#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৩২.
আজ সপ্তাহ খানেক পর মৌশিকে পড়াতে এসেছে নাদিম। গোটা সপ্তাহ নিরুদ্দেশ থাকার পরও তাকে কোনোরূপ প্রশ্ন করা হয়নি। কেন প্রশ্ন করা হয়নি তা ঠিক ধরতে পারছে না নাদিম। ধরার জন্য যে বিশেষ চেষ্টা চালাচ্ছে এমনটাও নয়। তার চোখ-মুখে বিন্দুমাত্র চিন্তা বা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। মৌশি মাথা নিচু করে ইংরেজি ট্রান্সলেশন করছে। গায়ে কটকটে লাল কামিজ। রোজকার চেহারাটা আজ একটু বেশিই সতেজ। চোখে-মুখে হাসি হাসি ভাব। মৌশি লেখা থামিয়ে মাথা উঁচিয়ে তাকাল। চোখে তার প্রগাঢ় চঞ্চলতা। নাদিম ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ কি ব্যাপার?’
মৌশি হাসল। সাথে সাথেই যেন বাম গালের এক চিমটি মাংস অদৃশ্য হলো কোথাও। গালের মাঝ বরাবর ছোট্ট একটা গর্ত তৈরি হলো। ভারি মিষ্টি দেখাল সেই মুখ। পাতলা ঠোঁট নেড়ে শুধাল,
‘ আমার একটা ইচ্ছে পূরণ করবেন স্যার? প্লিজ?’
মৌশির আশাভরা সকৌতুক চোখের দিকে তাকিয়ে খুবই স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিল নাদিম,
‘ না।’
মৌশির মুখটা মুহূর্তেই চুপসে গেল। এই লোকটা ভারি অভদ্র। বিন্দুমাত্র ম্যানার্স নেই। মুখের ওপর কথা বলতে দুই সেকেন্ডও ভাবতে হয় না তার।
‘ না শুনেই না করে দিলেন কেন? এভাবে কাউকে না করতে নেই। মিছে মিছেও তো রাজি হতে পারতেন। আমি নিশ্চয় ভয়াবহ কিছু চাইতাম না।’
মৌশির কন্ঠে তরল অভিমান। নাদিম মৃদু হেসে বলল,
‘ আমি অযথা মিথ্যা বলি না মৌশি।’
‘ তাই বলে এভাবে অপমান করবেন?’
‘ অপমান করলাম নাকি?’
‘ করলেনই তো। এটলিস্ট ইচ্ছেটা জিগ্যেস করতে পারতেন!’
নাদিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ তোমার ইচ্ছে শোনার ইচ্ছে আমার হয়নি বলেই জিগ্যেস করিনি। নিজের ইচ্ছেকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্যের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেওয়া আমার পছন্দ নয়।’
মৌশির মুখের অন্ধকার কেটে গেল। বই খাতা গুছিয়ে রেখে উৎসাহী কন্ঠে বলল,
‘ আজ পড়ব না। শিখব।’
নাদিম ভ্রু কুঁচকাল,
‘ কী শিখবে? বই-খাতা বন্ধ করে রাখলে শিখবে কিভাবে?’
নাদিমের প্রশ্নে খুশি হয়ে গেল মৌশি। উজ্জ্বল মুখে বলল,
‘ বই-খাতা দিয়ে হবে না। প্রেকটিক্যালি শিখব।’
‘ মানে?’
মৌশি দ্রুত হাতে টেবিলের ড্রয়ার খুলল। ড্রয়ার থেকে সাদা কাগজে মোড়ানো একটি সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করল। মৌশির ড্রয়ারে সিগারেট আর দেশলাই দেখে অবাক হলো নাদিম। কৌতূহলী চোখে দেখতে লাগল মৌশির অদ্ভুত সব কর্মকান্ড। মৌশি একটা সিগারেট বের করে উল্টো করে মুখে দিল। সিগারেটের প্যাকেটটা নাদিমের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ সিগারেট খাওয়া শিখব। নিবেন স্যার? আপনার পছন্দের সিগারেট। বেনসন। এক প্যাকেটে দুইশো আশি টাকা নিয়েছে। দামটা ঠিক আছে?’
নাদিম সিগারেট নিলো না। তবে জবাব দিল,
‘ হ্যাঁ। দাম ঠিক আছে।’
‘ আমার হাতে সিগারেট দেখে অবাক হচ্ছেন না,স্যার?’
