#চেম্বার_কথন_২৬
ভদ্রমহিলা, ” জানো সানজিদা! আমার ইদানিং খুব ইচ্ছে করে ওঁর হাতটা ধরতে! আমাদের তো ভালোবাসার বিয়েই ছিল! তারপর মাঝখানে একগাদা তিক্ততা! আমার জীবনে কেউ আসলো, ওঁর জীবনে কেউ আসলো। রেলওয়ে স্টেশনের রেস্ট রুমের মতো কিছুক্ষণ থেকে চলেও গেল। এদের কেউ বেশি সময় থাকলো, কেউ অল্প সময়। এর মধ্যেই বাচ্চাদের জন্য নীলকন্ঠ হয়ে একসাথে থাকলাম কত যুগ। এখন যখন আবার ছেলেমেয়েরা যে যার মতো আলাদা হয়ে নিজস্ব পরিবার তৈরি করেছে, আমরা আবার একলা। এই পয়ষট্টিঊর্ধ জীবনে ইদানীং সারাদিন কাজে, ব্যস্ততা খুঁজি। ভাগ্যিস এখনো পেশাগত কাজগুলো রিটারমেন্টের পরে আমাকে খুঁজে।”
আমি, ” কাজগুলো আপনাকে খুঁজে, নাকি আপনি কাজগুলিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুঁজে ফেরেন?”
ভদ্রমহিলা, ” কি করবো বলো? হাপ ধরে যায়! শুন্য বাসাটা খা খা করে অজগরের মতো গিলতে আসে। আমরা সন্ধায় পাশাপাশি বসে টিভি দেখি। বাসায় আর কেউ নেই কাজের লোক ছাড়া। পর্দায় একটার পর একটা দৃশ্য ভেসে যেতে থাকে; আমরা দৃশ্যের অন্তরঙ্গতায় সম্পৃক্ত হতে পারি না। আমাদের পারস্পারিক মুগ্ধতা হারিয়ে গেছে। অথচ জানো, আমি এখনো খেয়াল করে দেখি, ওকে কি অদ্ভুত রাজশৈলীতে অন্যদের সাথে কথা বলে! হাসে! রসিকতা করে! কিন্তু আমার জন্য ওর হাসি চোখ ছোঁয় না। আমরা দুজন দুই রুমে ধূ ধূ দ্বীপের মতন রাতে ঘুমাতে যাই। তারপর আবার সকাল হয়! আবার নাস্তার টেবিলে দেখা। এটুকু শুনে তুমি ভেবো না যে আমাদের কথা হয়না! হয়! বাজারের ফর্দ, অমুকের বাড়ির দাওয়াতের সামাজিকতা, কুটুম্বিতা, লোকাচার, কেউ আসলে হাসিমুখে বসার ঘরে বসা। সামাজিক খুনসুটি সব কিছুতেই আমরা কথা বলি সানজিদা। সামাজিক ফ্রেমে আমরা পারফেক্ট ফ্যামিলি পিকচার। কিন্তু আমাদের পরস্পরের ভাষা নেই। আমাদের সম্পর্কটা কি মরে গেছে?”
আমি, ” সম্পর্কটাতে কি মিস করেন যার জন্য মনে করছেন সম্পর্কটা মরে গেছে? একটা শব্দে বলুন।”
ভদ্রমহিলা, ” ইন্টিমেসি!”
আমি, ” আপনার ভাষায় ইন্টিমেসি মানে কি?”
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। আমি ওনার ডাই করা চুলের ভাঁজে লুকানো রুপালি ঝিলিক, আঙ্গুলে হীরের ঝিলিক, চোখের কোনে ক্লান্তির ঝিলিক, ঠোঁটের কোণে কাঠিন্যের ঝিলিক, কপালের ভাঁজে জীবনযুদ্ধের ঝিলিক দেখতে লাগলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ” প্রাণ খুলে কথা বলা।”
আমি, ” একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? যে ইন্টিমেসিকে আপনি এত মিস করেন, সেটা কি বলতেই এত সময় লাগলো কেন? এত ভাবতে হল কেন?”
ভদ্রমহিলা নিশ্চুপ।
আমি বললাম, ” উত্তরটা আমিই দিয়ে দেই, কারণ আপনারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি ট্রান্সপারেন্ট না। আমরা স্বচ্ছতার সাথে একজন অপরজনের সামনে নিজেকে খুলে ধরি না। যেই স্বচ্ছতায় আমরা স্নানের ঘরে নিরাবরণ হই। ইন্টিমেসি মানে খোলাখুলি ভাবে পারস্পরিক অনুভূতি এবং একে অন্যের কাছে নিজের চাহিদাগুলো ফুলের পাপড়ির মত মেলে ধরা। আন্ত সম্পর্কে, আমার একান্ত অবজারভেশন আমরা থেরাপিস্টের সাথে অনেক বেশি ইন্টিমেট জীবনসঙ্গীর থেকে। কারণ সেখানে খোলামেলা স্বচ্ছ কথায় আমরা নিজেকে প্রকাশ করি।
ইন্টিমেসিকে খুব মোটাদাগে আমরা চার ভাগে ভাগ করি। মেন্টাল, স্পিরিচুয়াল, ইমোশনাল, ফিজিক্যাল ইন্টিমেসি।
১. মেন্টাল বা মানসিক ইন্টিমেসিতে আমরা সাধারন দৈনন্দিন বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করি। যেমন আমার একান্ত ভাবনাগুলা কি কি? আমার ইচ্ছেগুলো কি? আমার স্বপ্নগুলো কি? আমার জীবনের আশা কি? আমার প্রত্যাশা কি? খুব বেশি করে জীবনে আমি কি চাই? ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর আমি থেকে আমরা’তে পৌছাই। যৌথ সম্পর্কে আমাদের ভাবনাগুলো কি? আমাদের যৌথ স্বপ্নগুলি কি কি? আমাদের যৌথ ইচ্ছাগুলো কি কি? এ ধরনের স্বচ্ছ আলোচনা হয় মেন্টাল ইন্টিমেসিতে।
২. স্পিরিচুয়াল বা আধ্যাত্মিক ইন্টিমেসিতে আমরা আলাপ করি, আসলে আমি কে? এই মহাকালের বিশাল শেকলে আদি থেকে অনন্ত যাত্রার পথে আমি কোথায় অবস্থিত? আমি কিভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে নিজেকে একত্বতা অনুভব করি? সেই প্রসঙ্গে আমার ভাবনাগুলো কি? পবিত্রতা, শুদ্ধতা কিভাবে আমার কাছে অর্থবোধক হয়? আমি কিভাবে সমস্ত সৃষ্টির সাথে নিজের আত্মিক যোগাযোগ অনুভব করি?
