# নীল চিরকুট
# লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
২০.
ঘড়িতে নয়টা বাজে। আকাশটা ঘন মেঘে ঢাকা। রাতের শেষ প্রহরে হুট করেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি। আকাশ-পাতাল অন্ধকার করা বৃষ্টি। শাহবাগের রাস্তায় হাঁটু সমান পানি। সেই বৃষ্টি আর পানিকে উপেক্ষা করে ভার্সিটিতে ছুটে এসেছে ডিপার্টমেন্টের ছেলেপুলে। চারদিন বাদে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। লাইব্রেরিতে বই আর নোটের বহর। মৃদু গুঞ্জন তুলে পড়াশোনায় ব্যস্ত সবাই। করিডোর অথবা সিঁড়িতে বসেও চলছে গম্ভীর ডিসকাশন। ফাঁকা ক্লাস রুমেও চার-পাঁচজনের গ্রুপ করে নিরন্তর ছুটে চলেছে গ্রুপ স্টাডি। শুধুমাত্র নম্রতাদের মধ্যে কোনো তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। ক্যান্টিনের চির পরিচিত টেবিলটা ঘিরে অলস বসে আছে তারা। একের পর এক চায়ের কাপ খালি হচ্ছে কিন্তু বিষণ্নতা যাচ্ছে না। টেবিলে পড়ে থাকা খোলা বইটির দিকে মনের ভুলেও তাকাতে ইচ্ছে করছে না। ছোঁয়া বার কয়েক বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে পড়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। বন্ধুদের থমথমে আড্ডায় বসে থেকে পড়ায় মনোযোগী হওয়া যায় না। চিরপরিচিত ছয় বন্ধুর আড্ডায় অন্তু অনুপস্থিত। দুই-তিনদিন যাবৎ বন্ধুদের সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ সে করছে না। ফোন তুলছে না। ভার্সিটিতেও দেখা যাচ্ছে না। চারদিন বাদে পরীক্ষা অথচ অন্তু সেমিস্টার ফি পরিশোধ করেনি। নোট জোগার করেনি। বন্ধুরা ব্যাগ, পকেট ঝেড়ে হাত খরচের বাড়তি টাকা জড়ো করে অন্তুর সেমিস্টার ফি সামলে নিলেও পরীক্ষায় বসার জন্য আপাতত তাকে চায়। পরীক্ষার ইতিহাসে সেমিস্টার ফি দিয়েই পাশ মার্ক পেয়ে যাওয়ার ঘটনা বিরল সুতরাং সেমিস্টার লস করতে না চাইলে অন্তুর পরীক্ষা দেওয়াটা চাই-ই চাই। কিন্তু অন্তুর কোনো হদিস নেই। নোট কালেক্ট বা পরীক্ষার কোনো চিন্তাই তার নেই। নাদিম ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেঁড়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল। এক চুমুকে কাপের বাকি চা’টুকু শেষ করে অন্তুর নাম্বারে ডায়াল করল। ‘ফোন রিসিভ হবে না’ এই মানসিকতা নিয়েই ফোনটা লাউডে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রথমবারেই ফোন রিসিভ করল অন্তু।
‘ বল।’
অন্তুর স্বাভাবিক কন্ঠস্বরে থমকে গেল নাদিম। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ধমকে উঠে বলল,
‘ বল মানে? কই তুই? চারদিন পর পরীক্ষা জানিস না? সেমিস্টার ফি কী তোর শশুর দিবে?’
অন্তু আগের মতোই স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
‘ আমি পরীক্ষা দেব না।’
অন্তুর কথাটা যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না নাদিম। চোখদুটো ছোট ছোট করে ফোনের দিকে তাকাল। সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ মানে?’
‘ আমি পরীক্ষাটা দিচ্ছি না।’
রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো নাদিমের। অন্তুর এই দায়সারা কথা বিন্দুমাত্র সহ্য হচ্ছে না তার। দাঁতে দাঁত চেপে ধমকে উঠল,
‘ পরীক্ষা দিচ্ছি না মানে কি? মামার বাড়ির আবদার পাইছিস তুই? সং শুরু করছিস? থাপড়াইয়া গাল লাল করে ফেলব।’
অন্তু শান্ত কিন্তু শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ আমার পরীক্ষা আমি দেব কি দেব না তা নিতান্তই আমার ব্যাপার। তাতে তোর কি?’
