#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
২৪.
বিশাল ড্রয়িংরুমের ধবধবে সাদা সোফায় বসে আছে নাদিম। কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেয়ালে টাঙানো পেইন্টিংটির দিকে তাকিয়ে আছে। পেইন্টিং-এ একটি নগ্ন মেয়ের ছবি। নগ্নদেহী মেয়েটির গলায় জড়োয়া গহনা, হাত ভর্তি চুড়ি। টলমলে চোখজুড়ে গাঢ় কাজলের রেখা। নাদিম তীক্ষ্ণ চোখে পেইন্টিংটির অর্থোদ্বার করার চেষ্টা করল। চেষ্টা সফল হচ্ছে না্। চিত্রশিল্পী নগ্ন মেয়ের গায়ে গহনা, চুড়ি ঝুলিয়ে কী প্রমাণ করতে চাইছে নাদিম বুঝতে পারছে না। নাদিমের ঠিক সামনের সোফাটাতেই বসে আছেন ইমায়েত সাহেব। মৌশির বাবা। গম্ভীর গড়নার এই মানুষটিকে সামনে রেখে একটি নগ্ন পেইন্টিং-এর দিকে ‘হা’ করে তাকিয়ে থাকাটা অনুচিত। নাদিমের উচিত পেইন্টিং থেকে চট করে নজর সরিয়ে ফেলা। নাদিম চোখ সরাল না। নরম, স্নিগ্ধ নারীদেহের দিকে তাকিয়ে থেকেই প্রশ্ন করল,
‘ এটা কার পেইন্টিং? অবশ্যই কোনো রুচিশীল পুরুষ হবেন এই চিত্রকার?’
ইমায়েত সাহেব অবাক হলেন। নাদিমের স্বতঃস্ফূর্ত কথায় কপালে মৃদু ভাঁজ পড়ল। পরমুহূর্তেই নিজের বিস্ময় চাপা দিয়ে বললেন,
‘ পুরুষই কেন হবে? চিত্রকার কী নারী হতে পারে না?’
নাদিম হাসল। আড়চোখে আরও একবার পেইন্টিংটি দেখে নিয়ে বলল,
‘ হতে পারে। কিন্তু এই পেইন্টিং এর চিত্রকার কোনো নারী বলে মনে হচ্ছে না।’
ইমায়েত সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘ মনে হচ্ছে না কেন?’
‘ নারীদেহ পুরুষের চোখে যতটা সৌন্দর্যমন্ডিতভাবে প্রকাশ পায়, নারী চোখে ততটা পায় না। পেইন্টিং-টা দেখেই বুঝা যাচ্ছে, চিত্রকার ছবিটা খুব অনুভূতি নিয়ে এঁকেছেন। কোনো নারীর নিজের দেহের প্রতি অত অনুভূতি আসার কথা নয়।’
ইমায়েত সাহেব কিছু বললেন না। তীক্ষ্ণ অথচ শান্ত দৃষ্টিতে নাদিমের দিকে চেয়ে রইলেন। টিউশনি করানো ছেলেগুলো ছাত্রীর অভিভাবকদের কাছে সবসময়ই অতিব পবিত্র হওয়ার ভান ধরতে পছন্দ করে। চোখে-মুখে তরল নিষ্পাপ ভাব আনার চেষ্টা করে। কথাবার্তার ধরন থাকে বিনীত। মৌশির আগের দুটো গৃহশিক্ষকও অনেকটা সেরকমই ছিল। কিন্তু নাদিমের মধ্যে এমন কোনো ধরন দেখা যাচ্ছে না। ছেলেটির কথাবার্তায় বিন্দুমাত্র সংকোচ নেই। ভয় নেই। নিজেকে নিষ্পাপ, নির্দোষ প্রমাণ করার কোনো তাড়া নেই। ইমায়েত সাহেব হঠাৎই উপলব্ধি করলেন তিনি বিরক্ত হচ্ছেন। বিচারক মানুষের এই এক সমস্যা। তাদের সুপ্ত মন সবসময়ই চায়, সামনে বসে থাকা মানুষটি তার ভয়ে অস্থির থাকুক। কথাবার্তা গুলিয়ে ফেলুক। কিন্তু নাদিম কথা গুলিয়ে ফেলছে না। নিঃসংকোচে নগ্ন পেইন্টিং নিয়ে আলাপজুড়ে বসে আছে। ইমায়েত সাহেব মৃদু কাশলেন। রণিতা নামের এক তরুণী চমৎকার, ঝকঝকে দুটো কাপ ভর্তি চা দিয়ে গেল। ইমায়েত সাহেব নিজের কাপটা তুলে নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘ তুমি করে বলছি বলে কিছু মনে করো না।’
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হালকা হাসল নাদিম। এই বাড়ির চা খেতে বিস্বাদ। কখনও শরবতের মতো মিষ্টি তো কখনও বিষের মতো তেতো। এই মূহুর্তে চা খেতে লাগছে নিমের পাতার মতো বিস্বাদ। নাদিমের অশ্লীল কিছু গালি দিতে ইচ্ছে করছে। নিষিদ্ধ ইচ্ছেটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে চায়ের কাপে মনোযোগ দিল নাদিম। চা বানানোটা একটা শিল্প। ঠিকঠাক চা বানানোর শিল্পটা এদের নেই। নাদিম হালকা গলায় বলল,
‘ কিছু মনে করছি না।’
ইমায়েত সাহেব আবারও ভড়কালেন। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন,
‘ তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়? বাবা কী করেন?’
