নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৫৭.
বেলা নয়টা। রমনায় নিজস্ব অফিসে বসে আছেন নুরুল সাহেব। টেবিলের উপর ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ আর খুলে রাখা অমীমাংসিত ফাইল। নাকের ডগায় চশমা রেখে ফাইলের প্রতিটি লাইন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন তিনি। এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল বেয়ারা। ছড়ানো ছিটানো ফাইলগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে বিনীত কন্ঠে বলল,
‘ আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে, স্যার।’
নুরুল সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। চশমার উপর দিয়ে কুটিল চোখে তাকালেন। বিরক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ এতো সকালে? এপয়েন্টমেন্ট ছিল নাকি? নাম কি?’
বেয়ারা পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এপয়েন্টমেন্ট বোধহয় ছিল না স্যার। এই কার্ডটা আপনাকে দিতে বলেছে। ভেতরে আসতে বলব স্যার?’
নুরুল সাহেব কার্ডটা নিলেন। গোয়েন্দাদের মতো খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। উল্টেপাল্টে দেখে নিয়ে মৃদু মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বেয়ারার দিকে তাকালেন। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বললেন,
‘ আসতে বলো।’
বেয়ারা নির্দেশ পেয়ে মাথা হেলিয়ে বেরিয়ে গেল। কয়েক মিনিট পরই দরজায় মৃদু শব্দ হলো। কেউ একজন ভরাট অথচ বিনয়ী কন্ঠে অনুমতি চাইল,
‘ মে আই কাম ইন, স্যার?’
নুরুল সাহেব তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড দরজার দিকে চেয়ে থেকে মাথা নাড়লেন। ঠোঁট নেড়ে বললেন,
‘ বসুন।’
আরফান ভেতরে এসে, সালাম দিয়ে, চেয়ার টেনে বসল। আরফানের কার্ডটা এখনও নুরুল সাহেবের হাতে। নুরুল সাহেব কার্ডটা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বললেন,
‘ ডক্টর আরফান আলম। লেকচারার অব ঢাকা মেডিকেল কলেজ, রাইট?’
‘ জি স্যার।’
‘ স্যার স্যার বলছেন কেন? আমি কি আপনার কলেজের প্রফেসর?’
নুরুল সাহেবের প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো আরফান। হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ আপনি একজন সিনিয়র এডভোকেট। অভিজ্ঞ একজন মানুষ। স্যার ডাকাটাই বোধহয় যথাযথ।’
‘ আপনি কোনো কেইসের কাজে এসেছেন নাকি পার্সোনাল?’
আরফান জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
‘ পার্সোনাল।’
‘ তাহলে স্যার শব্দটা এবোয়েড করুন।’
আরফান কিছুটা বিপাকে পড়ল। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে ডান চোখের ভ্রু চুলকিয়ে বলল,
‘ আসলে আঙ্কেল… ‘
আরফানকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই চায়ের কাপে চুমুক দিলেন নুরুল সাহেব। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘ ইংরেজদের আংকেল ডাকটা আমার পছন্দ নয়।’
আরফান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ তাহলে চাচা বলে সম্বোধন করতে পারি?’
নুরুল সাহেব বিরক্ত কন্ঠে আওড়ালেন,
‘ চাচা!’
আরফান এবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। নুরুল সাহেব ইচ্ছে করেই তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে বুঝতে পেরে সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুহূর্তেই মুখভঙ্গি পাল্টে স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ আমাকে মেয়ে জামাই বানালে আমি আপনাকে অনায়াসে বাবা ডাকতে পারি, স্যার। এটাই হয়তো পৃথিবীর শুদ্ধতম ডাক।’
নুরুল সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। আরফানের এমন অপ্রত্যাশিত উত্তরে কিছুটা হোঁচট খেলেন। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন,
‘ আপনি… ‘
‘ আপনি আপনি বলছেন কেন? আমি তো আপনার মক্কেল নই।’
কথার মাঝে বাঁধা পাওয়ায় থমকালেন তিনি। কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া আরও খানিকটা কুঁচকে আরফানের দিকে তাকালেন। পরমুহূর্তেই হেসে ফেলে বললেন,
‘ আমার কথায় আমায় ফিরিয়ে দিলে? গুড, ভেরি গুড। তবে, আমি তোমার উত্তরগুলো অন্যরকম আশা করেছিলাম।’
আরফান মৃদু হেসে বলল,
‘ বেয়াদবির জন্য সরি, স্যার।’
নুরুল সাহেব অমায়িক হাসলেন। বেয়ারাকে দু কাপ চা দিতে বলে কথা এগুলেন,
‘ তোমার মা আমাদের বাসায় সিভি পাঠিয়েছেন জানো?’
