোয়া নেই। ঢাকা আমি যাচ্ছিই।’
এটুকু বলে থামল নীরা। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ নমু কী এখনও রেগে আছে? ও আমার সাথে কথা বলবে না?’
অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নীরাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইল। চোখের সামনে ভেসে উঠল একের পর এক কষ্টমাখা রাত। একদিকে অন্তুর চাকরী নেই, অন্যদিকে নীরার অসুস্থতা। তারসাথে আবার অনাগত বাচ্চার চিন্তা। বারবার ডাক্তার দেখানোর জন্য বিশাল অঙ্কের টাকাও চাই। নাদিম নিরুদ্দেশ। এতোকিছুর মাঝে নম্রতার সাথে যোগাযোগ করে ওর বিয়ের আনন্দ, নতুন সংসারের আনন্দ নষ্ট করতে চায়নি অন্তু। হয়তো সুযোগটাও ছিল না। অন্তু তার যথাসাধ্য করেছিল। নীরাও সুস্থ হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। তারপর হঠাৎই, একদম আচমকা মিসক্যারেজ হয়ে গেল নীরার। একদিকে বাচ্চা হারানোর কষ্ট অন্যদিকে নীরার পাগলামো। নীরা মানসিকভাবে এতোটা অসুস্থ হয়ে পড়ল যে, অন্তু হঠাৎ কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছিল না। ভীষণ অন্ধকারে একলা পথিকের মতো অসহায় লাগছিল সব। নীরাকে রূপগঞ্জ, তার মায়ের কাছে রেখে এসেও স্বস্তি নেই। বারবার সুইসাইড এট্যাম্পের চেষ্টা করে সে। তার ধারণা এবোরশন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলেই বাচ্চাটা এলো না। সে আর মা হতে পারবে না। তার বাচ্চা মারা যাওয়ার জন্য একমাত্র সে-ই দায়ী। সে সকল দিনগুলোর কথা ভাবলেও শরীর কেঁপে উঠে অন্তুর। এমন বিভৎস দিনগুলোর মাঝে হঠাৎই এক ভালো সংবাদ এলো। নম্রতার বিয়ের দিনে দেওয়া ইন্টারভিউটা কাজে লেগে গেল। ব্যাংকের চাকরিটা হয়ে গেল। পোস্টিং হলো চট্টগ্রাম। অন্তু যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। নীরাকে এই শহর থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া দরকার। অন্তুর নিজেরও তখন বিষাক্ত লাগছে এই শহরের বাতাস। জয়েনিং-এর দুই সপ্তাহ আগেই নীরাকে নিয়ে পাড়ি জমাল চট্টগ্রামের পথে। চট্টগ্রাম আসার কয়েক মাসের মাথায় আবার কনসিভ করল নীরা। আচার-আচরণেও স্বাভাবিকতা এলো। চাকরির জন্য পড়াশোনা শুরু করল। বিস্ময়করভাবে প্রাইমারি স্কুলের চাকরিটা হয়েও গেল। এই বিশাল ঝড়-ঝাপটার মাঝে জীবনটা এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। এতোটা বিতৃষ্ণা আর কষ্টের গল্প জমে গিয়েছিল যে বাইরের পৃথিবীর দিকে তাকানোর সময় হয়নি কারো। তবে নম্রতা আর নীরার ঝামেলার ব্যাপারটা অন্তু জেনেছিল নীরার চাকরি হওয়ার পর। ততদিনে বিশাল গ্যাপ পড়ে গিয়েছে। নম্রতার সাথে যোগাযোগ হয় না অনেকদিন। এতোদিন পর হঠাৎ সরি বলার জন্য ফোন দেওয়াটা ভীষণ অস্বস্তির ছিল তাদের জন্য। আজ হঠাৎ এই নীল চিরকুটের নিমন্ত্রণ তাদের জন্য বিশাল অপেক্ষার সমাপ্তি। বিশাল এক আনন্দের চাবি। আহ! কতদিন দেখা হয় না সেই ভালোবাসাগুলোর সাথে। অন্তুর বুক কাঁপছে। কষ্টের স্মৃতি ছাপিয়ে স্মৃতির পাতা ছুটে চলেছে ক্যাম্পাসের মাঠে। মামার চায়ের দোকানে, ক্যাফেটেরিয়া আর সেই লাইব্রেরিটাতে। যেখানে নীরার হাত চেপে ধরেছিল প্রচন্ড জেদে!
