#চেম্বার_কথন_২৭
ভদ্রলোক, ” আমার এই ৬৩ বছরের জীবনে আমি ২ জন মহিলাকে স্পর্শ করেছি। আমার স্ত্রী আর দ্বিতীয় আর একজন। প্রথমটি ছিল শুদ্ধ ভালবাসা সেটা যখন মনোদৈহিকভাবে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে লাগলো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর গড়িয়ে গেলো, দ্বিতীয় জন এলেন আমার জীবনে। We started having wildest sex! And she got pregnant! আমি খুব চেয়েছিলাম বাচ্চাটাকে রাখুক। বিয়ে করে ফেলি। কিন্তু ওই যে, ‘শরীর আমার, সিধান্ত আমার’ মতাদর্শী। তারপর বাচ্চাটা আর আলোর মুখ দেখলো না। আমার বিবাহিত স্ত্রীও আমার শেষ সন্তানটিকে এ্যবর্ট করিয়েছিল। আমার বাকি ২ সন্তান দুধে ভাতে আছে। ইদানিং আমি সেই ভূমিষ্ট না হওয়া শিশু দুটোর আর্তনাদ শুনতে পাই। আমি শুনি, ওরা চিৎকার করে বলছে, ” বাবা, বাবা….” আর আমি একজন অক্ষম বাপ! অক্ষম পুরুষ! প্লীজ আপনি সিজোফ্রেনিয়া বলবেন না। মেডিকেল জারগনের পেছনে আশ্রয় নেবেন না। এটা আমার ডিলিউশনাল থট না! কিন্তু আমি স্পট শুনতে পাই, আমার সেই ২জন অনাগত পুত্রর আর্তনাদ। মন বলে ছেলে ছিল। ওদের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করছে একটু একটু করে ডিএনসি। আমার নিজেকে একটা পুরুষ বেশ্যা মনে হয় আজকাল।”
ভদ্রলোক দু’হাতে মুখ ঢাকলেন। কিছু মানুষের চেহারায় আভিজাত্যে ঠিকরে বের হয়। ভদ্রলোক তেমনি। সম্ভবত একেই বলে রাজপুত্র।
আমি, ” আপনার দুটো সম্পর্কের মধ্যেই পারস্পরিক শ্রদ্ধার জায়গাটা নষ্ট হবার কমন গ্রাউন্ড কি?”
ভদ্রলোক স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
আমি, ” একটু সহজ করে দেই। কবে থেকে এই দুই
আন্তসম্পর্কেই আপনারা একে অন্যকে অসম্মান করা শুরু করলেন? সম্পর্ক দুটোই কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে শুরু হয়েছিল। মাঝখানে কি এমন ঘটলো যার জন্য ভালোবাসার থেকে অসম্মানটা বেড়ে গেল? একটু খেয়াল করে দেখেন দুটো সম্পর্কেই কিন্তু অসম্মানটা ঢুকে পড়ল। দুটো সম্পর্কে এই অসম্মানটা কোথায় কোথায় একই প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকে? যেখান থেকে মনে হয় উল্টাদিকের মানুষটা সেটা পোটলা বেঁধে আপনার মুখে ছুড়ে দিল?”
ভদ্রলোক, ” আমার আল্লাহ জানেন, আমি তাদের অসম্মান করিনি। কিন্তু বিস্তর অসম্মান পেয়েছি। পুরুষের আত্মমর্যাদার কষ্ট আপনি কি বুঝতে পারেন? টেস্টোস্টেরন কি তীব্র দহনে শরীরে পুড়ায়! আমি নামাজে লুটিয়ে পড়ে দোয়া করতাম আমার দৈহিক চাহিদা যেন নষ্ট হয়ে যায়।”
আমি, ” আমি খুব কম জিনিস বুঝি এটুকু অন্তত আজকাল বেশ বুঝি। আমাদের প্রত্যেকটা মানুষের সীমাবদ্ধতা আছে। এটুকু বুঝতে পারার বিদ্যাটুকুই আমার সম্বল। আমি এমন বহু নারীকে চিনি, যিনি সারা জীবন অর্গাজমের তৃপ্তিটুকু পাননি। কাজেই সেই জেনারালাইজড জেন্ডার আলোচনা বাদ দেই। এই দুই ভদ্রমহিলার কাছে আপনার কমন সীমাবদ্ধতাটা অনুভূতিতে, চিন্তায় এবং আচরনে কি ছিল?”
