নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৪৬.
দূর আকাশে তারার মেলা। হেমন্তের আগমনী বার্তা বাতাসে। টিএসসির চা স্টলের বেঞ্চিতে বসে আছে অন্তু, ছোঁয়া, নাদিম, নম্রতা। ঘড়িতে আটটা কি নয়টা বাজে। নাদিম হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে বলল,
‘ তোরা সব ঝিম মাইরা বইসা আছিস কেন বা*? তোগো ভাবসাব দেইখ্যা মনে হইতাছে আড্ডায় নয় শোকসভায় বইসা বইসা নিরবতা পালন করতেছি।’
নম্রতা খুব ধীরে চায়ের কাপে চুমুক দিল। উদাস কন্ঠে বলল,
‘ রঞ্জন আর নীরুকে মিস করছি। একসাথে থাকার সময়গুলো কেমন ধুম করে কেটে গেল, তাই না? ভার্সিটির প্রথম দিন কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিলাম সবাই। ক্লাস বাঙ্ক, হৈচৈ, পানিশমেন্ট সবকিছুতে ছিল কৈশোরের ছোঁয়া। আজ মনে হচ্ছে হুট করেই বড় হয়ে গেলাম সব। বড় হলে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলতে হয়, তাই না?’
কেউ উত্তর দিল না। সবাই নীরব বসে চায়ের কাপে চুমুক দিল। পাশেই কোনো উচ্ছ্বসিত বন্ধুমহল থেকে ভেসে এলো গিটারের সুর। চার বন্ধুর মনে খুব সন্তপর্ণে ধাক্কা দিয়ে গেল সেই বিরহী পঙক্তি মালা। আজ থেকে কয়েক বছর আগে তারাও এমন উচ্ছ্বাসিত গানের পসরা সাজাত। গলা ফাটিয়ে গান গাইতো। মাঝ রাস্তায় লাফালাফি, এক রিক্সায় ছয়জন উঠে হৈ-হুল্লোড়। দিনগুলো কী তবে সত্যিই ফুরিয়ে গেল? খুব বেশিই বড় হয়ে গেল তারা? হাজারও দায়িত্বের বেড়াজালে কৈশোরটা তবে ছাপিয়েই গেল? এইতো আর মাত্র ছয় মাস বাকি। ভার্সিটি প্রাঙ্গন ছেড়ে অজানায় ছড়িয়ে পড়বে সবাই। হারিয়ে যাবে সময়ের স্রোতে। চারজনের মনই ভার হয়ে আসে অজান্তে। বেশ কিছুক্ষণ পর গিটারের সুর বদলায়। বদলায় গানের কথা। সেই গভীর নীরবতায় ফাঁটল ধরিয়ে নাদিমই কথা বলল প্রথম। হাই তুলতে তুলতে বলল,
‘ নমু দি ফিলোসোফিশড। দর্শনের বইয়ে প্রেম ঝাড়তে ঝাড়তে শেষমেস দার্শনিক হইয়া গেলি নাকি মামা? অন্তু বড় হইয়া আস্ত একটা বউ পাইয়া গেল আর তুই এখনও বড় হওয়া ইকুয়াল টু হারানোর ফিলোসোফি নিয়া গাঞ্জা টানতেছিস?’
নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছোঁয়া অবাক হয়ে বলল,
‘ গাঞ্জা টানছে মানে? গাঞ্জা টানে কিভাবে? ওটা তো একটা খাওয়ার জিনিস, তাই না?’
নাদিম মুখ কুঁচকে ছোঁয়ার দিকে তাকাল। ধমক দিয়ে বলল,
‘ হ। গাঞ্জা অতি সুস্বাদু ফাস্টফুড। এক নম্বরের বড়লোকী খাবার। তোর মতো ধনবান বলদদের জন্য একদম খাপে খাপ। তোর বড়লোক ম্যা ম্যা কে বল, তোকে যেন গাঞ্জার মধ্যে ডুবাইয়া মাইরা ফেলে। আজাইরা।’
ছোঁয়া গরম চোখে তাকাল। শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ খবরদার মাম্মামকে ম্যা ম্যা বলবি না। ট্রাই টু বি আ স্মার্ট গাই। খ্যাত একটা।’
নাদিম ফুঁসে উঠল। ছোঁয়াকে নকল করে বলল,
‘ ট্রাই টু বি আ স্মার্ট গাই! ট্রাই টু বি তোর মাথা। ওই হারামি, তোরে না কইছি? আমার কথার মধ্যে বামহাত ঢুকাবি না? শালা ইংরেজের বংশদূত। ফুট এইখান থেকে। তোর ম্যা ম্যা এর আঁচল ধরে স্মার্টনেস শিখগা যা। ম্যা ম্যা ম্যা…’
ছোঁয়াকে ভেঙাতে ভেঙাতেই বিশ্রী এক গালি দিল নাদিম। ছোঁয়া মুখ কুঁচকে ফেলল ঘৃণায়।
‘ ছিঃ, কি অশ্লীল ভাষা!’
