#চেম্বার_কথন_৩২
ভদ্রলোক, ” মাত্র সাতদিন পরে আমাদের বিয়ে, দাওয়াত দেওয়া শেষ; এক বছর আগে হল বুক; এখন যদি এই শেষ মুহূর্তে কনে বলে বিয়ে করবো না! এটা কি তামাশা? আপনি কি বুঝতে পারছেন উভয় পরিবারের মান-সম্মান কোথায় নামবে? তাছাড়া আমাদের দুজনের মধ্যে এমন কিছুই হয়নি যে এই কঠিন সিধান্ত নিতে হবে। যেভাবেই হোক আপনি ওকে বোঝান! “
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
হবু বর একা আসেন নাই। সাথে নিজের বাবা-মা এবং হবু শ্বশুর শাশুড়িও আছে। সবাই একবাক্যে মেয়ের মাথায় গন্ডগোল হয়েছে বলে সাব্যস্ত করেছে। নাইলে এমন সোনার টুকরা পাত্রকে না করে!
মেয়েটির এক কথা, “আমি বিয়ে করবো না, কারণ ছেলে প্রচন্ড কন্ট্রোলিং। আপনি বলতেই পারেন আমি এতদিন কেন না করিনি? কারণ আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি মেনে নিতে। আমার বয়স ৩৮, তাই বাসা থেকে প্রচন্ড চাপ ছিল; বয়স হয়ে যাচ্ছে, বিয়ে করছি না কেন ? এখন যখন বিয়ে একদম ঘাড়ের উপর চলে এসেছে; আমি নিজে নিজের সাথে বুঝে দেখেছি আর নিতে পারছি না ! সারাজীবন কষ্ট করার থেকে এখন না বলে দেওয়াটাই সবদিক থেকে শ্রেয়। কে কি বলল তাতে তো আমার জীবন চলবে না। ছোটবেলা থেকে শুনছি সবকিছুতে ফার্স্ট হতে হবে। নাইলে দাম নেই! তারপর শুনলাম বিদেশী ডিগ্রী লাগবে নাইলে দাম নেই! পিএইচডি করলাম: পোস্ট ডক্টরেট করলাম! এরপরের দাবী হল এত বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে বাংলাদেশে কোথায় কাজ পাবা? অমুকের মেয়ে গুগলে কাজ করে, তমুকের ছেলে নাসাতে কাজ করে তোমাকে এর থেকে ভালো কোথাও ঢুকতে হবে। এর মধ্যে গান শুরু হয়ে গেল বিয়ে করতে হবে, না হলে “বাচ্চা হওয়ার বয়স” চলে যাবে। আমি কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে আমার বাবা মা যেই লেভেলের ক্যারিয়ার চায় সেই লেভেলের ক্যারিয়ার করতে গেলে বিয়ে, বাচ্চা, ক্যারিয়ার একসাথে হয় না। প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে সময় দেওয়া দরকার। সব কিছুই তাদের কাছে পিকচার পারফেক্ট হতে হবে। নাইলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না। আমি আমার এই ৩৮ বছরের জীবনে প্রথম একা নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছি; বিয়েটা করবো না, কারণ এই ভদ্রলোক চমৎকার মানুষ কিন্তু অসম্ভব কন্ট্রোলিং। ঠিক আমার বাবা মায়ের মতন। বাবা মা’কে বাধ্য হয়ে মেনেছি কারণ উপায় ছিল না। কিন্তু বাকি জীবনটা আমি আমার মতন করে কাটাতে চাই।”
রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ল। তিনি বলেছেন, ” মানুষের একটা বয়স আছে যখন সে চিন্তা না করিয়াও বিবাহ করিতে পারে । সে বয়স পেরোলে বিবাহ করিতে দুঃসাহসিকতার দরকার হয়।”
আমি ভদ্রমহিলার দিকে ইশারা করে ভদ্রলোককে বললাম, “আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন আপনার আচরণকে যেটা উনি কন্ট্রোলিং বলে উল্লেখ করছেন?”
ভদ্রলোক,” আমি যা বলি, সেটা ওর ভালোর জন্যই বলি। সাবধানে চলতে বলি। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বলি। কোথায় কোথায় যাচ্ছে লোকেশন শেয়ার করতে বলি! আমার হবু স্ত্রীর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এই কথাগুলো বলা কি আমার অন্যায়? সে কোথায় যাবে? কার সাথে মিশবে এগুলো নিয়ে আলাপ করা কি আমার অসভ্যতা?”
ভদ্রলোক বেশ তেরিয়া হয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন।
আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। এই ভঙ্গিটি আমার খুব পরিচিত। মনস্তত্ত্বের ভাষায় বলে, NIGSOB (now I get you son of a bitch) game. প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে বহুল ব্যবহৃত। ভদ্রলোকের বয়স ৪২। তিনিও পোস্ট ডক্টরেট। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে একই ভঙ্গীতে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ” আপনি ওনাকে কতদিন থেকে চেনেন?”
ভদ্রলোক, ” বছর দুয়েক!”
আমি, ” তারমানে আপনার সাথে পরিচয় হবার আগেই উনি পোস্ট ডক্টরেট শেষ করে চাকরিতে ঢুকে গেছেন তাইতো?”
ভদ্রলোক ইংরেজি কেতায় কাঁধ ঝাঁকিয়ে, “অভিয়াসলি!”