‘ একদমই হচ্ছি না তা নয়। তবে যতটুকু হয়েছি ততটুকুও হওয়া উচিত হয়নি। মেয়েদের হাতে সিগারেট থাকাটা অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। অনেক মেয়েই সিগারেট খায়।’
মৌশি একটু অসন্তুষ্ট হলো। মুখ থেকে সিগারেটটা সরিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ সব মেয়ের সাথে আমার তুলনা করবেন না। আমি সব মেয়েদের মতো নই। সিগারেটের প্যাকেটটা আমি আপনার জন্য কিনেছি। আপনি কী আমার সামনে বসে একটা সিগারেট খাবেন?’
‘ না।’
মৌশির চোয়াল শক্ত হলো। নাদিমের মুখে স্থির দৃষ্টি রেখে বলল,
‘ আপনার জন্য সিগারেটের প্যাকেট কিনেছি বলে কী আপনার মনে হচ্ছে আমি আপনার প্রেমে পড়েছি?’
নাদিম হাসল। মৌশি কড়া কন্ঠে জবাব দিল,
‘ হাসবেন না। আমি আপনার প্রেমে পড়েছি এমন ভুল ধারণাও রাখবেন না। সেদিন আপনাকে সিগারেট খেতে দেখে হঠাৎই সিগারেট কিনতে মন চাইল। আমি এমনই একটি প্যাকেট ড্রাইভারকেও গিফ্ট করেছি। এটা বড় কোনো ব্যাপার না।’
মৌশির রূঢ় কথার কোনটিই নাদিমকে তীব্র আঘাত হানল বলে মনে হলো না। মৌশি বিরক্ত চোখে চেয়ে রইল। নাদিম ফোন হাতে উঠে দাঁড়াল। অত্যন্ত দায়সারা কন্ঠে বলল,
‘ তুমি নিজেই নিজেকে ডিসক্লোজ করছ মৌশি। তুমি কাকে কী গিফ্ট দিচ্ছ আর কাকে দিচ্ছ না তাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে, প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে দামী গাড়ি নিয়ে ছায়ার মতো কাকে লক্ষ্য করে বেড়াচ্ছ তাতেও আমার আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ খুবই সীমিত। আমার সীমিত আগ্রহে তুমি বা তুমি সম্পর্কিত কোনো ব্যাপার নেই।’
মৌশি মাথা নিচু করে ফেলল। খুবই সুনিপুণভাবে ধরা পড়ে গিয়েছে সে। দূর থেকে নাদিমের আড্ডামহলে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকার ব্যাপারটা খুবই নগ্নভাবে জেনে গিয়েছে নাদিম। খেয়ালও করেছে। লজ্জায় আর অপমানে ভেতরটা টলমল করছে তার। মৌশির গলা দিয়ে কোনো কথা বেরুচ্ছে না। বহু কষ্টে বলল,
‘ আপনি কাল আসবেন না,স্যার?’
নাদিম তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল,
‘ আমি অভদ্র মেয়েদের ঠিক সহ্য করতে পারি না মৌশি।’
মৌশির টলমলে চোখদুটোতে এবার বর্ষণ হলো। আত্মসম্মানের এমন রূঢ় বলিদানে টলমল করছে তার বুক। প্রচন্ড রাগে জ্বলে যাচ্ছে শরীর। নাদিমের এই মুখের ওপর কথা বলে দেওয়ার স্বভাবটাই একসময় অসহ্য লাগত মৌশির। রাগ লাগত, বিরক্ত লাগত। দূর্ভাগ্যবশত, আজ নাদিমের এই স্বভাবটার জন্যই তাকে এতো ভালোবাসে মৌশি! নাদিম সব সময় কেন এতো অবহেলা করে তাকে? দুই টাকার দামও দেয় না। মৌশি কী এতোটাই তুচ্ছ? টাকা-পয়সা, সৌন্দর্য্য কোনো কিছুতেই পিছিয়ে নেই মৌশি। তবুও কেন এতো বিরাগ নাদিমের? এইযে মৌশি লুকিয়ে চুরিয়ে নাদিমকে দেখে। তার সিগারেট খাওয়ার মতো তুচ্ছ স্বভাবটাতেও ভাবনাতীত মুগ্ধ হয়। মেয়ে বান্ধবীরা তাকে একটুখানি ছুঁয়ে দিলেই কেঁদে ভাসায়, এসব কি চোখে পড়ে না নাদিমের? মৌশির মতো অতো আয়োজন করে কেউ কী ভালোবাসতে পারবে তাকে? তবু নাদিম উদাসীন। আচ্ছা? আর কী চাই নাদিম? নাদিমের চাহিদাটা মৌশির মাঝেই কেন নেই?