নাদিমের মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না । বেঞ্চের উপর রাখা গিটারটা কোলে টেনে নিয়ে বলল,
‘ অশ্লীলের দেখেছিসটা কি? আমি তো কিছুই না। অন্তুর কাছে অশ্লীলকথন আছে। বিবাহিত মানুষের এই সম্পর্কে বরাবরই জ্ঞান বেশি। শুনতে চাস?’
অন্তু-ছোঁয়া দু’জনেই দাঁত কটমট করে তাকাল। নম্রতা হেসে ফেলে বলল,
‘ অন্তুর বউ অন্তুকে পেয়ে সারা দুনিয়া ভুলে গিয়েছে। দিনে দশবার ফোন দিলেও তাকে পাওয়া যায় না। মাইয়া করে কি সারাদিন? অশ্লীলকথন দিয়েই ভুলিয়েছিস নাকি তাকে?’
নাদিম গিটারে টুন টান শব্দ তুলতে তুলতে বলল,
‘ কানারে জিগাইতেছিস রংধনুর ঠিকানা। ও বাসায় থাকে নাকি আজকাল? সপ্তাহে তিনদিন তো আমার সাথে হলেই পড়ে থাকে। বউয়ের খবর রাখে নাকি ও….’
বাক্যটা সম্পূর্ণ শেষ না করেই থেমে গেল নাদিম। গিটার থেকে হাত সরিয়ে অন্তুর দিকে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ অন্তু? নীরুর সাথে তোর সব ঠিকঠাক আছে তো না? তুই বাড়িতে বউ রেখে আমার সাথে পড়ে থাকিস, ব্যাপার কি?তুই কি নীরুকে এবোয়েড করছিস?’
শেষ কথাটাতে চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল নাদিমের। নম্রতা, ছোঁয়াও ভ্রু কুঁচকে উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগল। অন্তু বুক ভরে শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
‘ তাকে এবোয়েড করার সাহস আছে নাকি আমার? তোদের নীরু যে আমায় কোনোদিনই সহ্য করতে পারে না সে তো জানা কথা। বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে। আমিও অনেকটা বাধ্য হয়েই করেছি। তার এই বাধ্যবাধকতার চাপ কমাতেই খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে চলি। তেমন কিছু না।’
কেউ উত্তর দিল না। তিন জোড়া চোখ ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল খানিক। অন্তু অস্বস্তি নিয়ে বন্ধুদের দিকে তাকাল। বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ কি সমস্যা?’
নম্রতা হতাশ হয়ে বলল,
‘ পুরোটাই সমস্যা। তোরা দুইজন যে চুপিচুপি বাংলা সিনেমা করছিস তা তো ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি দোস্ত। বিয়ের প্রায় একমাস হতে চলল, এখনও তোদের ইগোর লড়াই চলছে? মাই গড!’
অন্তু প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
‘ একটা টিউশনি দিয়ে বউ চালানো যাচ্ছে না। আব্বা বাড়িতে কোল্ড ওয়ার জারি করেছে। আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমার বউয়ের খাওয়া-পরার জন্য এক পাই খরচ তিনি করবেন না। ইভেন আমার জন্যও না। অল ফান্ড ইজ ক্লোজ।’
নাদিম হেসে বলল,
‘ তোর বাপ তো হেব্বি মাল দোস্ত। এখনও ক্ষেপে আছে?’
