#কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
“ও ঘরে থাকলে এক রকম, আর ঘরের বাইরে গেলে আরেকরকম! দুটো মানুষকে আমি মেলাতে পারিনা।” ভদ্রমহিলা বললেন। বয়স ৩৩ বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক। প্রথমে নিজেদের পছন্দ, পরবর্তীতে দুই পরিবার আপত্তি করার কিছু না পেয়ে সানন্দে বিয়েটা দিয়েছে।
স্বামী ও স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য বছর তিনেক। উভয়েই ঈর্ষণীয় পেশাজীবি। সামাজিক পরিমন্ডলে রাজযোটক।
দুজনই একই অফিসে কাজ করেন। পারস্পরিক হৃদ্যতার অভাব নেই। কিন্তু সমস্যা হল ভদ্রলোক ঘরে ঢোকার সাথে সাথে গম্ভীর হয়ে যান। কিছুটা খোঁচা মারা কথা বলেন। ভদ্রমহিলার সবকিছুতে দোষ ধরতে থাকেন।
ভদ্রমহিলা, ” ও ঘরের দরজায় দাড়ানো মাত্রই কলিং বেল টেপার আগেই বদলে যায়।”
আমি, “প্রথমে কি বদলায়? কথা নাকি শারীরিক ভঙ্গি?”
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ” শারীরিক ভঙ্গি প্রথমে তারপর আস্তে আস্তে কথার ধরন।”
আমি, ” বাসায় কে কে থাকেন?”
ভদ্রমহিলা, ” আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, আর দেবর ননদ।”
আমি, ” দেবর ননদের সাথে সম্পর্ক কেমন?”
ভদ্রমহিলা, ” চমৎকার। আমি যেহেতু বাবা-মার সিঙ্গেল চাইল্ড তাই সব সময় একটা ভাই-বোন চাইতাম। এখানে মনে হল প্যাকেজ পেয়ে গেছি” ভদ্রমহিলা মিস্টি করে হাসলেন। খেয়াল করলাম ওনার একটা গজদন্ত ঝিকিয়ে উঠলো। কিছু কিছু মেয়ের একটা আলাদা সৌন্দর্য থাকে। হয়তো খুব সাধারন চেহারা, কিন্তু হাসলে একটা উজ্জ্বল্য আভা ছড়ায় তাঁর চোখের কোনে, ঠোঁটের ভাঁজে এই মেয়েটির ঠিক সেরকম।
আমি বললাম, ” শ্বশুরের সাথে সম্পর্ক কেমন?”
ভদ্রমহিলা বললেন, ” আমার মাঝে মাঝে মনে হয় উনি ওনার ছেলে মেয়েদের থেকেও আমাকে বেশি প্রেফার করেন।” আবার সেই ভুবনমোহিনী হাসি।
আমি আস্তে আস্তে বললাম, ” আর শাশুড়ি?”
ভদ্রমহিলা একটু থমকালেন। চোখের কোনার উজ্জ্বল্য পলকে নিষ্প্রভ হলো। মানুষের চোখ আমার খুব পছন্দের একটি অনুষঙ্গ। চোখকে আমার মানসিক আদান-প্রদানের সেতু মনে হয়। বহু কথা মানুষ যেটা মুখে বলে না, নিজের অজান্তেই সেটা চোখ বলে ফেলে। নিউরোসাইন্সে সেটার একটা ব্যাখ্যাও আছে। আগে কোন পর্বে সেটা লিখেছিলাম বিধায় পুনরায় পাঠকদের আর বিরক্ত করতে চাইনা।
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ” এটা একটু কমপ্লিকেটেড। উনি এক কথায় কখনো আমাকে জোর করেন না। আমার ইচ্ছার উপর কখনো কোন কিছু চাপিয়ে দেন না। শাশুড়িরা যে ধরনের যন্ত্রণা করেন শুনেছি উনি তার কিছুই করেন না। “
আমি, ” তাহলে সমস্যাটা কোথায়?”
ভদ্রমহিলা, ” কখনো কখনো মনে হয় উনি প্রচন্ড প্রগতিশীল, আমার ছোটখাটো ইচ্ছা-অনিচ্ছা গুলোকে খুব যত্ন করেন। আবার মাঝে মাঝে আমি খেয়াল করি উনি আমাকে সহ্য করতে পারেন না। এবং উনি যে পারেন না সেটা উনি নিজেও সম্ভবত সব সময় বোঝেন না।”
আমি, ” আপনি যে বললেন আপনার স্বামী বদলে যান ঘরে পা দিলে, একটু খেয়াল করে ভাবুন তো, উনি কি ঠিক সেই আচরণগুলো করেন যেগুলো আপনার শাশুড়ি আপনার সাথে করেন এবং যেগুলোকে আপনি বলছেন উনি সম্ভবত না বুঝেই করছেন।”
ভদ্রমহিলার চোখের পাতা মৃদু কাঁপলো। চোখের তারা চঞ্চল হলো।
হঠাৎ করে কোন কিছু মনে পড়ার মতো ভাবে ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, ” হ্যাঁ! তাইতো!”