‘ জি জানি।’
‘ তাহলে হঠাৎ আমার সাথে দেখা করার কারণ? নম্রতার জেদ?’
আরফান হাসল। নুরুল সাহেব আরফানকে চা নিতে ইশারা করে বললেন,
‘ আমার স্ত্রী বলে, আমি আমার মেয়েদের বিগড়ে ফেলেছি। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে নয়। আমার মেয়েগুলো খুব স্বাধীনচেতা, একরোখা, জেদী। আমি কখনও তাদের ডানা কাটিনি বরং উড়তে দিয়েছি। উড়তে শিখিয়েছি। আমার এই বিগড়ে যাওয়া মেয়ের জন্য পাঞ্চুয়াল, ম্যাচিউর এবং রেসপন্সেবল একজন লাইফ পার্টনার প্রয়োজন। যে আমার মতো তাকে বুঝবে। ডানা কেটে ঘরে না বসিয়ে, উড়তে দিবে। কি মনে হয়? আমার বিগড়ানো মেয়েটাকে সামলাতে পারবে?’
আরফান ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রেখে বলল,
‘ নম্রতার সাথে আমার পরিচয়টাই হয়েছিল তার চূড়ান্ত অবাধ্যতার বয়সে। কলেজ পড়ুয়া জেদী, অগোছালো কিশোরী ছিল তখন। আমি তাকে ওভাবে ভেবেই অভ্যস্ত। তাকে কখনো শান্ত, চুপচাপ, মানিয়ে নেওয়া ধরনের মেয়ে হিসেবে কল্পনাই করিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি তাকে যতটা ভালো রাখতে পারব, অন্য কেউ পারবে না।’
নুরুল সাহেব জবাব না দিয়ে চুপ করে চেয়ে রইলেন। আরফানের আত্মবিশ্বাসী কথাবার্তা, ব্যক্তিত্ব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে খেয়াল করলেন। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
‘ ডাক্তার হিসেবে তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। গত মাস থেকে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে৷ আজকাল চোখেও দেখছি ঠিকঠাক। বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ হাই, হ্যালো করলে স্পষ্ট দেখতে খুব একটা সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।’
আরফান হেসে ফেলল। প্রসঙ্গটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বলল,
‘ মা এসেছেন আমার সাথে। বাইরে অপেক্ষা করছেন। তিনি আপনার সাথে কথা বলতে চান।’
নুরুল সাহেব অবাক হলেন। ব্যস্ত হয়ে বললেন,
‘ সে কি? কোথায়? বাইরে বসিয়ে রেখেছ কেন? ডাকো তাঁকে?’
এটুকু বলে নিজেই বেয়ারা ডেকে বাইরে থাকা ভদ্রমহিলাকে ভেতরে আসতে বললেন। কিছুক্ষণের মাঝেই কালো ডোরাকাটা সাদা শাড়ি পরিহিতা এক ভদ্রমহিলা দরজায় এসে দাঁড়ালেন। নুরুল সাহেব উঠে দাড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতেই অমায়িক হাসলেন ভদ্রমহিলা। দরজা থেকে হেঁটে ভেতর পর্যন্ত আসতেই প্রকাশ পেলো তার তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্ববোধ। নুরুল সাহেবের দিকে চেয়ে অমায়িক হেসে বললেন,
‘ অসময়ে বিরক্ত করার জন্য মাফ করবেন ভাইসাহেব। কী করি বলুন তো? আপনাদের মেয়ে নিতে চাই। যাদের বুক থেকে জান্নাতের নূর নিতে চলেছি তাদের কী ঘটকের হাতে নিমন্ত্রণ পাঠালে চলে?’
ভদ্রমহিলার আন্তরিক, মিষ্টি কন্ঠে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন নুরুল সাহেব। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, নম্রতার বিয়েটা তিনি দিবেন। নম্রতা রাজি না থাকলেও দিবেন। এমন একটা ছায়া। এমন একটা মায়ের লোভ আদৌ হাতছাড়া করা যায়? না, কখনো না।
_
দুপুর গড়াতেই ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এলো নম্রতার বন্ধুরা। অন্তু নীরাকে নিয়ে বাইকে উঠতেই টিএসসির দিকে হাঁটা দিল নাদিম, নম্রতা আর ছোঁয়া। অন্তু আর নীরা চোখের আড়াল হতেই দৌঁড়ে এসে নাদিমের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল নম্রতা। নাদিমের বাহুতে জোরেসোরে একটা চড় বসিয়ে গদগদ কন্ঠে বলল,
‘ আমি তোকে বলেছিলাম না? একমাত্র রঞ্জনই পারবে অন্তুর মাথায় সুবুদ্ধি ঢুকাতে? দেখেছিস? মিলে গেল তো?’