নাদিম এবার জ্বলে উঠল। রাগে লাল টুকটুকে হয়ে গেল তার ফর্সা মুখ। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ফোনটা নিজের হাতে তুলে নিল রঞ্জন। নাদিমকে হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলে ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ কই আছিস দোস্ত?’
‘ আছি ভার্সিটিতেই।’
‘ কোনদিকে?’
‘ স্ট্যাচু পার্ক।’
রঞ্জন অবাক হয়ে বলল,
‘ এই বৃষ্টিতে?’
‘ বৃষ্টি তো এখন নেই।’
রঞ্জন বাড়তি কোনো প্রশ্ন না করে কল কাটল। চোখ তুলে বন্ধুদের দিকে তাকাতেই সবার বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। অর্ধেক খাওয়া চা রেখেই স্ট্যাচু পার্কের দিকে হাঁটা দিল তারা। নীরা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
‘ তোরা যা। আমি বরং এখানেই থাকি?’
নাদিম তেড়ে এসে বলল,
‘ ঢং দেখাও? তোগো এইসব বাংলা ঢং দেখার টাইম আমাগো নাই। বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি জাস্ট। ব্যাংকারকে বিয়ে করবি কর। বন্ধুদের সাথে আগলা ঢং দেখানোর মানে কি?’
নাদিমের কথায় মুখটা ছোট হয়ে গেল নীরার। অসহায় চোখে তাকিয়ে থেকে মাথা নুয়ালো। রঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ তোরা কি এখন নিজেদের মধ্যে ঝামেলা ক্রিয়েট করতে চাইছিস? অযথা তর্কা-তর্কী করার মানে কি? নীরু? তুইও চল। অন্তু তো আমাদের একার নয় তোরও ভালো বন্ধু, তাই না? ওর খারাপ সময়ে আমাদের সাথে তোরও উচিত ওর পাশে দাঁড়ানো। ওকে একটু বুঝা। হয়তো ও তোর কথা শুনবে।’
নীরা আবারও অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। নম্রতা চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে বলল,
‘ রঞ্জন হয়তো ঠিকই বলছে নীরু। অন্তুর উচিত সত্যটা একসেপ্ট করে নেওয়া।’
নীরা মুখ ভার করে বসে রইল। অন্তু তার বন্ধু। ভীষণ পরিচিত। এই ভীষণ পরিচিত মানুষটিকেও হঠাৎ হঠাৎ চিনতে পারে না নীরা। কেমন যেন ভয় হয়। চোখের দিকে তাকালে আত্মা কাঁপে। তার এই অনুভূতি কি করে বুঝাবে সে?
স্ট্যাচু পার্কে শান বাঁধানো একটি বেঞ্চে বসে আছে অন্তু। গায়ে জবজবে ভেজা শার্ট। সবসময় খাঁড়া করে গুছিয়ে রাখা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে চোখের উপর এসে পড়েছে। চুল দিয়ে টপাটপ পানি ঝড়ছে। রঞ্জন ধীর পায়ে অন্তুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বন্ধুদের উপস্থিতি ঠিক ধরতে পারল না অন্তু। আগের মতোই চুপচাপ, ভাবলেশহীন বসে রইল সে। নম্রতা কাঁধে হালকা স্পর্শ করতেই চমকে উঠল অন্তু। মুখ তুলে পাশে তাকাল। চোখের উপর এসে পড়া চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে চমৎকার হাসল অন্তু। টকটকে লাল চোখের সাথে হাসিটা বড্ড বেমানান লাগল নম্রতার। নাদিম ফুঁসে উঠে বলল,
‘ নিজেকে কি মনে করিস তুই? তোর পরীক্ষা তুই দিবি কি দিবি না এটা নিতান্তই তার ব্যাপার? তোর ওপর আমাদের কোনো অধিকার নাই? ভালো বলেছিস। থেংকিউ।’
রঞ্জন আর ছোঁয়া নাদিমকে থামানোর চেষ্টা করল। ছোঁয়া নাদিমের বাহুতে হাত রাখতেই এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে জায়গাটা থেকে সরে গেল নাদিম। কয়েক সেকেন্ড নাদিমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে গাল ফুলিয়ে শ্বাস নিল রঞ্জন। চোখ ফিরিয়ে অন্তুর দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
‘ হঠাৎ পরীক্ষা দিবি না কেন? শুধু শুধু এক সেমিস্টার লস দেওয়ার কোনো মানে হয়? তোর ক্যারিয়ারের কথাটা তো আপাতত চিন্তা কর। কোনো সমস্যা থাকলে বল আমাদের। হয়েছেটা কি?’
