#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_৪১
আশিয়ানের সামনে মিটমিট করে হাসছে লারা। লারার বাবার মুখেও ক্রুর হাসি। আশিয়ান ভ্রু কুচকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। আশমিনের নিষেধ না থাকলে এতক্ষণে এদের লীলাখেলা সাঙ্গ হয়ে যেতো। আশিয়ান দু দিকে মাথা ঝাকিয়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো। মাথা হালকা উচু করে অসহায় গলায় বলল,
— এভাবে হেসো না লারা সোনা।আমার চুলকানি হয়।হাত নিশপিশ করে। তোমার ড্রাকুলার মতো মুখটা ভেঙে দিতে ইচ্ছে করে তো সোনা। আমি আবার মেয়েদের গায়ে হাত তুলি না বাবু। এই রট চলবে তো?(হাতের রট টা দেখিয়ে)
লারা মুখটা পাংসুটে হয়ে গেলো। আশিয়ান কে বুঝতে না দিয়ে মুচকি হেসে বললো,
— আমাকে তুমি কিছুই করতে পারবে না। আমাদের গায়ে একটা টোকা লাগলেও তোমার সৎ মায়ের মাথা ঝাঝরা করে দিবে।
আশিয়ান অলস হাই তুললো। এই মুহুর্তে রাগের মাত্রা তার আকাশসম। হাতের রট টা এদিক সেদিক ঘুরিয়ে হুট করেই লারার বাবার গায়ে নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে আঘাত করা শুরু করলো। আচমকা আক্রমনে লারার বাবা দিশা হারিয়ে ফেললো। কয়েক সেকেন্ড পর আর্তনাদ করে উঠলো সে।লারা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো আশিয়ানের দিকে। হুশ ফিরতেই সে চিৎকার করে আশিয়ান কে থামতে বললো। হুমকি দিয়ে বলল,
— পাপা কে ছেড়ে দাও আশিয়ান। কেন নিজের ধ্বংস ডেকে আনছো? কাদের সাথে লাগতে যাচ্ছো সে ধ্যান আছে? ওরা তোমাকে শেষ করে দিবে। আমাদের সাথে হাত মেলাও। নিজের প্রতিশোধ ও নিতে পারবে। সমস্ত সম্পত্তিও তোমার হয়ে যাবে।
আশিয়ান থেমে গেলো। হাপাতে হাপাতে ঘাড় বাকা করে লারার দিকে তাকালো। লারা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আশিয়ানের দিকে। হাত পা থরথর করে কাপছে। আশিয়ান লারার ঘামে ভিজে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসলো। রড টা নিচে ফেলে আহ্লাদী গলায় বলল,
— ভয় পেয়ো না সোনা। আমি ভালো ছেলে। তোমার কথা শুনে একটু হাত চালাতে ইচ্ছে হয়েছিল। আমি কিন্তু বেশি জোরে মা*রি নি।
কিছুক্ষণ জোরে শ্বাস নিয়ে দাতে দাত চেপে বলল
— তোমার আমাকে ভিখারি মনে হয় বাবু! আমাকে চেনো না? হু? আমি কাওকে ভয় পাই? আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে আমাকে ধ্বংস করার? আর বাকি রইলো মিসেস শিকদারের কথা,তাকে নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। মরলো কি বাচলো আই ডোন্ট কেয়ার। কিন্তু তোমাদের কি হবে জান? আমি তো তোমাদের ছোট ছোট পিস করবো। তখন তোমাদের কে বাচাবে সোনা? এর চেয়ে ভালো তাদের ঠিকানা টা আমাকে দিয়ে দাও বাবু। (ঠোঁট উচু করে চুমু দেখিয়ে)
লারা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলো আশিয়ানের দিকে। তার বাবার অবস্থা করুণ। মনে হয় না বেশিক্ষণ বেচে থাকবে।
আশিয়ান লারা কে চুপ থাকতে দেখে আফসোসের স্বরে বলল,
— ভাইয়ের হাতের আদর খেতে চাইছো বুঝি? আহা সোনা! আমি ও কিন্তু কম আদর করতে জানি না। টেস্ট করতে চাও?