আমি নরম ভাবে বললাম, ” এই আচরণগুলোর পিছনে অনুভূতিগুলো একটু যদি আমরা চিন্তা করি, একটু ভেবে বলুন তো এই অনুভূতিগুলো কি রাগ, দুঃখ না ভয়?”
ভদ্রমহিলা বললেন, ” বুঝি নাই।”
আমি বললাম, ” ধরুন আপনার স্বামী একটা নির্দিষ্ট আচরণ করলেন, এই আচরণটা কী বোঝায়, তার এই আচরণটা করার পেছনের অনুভুতিটা কি আপনার প্রতি রাগের বহিঃপ্রকাশ? নাকি ভয়ের বহিঃপ্রকাশ? নাকি দুঃখের বহিঃপ্রকাশ?”
ভদ্রমহিলা মনে হলো ঠিক মত ভাবতে পারছেন না। আমি ওনাকে একটা কাগজ কলম দিয়ে বললাম, আপনি গত ১০ দিনের আনকম্ফোর্টেবল ঘটনাগুলো মনে করতে পারেন যেটা আপনার এবং আপনার স্বামীর মধ্যে ঘটেছে?”
ভদ্রমহিলা বললেন, “পারবো !”
আমি বললাম, ” আপনি এই কাগজে একটু টালি করে দেখবেন এর মধ্যে কয়টা রাগ প্রকাশের আচরণ? কয়টাতে উনার দুঃখ প্রকাশ পেয়েছে? আর কোন আচরণে আপনার মনে হয়েছে মনে ভয় থেকে তিনি এমন ব্যবহার করছেন! আপনি কিছুক্ষণ সময় নিন। তাড়াহুড়া করবেন না। আমাদের হাতে প্রচুর সময় আছে।”
ভদ্রমহিলা প্রথমে কিছুক্ষণ পেন্সিল হাতে মূর্তির মতন বসে থাকলেন। তারপর লিখলেন। কাটলেন। আবার লিখলেন। কাটলেন। আমি বুঝতে পারছি ওনার কপালে ভাঁজ পড়ছে। নাকের কোনা কুঞ্চিত হচ্ছে।
চায়ের কাপ ঠোঁটে ছোয়াতে ছোঁয়াতে দেখলাম ওনার শ্বাস প্রশ্বাসের গতিও একটু বাড়লো। ভদ্রমহিলা যতই নিবিষ্ট মনে নিজের ভাবনা রাজ্যে ডুবে যাচ্ছেন ততই ওনার বিস্ময় মুখের মধ্যে অকপট খেলা করছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর ভদ্রমহিলা বললেন, আমার কাছে ১০ টার মধ্যে ৮টাই রাগ মনে হল। বাকি দুটো বুঝতে পারছিনা। সম্ভবত ভয়? আমি শিওর না।”
আমি ভদ্রমহিলার স্বামীর সাথে খোলাখুলি কথা বলতে চাইলাম ভদ্রমহিলার অনুপস্থিতিতে। ভদ্রলোক এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। উনি বললেন যে আন্তঃসম্পর্ক পুনরুদ্ধারে তিনি কোনোভাবে স্ত্রীকে সহায়তা করতে প্রস্তুত।
এরপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
ভদ্রলোকের বাবা তাঁর ছেলেবেলায় একটি বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ভদ্রলোকের বয়স তখন ৫ বছর। এই সম্পর্কের জের পরিবারটির উপর আরো বছর পাঁচেক চলে।
ভদ্রলোক বললেন, “বিশ্বাস করুন, আমার বাবা-মা দুজনেই চমৎকার মানুষ। কিন্তু কেন যেন তাদের দুজনের মধ্যেই ইন্টিমেসি হলো না।”
আমি বললাম, ” আপনি মায়ের কষ্টগুলো খুব ফিল করেন তাই না?”