অন্তু নিরুত্তর বসে রইল। নম্রতা অধৈর্য্য কন্ঠে বলল,
‘ আংকেলের কথাটা একবার ভাব। তুই পরীক্ষা দিচ্ছিস না এই খবরটা উনার উপর কেমন ইফেক্ট ফেলবে। উনি কষ্ট পাবেন।’
অন্তু এবারও কিছু বলল না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর খুব স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিল অন্তু,
‘ আমি ঠিক আছি। কোনো সমস্যা নেই। পরীক্ষা দিতে ইচ্ছে করছে না তাই দিব না। কে কষ্ট পাবে আর কে পাবে না তার দায়ভার আমার নয়।’
নম্রতা-রঞ্জন একে অপরের দিকে তাকাল। সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। নীরা আর ছোঁয়া খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। নম্রতা নীরার হাত টেনে কিছুটা সরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ তুই একটু চেষ্টা কর না রে নীরু।’
নীরা বিপন্ন কন্ঠে বলল,
‘ আমার কথা কেন শুনবে ও?’
‘ শুনবেই এমন কোনো নিশ্চয়তা তো আমরা দিচ্ছি না। তবে শুনতে পারে। চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।’
রঞ্জন আর ছোঁয়াও সাঁই জানাল। নীরা কিছুক্ষণ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রাজি হলো। নম্রতাদের রেখে দুরুদুরু বুকে অন্তুর দিকে এগুলো। আধভেজা বাঁধানো বেঞ্চিটাতে বসে সরাসরি অন্তুর দিকে তাকাল। অন্তুর দৃষ্টি কঠিন। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে জমা থাকা কাদা পানির দিকে।
‘ অন্তু?’
অন্তু উত্তর দিল না। নীরা বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখেই বসেছিল। সেই দূরত্ব বহাল রেখেই মাথা নিচু করে বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবতা কাটিয়ে নিজে থেকেই কথা বলল অন্তু,
‘ কি চাই?’
নীরা চোখ তুলে তাকাল।
‘ কি চাই মানে? তোর সাথে কি আমার চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্ক?’
অন্তু দূর্ব্যোধ্য হাসলো। নীরা অভিমানী কন্ঠে বলল,
‘ নম্রতা বা ছোঁয়ার সাথে তো এমন রূঢ় ব্যবহার করিস না তুই। তাহলে আমার সাথেই কেন?’
‘ রূঢ় ব্যবহার করলাম নাকি?’
‘ করিসনি? গত চার-পাঁচ দিনে সবার ফোন তুললেও আমার ফোন একটা বারের জন্যও তুলিসনি। কেন?’
নীরার কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল অন্তু,
‘ প্রেম কেমন চলছে তোর?’
নীরা বিস্ময় নিয়ে তাকাল। বড় বড় চোখদুটোতে একগাদা প্রশ্ন নিয়ে বলল,
‘ মানে?’
‘ ওই ব্যাংকারের কথা বলছিলাম। সেদিন শাহবাগ পার্কে পাশাপাশি হাঁটছিস দেখলাম। দারুণ মানিয়েছে তোদের।’
কথাটা বলে হাসল অন্তু। সেই হাসিতে ভেতরটা কেঁপে উঠল নীরার। কি মায়াময় হাসি! এই হাসিটার জন্য নীরার মরণও সই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। নীরা আর দশটা মেয়ের মতো পাগলামো করতে পারে না। কাউকে ভালোবেসে প্রচন্ড সুখে মরে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করতে পারে না। তার যে অনেক দায়িত্ব। পরিবারের প্রতি, মায়ের প্রতি, সমাজের প্রতি। দায়িত্বের বহরেই যে সাজানো তার জীবন। অন্তুর দিকে আটকে থাকা দৃষ্টিটা সরিয়ে সামনে তাকাল নীরা। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ পরীক্ষা কেন দিচ্ছিস না অন্তু?’