ভদ্রলোক একটু থেমে গেলেন। অস্ফুট স্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” সীমাবদ্ধতা? আমার সীমাবদ্ধতা?”
আমি, ” জ্বী! আপনার সম্পর্কে দুইজনের কমন অভিযোগ কি ছিল?”
ভদ্রলোক, ” অনুভূতিতে আমি খুব সেনসেটিভ, আচরনে আমি সব সময় প্রথমে সরি বলি।”
আমি, ” এটা কি হেল্পফুল ছিল?”
ভদ্রলোক, ” না!”
আমি, ” এই ধরনের মনোদৈহিক ঘনিষ্ঠ আন্তসম্পর্কে আমি কিন্তু নিজেও অদৃশ্যভাবে বাউন্ডারি ঠিক করি যে আমাকে কিভাবে ট্রিট করবে পার্টনার। আমি কতটুকু নেব, কতটুকু নেব না। আমি কোথায় চুপ থাকবো, কখন সরি বলবো, কিংবা রাগ করবো। দুটো সম্পর্কে কি আপনার একটা ক্লিয়ার বাউন্ডারি ছিল?”
ভদ্রলোক দীর্ঘ সময় আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকলেন। আমি দীর্ঘ সময় পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকতে অভ্যস্ত। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, ভদ্রলোকও তাই।
ভদ্রলোক, ” আমি মিলগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! দুটো সম্পর্কে এতদিন পার্থক্য খুঁজেছি। এখন মিলগুলিও সুস্পষ্ট। “
আমি, ” আপনি আমার কাছ থেকে কি চান?”
ভদ্রলোক, ” আমি আমার ভূমিকাটা বুঝতে চেয়েছিলাম। এখন যখন নিজের কাছেই দুটো সম্পর্কেই আচরণগত মিলগুলো স্পষ্টতর হচ্ছে, আমার মনে হয় আমার পাজলের ছেঁড়া অংশগুলো মিলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আয়নায় দেখছি।”
আমরা সব সময় অন্যের দোষ খুঁজি। কিন্তু মনের আয়নায় সমস্যা তৈরিতে নিজের রোলটা কি ছিল সেটা একবার দেখবার অভ্যাস করলেই আন্তঃসম্পর্কের অনেক জট এমনিই খুলে যাবে। অথচ আমরা নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য প্রাচীর বানিয়ে তার ভেতরে আরো গুটিয়ে যেতে থাকি।
নজরুলের একটা কথা মনে হলো,
“আঘাত করবার একটা সীমা আছে, যেটাকে অতিক্রম করলে- আঘাত অসুন্দর হয়ে ওঠে- আর তখনই তার নাম হয় অবমাননা। – গুণীও বীণাকে আঘাত করেই বাজান, তাঁর অঙ্গুলির আঘাতে বীণার কান্না হয়ে ওঠে সুর। সেই বীণাকেই হয়ত আর একজন আঘাত করতে যেয়ে ফেলে ভেঙে।
মন্থনের একটা স্টেজ আসে- যাতে করে সুধা ওঠে। সেইখানেই থামতে হয়। তার পরেও মন্থন চালালে ওঠে বিষ।”
সম্পর্ক দুটোতেই তিনি এত কচলে ফেলেছেন, এখন সেই তিক্ততায়, বিষে নীলকন্ঠ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
(আমার চেম্বারে আসা মানুষটির অনুমতি সাপেক্ষে কনফিডেনশিয়ালিটি রেখে কথোপকথনের এই অংশটুকু প্রকাশ করা হলো মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে।)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া,
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।