আমি, ” তাহলে উনি এতদিন যদি নিজের দায়িত্ব নিতে পারেন, দেশেবিদেশে চাকরি করতে পারেন, গত দুই বছরে হঠাৎ এমন কি হল যে ওনাকে আপনার বলে দিতে হচ্ছে? নাকি ওনার ওপর আপনার আস্থা নেই?”
ভদ্রলোক বিরক্তির স্বরে, “আমি বলব না তো কে বলবে?”
আমি, ” অবশ্যই আপনিই বলবেন, কিন্তু সেই বলাটা যদি আপনার জীবনসঙ্গীর মধ্যে বিরক্তি তৈরি করে তবে সে বিরক্তিটুকু আপনি খেয়াল করবেন না?”
ভদ্রলোক একটু থমকালেন।
আমি বললাম, “একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে যদি প্রতিমুহূর্তে আদেশ করা হয়, “এটা করো, সেটা করো না!” যিনি কিছুদিন আগেও নিজের মত চলেছেন তাঁর কেমন লাগবে? ধরুন আপনাকে যদি হঠাৎ করে আজ থেকে ডিকটেট করা শুরু হয়, “এটা করো, সেটা করো না বলে”, প্রতিমুহূর্তে জবাবদিহিতার চাপ যদি আপনার উপরে থাকে তবে যে সম্পর্কের দাবিতে এই আদেশ-নির্দেশ চলছে সেই সম্পর্কের মাধুর্যতা কি আর থাকে? আপনি যেটাকে ভালোবাসা মনে করছেন নট নেসেসারি অপরপক্ষও সেটাকে একইভাবে দেখবেন। তিনি সেটাকে জবাবদিহিতা কেন মনে করছেন সেটা কি একবারও বোঝার চেষ্টা করেছেন?”
ভদ্রলোক এবার একদম চুপ।
আমি, ” আপনাদের মধ্যে প্রেম না সেটেল ম্যারেজ হচ্ছে। ভদ্রমহিলা এতদিন বিয়ে করেননি কারণ উনি সময় করে উঠতে পারেননি। আপনিও কি তাই? আমাকে উত্তর দিতে হবে না। আপনার এই চল্লিশোর্ধ জীবনে যদি আগে কোনো সম্পর্ক থেকে থাকে সেই সম্পর্ক কি আপনার এই কন্ট্রোল করবার প্রবনতার কারণে ভেঙে গেছে? নিজে নিজে একটু ভেবে দেখবেন?”
দুটো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের বেড়ে ওঠার পরিবেশ ভিন্ন। কিন্তু বিবাহ তাদেরকে বিনি সুতোয় বেঁধে ফেলে। তখন সেখানে যদি একজন অন্যজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, প্রতিমুহূর্তে তাকে শুধরাতে চান, তাহলে কিন্তু দ্বিতীয় জনের দমবন্ধ হয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক। কোনক্রমে যদি এই বিয়েটা হয়েও যায় তবে সেটা কতদিন টিকবে এটাও কিন্তু ভাবনার বিষয়। বিয়ে কিন্তু রূপকথায় গল্পের শেষ। অথচ বাস্তবে বিয়ে মানে কেবল শুরু। দুটো মানুষের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক সেতুবন্ধনের প্রথম ধাপ। একজন অন্যজনের উপর যদি নিজস্ব চাহিদাগুলো আদায়ে অস্বস্তিকর ভাবে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন তাহলে দ্বিতীয় জনের তো দম ফেলা মুশকিল হয়ে যাবে। তখন দেখা যায় দুইজন দুইজনকে পরস্পরকে নিয়ন্ত্রণের আপ্রাণ চেষ্টায় সম্পর্কটাই নষ্ট করে ফেলে।
আবার রবীন্দ্রনাথেই ফিরি, “ভালোবাসায় ট্রাজেডি সেখানেই ঘটে যেখানে পরস্পরকে স্বতন্ত্র জেনে মানুষ সন্তুষ্ট থাকতে পারে নি – নিজের ইচ্ছা অন্যের ইচ্ছে করবার জন্যে যেখানে জুলুম – যেখানে মনের করি, আপন মনের মত করে বদলিয়ে অন্যকে সৃষ্টি করে।”
যেকোনো আন্তঃসম্পর্কে বাউন্ডারি খুব জরুরী। প্রত্যেকটা মানুষের নিজস্ব একটা প্রাইভেসি থাকে। সেখানে আরেকজনের প্রবেশাধিকার বড়ই বিব্রতকর। আন্তঃসম্পর্কে এই পারস্পরিক শ্রদ্ধার জায়গাটা থাকলে সম্পর্কগুলোতে দম আটকে আসবে না। কাজেই অতিরিক্ত ঘষাঘষি করে দম বন্ধ করার থেকে, পরস্পরকে একটু ছাড় দেয়া স্বাস্থ্যকর। বাবা-মা নিজেদের অপূর্ন চাহিদাগুলো বাচ্চাদের উপর কতটুকু চাপ তৈরি করবে না ভেবেই চাপিয়ে দেন। এটাও সমপরিমাণ অস্বাস্থ্যকর। প্রত্যেকটা মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার।
ভদ্রমহিলা বিয়েটি ভেঙে দিয়েছেন।
( আমার চেম্বারে আসা মানুষগুলোর অনুমতি সাপেক্ষে কনফিডেনশিয়ালিটি রেখে কথোপকথনের এই অংশটুকু মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া,
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।