কথাটা বলে অন্তুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে আবারও বলল,
‘ এগ্লা রাগ থাকে নাকি? দুই দিনেই রাগ পড়ে যাবে। চাপ নিস না।’
অন্তু মুখভঙ্গি গম্ভীর করে বলল,
‘ আব্বার রাগ পড়া নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। আমার মাথাব্যথা আমার যোগ্যতা প্রমাণ করা নিয়ে। পরের মাস থেকে সংসারের কিছুটা খরচ আমার কাঁধে না নিলে চলছেই না। আব্বাকে দেখাতে হবে, আমার বউ তাঁর ঘাড়ে বসে খাচ্ছে না।’
অন্তুর কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল নম্রতা-নাদিম। ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে অন্তুর পিঠ চাপড়ে উদ্বেগহীন কন্ঠে আশ্বাস দিল নাদিম,
‘ ধুরু! এইডা টেনশনের কিছু হইল নাকি? চাপ নিস না। হইয়া যাইব। আমরা আছি না?’
অন্তু হতাশ চোখে বন্ধুর দিকে তাকাল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে হঠাৎই প্রশ্ন করল,
‘ তুই না কিছুদিন আগে গাজীপুর গিয়েছিলি? গাজীপুর তোর কোনো আত্মীয়স্বজন আছে বলে তো জানতাম না। কে থাকে ওখানে?’
নাদিমের মুখভঙ্গি গম্ভীর হয়ে এলো। পরমুহূর্তেই ঠাট্টার কন্ঠে বলল,
‘ তোর বউ।’
অন্তু বিরক্ত চোখে তাকাতেই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
‘ ধূর! তেমন কিছুই না। এইসব ছাইড়া বাড়িতে যাইয়া বউ সামলা। আজ আমার সাথে থাকার কথা চিন্তাও করবি না।’
সাড়ে নয়টার দিকে আড্ডা ভেঙে যার যার বাড়ির দিকে রওনা দিল তারা। নাদিম হাজারটা গালি আর দুই চারটা কিল-ঘুষি দিয়ে এক রকম জোর করেই অন্তুকে বাড়ির পথে ফেরত পাঠাল। তিন বন্ধু তিন রাস্তায় আলাদা হতেই নাদিম হঠাৎ উপলব্ধি করল, তাদের শক্তপোক্ত বন্ধুমহল থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণ। প্রথমে রঞ্জন। তারপর নীরা। তারপর কে? অন্তু, নম্রতা, ছোঁয়া নাকি নাদিম নিজে? নাদিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শহরটা বড় বিষাক্ত লাগে আজকাল।
_
শহরজুড়ে নিশুতি রাতের ঝাঁপ মেলতেই আকাশে ক্ষুদ্র মেঘের আনাগোনা দেখা গেল। বাতাসে ভর করল শীতল স্পর্শ। গাছের পাতায় পাতায় তীব্র আন্দোলন শুরু হতেই রান্নাঘরের জানালাটা বন্ধ করে দিল নীরা। উদ্বিগ্ন চোখে আকাশটা একবার দেখে নিয়ে কড়াইয়ে খুন্তি নাড়তে ব্যস্ত হল। জাহানারা চা বানাচ্ছিলেন। চুলোর আঁচটা খানিক কমিয়ে দিয়ে নীরার দিকে তাকালেন। কপাল কুঁচকে বললেন,
‘ ঝড় আসবে নাকি?’
নীরা মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ মনে হয়। ঠান্ডা হওয়া হচ্ছে।’
‘ অন্তু কখন ফিরবে? কথা হয়েছে ওর সাথে?’