আধঘন্টা হলো হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছে আরফান। গায়ে তার হাজার টন ক্লান্তি। গত তিনদিন ভয়ানক ব্যস্ততায় সময় কেটেছে তার। নম্রতার সাথে যোগাযোগটাও হয়ে উঠেনি। যোগাযোগটা মূলত আরফান ইচ্ছে করেই করেনি। আরফান নম্রতাকে সময় দিতে চায়। একটু সময় তার নিজেরও প্রয়োজন। একটা সম্পর্ক এগিয়ে নিতে যে মানসিক বোঝাপড়াটা দরকার তা এখনও গড়ে উঠেনি তাদের। আরফান বাইরের পোশাক গাঁয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিল। পুরো ঘরে বেলীফুলের সুবাস। জানালার ভারী পর্দা ভেদ করে আসছে শরতের শিরশিরে বাতাস। চাঁদের আলোয় চকচক করছে থোকা থোকা বেলীফুলের রাজ্য। সেই রাজ্যে মুহূর্তেই উদয় হলো শ্যামলতা। সেই লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। আলতা রাঙা খালি পায়ে পায়েল বাজছে। বেলীফুলের সৌরভে ভরে আছে তার শরীর। দু’চোখে তীব্র অভিমান নিয়ে চিঠির কথাগুলোই আওড়ে চলেছে পাতলা, সুন্দর ঠোঁট নেড়ে,
“শুনো,
আজ আমার মনটা খুব খারাপ। এই মনটা খারাপ ছিল দীর্ঘ চার বছর। প্রগাঢ় এক মন খারাপ নিয়েই কিশোরী থেকে যুবতী হয়েছি। নিতান্তই বাচ্চা থেকে পরিপূর্ণ নারী হয়েছি। তুমি প্রশ্ন করেছিলে, তুমি হারিয়ে গিয়েছ নাকি হারিয়ে ফেলেছ আমায়? আমি প্রশ্ন করতে চাই, তুমি কি ভালোবেসেছিলে নাকি জাদু করেছিলে আমায়? না দেখে, না শুনে এক কাল্পনিক পুরুষের প্রতি এই প্রগাঢ় ভালোবাসা কি করে তৈরি হয়েছিল, জানি না। কি করে তাকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিলাম, জানি না। হয়ত কিশোরী ছিলাম বলেই। তুমি একবার বলেছিলে, কিশোরীরা খুব যত্ন করে চিঠি লিখতে পারে। যুবতীদের সেই গুণ থাকে না। আজ পরিপূর্ণ যুবতী রূপে অধিষ্ঠিত হয়ে বুঝতে পারছি, সেই গুণটা আসলেই যুবতীদের থাকে না। থাকতে নেই। তোমার নামে এই চিঠিটা আমি লিখতে পারছি না। কালো অন্ধকার শব্দ ভান্ডারে ছোট্ট ছোট্ট ভালোবাসাময় শব্দ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। বারবার আঁটকে যাচ্ছে কলম। ইচ্ছে হচ্ছে নীলাভ এই কাগজটিতে মন খারাপের দীর্ঘ গল্পটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিই। সেই ভয়ানক মন খারাপের সাথে তোমার অস্তিত্ব যে কতটা প্রগাঢ় ছিল তা তুমি দেখো। একটিবারের জন্য হলেও চমকে উঠো। উপলব্ধি করো, তুমি বড় নিষ্ঠুর।
এই চারবছরে অনেক বদলেছি আমি। হারিয়েছি আমার চঞ্চলতা। হারিয়েছি এক সমুদ্দুর চোখের জল। এতোকিছু হারিয়েছি শুধু তোমার জন্য। কতো কতো প্রশ্নমাখা চিঠি জমিয়েছি শুধু তোমার নামে। সব কয়টার উত্তর চাই আমার। প্রশ্নমাখা চিঠিগুলো আকাশে উড়িয়ে আমাকে শাপমুক্ত করো প্লিজ। এই বন্দিনী রাজকন্যাকে শেকলমুক্ত করে অনুভূতির সাগরে ভাসিয়ে দাও। আমি সত্যিই ভাসতে চাই। শরতের মেঘের মতোই উড়তে চাই। আমার বড্ড দুঃখ বুঝলে? আমি খুব দুঃখী।
গত চারবছর, চার হাজার তিনশো আশিটি রাত শুধু তোমায় দেওয়া শাস্তির কথা ভেবেই কাটিয়েছি আমি। কতটা দুঃখ তোমায় দেব বলে জমিয়ে রেখেছিলাম,জানো? কিন্তু তুমি যখন সত্যিই এলে তখন কেমন অসহায় হয়ে পড়লাম দেখো! কিভাবে এতো দুর্বল হয়ে পড়লাম আমি? আমি তোমাকে ক্ষমা করতে চাই না। কিন্তু, এই না চাওয়াটা আমার কথা শুনছে না। তোমাকে তীব্র দুঃখ দিতে চেয়েও পারছি না? বড় দুঃখ হচ্ছে আমার। এই দুঃখ কী করে তাড়াই বলো?’