‘ আমার ইচ্ছে।’
‘ সবার কাছে আমায় দোষী বানিয়ে দিস না প্লিজ।’
অন্তু হেসে ফেলে বলল,
‘ তুই দোষী কেন হবি?’
নীরা মুখ ফিরিয়ে অন্তুর দিকে তাকাল। ভারি মায়াময় কন্ঠে বলল,
‘ ভালোবাসার থেকেও বড় বন্ধন, বড় প্রাপ্তি হলো বন্ধুত্ব। আমাকে এভাবে অবহেলা করিস না। বন্ধু হিসেবে থাকতে দে।’
অন্তু উত্তর দিল না। নীরা হঠাৎ-ই অন্তুর হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
‘ পরীক্ষাটা দে প্লিজ। নয়তো আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।’
অন্তুর সাবলীল জবাব,
‘ আমার পরীক্ষা না দেওয়ার সাথে তোর নিজেকে ক্ষমা করতে পারা বা না পারার সম্পর্ক কী? আর যদি আদৌ কোনো সম্পর্ক থেকে থাকে। তাহলে আমি চাইব তুই সারাজীবন অপরাধীই থাক। এক জীবনে এতো শান্তি, এতো ক্ষমা তোর ভাগ্যে জুটবে কেন?’
নীরা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। অন্তু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
‘ আমার তাড়া আছে। মিরপুর যেতে হবে। আসছি।’
নীরা ব্যস্ত হয়ে বলল,
‘ হঠাৎ মিরপুর কেন? এই ভেজা জামা-কাপড়ে অতোদূর যাবি? জ্বরে পড়বি তো।’
অন্তু এবার নীরার চোখের দিকে তাকাল। সেই সম্মোহনী দৃষ্টিতে শরীরটা কেমন বিবশ হয়ে গেল নীরার। হাত-পায়ে ছড়িয়ে পড়ল মৃদু শিহরণ। কয়েক সেকেন্ড গভীর চোখে তাকিয়ে থেকে শক্ত কন্ঠে উত্তর দিল অন্তু,
‘ আমাকে নিয়ে ফালতু কনসার্ন দেখানোর দুঃসাহস দ্বিতীয়বার করবি না নীরা। তুই কাকে বিয়ে করছিস। কতদিনের জন্য হানিমুনে যাচ্ছিস। কয় বাচ্চার মা হচ্ছিস তা যেমন আমার ভাবনার বিষয় নয়। ঠিক তেমনই আমি সম্পর্কিত কোনো কিছুই তোর ভাবনার বিষয় হতে পারে না।’
কথাগুলো বলে এক মুহূর্ত দাঁড়াল না অন্তু। অন্তুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোখ ভরে জল নীরার। চোখের পলক ফেলতেই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে ছেঁয়ে গেল নরম গাল।
পড়ার টেবিলের পাশে ছোট্ট টেবিলটাতে তিন-চার পদের খাবার সাজানো। ঝকঝকে কাঁচের গ্লাসে খাবার পানি। চায়ের কেতলি আর কাপটাও পরিষ্কার, ধবধবে। মধ্যবিত্ত পরিবারে যে কাপ-পিরিজগুলো যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা হয় সেগুলো থেকেও চমৎকার তার ডিজাইন। নাদিম খাবারগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই অল্প বয়সী এক তরুনী সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখে গিয়েছে এই বিলাসবহুল খাবারের ট্রে। তরুনী যাওয়ার আগে নাদিম তাকে মৌশির কথা জিগ্যেস করেছিল। সে বলেছে, ছোট আফা পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছে। এরপর আধাঘন্টা কেটে গিয়েছে। মৌশির পাঁচ মিনিট আদৌ শেষ হয়েছে নাকি আরও ঘন্টাখানেক চলবে বুঝতে পারছে না নাদিম। মাথার ভেতর থিতিয়ে রাখা রাগটা কেমন ঝিমঝিম করছে। সামনে রাখা খাবারের ট্রে-টা ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। মৌশির গালে দুটো শক্ত চড় বসিয়ে দিয়ে হলে ফিরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু নাদিম তেমন কিছুই করল না। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইল। অন্তুর কথায় মন খারাপ হয়েছে তার। সেই মন খারাপের রেশ ধরে রাগটা বেশ আয়োজন করেই ধরা দিচ্ছে মাথায়। দরজার কাছে খুট করে শব্দ হওয়ায় চোখ তুলে তাকাল নাদিম। মৌশি এসেছে। গায়ে জলপাই রঙা শাড়ি। চোখ ভর্তি কাজল।। ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক আর হাত ভর্তি জলপাই রঙা চুড়ি। চুলগুলো একটু অন্যরকম করে খোঁপা বাঁধা। সদ্য কিশোরী মেয়েটির দেহজুড়ে প্রথম যৌবনের ঢেউ। মৌশির এমন সাজে ভ্রু কুঁচকে তাকাল নাদিম। মৌশি ঠোঁট ভর্তি হাসি নিয়ে নাদিমের সামনে গিয়ে বসল। নাদিম কিছু বলার আগেই কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে অনেকটা স্বীকারোক্তির মতো করে বলে উঠল মৌশি,
‘ আজ আমার জন্মদিন। জন্মদিনে আমি শাড়ি পরি। আমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে, স্যার?’