নীরা মুহূর্তেই মাথা নিচু করে ফেলল। কড়াইয়ে অতিমাত্রায় ব্যস্ততা দেখিয়ে ছোট্ট করে বলল,
‘ জি না, মা।’
জাহানারা বিরক্ত চোখে তাকালেন। তেঁতো মুখে বললেন,
‘ না কেন? নিজের বরের প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই তোমার? অন্তু যে রাতে বেশির ভাগই বাসায় ফেরে না, তা কিন্তু আমার চোখ এড়ায় না। কেমন বউ তুমি যে বরকে বাড়িতে আটকে রাখতে পারো না? আমার ছেলে তো আগে এমন ছিল না। বিয়ের পর পরই এমন পরিবর্তন কেন? নিশ্চয় তোমার সাথেই কিছু হয়েছে? কি হয়েছে, কি হয়নি তা আমি জানতে চাই না। আমার ছেলেকে বাড়িতে আটকানোর দায়িত্ব তোমার। এরপর এমন কিছু দেখলে কিন্তু আমি ছেড়ে কথা বলব না।’
নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কোনোরূপ জবাব না দিয়ে চুলোর আঁচ কমাল। বারান্দা থেকে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ আসতেই ছাঁদের কাপড়ের কথা মনে পড়ল নীরার। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ছাঁদের দিকে দৌঁড়াল সে। ততক্ষণে শুকনো কাপড়গুলো ভিজে একাকার। সবগুলো কাপড় তুলে নিয়ে নামতে নামতে নিজেও খানিকটা ভিজে গেল নীরা। দরজার কাছাকাছি আসতেই মুখোমুখি এসে দাঁড়াল প্রিয় একটি মুখ। শ্যামলা মুখটি বৃষ্টির জলে ভেজা। কপাল পড়ে থাকা চুলগুলো থেকে টুপটুপ করে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা জল। ভাজ করা কপালটির ঠিক নিচে ল্যাপ্টে আছে জোড়া ভ্রু। বিস্মিত চোখদুটো নীরার মুখে স্থির। অন্তুর চাহনীতে ভেতরটা ধুক করে উঠল নীরার। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় আবেশিত হল মন। কয়েক সেকেন্ড নীরার দিকে চেয়ে থেকে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল অন্তু। নীরাও ঢুকল তার পিছু পিছু। শুকনো কাপড় ভিজিয়ে ফেলার দায়ে শাশুড়ীর কাছে বেশ খানিকটা বকাও শুনল সে। তবুও নীরার মন ফুরফুরে। শাশুড়ীর বকাঝকাও যেন মিষ্টি লাগছে আজ। নীরাকে ভার্সিটি দিয়ে আসার দায়িত্বটা খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করলেও রাতের বেলা তার দেখা মিলাটা হয়ে উঠেছে অমাবস্যার চাঁদের মতোই অসম্ভব। সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিনের বেশি তাকে বাড়িতে পাওয়া যায় না বললেই চলে। আর যে ক’দিন থাকে সে কয়েকদিনও গভীর রাত পর্যন্ত বই নিয়ে বসে থাকে অন্তু। বিছানায় আদৌ গা এলায় কি-না সন্দেহ। নীরা এক কাপ চা নিয়ে ঘরে ফিরল। অন্তু ততক্ষণে বিছানায় গা এলিয়েছে। কপালের উপর ডানহাতটা তুলে দিয়ে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে আছে। শার্ট পাল্টে গায়ে টি-শার্ট জড়িয়েছে। পরনে কালো টাউজার। নীরা চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখে মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইল। অন্তুকে ডাকবে কি ডাকবে না তা নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। আর ডাকতেই যদি হয় তাহলেই কি বলে ডাকবে? তুমি নাকি তুই? নীরা অসহায় চোখে চেয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ জল্পনা কল্পনা করার পর ঠান্ডা হাতটা অন্তুর কপালের একাংশে ছোঁয়াল নীরা। অন্তু তো এ-সময়ে ঘুমোয় না। জ্বর হল না তো আবার? নীরার ছোঁয়া পেয়েই যন্ত্রের মতো দু’চোখ মেলে তাকাল অন্তু। কপালে হালকা ভাঁজ। ঘুমু ঘুমু চোখদুটোতে একঝাঁক প্রশ্ন। নীরা সাথে সাথেই হাত সরিয়ে নিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল। হৃদপিণ্ডের ভয়ানক আন্দোলনে হঠাৎই উপলব্ধি করল, অন্তুকে সে ভয় পাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে বিয়ের প্রথম দিন থেকেই। কিন্তু কেন? অন্তু তো কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি। চোখ রাঙায়নি। তবে ভয় কেন? স্বামী বলে? তার জীবনটা এখন এই মানুষটিকে ঘিরে আবর্তিত বলে? অন্তুকে স্থির চেয়ে থাকতে দেখে ঢোক গিলল নীরা। অস্বস্তি নিয়ে বলল,
‘ চা এনেছিলাম।’
অন্তু চোখ ফিরিয়ে পাশের টেবিলে তাকাল। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,
‘ এখন চা খাব না। বাইরে খেয়েছি।’
কথাটুকু বলেই চোখ বন্ধ করল অন্তু। নীরা আগের মতোই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। অন্তুর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কি বলা যেতে পারে বুঝতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর চোখ বন্ধ রেখেই বলে উঠল অন্তু,
‘ ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কি?’