~~
আশমিন আই সি ইউর সামনে দাড়িয়ে আছে। সুখ কে সামলানো মুশকিল হয়ে পরেছে তাদের জন্য। মায়া বেগম থাকলে অবশ্য সুখকে সামলাতে পারতো। আশমিনের বুক ভাড় হয়ে এলো মায়া বেগমের কথা মনে হতেই। এই মানুষ টাকে সে অকারণেই ভালবাসে। মানুষ টাও তাকে আগলে রেখেছিলো নিজের ছেলের মতো। আজ সেই মানুষটাই নেই। সুখ কে লুবানা সামলাচ্ছে। আজ সকালে সে কানাডা থেকে ফিরেছে। আরো কিছুদিন থাকার কথা ছিল।কিন্তু এই পরিস্থিতি তে সে কোন ভাবেই দূরে থাকতে পারে নি। লুবানা তাদের জন্য বরাদ্দকৃত কেবিনে গিয়ে বসলো। আশমিন নূরের কেবিনের সামনে এখনো দাঁড়িয়ে। আমজাদ চৌধুরী এখন মোটামুটি সুস্থ।তাকে নরমাল কেবিনে সিফট করা হয়েছে। কিন্তু নূরের অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। আশমিন নূরের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় আছে। লারার সাথে কথা বলা আর না বলা সমান সে জানে। উপরমহলের কারোর হাত আছে এতে সে নিশ্চিত। তারা মাফিয়াদের ব্যবহার করেছে তারা। তার জালে সবগুলো আটকে। শুধু জাল গুটিয়ে আনার অপেক্ষা। ততক্ষণ তারা নিজেদের মুক্ত ভেবে সাতার কাটতে থাকুক। এখন পরিবার থেকে এক মুহুর্ত ও দূরে থাকা সম্ভব নয়। সব সময় সে এখানেই থাকবে। তার আপন মানুষ গুলো চোখের সামনে রাখবে সবসময়। হাসপাতালে নিরাপত্তার জন্য সর্বত্র র্যাব আর ডিবি সদস্যদের মোতায়ন করা হয়েছে। তবে আশমিন কাওকে ভরসা করছে না।সর্ষের মধ্যেই ভুত আছে। তাই হাসপাতাল থেকে একপা ও নড়ছে না সে। পরিবার ই যদি না থাকে প্রতিশোধ নিয়ে কি হবে! সবগুলো কে হাজার ভাগ করলেও তো তাদের ফিরে পাওয়া যাবে না।
— স্যার লারার বাবা মা*রা গেছে।
আশমিন কিছু বললো না। দরজার ছোট্ট গ্লাস দিয়ে নূরের উপর চোখ রেখেই বললো,
— টু*করো টু*করো করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দাও। অবশ্যই লারার সামনে করবে।
সানভি দেড়ি করলো না। দ্রুত প্রস্থান করলো। অমি পাখির কাছেই সারাদিন থাকে। দুই ঘন্টা অফিস সামলে বাকি সময়টা পাখির কেবিনেই কাটিয়ে দেয়। নূরের জন্য এখন আশমিন আছে। সে ও প্রয়োজনে সাহায্য করে আশমিন কে। রাতে আশমিন দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে পাখির কেবিনে শুয়ে পড়ে।পাখির বেড অবশ্য আলাদা। সবার সময় গুলো দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
আশমিন আগের থেকে আরো বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে। যাদের সাথে তার মনের কথা গুলো খুলে রাখে তারা কেউ ই তো কথা বলার অবস্থায় নেই। এখন আশমিনের সামনে একটা শব্দ করতেও সবাই ভয় পায়।