নাদিম ছোট্ট করে উত্তর দিল,
‘ হ্যাঁ। সুন্দর দেখাচ্ছে।’
মৌশি উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ আমি আজকে রান্নার দারুণ কিছু প্রিপারেশন তৈরি করেছি স্যার। ইতালির বিখ্যাত নেপোলিতান পিৎজাও বানিয়েছি। আপনি কি একটু টেস্ট করবেন?’
কথাটা বলে বড় বড় মায়াবী চোখ মেলে নাদিমের দিকে তাকাল মৌশি। নাদিম মৌশির দিকেই তাকিয়ে ছিল। তীক্ষ্ণ তার দৃষ্টি। মৌশিকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করে নাদিমের হঠাৎ-ই মনে হলো, মেয়েটা অতীশয় রূপবতী। এই রূপবতী মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করতে নেপোলিতান পিৎজা নামক খাবারটা চট করে টেস্ট করে নেওয়া উচিত। টেস্ট করা শেষে মুগ্ধ গলায় বলা উচিত, ‘অসাধারণ! পিৎজার মতো খাবারও যে এতোটা সুস্বাদু হতে পারে তা আমি ভাবতেই পারিনি। একদম মুখে লেগে থাকার মতো স্বাদ।’ কিন্তু নাদিম এমন কিছুই বলল না। তার কাছে উচিত কাজগুলো কখনোই উচিত বলে বোধ হয় না। তার কাছে উচিত কাজ মানেই দুনিয়ার বিরক্তিকর কাজ। নাদিম বেশ গম্ভীর এবং স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ নেপোলিতান নামক কোনো পিৎজা খাওয়ার জন্য আমাকে আসতে বলা হয়নি মৌশি। আমি পড়াতে এসেছি। পড়ানো শেষ হলে চলে যাব। তুমি অলরেডি আধাঘন্টা লেইট। চটজলদি বই বের করো, ফ্যাস্ট।’
মৌশি তার টলমলে চোখদুটো লুকাতে তাড়াহুড়ো করে মাথা নিচু করল। ডানহাতে থাকা চুড়িগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বলল,
‘ আজ পড়ব না। জন্মদিনের দিন পড়তে হয় না। জন্মদিনে আনন্দ করতে হয়, এটাই নিয়ম। জন্মদিনের নিয়ম।’
নাদিম বিরক্তি নিয়ে তাকাল। যথাসম্ভব শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ তাহলে আমায় ফোন করে মানা করলে না কেন?’
‘ আপনাকে নেপোলিতান পিৎজা আর চিকেন মুয়াম্বা খাওয়াব বলে। বাবা বাড়ি নেই। আসতে আসতে রাত। আপনি কি আমার সাথে আমার জন্মদিনটা সেলিব্রেট করবেন স্যার?’
