#কাউন্সেলিং_টেবিলের_গল্প_পর্ব_৪৫
“ম্যাডাম আপনার কত টাকা লাগবে? যা বলবেন তার একশগুণ দেবো, খালি আমার বউকে ঠিক করে দেন।” ভদ্রলোকের বক্তব্য।
ভদ্রলোকের বয়স ৪৩, স্ত্রীর বয়স ১৮। বিয়ে হয়েছে বছরখানেক। এর মধ্যে অন্তত দশবার বউ বাপের বাড়ি চলে গেছে। প্রতিবারই বাপের বাড়ি থেকে জামাইকে ডেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে মেয়েটাকে স্বামীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
মেয়ের মায়ের ভাষ্য: “স্বামী হলো সোনার আংটি। সোনার আংটি বাঁকা হলেও চলে। চরিত্র ভালো, মদ, গাঁজা, পান, বিড়ি, সিগারেট, মেয়ে মানুষের দোষ নাই। এরকম সোনার টুকরা ছেলে কই পাবে?”
মেয়ের বাপের কথা: “ঢাকা শহরে শুধু গুলশান এলাকায় দুইটা বাড়ি, বনানীতে দুইটা বাড়ি, মহাখালীতে একটা বাড়ি, চিটাগংয়ের খুলশীতে দুইটা বাড়ি, খুলনায় দুইটা বাড়ি, মালয়েশিয়ায় ভিলা, ব্যবসাপাতির বরকত, কিছুরই কমতি নাই । এরকম জামাইতো লাখে একটা মিলে। এই অসভ্য মেয়ে যে কাউকে কিছু না বলে বারে বারে বাপের বাড়ি চলে আসে জামাই ভালো না হলে কি ফেরত নিয়ে যায়? এ জামাইয়ের জন্য কি মেয়ের অভাব? এমন ছেলের জন্য তো মেয়েরা লাইন দিয়ে দাঁড়ায় থাকে।”
আমি: ” আমি কথা বলবো মেয়েটার আলাদা করে। আপনাদের থেকে শুনতে চাই না। কারন আমি সাধারন মানুষ তো। বায়াস্ড হয়ে যেতে পারি।”
মেয়েটা একাই ঢুকলো চেম্বারে। দেখে প্রথম যে কথাটা মনে হল, এর বয়স কত? ভারী একটা কাতান শাড়ি পরা। শাড়ির ওজন, নাকি মেয়েটার ওজন বেশি আমি কনফিউজড।
মাথা নিচু করে এক কোণে বসলো। বিধাতা এত অপূর্ব করে একটা মানুষকে তৈরী করতে পারেন? সৃষ্টিকর্তা নিজে সুন্দর না হলে এতো অপরূপ একটা মানুষ তৈরি করতে পারতেন না। বসতে বসতে মেয়েটির এলো খোঁপা খুলে গেল। ঝরনার মত চিকমিকে এক ঢাল চুল গড়িয়ে পড়ল হাঁটুর নিচে। আমি আবার কনফিউজড হয়ে গেলাম, এই চুলের নাকি মেয়েটার ওজন বেশি?
আমি প্রশ্ন করলাম: ” তোমাকে কি বলে আমার কাছে এনেছে?”
মেয়েটা মাথা নিচু করে আছে।
আমি: “বললাম থাক। কথা বলতে ইচ্ছা না হলে কিছু বলতে হবে না। তুমি চা খাবে?”