নাদিমের অপর পাশে পাশাপাশি হাঁটছিল ছোঁয়া। নম্রতার কথা শুনে বেশ কৌতূহল নিয়েই পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল সে। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল,
‘ কেন? অন্তুর মাথায় কি হয়েছিল আবার? ওয়াজ হি সিক?’
নম্রতা বেশ উৎসাহ নিয়ে বিষয়টা বুঝাতে নিতেই সটান দাঁড়িয়ে পড়ল নাদিম। ভীষণ চোটপাট দেখিয়ে বলল,
‘ এই ইংরেজের বাচ্চা চুপ। শইল্যের উপরে পইড়া ভর্তা বানাইয়া জিগাইতাছিস, ওয়াজ হি সিক? এই তোরা দূরে যাইয়া খাড়া। দুইপাশ থাইকা চাইপা চুইপা স্যান্ডউইচ বানায় ফেলতাছিস আমারে। সর!’
ছোঁয়া চশমা ঠিক করে একটু সরে দাঁড়াল। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ শইল? হোয়াট ইজ শইল নমু?’
নম্রতা কন্ঠে গাম্ভীর্য আনার চেষ্টা করে বলল,
‘ শইল অর্থ দেহ। যাহাকে অঙ্গ বলে তাহাই হইল শইল। বুঝেছ?’
ছোঁয়া কি বুঝল বুঝা গেল না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
‘ পরশু আমার বিয়ে, তোরা আসবি না?’
নাদিম চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে পা ছড়িয়ে বসে বলল,
‘ তোগো ছাতার বিয়েত যাই না। দুই বলদে মিলে হাম্বা হাম্বা করবি ওইনে আমাগো মতো মানুষের কি কাম?’
ছোঁয়া চোখ রাঙিয়ে তাকাল। রাগ নিয়ে বলল,
‘ এসব থার্ডক্লাস ওয়ার্ড আমার সামনে বলবি না। তোর এই থার্ডক্লাস পার্সোনালিটির জন্যই মাম্মা তোকে একদম সহ্য করতে পারে না। ট্রাই টু গিভ আদার রেসপেক্ট।’
ছোঁয়ার কথায় তেড়ে আসতে নিতেই থামিয়ে দিল নম্রতা। মামাকে তিন কাপ চা দিতে বলে নাদিমের পাশে বেঞ্চে গিয়ে বসল। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ দুই সপ্তাহ পর সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। তাও আবার লাস্ট সেমিস্টার। বিয়েটা দুই তিন মাস পরে করলেও তো পারিস। তোর মা এতো তাড়াহুড়ো কেন করছে বুঝলাম না। বর তো আর ভেগে যাচ্ছে না।’
‘ আরে অস্ট্রেলিয়ান মাল তো। টোটাল হাইব্রিড গরু। কখন উষ্টা খাইয়া মইরা যায়, গেরেন্টি নাই। হের লাইগা এতো তাড়াহুড়া। ঠিক কইছি না ছোঁয়াইয়া?’
কথাটা বলেই ছোঁয়ার মাথায় চাটি মারল নাদিম। ছোঁয়া নাদিমের বাহুতে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে সরে বসল। তারপর বাধ্য মেয়ের মতো বলল,
‘ পরীক্ষার জন্যই বিয়েতে এতো তাড়াহুড়ো। বিয়েটা হয়ে গেলে সাইম অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাবে। আমার পরীক্ষা শেষ হতে হতে ওখানের বাদ বাকি ফর্মালিটিসগুলোও কমপ্লিট হয়ে যাবে। নয়তো ওখানের ভার্সিটিতে তো ঠিক টাইমে জয়েন হতে পারব না।’
নম্রতা জবাব না দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল। যে মেয়ের কাছে বিয়ের আগের দিনও ভার্সিটি আর পড়াশোনার চিন্তায় বড়। সেই মেয়েকে কিছু বলে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
_
টেবিলের উপর থাকা ফোনটা পঞ্চম বারের মতো বেজে উঠতেই বিরক্তি নিয়ে তাকাল আরফান। ফোনটা সাইলেন্ট করে রোগীর কথায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুরেফিরে ফোনের ব্যাপারটাই মস্তিষ্কে ছন্দপতন করতে লাগল বারবার। সকাল থেকে একই নাম্বার থেকে কমপক্ষে ছয়- সাতবার কল করেছে একটি মেয়ে। ফোন দিয়ে কথাবার্তা না বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কি আশ্চর্য! কে এই মেয়ে? আরফান আড়চোখে ফোনের দিকে তাকাল। এইতো, আবারও কল করেছে মেয়েটা। আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তার থেকে কী চাই এই মেয়ে?
#চলবে….