৩. এরপর ইমোশনাল বা আবেগীয় ইন্টিমেসিতে আমরা আলাপ করি আমার আবেগগুলো কি কি? আমি কি কি পছন্দ, অপছন্দ করি? আমরা প্রত্যেকটা মানুষ কিন্ত আবেগ শরীরে অনুভব করি। আমি আমার তীব্র আবেগগুলো শরীরে কোথায় কোথায় বোধ করি? খুব কষ্ট পেলে কি আমার গলার কাছটা দলা পাকায়? নাকি বুকের মধ্যে চাপ লাগে? খুব দুশ্চিন্তা হলে কাঁধটা বা ঘাড়টা কি ভার বা শক্ত হয়ে থাকে? আমি কিসে ভয় পাই, আনন্দিত হই, দুঃখ পাই, রাগ করি সেটাকে কি খোলাখুলি জীবনসঙ্গীকে বলতে পারি? অথবা জীবনসঙ্গী যখন বলেন তাঁরটা সেটা কি শুনতে পারি? তাঁকে বলবার সুযোগ দেই? তাঁর রাগ, দুঃখ, ভয়, আনন্দের অনুভূতিগুলো শুনলেও কি নিজের মনের মধ্যে নিঃশর্তে সেটা নিতে পারি? একান্ত আবেগের জায়গা থেকে আমি কি তাঁর সাথে কমিটমেন্ট করতে এবং তাঁর কমিটমেন্টগুলোর সম্মান রাখতে পারি? নিজের মনকে নগ্ন করে তাঁর সামনে মেলতে পারি? তাঁকে মেলতে দেই? নিজের দোষ, নিজের ত্রুটি, নিজের ক্ষুদ্রতাকে নিয়ে তাঁর সামনে খোলামেলা বলতে পারি? আলোচনা করতে পারি? তাঁর সাথে কি সেই বন্ডিংটা আমার আছে? আমরা কি পারস্পরিক সে বন্ডিংটা তৈরি করতে পেরেছি?
মতের মিল না হলেও শ্রদ্ধার সাথে অমত কি জানাতে পারি? মাঝে মাঝে যখন ভুল করে ফেলি তারপর কি মাফ চাইতে পারি? বা তিনি ভুল করে ফেললে ক্ষমা করতে পারি? নাকি বারবার পেছনের কথা, পুরনো কথা ভাঙা রেকর্ডের মতো ভাবতেই থাকি? ভাবতে ভাবতে নিজে যন্ত্রণায় ভুগতে থাকি! আর জীবন সঙ্গীকে নিষ্ঠুর ভাবে তীর বিদ্ধ করতে থাকি? কতটুকু ছাড় চাই কতটুকু ছাড় দেই?
৪. শারীরিক ইন্টিমেসিতে আমার কি তাঁর পাশে বসতে, তাঁর চোখের দিকে তাকাতে ভালো লাগে? আমরা কি শুধুই সহবাস করি, সহবাস (মনের ঘরে একত্রে বাস) করি না? ছোট ছোট গল্প করবার সময় আমরা কি পরস্পরকে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ছুঁয়ে দেই? আমরা কি পরস্পরকে পক্ষী মাতার মত দুই বাহুর মধ্যে মধ্যে আগলে রাখতে ঢেকে ফেলি নিজেদের? পরস্পরকে জড়িয়ে ধরি? কপালে ছোট্ট একটা চুমু দেই? আলতো করে আহ্লাদে থাপড়ে দেই? ঠিক যেমন পোষা বিড়ালটাকে আদর দেই? আমরা কি লাভ মেকিং করি? নাকি শুধুই সেক্স বা শারীরিক যৌনতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি?
আন্তঃসম্পর্কগুলো চারা গাছের মতন। প্রতিদিনের যত্ন করতে হয়। গাছের গোড়ায় পানি দিতে হয়, আগাছা বাছতে হয়। বেশি পানি জমলে শেকড় পচে যায়। আবার যেই আন্তঃসম্পর্কগুলো অসুস্থ সেগুলোকে ছেটে বাদ দিতে হয়। শরীরে গ্যাংগ্রিন হলে বা পচন ধরলে যেমন কেটে ফেলে দিতে হয়। সম্পর্কের সুস্থতা বজায় রাখার দায়িত্ব তাই উভয়পক্ষেরই।
একজন শত প্রচেষ্টা দিলেও সম্পর্কটিতে মাত্র ৫০% কন্ট্রিবিউট করবেন। প্রত্যেকের হাতে মাত্র ৫০% নাম্বার। দুই হাত যোগ করলেই ১০০% হবে। তাই না?
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।