_
নিউইয়র্কে গ্রীষ্মকাল চলছে। শীতের জীর্ণতা কাটিয়ে সজীব হয়ে উঠেছে গাছ, লতা। বাড়ির আঙিনা আর বারান্দাগুলো সেজে উঠেছে বাহারি ফুলে। রাস্তায় উৎফুল্ল যুবক-যুবতীর পদচারণ। সবার ঠোঁটেই এক চিলতে সৌজন্যতার হাসি। গ্রীষ্মের শুরুতে মন-মেজাজ প্রফুল্ল। রঞ্জন খুব ভোরে দৌঁড়াতে বেরিয়েছিল। পরনে ছাইরঙা হাফপ্যান্ট, সাদা টি-শার্ট আর স্পোর্টস শো। গলায় ঝুলছে টকটকে লাল রঙের হেডফোন। রঞ্জন দৌঁড়ে এসে নিজের এপার্টমেন্টের সামনে থামতেই এগিয়ে এলো মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক। গায়ে তার ভিন্ন ধরনের ইউনিফর্ম। মুখভর্তি প্রফুল্লতার হাসি। রঞ্জন ফাঁপাতে ফাঁপাতেই সৌজন্যতার হাসি হাসল। ছোট্ট করে বলল,
‘ হেই, গুড মর্নিং।’
‘ মর্নিং। আর ইউ রেনজ্যান চ্যাকরাবার্তি?’
‘ ইট’স রঞ্জন। এনিওয়ে হোয়াট’স দ্যা ম্যাটার?’
‘ ইউ হ্যাভ আ লেটার ফ্রম বাংলোডেশ।’
‘ লেটার?’
অবাক হলো রঞ্জন। দেশ থেকে চিঠি পাঠানোর মতো মানুষ তার নেই। তাছাড়া, এই যুগে এসে চিঠি লিখতে বসবেই বা কে? টেক্সট, মেইল এসব ছেড়ে চিঠি? আশ্চর্য! রঞ্জন হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিল। ফর্মালিটিস শেষ হতেই মুখভর্তি হাসি উপহার দিলেন ভদ্রলোক। উৎফুল্ল মনে বললেন,
‘ ওয়াও, হোয়াট আ বিউটিফুল ডে। এনজয় ইউরসেলফ।’
রঞ্জন ঠোঁট টেনে হাসল,
‘ইয়াহ, ইট্স রিয়েলি বিউটিফুল! হ্যাভ ফান।’
গেইট পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে চিঠিটা উল্টেপাল্টে দেখল রঞ্জন। রেজিস্ট্রি করা চিঠি। প্রেরকের নাম, ঠিকানা বৃত্তান্ত নেই। রঞ্জন কাউচে বসে খাম খুলল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আরও একটি নীল রঙা খাম। তাতে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা, ‘নীল চিরকুট’। রঞ্জনের বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁলো। নীল চিরকুট মানে কী? কেউ এতোদূর থেকে চিঠি পাঠিয়ে ফাজলামো নিশ্চয় করবে না? রঞ্জন কৌতূহল নিয়ে খাম খুলল। নীল খামটা খুলতেই বেরিয়ে এলো একই ফ্রেমে আবদ্ধ ছয় বন্ধুর হাস্যোজ্জল ছবি। টিএসসির চা স্টলে বসে আছে সবাই। নাদিমের হাতে চিরচেনা গিটার। রঞ্জন হতভম্ব চোখে চেয়ে রইল। সাথে থাকা চিরকুটটা পড়ে হৃদস্পন্দন থেমে গেল তার। উত্তেজনায় কেঁপে উঠল শরীর। ঘন্টাখানেক ঠাঁই বসে থেকে লাফিয়ে উঠল সে। কম্পিত হাতে ফোন লাগাল দেশে। দেশে তখন সন্ধ্যা নেমেছে মাত্র। পূজা মাত্রই ধূপকাঠি জ্বলেছে। এমন সময় রঞ্জনের ফোন পেয়ে অবাক হলো সে। মায়ের সামনে থেকে সরে এসে ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রঞ্জন,
‘ আই এ্যাম কামিং পূজা। আমি নেক্সট উইকেই ফ্লাইট ধরছি।’
পূজা অবাক হয়ে বলল,
‘ কিন্তু তুমি যে বললে আসবে না? একদম বিয়ের ডেইট ফিক্সড হলে ফিরবে।’
রঞ্জন উত্তেজনা নিয়ে বলল,
‘ আগে যা বলেছি ভুলে যাও, সুইটহার্ট। ডিসিশন চেইঞ্জ হয়েছে। আমি অবশ্যই ফিরছি এবং নেক্সট উইকের মধ্যেই ফিরছি।’
পূজা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
‘ কিন্তু হঠাৎ কী হলো? তোমার কন্ঠও অন্যরকম শুনাচ্ছে। ঠিক আছো?’
রঞ্জন হেসে বলল,
‘ না। ঠিক নেই। আমার দুয়ারে নীল চিরকুটের আমন্ত্রণ এসে গেছে পূজা। আমি ঠিক থাকতে পারছি না। তোমাকে এই মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। কাছে নেই বলে পারছি না। দেশে ফেরার পর অবশ্যই মনে করিয়ে দেবে, ওকে?’
পূজা বিস্ময়ে কথা খুঁজে পাচ্ছে না। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। দেশে এখন আষাঢ়িয়া কান্না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা পূজার শরীর মাখামাখি হচ্ছে মিষ্টি শীতল জলে। সেই জলে হাত ভিজিয়েই ফিসফিস করে বলল সে,
‘ তুমি কী পাগল হয়ে গিয়েছ রঞ্জন? আমার তোমাকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।’
#চলবে….