অন্তুর কথার পিঠে কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল নীরা। বুকের ভেতর তরল অনুভূতির প্রলেপ নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। বুকের ভেতর টলটলে খুশি যেন ডানা মেলেছে আজ, আহ! অন্তু তবে একটু হলেও তাকে খেয়াল করেছে!
_
‘আপনি আসবেন কি আসবেন না?’
মাঝরাতে নম্রতার এমন অদ্ভুত বায়না শুনে হতভম্ব হয়ে গেল আরফান। বাইরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ছাঁদের আলোটা জ্বালিয়ে রাখায় বৃষ্টির পানিতে চকচক করছে বেলীফুলের গা। ছাঁদে ঘিরে থাকা বেলীফুলের ডালপালাগুলো অল্প অল্প দুলছে। ছাঁদের পাটাতনে নৃত্যরত ঝপঝপে বৃষ্টির শব্দে তালা লেগে যাচ্ছে কান। বারান্দার এক কোণায় বন্ধী খাঁচায় ‘শ্যামা’ ‘শ্যামা’ করে ডাক পাড়ছে হৃষ্টপুষ্ট এক টিয়া। দেশে ফিরে শ্যামালতাকে না পেয়ে যখন পাগলপ্রায় অবস্থা ঠিক তখনই এই টিয়াকে কিনে এনেছিল আরফান। অনেক বছর আগে, কোনো এক আবেগময় চিঠিতে নম্রতা লিখেছিল তার ইচ্ছের কথা। বহু বায়নার পসরা সাজিয়ে পাঠিয়েছিল তার প্রিয়র নামে। তারই মধ্যে একটি বায়না ছিল, ‘পোষা একটা টিয়া থাকবে। আমাদের ছোট্ট ঘরে তারও ছোট্ট ঘর থাকবে।’ ব্যস! আর কী চাই? এরপরও টিয়া পাখি না কিনে পারে নাকি আরফান? টিয়া পাখিটির খুব সুন্দর নামও রেখেছে আরফান। আরফানের ভাবনার মাঝে আবারও একই প্রশ্ন করল নম্রতা। আরফান বারান্দা থেকে সরে এসে বলল,
‘ আপনি বড় জ্বালাচ্ছেন আজকাল।’
‘ জ্বালাচ্ছি? আচ্ছা বেশ। এখন থেকে আর জ্বালাব না। দুইদিন বাদে বিয়েশাদী করে যখন আপনারই হসপিটালে সিজারিয়ান সেকশনে ভর্তি হয়ে যাব তখন বুঝবেন। আমার বাচ্চা হওয়ার সাথে সাথে আপনাকে মামা বলে পরিচয় করে দিব। নো চাপ। আপনি হবেন জাতীয় মামা।’
নম্রতার কথায় হেসে ফেলল আরফান। আরফানের হাসি যেন আগুনে ঘিয়ের কাজ করল। নম্রতা আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠে বলল,
‘ হাসবেন না। আমি হাসার মতো কিছু বলিনি। আই অ্যাম সিরিয়াস।’
আরফান এবার শব্দ করে হাসল। হাসি থামানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
‘ আচ্ছা।’
‘ আচ্ছা? কিসের আচ্ছা?’