ভদ্রলোক ছোট্ট করে পড়লেন, ” জ্বী।”
এই জ্বী শব্দটা আমার খুব পছন্দের। আমার মনে হয় এই একটা শব্দ দিয়ে অনেকখানি জোর গলার টোনে বোঝানো যায়।
আমি বললাম, ” এক্সট্রা ম্যারিটাল রিলেশন সম্পর্কে আপনার চিন্তা কি?”
ভদ্রলোক এক কথায় বলে উঠলেন, ” জঘন্য!”
আমি বললাম, ” আপনি কি সেই ভদ্রমহিলাকে দেখেছিলেন কোনদিন?”
ভদ্রলোক বললেন, “অনেকবার দেখেছি। উনি নিয়মিত আমাদের বাসায় আসতেন।”
আমি বললাম, ” একটু চিন্তা করে বলুন তো, আপনার স্ত্রীর সাথে সেই ভদ্রমহিলার কোন কোন ভঙ্গিমার মিল আছে?”
ভদ্রলোক সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকালেন। মনে হল প্রথমে দৃষ্টিটা একদম ব্ল্যাঙ্ক। তারপর আমার মাথা ছাড়িয়ে ওনার দৃষ্টি পেছনের জানালার দিকে চলে গেল।
আমি পেশাগত জীবনে একটা জিনিস শিখেছি। সেটা হল চুপ করে থাকা।
দুজনেই চুপ করে বসে থাকলাম বেশ খানিকটা সময়। আমার চেম্বারে কতগুলো টব আছে। টবের ছায়াগুলো বেলা বাড়ার সাথে সাথে দীর্ঘ হয়। টাইলসের কত দাগ ছায়াগুলো অতিক্রম করছে সেটাতেই মনোযোগ দিলাম। ভদ্রলোক ঠায় বসে আছেন।
বেশ অনেক্ষণ পর ভদ্রলোক ফিসফিস করে বললেন, ” ওদের হাসিতে মিল আছে। হাত নাড়ায় আছে।”
আমি মৃদু স্বরে বললাম, ” সেই ভদ্রমহিলারও কি গজদন্ত ছিল?”
ভদ্রলোক চমকে উঠলেন, ” আপনি কিভাবে জানলেন?”
আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ” আপনি মায়ের চোখে আপনার স্ত্রীকে দেখলে সেই ভদ্রমহিলার ছায়া দেখেন তাইনা?”
মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই ইস্যুগুলোকে ট্রান্সফারেন্স বলে। আমরা নিজের অজান্তে অতীতের কোন ঘটনার সাথে অবচেতনভাবে বর্তমানকে কানেক্ট করাই।
এই ভদ্রলোকটি শৈশবে তার মাকে এত ভালোবাসতেন, যে মায়ের সেই রাগ এবং কষ্ট নিজের অজান্তে কপি করেছেন। ধারণ করেছেন। লালন করেছেন। এখনো নিজের অজান্তেই সেটা বয়ে চলেছেন। মা যখন হঠাৎ হঠাৎ করে পুত্রবধূর মধ্যে সেই পুরনো স্বামীর প্রেমিকার ছায়া দেখেন তাঁর মনে অবচেতনভাবে
ট্রান্সফারেন্স হয়। এবং ছেলে অবচেতনভাবে সেটা কপি করে।
আমি ভদ্রলোককে বললাম, ” আপনি কি আজ বাসায় যে মা’কে বলবেন, সেই ভদ্রমহিলা এবং আপনার স্ত্রী দুজন সম্পূর্ণ আলাদা দুটো মানুষ, দুই সময়ের মানুষ! দুই পরিস্থিতির মানুষ। এবং আপনার স্ত্রী আপনার মাকে সম্মান করেন।”
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে বসে থাকলেন।
আমি বললাম, ” আপনারা দুজন চমৎকার কাপল। আমি বিজ্ঞাপন নির্মাতা হলে, আপনাদের দিয়ে সুখী পরিবারের মডেলিং করাতাম।”
ভদ্রলোক হেসে ফেললেন।
আমাদের সাথে সামনের মানুষটি অনেক সময় নিজের অজান্তে এমন কিছু আচরণ করেন যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমেই তাকে বাতিলের কাতারে না ফেলে মানুষটি কেন এমন আচরণ করছেন তার পেছনের কারণটি তলিয়ে ভাবাটাই মনুষ্যত্বের কাজ। কারণ মানুষের ভাবনার জায়গাটা, বা নিউরো সায়েন্স এর ভাষায় মানুষের গ্রে ম্যাটারের থিকনেস অনেক বেশি।
যারা অন্যদেরকে নন জাজমেন্টাল জায়গা থেকে দেখেন, তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্রাকটিশনার।