#চেম্বার কথন পর্ব ২৩
ভদ্রলোক, ” সানজিদা আপা, আমি আইসিইউতে আমার স্ত্রীর হাতটা ধরে বসতে চাই। জানি এটা এলাউড না। কিন্তু আমার দাবিটা কি খুব অযৌক্তিক? ও যেখানে রাতের বেলা ঘরের লাইট অফ থাকলে ভয় পায়, একা বাথরুমে যেতে ভয় পায়, সেখানে একদম একা একটা অন্য ভুবনে চলে যাচ্ছে, আমি যদি আইসিওতে ওর হাতটা ধরে থাকি, মনে মনে হয়তো বা একটু সাহস পাবে। খুব ইমোশনাল তো! কখনতো ওকে একা একা ছাড়ি নাই। নিজের মৃত্যু পথযাত্রী স্ত্রীর শুধু হাতটা ধরবো সেটা কি একান্তই ভুল চাওয়া আমার? ইনফেকশন কন্ট্রোলের কথা বলছে, আমি প্রোপার ব্যবস্থা নিয়ে যাব যেভাবে ডাক্তার-নার্সরা যাচ্ছেন। আমি তো জানিই আমার স্ত্রী মারা যাচ্ছে। আমি জানি সে লাইফ সাপোর্টে আছে। আমি যদি লাইফ সাপোর্টে দেবার অনুমতির জন্য সই করতে পারি, আমি যদি লাইফ সাপোর্ট উইথড্র করার জন্য অনুমতি দিতে পারি, তাহলে যেই মানুষটা মারা যাচ্ছে তার হাতটা ধরে বসে থাকতে পারবো না কেন?”
আমি নিরুত্তর।
পরিচিত আইসিইউ ইনচার্জকে অনুরোধ করা ছাড়া আর করণীয় কিছু ছিল না। তিনি স্বহৃদয় দেখতে দিয়েছিলেন।
কিন্তু প্রশ্নটা আমার মাথায় ঘুরছে তো ঘুরছেই। ইদানিং পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে কত কম বুঝি সেটাই বারবার চোখের সামনে ফুটে ওঠে।
আমি খুব অবাক হয়ে ভাবলাম, আমাদের ডাক্তারী শিক্ষা জীবনে ‘End of life care’ আসলে কতটুকু পড়ানো হয়?
মৃত্যু একটা মানুষের শুধুমাত্র শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া নয়। কারণ এটা শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের অংশ নয়। স্বাস্থ্যর অংশই হলো শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য।
বহুদিন আগেই আমরা high quality death সুনিশ্চিত করতে আমাদের মৃত্যু পথযাত্রীর বিছানার পাশে থেকে হুজুর/পুরোহিত ইতাদিদের সরিয়েছি। এরপর সরালাম কমিউনিটিকে। ফলে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুটা যদি আইসিউওতে হয় তখন আমরা আত্মতৃপ্তি পাই যে, যাই হোক আমি তো সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম।
কিন্তু আসলে যিনি মারা যাচ্ছেন তিনি আইসিইউর বিছানায় নিঃসঙ্গ মেশিনের টিকটিক শব্দের মধ্যে কতটুকু প্রস্তুত হন অন্যভুবনে যেতে? যতক্ষণ পর্যন্ত তার মস্তিষ্ক কাজ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষটি কতটুকু ভয় পান একা একা এই পথ চলায়? তিনি কতটুকু দুঃখ পান তাঁর প্রিয় মুখগুলো আশেপাশে হাত ধরে নেই বলে? তাঁর কি তখন রাগ হয়? কতটুকু অসহায় লাগে?
এই মৃত্যুটি কি আমারও হতে পারে?
আর প্রিয় মানুষগুলো আইসিইউর দেয়ালের বাইরে বোবা অপেক্ষায় কিভাবে ছিন্নভিন্ন হতে থাকেন?
আইসিউ কর্মীরাই বা কিভাবে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর এই অবিরাম বেদনার ভার নেন? দিন শেষে মানুষই তো!
ভালো মৃত্যুর সংজ্ঞা কি?
( আমার সাথে কথা বলা মানুষটির অনুমতি সাপেক্ষে কথোপকথনের এই অংশটুকু প্রকাশ করা হলো।)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।