পুলিশের তদন্ত অনুযায়ী আশমিনের বাসায় কয়েকজন মাফিয়া এক হয়ে প্ল্যান মাফিক আক্রমণ করেন। আশমিনের জন্য তাদের কয়েকশ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকেই তারা আশমিনের পরিবারের উপর আক্রমণ করে। সিকিউরিটি তে থাকা কয়েকজন পুলিশ কে হাত করে বাড়ির ভিতরে ঢুকে তারা। জড়িত থাকা পুলিশ সদস্যরা বাকিদের খাবারের সাথে বিষ দিয়ে মেরে ফেলে। কয়েকজন বাচলেও সবাই বাচতে পারেনি। ওই নারী চক্র কে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশের রিপোর্ট শুনে আশমিন কিছু বললো না। ইশারায় তাদের বেরিয়ে যেতে বলল। অমি ক্লান্ত গলায় বলল,
— ওদের পুলিশ কাস্টাডিতে রাখা যাবে না স্যার। কামিনী ম্যামের বিষয় টা তাহলে সামনে চলে আসতে পারে।
আশমিন চুপ করে চোখ বন্ধ করে রইলো। এর মধ্যেই একজন নার্স হন্তদন্ত হয়ে এসে বললো,
— স্যার,,ম্যামের জ্ঞান ফিরেছে।
আশমিন দ্রুত পায়ে চলে গেলো নূরের কেবিনে। নূর চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। কয়েকদিনে পুতুলের মতো মুখটা কেমন কালো হয়ে গেছে। কেউ দেখলে বলবে না এই মেয়েটা দুধের মতো ফর্সা। আশমিন নিচু হয়ে নূরের কপালে চুমু খেলো। নূরের চোখের দিকে তাকিয়ে আস্বস্ত গলায় বলল,
— আমাদের মেয়েরা ঠিক আছে। এখন শুধু তুমি ঠিক হয়ে যাও। আমি তোমার চিন্তায় শুকিয়ে যাচ্ছি বউ।
নূর ঠোঁট হালকা বাকা করে ফেললো। কপালে ভাজ ফেলে পুনরায় চোখ বুজে রইলো। শরীর ব্যথায় অবশ হওয়ার জোগাড়। কথা বলার অবস্থায় নেই। নাহলে দু কথা শুনিয়ে দিতো।
আশমিন একটা চেয়ার টেনে নূরের হাত ধরে বসে পরলো। পরপর কয়েকটা চুমু খেয়ে নূরের হাতটা নিজের গালে লাগিয়ে বসে রইলো।
— নূর (কোমল স্বরে)।
নূর নিজের চোখ দুটো টেনে খুলে আশমিনের দিকে তাকালো। আশমিন শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে।
— আমি খুব অভাবি নূর। একেবারে ভিখারির মতো অভাবি।আমার জীবনে ভালবাসা, স্নেহ,যত্ন এগুলো করার মতো কখনোই কেউ ছিল না। আমি বড্ড লোভী জানো? আমার একটা পরিবারের বড় লোভ নূর। ভালবাসার কাঙ্গাল আমি। আগে আমার কোন পরিবার ছিল না। এখন তোমরা আছো। তুমি আছো,আমার মেয়েরা আছে। তোমাদের ছাড়া আমি শূন্য বরাবর। আমার জন্য হলেও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও। কষ্ট হবে।যন্ত্রণা হবে। তুমি মনের জোর হারিয়ে ফেলো না। আমি আছি তোমার পাশে।তুমি আমার ভালবাসা,আমার স্বপ্ন, আমার বাবুদের আম্মু। আমার তোমাকে চাই।আমার বুকে চাই। খুব দ্রুত টুইনস ছেলের বাবা হতে চাই। আমার প্রেম পেলে আমি কি করবো বলো? তুমি ছাড়া কি আমার আর কেউ আছে? দুই সেকেন্ডের জন্য অক্সিজেন মাক্সটা খুলে একটা চুমু খাবো।রাগ করো না। নিঃশ্বাস টা একটু আটকে রাখো বউ। আজ আটদিন হয়ে গেছে চুমু খাই না।
চলবে,,
.