‘ আপনার কি ধারণা? বিয়ে করা এতো সহজ? আপনাকে যে বিয়ে করতে আসবে তাকে বিনা জঞ্জাটে আইসিইউতে ভর্তি করে দেব। আমার জিনিসে আমার অধিকার।’
আরফানের উত্তরে কিছুটা খুশি হলেও প্রকাশ করল না নম্রতা। ফুঁসে উঠে বলল,
‘ জিনিস? আমি মোটেও কারো জিনিস নই। আমি অবশ্যই বিয়ে করব এবং ডেলিভারীর জন্য অতি শীঘ্রই আপনার হসপিটালে সিজারিয়ান সেকশনে ভর্তি হব। ডিসিশন ফাইনাল। যে ভদ্রলোক আমার বাবার সাথে দেখা করতে আসা নিয়ে টালবাহনা করে সেই ব্যক্তির ব্যক্তিগত জিনিস হওয়ার প্রশ্নই আসে না। নো, নেভার।’
আরফান হাসল। ঘড়িটা এক নজর দেখে নিয়ে লাইট অফ করে বিছানায় গা এলাল। দুষ্টুমি করে বলল,
‘ আমি কখন বললাম আপনি বিয়ে করবেন না নম্রমিতা? আপনি অবশ্যই বিয়ে করবেন, আমার হসপিটালে সিজারিয়ান সেকশনে ভর্তিও হবেন এবং এই সকল কিছুর পেছনে এক এবং মূলীভূত কারণ থাকবে আরফান আলম নিষ্প্রভ। আপনার ডেলিভারির দায়িত্বও তার। হসপিটালের ফি ভরার দায়িত্বও তাই। আপনার বাচ্চাকে পিতৃ পরিচয় দেওয়ার দায়িত্বও তার। ও হ্যাঁ, আপনার বাবাকে নানা বানানোর দায়িত্বও তার। বাচ্চার নানার সাথে দেখাটা নাহয় তখনই হবে। চিন্তা কি? নো চাপ।’
শেষ কথাটা নম্রতার মতো করে বলল আরফান। নম্রতা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ আপনাকে আমি খুন করে ফেলব, ডক্টর।’
আরফান ঠোঁট টিপে বলল,
‘ আহ! সে তো অনেক আগেই করেছেন। চিঠির ছুঁড়িতে খুন। এবার আপনার শাস্তির পালা। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হোন মিস. নিম পাতা।’
নম্রতা কিছুক্ষণ ফুসফাস করে মিইয়ে এলো একসময়। হতাশ কন্ঠে বলল,
‘ বাবা আপনাকে আসতে বলেছে নিষ্প্রভ। আপনার সাথে পরিচিত হতে চায়।’
‘ আপনার বাবার সাথে আমার পরিচয়ের কিছু বাকি আছে নাকি নম্রমিতা? শুরু থেকে ধরা খাচ্ছি আর পরিচিত হচ্ছি। প্রথমবার ফোনে৷ দ্বিতীয়বার আপনার বাড়ির সামনে। তৃতীয়বার আমারই চেম্বারে। আমার চেম্বারে এসে আমাকেই ভেলকি দেখিয়ে গেলেন। এরপরও পরিচয়ের কিছু বাকি আছে? সেদিন ফোন ধরেই যদি চুমু টুমু দিয়ে দিতাম তখন কি হতো? প্রেমিকার চুমু ডিরেক্ট শশুরের গালে। মাই গড!’
আরফানের কথার ধরনে হাসি পেয়ে গেল নম্রতার। মুখ টিপে হেসে বলল,
‘ আজ আপনি খুব বেসামাল কথা বলছেন ডক্টর।’
‘ না বলে যাব কোথায়? এমনিতেই মাঝরাত। বাইরে তুমুল বর্ষন। বাতাসে বেলীফুলের তীব্র সুগন্ধ। ফোনের ওপাশে আপনি। অনুভূতির জ্বালাপোড়নে ডাক্তার নিজেই রোগী হয়ে যাচ্ছে আজ। বেসামাল না হয়ে তো উপায় নেই। শ্যামলতা চিকিৎসা না করলে এই ডাক্তারের নির্ঘাত মৃত্যু।’
নম্রতা উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। আরফান একটু থেমে খুব অন্যরকম কন্ঠে বলল,
‘ নম্রতা? একটা গান শুনাবেন প্লিজ?’
নম্রতা আবারও চুপ। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ নিঃশ্বাস বিনিময়ের পর বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে কিন্নর কন্ঠে গেয়ে উঠল নম্রতা,
‘ এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনাতো মন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ?
যুঁথি বলে ওই হাওয়া
করে শুধু আসা যাওয়া
হায় হায়রে দিন যায়রে
ভরে আঁধারে ভুবন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ?’
#চলবে…..
( পান্ডুলিপি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ব কিছুদিনের মাঝে। কোনটা রেখে কোনটা লিখি!)