তোমার শ্যামলতা”
পাশ থেকে খিলখিল হাসির শব্দে ভাবনা কাটে আরফানের। চোখ মেলে পাশে তাকায়। আরফানের পাশেই অর্ধেক শরীর বিছানার বাইরে ঝুলিয়ে শুয়ে আছে নিদ্রা। খিলখিল করে নিরন্তর হেসে চলেছে। হাসির দাপটে তার শরীর কাঁপছে। আরফান নিজেও হাসল। উঠে বসতে বসতে বলল,
‘ হাসছ কেন?’
নিদ্রা উঠল। বিছানায় পা মুড়ে বেশ আরাম করে বসে বলল,
‘ তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কার সাথে কথা বলছিলে? খুবই অড টাইপ কথা বলছিলে। আমি শুনে ফেলেছি।’
‘ অড টাইপ? কখনো নয়। আমি খুবই মিষ্টি একটা মেয়ের সাথে কথা বলছিলাম। মিষ্টি মেয়েদের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হয়। আমি নিশ্চয় মিষ্টি কোনো কথা বলেছি। তুমি মিথ্যা বলছ।’
নিদ্রা চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ মিষ্টি মেয়ে? ও মাই গড! হু ইজ দিজ সুইট গার্ল? তুমি কী প্রেমে পড়েছ?’
আরফান উঠে দাঁড়াল। জানালার পর্দাটা পুরোপুরি সরিয়ে দিয়ে ভারি নিশ্বাস নিল। রহস্যময়ী হেসে বলল,
‘ অনেকটাই।’
নিদ্রা লাফিয়ে উঠে বলল,
‘ কি বলছ? কে সেই মেয়ে?’
‘ তুমি তাকে চেনো।’
নিদ্রা ভাবে। বেশ কিছুক্ষণ আকাশ-পাতাল চিন্তা করে লাফিয়ে উঠে বলল,
‘ ও মাই গড! ও মাই গড! ওই ছুড়াছুঁড়ি মেয়েটা? তুমি ওই ছুঁড়াছুঁড়ি মেয়েটার প্রেমে পড়েছ? সাংঘাতিক। ‘
নিদ্রার এমন অদ্ভুত সম্বোধনে হেসে ফেলল আরফান।
‘ ওর নাম ছুঁড়াছুঁড়ি নয়। ওর নাম শ্যামলতা।’
নিদ্রা অবাক হয়ে বলল,
‘ শ্যামলতা! বেশ মিষ্টি নাম তো। শ্যামলতাও কারো নাম হয়?’
‘ হ্যাঁ হয়।’
নিদ্রা নাম নিয়ে খুব একটা ঘাটাঘাটি করল না। আপ্লুত কন্ঠে বলল,
‘ তুমি তবে বিয়ে করছ?’
‘ মনে হয়।’
‘ তার মানে আমি বুড়ি হওয়ার আগেই হ্যান্ডসাম একটা বর পেয়ে যাচ্ছি?’