নাদিম চোখ তুলে তাকাল। ইমায়েত সাহেব যে তার কথাবার্তায় চরম বিরক্ত তা সে প্রথম থেকেই বুঝতে পারছে। ইমায়েত সাহেবকে বিরক্ত করে মনের কোথাও একটা প্রচন্ড আনন্দও হচ্ছে। নাদিম বিরস মুখে বলল,
‘ গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল। বাবা নেই। তাই কিছু করার প্রশ্নও উঠছে না।’
‘ মা?’
‘ মা-ও নেই।’
‘ ভাই-বোনও নেই?’
নাদিমের সাবলীল উত্তর,
‘ একটা বোন আছে। এবার বোধহয় এসএসসি পরীক্ষার্থী। একজেক্ট বলতে পারছি না।’
‘ বোধহয় কেন? তোমার বোন কোন ক্লাসে পড়ে তা তুমি জানো না? আশ্চর্য!’
‘ জিগ্যেস করা হয়নি।’
ইমায়েত সাহেবের বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁলো। কিছুক্ষণ নীরব দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু একটা বলবেন তার আগেই উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ল নাদিম,
‘ আপনি আমাকে কেন ডেকেছিলেন স্যার?’
নাদিমের প্রশ্নে কন্ঠনালিতে আটকে থাকা প্রশ্নগুলো গিলে ফেললেন ইমায়েত সাহেব। নাদিমের কথার ধরনই বলে দিচ্ছে, সে নিজের সম্পর্কে আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। ইমায়েত সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই ছেলেকে তার পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু মেয়ের জন্য ছাড়িয়েও দিতে পারছেন না। ইমায়েত সাহেব ক্লান্ত হাতে খবরের কাগজটা তুলে নিলেন। কাগজটা মুখের সামনে মেলে ধরে বললেন,
‘ মৌশি বলছিল, তুমি দুদিন ধরে পড়াতে আসছ না।’
‘ জি। আসছি না।’
‘ কিন্তু কেন?’
নাদিমের বলতে ইচ্ছে করল, আপনি বালের জাজ। নিজের মেয়েকে যে জাজ করতে পারে না সে আবার কিসের জাজ? মেয়ে যে গাছে বসে কাঁঠাল খাচ্ছে সেদিকে না তাকিয়ে নাদিমকে জিগ্যেস করা হচ্ছে, আসে না কেন? নাদিম শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ আমার ফাইনাল সেমিস্টারের প্রস্তুতি চলছে। সময় হয়ে উঠছে না। আপনি চাইলে নতুন টিচার নিয়োগ দিতে পারেন। আমি খোঁজ দেব?’
ইমায়েত সাহেব খবরের কাগজটা সরালেন। নাদিমের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন,
‘ প্রয়োজন নেই। তোমার পরীক্ষা শেষ হবে কবে নাগাদ?’
নাদিম খানিকটা বাড়িয়ে চারিয়ে বলল,
‘ দেড় মাসের মতো তো লাগবেই।’
‘ বেশ! দেড় মাস পরই রেগুলার পড়ানো শুরু করো। মাঝে মাঝে পড়াশোনাতেও একটু আধটু গ্যাপ প্রয়োজন। ম্যান্টাল রিফ্রেশমেন্ট, ইউ নো? মৌশি একটু রেস্ট নিক বরং। এই দেড়মাস সপ্তাহে দু’দিন করে পড়িও। তাতেই হবে। হবে না?’
নাদিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হতাশ চোখে ভদ্রলোকের মুখের দিকে চেয়ে রইল। মৌশির মাঝে আজকাল বেশ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ-ই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকছে। পড়তে আসার আগে বেশ সাজুগুজু করছে। নাদিমের লো-ক্লাস কথাবার্তা। হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলা দুই একটা নিষিদ্ধ শব্দ মেয়েটাকে আজকাল ভীষণ আকর্ষণ করছে। পড়ার মাঝে হুটহাটই খিলখিল করে হেসে উঠছে। নাদিম সাইকোলজির স্টুডেন্ট। এর বাইরেও পূর্ণাঙ্গ পুরুষ মানুষ। কিশোরী মনের তাড়না সে বুঝে। মৌশির মনে বাসা বাঁধা ভয়ানক রোগটা হয়তো সে ধরে ফেলেছে।
হল থেকে বেরিয়ে ডিপার্টমেন্টের দিকে হাঁটছে নীরা-নম্রতা। হাতে থাকা নোট নিয়ে কিছু একটা আলোচনা চালাচ্ছে। দুই দিন বাদে পরীক্ষা। প্রচুর নোট বাকি। তারওপর শীটের এতো এতো মুখস্থ। নম্রতা-নীরার টেনশন মাখা কথাবার্তার মাঝেই ফোন বাজল নম্রতার। স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার দেখে কপাল কুঁচকাল নম্রতা। ফোনটা কানে নিয়ে সালাম দিল কিন্তু অপর পাশে নীরব। নম্রতা আবারও সাড়া দিল,
‘ হ্যালো? হ্যালো, কে বলছেন? হ্যালো?’
নীরা চোখের ইশারায় জিগ্যেস করল, ‘কে?’ নম্রতা ভ্রু কুঁচকে ফোনের স্ক্রিনটা চোখের সামনে আনল। ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ কি জানি? কথা বলছে না তো।’
কথাটা বলে আবারও সাড়া দিল নম্রতা,
‘ হ্যালো? হ্যালো? হ্যালো? শুনছেন?’
ওপাশ থেকে একবার জোড়াল দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে এলো তারপরই কেটে গেল কল। নম্রতা খানিক অবাক হলো। রং-নাম্বার ভেবে বিষয়টাকে খুব একটা আমলে আনল না। কিন্তু নীরার সাথে গল্পে মশগুল হতেই আবারও বেজে উঠল ফোন। এবারও সেই অপরিচিত নাম্বার। নম্রতা ফোনটা তুলে নরম কন্ঠে বলল,
‘ হ্যালো! কে বলছেন?’
ওপাশে নীরব। কেউ একজন তুমুল অস্বস্তি নিয়ে কথা খুঁজছে। বিশাল অস্বস্তির সাগরে কোনোরূপ কথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নম্রতা আবারও একই কথা জিগ্যেস করতেই, ফোনের ওপাশে গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করল। আবারও কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,
‘ আমি আরফান আলম।’
এই তিন তিনটা শব্দ উচ্চারণ করতেই অস্বস্তিতে গলা বসে আসতে চাইল আরফানের। নম্রতার সাথে এভাবে কথা বলতে হবে কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি সে। আরফান অস্বস্তি ঢেকে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালাল। ‘ আরফান আলম’ নামটা শুনেই চমকে উঠল নম্রতা। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আরফানকে কপি করে বলল,
‘ কি চাই?’
আরফান অস্বস্তি ভুলে এবার একটু হাসল। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ দেখা করতে চাই।’
‘ কেন?’
‘ দেখা হলে বলি?’
‘ সরি! আমি ব্যস্ত। দেখা করতে পারছি না। বলুন, কি বলবেন?’
আরফান থতমত খেয়ে বলল,
‘ এভাবে কিভাবে বলব? আপনি ফ্রী হবেন কখন?’
নম্রতা ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,
‘ আপাতত আমি ফ্রী হচ্ছি না। টানা এক-দুই মাস চলবে এই ব্যস্ততা। ব্যাপারটার জন্য আমি দুঃখিত। আপনি বরং ফোনেই বলুন।’
‘ এর মধ্যে কী একটুও ফ্রী হবেন না? জাস্ট দশ মিনিটের জন্য। আমি বরং আপনার ভার্সিটি আসি। ক্যান্টিনে বসে কথা বলা যাবে। ইট’স আর্জেন্ট।’
নম্রতা শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ হবে না। ভার্সিটির পর আমি শপিং-এ যাব। বিয়ের শপিং-এ অনেক সময় লাগে। ফ্যামিলি থাকবে সাথে। আই এম সো সরি, ডক্টর আরফান।’
আরফান সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘ কার বিয়ের শপিং?’
‘ আমার।’
আরফান চমকে উঠে বলল,
‘ আপনার বিয়ে হচ্ছে?’
‘ হচ্ছে না হবে। আমি কি ফোনটা রাখতে পারি ডক্টর?’
আরফান জবাব দিল না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
‘ পাঁচ মিনিটের জন্য দেখা করুন। একটু দেখব শুধু।’
নম্রতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ কি দেখবেন?’
আরফান উত্তর দিল না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
‘ আপনি কি দেখা করছেন?’
নম্রতা শক্ত কন্ঠে জবাব দিল,
‘ না।’
ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো জোড়াল দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। নম্রতা ফোনটা কেটে নিজেও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নীরার দিকে তাকাতেই চিন্তিত নীরা হঠাৎই প্রশ্ন করল,
‘ অন্তুর খোঁজ কি পাওয়া গিয়েছে? ফোন ধরেছিল?’
# চলবে..
[ দেরী করে ফেলছি। সরি! ]