নাদিম উঠে দাঁড়াল। সামনে বসে থাকা অসম্ভব রূপবতী মেয়েটির টলমলে চোখদুটো উপেক্ষা করে বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
‘ শুভ জন্মদিন মৌশি। জন্মদিনের দিন আনন্দ করতে হয়। তুমি আনন্দ করো। আমি কাল এসে তোমাকে পড়িয়ে যাব। শার্প এট টুয়েলভ।’
শাহবাগ গ্রন্থাগারে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে নম্রতা। আজ প্রায় দুই সপ্তাহ পর গ্রন্থাগারে পা রাখতে চলেছে সে। ভার্সিটিতে অন্তুকে নিয়ে ঝামেলাটা হয়ে যাওয়ার পর সবার মনই বেশ বিক্ষিপ্ত। বিশেষ করে নীরার। নীরার চোখ-মুখে থমথমে ভাব। অনেকটা আষাঢ়ের ভারী আকাশের মতো। গা ভর্তি জল অথচ ঝড়ে পড়ার উপায় নেই। নম্রতা আজ ইচ্ছে করেই একা ছেড়ে দিয়েছে নীরাকে। থাকুক কিছুক্ষণ একা। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষরই একান্ত ব্যক্তিগত কিছু সময় প্রয়োজন। যেখানে সে থাকবে আর থাকবে তার নিজস্ব সত্তা। সেখানে তৃতীয় কারো থাকার অধিকার নেই। নম্রতা ছোট্ট শ্বাস ফেলে সিঁড়ি ডিঙিয়ে দুই তলায় উঠল। অলস পায়ে চিরপরিচিত সেল্ফটির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে উঠল। পুরাতন সেই বইটি সেল্ফের এক কোণায় পড়ে থাকতে দেখে একরকম লুফে নিল নম্রতা। বই হাতে কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে ধীরে ধীরে বইয়ের মলাটের নিচের দিকটাই তাকাল। কম্পনরত হৃদপিণ্ডটি যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তারপর আবারও পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে লাগল হৃদস্পন্দন। পুরো চার বছর পর চেনা সেই চিরকুট দেখে নম্রতার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগার। হৃদপিন্ডটা বুঝি বেরিয়ে আসবে এখনই? নম্রতা দু’হাতে মুখ চেপে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত করে চিরকুটটি খুললো। সেই পরিচিত গুটি গুটি অক্ষরে লেখা,
‘ শ্যামলতা? আমি কি হারিয়ে গিয়েছি? নাকি হারিয়ে ফেলেছি তোমাকে? আমার ঘরে এখন আর বেলীফুলের সুগন্ধটা আসে না। বেলীফুলের সুগন্ধহীন এই অক্সিজেনটা আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি আর পারছি না। ফিরে এসো নয়ত ফিরিয়ে নাও আমায়।’
চিরকুটটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল নম্রতা। সারা শরীরে ঘাম দিচ্ছে তার। হাত-পা কাঁপছে। উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তি পাওয়া যাচ্ছে না। নম্রতা ঘন্টাখানেক বসে থেকে নিজেকে শান্ত করল। লাইব্রেরির কর্মচারীদেরকে বইটা ইস্যু করার ডেইট জিগ্যেস করে জানল, বইটা কাল ফেরত দেওয়া হয়েছে। নম্রতার চিন্তাগুলো ধোঁয়াশা হয়ে আসছে। নিষাদ কি তবে ফিরে এসেছে ঢাকা? আর নিষাদ যদি নম্রতাকে চিনেই থাকে তাহলে এই চিরকুটের মানে কি? নিষাদ আর সে একই ব্যক্তি হওয়াটা কি আদৌ সম্ভব? নম্রতা বইটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়ে এলো। নতুন কোনো চিরকুট সে লিখল না। গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়েই নিষাদকে ফোন লাগাল সে। দু’বারের মাথায় ফোন উঠিয়ে হাস্যোজ্জল কন্ঠে সালাম দিল নিষাদ। নম্রতা সালামের জবাব দিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ল ,
‘ আপনি কোথায়? ঢাকায় ফিরেছেন?’
‘ হ্যাঁ। মাত্রই স্টেশন থেকে বেরুলাম৷ কেন বল তো?’
‘ আপনার সাথে দেখা করতে চাই। এখনই।’
নিষাদ অবাক হয়ে বলল,
‘ এখনই কিভাবে?’
‘ প্লিজ!’
#চলবে….