আরফান হেসে ফেলল। নিদ্রা খুশি হয়ে মায়ের কাছে ছুটলো। তাকে দূর্দান্ত এক খবর দিতে হবে। এখনই এবং এখনই দিতে হবে। আরফান বাইরের কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হলো। তারপর ছাঁদের মাঝ বরাবর বেলীফুলের রাজ্যে চেয়ার টেনে বসল। ছাঁদের সব লাইট অফ করে পুরাতন এক হারিকেন জ্বালাল। নম্রতা চিঠিতে একবার বলেছিল, তার ছোট্ট ঘরে লন্ঠন থাকবে। আরফান বহু কসরত করে এই প্রাচীন লন্ঠন জোগার করেছে, প্রায় পাঁচ বছর আগে। আকাশে হলদেটে চাঁদ। চারদিকে সাদা বেলীফুলের রাজত্ব। তার মাঝে লন্ঠনের আলোয় একেলা এক যুবা প্রিয়তমাকে চিঠি লিখছে। শরতের শিরশিরে হাওয়ায় মৃদু মৃদু উড়ছে যুবকের কপালে পড়ে থাকা চুল। বেলীফুলের রাজ্যেও হচ্ছে আনন্দময় হেলদোল।
এক টুকরো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে নম্রতা। মেজাজ তার চূড়ান্ত খারাপ। এই নিষ্প্রভ নামক ছেলেটিকে একদম দেখে নিবে সে। পেয়েছেটা কি? নম্রতার প্রতি বিন্দুমাত্র টান আছে তার? কই? নম্রতা তো খুঁজে পায় না। তিনদিন যাবৎ কোনো যোগাযোগ নেই অথচ দেখা হলে গদগদ সংলাপ? আরেকবার শুধু আসুক কাছে। ধাক্কা দিয়ে যদি মেইনহলে না ফেলেছে তো তার নাম নম্রতা না। অভদ্র একটা। নম্রতা এবার সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফেলবে। শুধু বিয়ে করেই সে শান্ত হবে না। অতি শীঘ্রই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে আরফানের হাসপাতালেই ডেলিভারি করাবে। ভয়ানক প্রতিশোধ তুলবে সে। এতো সহজে ছাড়বে না। কক্ষনো না। নম্রতার ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে ডেকে উঠল নীরা,
‘ শেষ হলো? চল।’
নীরার মুখ থমথমে। সকাল থেকেই কেমন গম্ভীরভাবে চলাচল করছে সে। বেশি কথা বলছে না। নম্রতা বুঝেছে কিছু হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছে ধরতে পারছে না। নম্রতা তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সম্মতি জানাল, তার শেষ। নীরা বিরস মুখে বেরিয়ে পড়ল। চারদিনেই কেমন বিধস্ত হয়ে গিয়েছে মেয়েটির মুখ। সবসময় সেজেগুজে থাকা মেয়েটি ঠিকমতো চুল পর্যন্ত আচঁড়াচ্ছে না। নম্রতার কষ্ট হয়। ভেতরে কোথায় যেন চিনচিনে ব্যথা করে উঠে। এই মেয়েটার জন্য যদি একটু কিছু করতে পারত সে! ভার্সিটিতে পৌঁছে ডিপার্টমেন্টের সামনে আসতেই একরকম দৌঁড়ে এলো একটা হ্যাংলা পাতলা ছেলে। নম্রতা-নীরা প্রথম দফায় চিনতে না পারলেও পরে চিনল। লোকটি ডাক্তার আরফানের এসিস্ট্যান্ট গুছের ছেলেটি। নম্রতা অবাক হয়ে বলল,
‘ আপনি? এখানে?’
ছেলেটি বামহাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে একটা বই এগিয়ে দিল। সাইকোলজির উপর লেখা মোটা ইংরেজি একটি বই। নম্রতা হাত বাড়িয়ে বইটি নিল। আগের থেকেও অবাক হয়ে বলল,
‘ এটা কী?’
‘ স্যার দিয়েছে, আরফান স্যার। বইটা নাকি ফেলে এসেছিলেন আপনি? খুব গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমায় পাঠাল।’
ডাহা মিথ্যা কথা। নম্রতা কখনোই কোনো বই ফেলে আসেনি। এই ডাক্তার খুব পাজি। নির্ঘাত কোনো কান্ড ঘটিয়েছে এই বইয়ে? কিন্তু সত্যটাও মুখ ফুটে বলল না নম্রতা। ঠোঁটে ভদ্রতার হাসি ফুটিয়ে ধন্যবাদ জানাল। লোকটি বিদায় নিতেই অন্যরকম এক অনুভূতিতে বুক ধরফর করে উঠল তার। অভ্যাসবশত বইয়ের মলাটের নিচে হাত দিতেই পেয়ে গেল লেফাফায় মোড়া চিরকুট। নম্রতার উত্তেজনা এবার দ্বিগুণ হলো। প্রথম চিঠি পাওয়ার মতো কাঁপতে লাগল হাত-পা। নম্রতার সেই কাঁপুনি দীর্ঘস্থায়ী হলো না। আকস্মিক এক ঘটনায় কেটে গেল উত্তেজনা আর তীব্র অনুভূতি। অন্তু নীরাকে হাত চেপে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে নীরাকে? নম্রতা চিঠি ভুলে ওদের পেছনে দৌঁড় লাগাল। কিন্তু মাঝপথেই ঘটে গেল এক অঘটন। নম্রতা কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই সটান চড় পড়ল অন্তুর গালে।
#চলবে……
[ এই মুহূর্তে পৃথিবীর রূঢ় সত্য হলো, আমি লিখতে বসলেই যত ঝামেলা শুরু হয় চারপাশে। একটু ছোট হয়েছে পর্ব। এলোমেলোও লাগতে পারে। বাসায় আজ লেখার পরিবেশ ছিলো না। বাইরে দাঁড়িয়ে লিখতে হয়েছে। সরি ফর বিয়িং লেইট।]