আলতো করে মাথা নাড়লো নেতিবাচক ভঙ্গিতে।
আমি বললাম: ” তোমার জন্য আমার দেড় ঘন্টা সময় বরাদ্দ আজকে। তোমার সাথে আমার যা যা কথা হবে, বা হবে না সেটা আমি কাউকে বলবো না। কাজেই এই সময়টা চলো তুমি, আমি গল্প করি। তোমার স্বামী, মা-বাবা বাইরে অপেক্ষা করছে করুক। দেড় ঘন্টা তুমি বের হয়ে যাবে। আমি বলব না যে তুমি কিছু কথা বলোনি।”
মেয়েটা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো। প্রায় ঘন্টাখানেক কাঁদলো এক মনে। আমি চুপ করে বসে থাকলাম। শুধু দশ মিনিট পরে উঠে ওর হাতটা ধরেছিলাম। একসময় কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার চোখের পানি থাকলো না। তারপরও মেয়েটা কেঁদেই গেলো শুকনো চোখে পাথরের মূর্তির মতন বসে।
এক ঘন্টা পর মেয়েটা বলল, “আপনার কাছে নিয়ে এসেছে, আমি যাতে সংসার করি।”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
স্বামী পুঙ্গব স্যাডিস্ট। বিয়ের প্রথম রাতেই মেয়েটাকে ইমারজেন্সিতে নিতে হয়েছিল পেরিনিয়াল টিয়ার বা যোনিপথে ক্ষত নিয়ে। অনেকগুলো সেলাই দিতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে একাধিক ব্যাগ। পরদিন যখন মেয়েটিকে কেবিনে ফেরত দিয়েছে, তন্দ্রাচ্ছন্ন মেয়েটির কানে এসেছে, একজন আরেকজনকে হাসতে হাসতে বলছে, ” ফাটিয়ে দিয়েছ।”
এই লকডাউন এর মধ্যে প্রতিদিন অবিরাম ভদ্রলোক তার স্বামীত্বের অধিকার নিয়ে এই যৌন নির্যাতন চালিয়েছেন ঘন্টায় ঘন্টায়।
ফলশ্রুতিতে একাধিকবার মেয়েটিকে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়েছে। একমাত্র আশ্রয়স্থল বাবা মার বুকে যতবার পালিয়ে গেছে ততোবারই বাবা-মা স্বামীকে ডেকে মাফ চেয়ে মেয়েটিকে তার হাতেই তুলে দিয়েছে। এমনিতেই কিন্তু মেয়েটিকে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত যখন মেয়েটি যখন আত্যহত্যার চেষ্টা করেছে, তখন তারা কাউন্সেলিং এর জন্য আমার কাছে নিয়ে এসেছে।
“ম্যারিটাল রেপ” বা বিবাহিত সম্পর্কে থাকা অবস্থায় স্বামী কর্তৃক ধর্ষণ একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাংলাদেশের বড় সংখ্যক নারী এর ভুক্তভোগী। কিন্তু আফসোস বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
আমি মেয়েটার বাবা-মা এবং স্বামী তিনজনকেই সেশন শেষে চেম্বারে ডাকলাম। বললাম, ” হেলথের ডেফিনেশন কি জানেন ? Health is a state of physical, mental and social well-being….. ,কাজেই শারীরিক এবং সামাজিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে মানসিক স্বাস্থ্য একা কিভাবে ভালো থাকে? আমি জানি আপনারা মেয়েটিকে আপনাদের মতন করে ভালোবাসেন। কিন্তু আপনাদের মধ্যে চাওয়া-পাওয়ার হিসেবগুলো মেয়েটির শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতার সাথে একই প্লাটফর্মে নাই। তাই আমি আপনাদের তিনজনকেই ফ্যামিলি কাউন্সেলিং সাজেস্ট করবো। এই মেয়েটিকে আমি বাচ্চাই বলবো। বাচ্চাটি এখন যেকোন ধরনের দৈহিক সম্পর্ক বা মানসিক চাপ নেয়ার মতো অবস্থায় নেই। ওকে কিছুদিন বাবার বাসায় কি রাখা যায়? শুধু কাউন্সেলিং করে এই মেয়েটা ভালো হবে না। এই বিয়েটা অত্যাচারের সমতুল্য হিসেবে ওর শরীর এবং মনে দাগ কেটেছে। এই মেয়েটা যদি এখন আত্মহত্যা করে এই দায়ভার কিন্তু আপনাদের তিনজনের উপরই বর্তাবে। ”
মাঝে মাঝে আমার নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। কিছু কিছু কেসে অনুভব করি চরমতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের। খুব কষ্ট লাগে যখন এদের জন্য কিছু না করতে পারার অক্ষমতায়।
আমি তীব্র কড়াভাবে ছেলেটিকে ধুয়ে দিতে পারতাম, বাপ মাকে ধুয়ে দিতে পারতাম কিন্তু দিনের শেষে মেয়েটিকে তো আমি আশ্রয় দেবো না। মেয়েটিকে তাদের হেফাজতেই থাকতে হবে।
আমার পরিচিত কিছু শেল্টার হোম আছে, কিন্তু সেগুলোর পরিবেশ এমন আশাব্যঞ্জক নয় যে আমি বড় মুখ করে মেয়েটিকে সেই ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠিয়ে দেবো।
রবীন্দ্রনাথের আমলে “কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নি।” রবীন্দ্রনাথের আমলে, হৈমন্তীর বাবা অনুধাবন করেছিলেন, ” অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিবার মতন বিড়ম্বনা আর কিছু নেই।”
আর এই ২০২১’শে আমিও বিড়ম্বিত হই যখন দেখি আধুনিকা বীরঙ্গনা।
এই অতিব উচ্চবিত্তের ভিকটিম বউগুলার থেকে, আমার বাড়ির কাজের বুয়াটা, রাস্তায় মাঝে মাঝে রেইপ হওয়া গার্মেন্টসের কর্মী মেয়েটাও অনেক বেশি মাথা উঁচু করে চলে।
যারা ম্যারিটাল রেপকে সত্য বলে স্বীকার করেন তাদের জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
অধ্যাপক সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপিস্ট