বিচ্ছেদ পর্ব ৩
সেদিন রায়নাকে নিয়ে আশিকদের বাড়ী থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়েছিলো। রাশিক ওদেরকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলো।
রিয়া বার বার বলছিলো সিএনজিতে করে চলে যেতে পারবে। কিন্তু রায়নার দাদী কিছুতেই শোনেন নি।
রাশিক কে বলেছেন গাড়ীতে করে পৌঁছে দিতে।
আজ ওবাড়ীতে খেতে হয়েছে রিয়াকে।
ইভা,রাশিক আর মা এমন করে বলছিলেন যে না করার উপায় ছিলো না।
অথচ, আশিক একবারও বলেনি খেতে।
পুরোটা সময় সে রায়নার সঙ্গে কাটিয়েছে।
রায়না আশিকের রুমে গিয়ে প্রচুর খেলনা,পোষাক,চকলেট দেখে মহাখুশী।
এগুলো তার বাবা আমেরিকা থেকে নিয়ে এসেছে।
একবার দৌড়ে এসেছিল রিয়ার কাছে। হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবে আশিকের রুমে।
রিয়া বলেছিলো,আমি একটু ফুপির রুমে থাকি।
ফুপির সঙ্গে একটু গল্প করি ?
আচ্ছা তাকো, বলেই চলে গিয়েছিল বাবার কাছে।
এখন আর ঐ রুমটা তার নেই। সে এখন বাইরের মানুষ।
আজ ওবাড়ীতে গিয়েছিল গেস্টের মতো।
বুকের ভিতরটা চিন্ চিন্ করে উঠেছিলো কি ?
রায়নাকে ওর দাদী প্রথমে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।
তারপর অঝোর নয়নে কেঁদেছেন…
তার রক্ত.. তার বংশধর.এতো কাছে থেকেও কতো দূরে.. একথায় বলছিলেন।
ইভা,রাশিক ছোট্ট রায়নাকে নিয়ে কি করবে ভেবেই পাচ্ছিলো না। ওরা তিন জন মিলে বাসার মধ্যেই ক্রিকেট খেলেছিলো কিছুক্ষণ।
রায়না খুব খুশী..
রিয়ার কষ্ট হচ্ছিল খুব।
সারা রাজ্যময় এতো ভালবাসার মনি-মুক্তা ছড়ানো..
অথচ সেখানে রাজকন্যা নেই !
ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছিল একসঙ্গেই।
কিন্তু আশিকের সঙ্গে কোন কথা হয়নি রিয়ার।
রিয়া চুপচাপই ছিলো পুরোটা সময়। বেশীর ভাগ সময়টা ইভার রুমে বসেছিল।
কিছুক্ষণের জন্য রায়নার দাদীর রুমে গিয়েছিল উনি ডেকেছিলেন বলে।
রিয়া এখন কোথায় কি করছে..ওর বাবা-মা কেমন আছে .. এইসব জানতে চাইছিলেন তিনি।
খানিকক্ষণ কথা বলে রিয়ার মনে হয়েছিলো,
রায়নাকে দেখতে না পাওয়ার কষ্টে উনি কাতর
হয়েছিলেন।
আশিক চেয়েছিল, যে ক’দিন ঢাকায় থাকবে প্রতিদিন রায়না আসুক আশিকের কাছে।
রিয়া তাতে আপত্তি করেনি।
কিন্তু রিয়ার তো অফিস আছে।কাজেই সে যেতে পারে নি। ইভা এবং রাশিক এসে রায়নাকে প্রতিদিন সকাল ১১ টায় নিয়ে যেতো।
আর রিয়া অফিস থেকে ফেরার পথে রায়নাকে নিয়ে আসতো।
রিয়া খুবই চিন্তায় ছিল যে তাকে ছাড়া রায়না ওদের সঙ্গে এতোটা সময় থাকতে পারবে কিনা।
রায়না থাকতে পেরেছে যদিও প্রথম দিন বার বার রিয়াকে খুঁজেছে।
ইভা রায়নাকে রিয়ার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়েছে।
ওদের সবার আদর আর সর্বোপরি আশিকের মায়ের উপর রিয়ার ভরসা ছিল।
মা রায়নাকে ভুলিয়ে রাখতে পারবেন।
তিনি রায়নাকে খুব ভালবাসেন।
আশিকের পোস্টিং হয়েছে চিটাগং।
মাঝে মাঝে ল্যান্ড ফোনে কল দিয়ে রায়নার সঙ্গে কথা বলে। মাসে একবার ঢাকায় আসে। তখন রায়নাকে নিয়ে যায় ধানমন্ডির বাসায়।
সারাদিন মেয়ের সঙ্গে কাটায়।
মেয়েকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যায়।
ফিরে এসে রায়না চোখ বড় বড় করে, হাত-পা
নেড়ে নেড়ে গল্প করে মায়ের কাছে।
রিয়ার ভাল লাগে।
দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেল।
রায়নাকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে।
রিয়া ভালো স্কুলের খোঁজ খবর শুরু করলো।
এর মাঝে একদিন রায়নার দাদী ফোন করলেন,
রিয়ার মোবাইলে।
রিয়া তো বেশ অবাক !
সাধারণত; ইভা ফোন করে তাকে।
রায়নার খোঁজ-খবর নিয়ে বললেন,
বাসায় এসো তোমার সঙ্গে জরুরী কথা বলতে চাই।
রিয়া পরদিন রায়নাকে নিয়ে আশিকদের বাড়ীতে গেল। আশিক ছিলোনা। সে চিটাগং।
আশিকের মা রিয়াকে তার রুমে ডেকে সরাসরি বললেন, আমি চাইছি তোমরা নতুন করে ভাবো।
বাচ্চাটার কথা ভাবো। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নাও।
রিয়ার চোখ ছল ছল করছিল।
কিছুই বলতে পারেনি।
শুধু বলেছিল,মা আমি আজ আসি।
মা বলেছিলেন, এসো। ভাবো তারপর জানাও।
আমি আশিকের সঙ্গে কথা বলবো।
সেরাতে রিয়া এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি।
সারারাত বারান্দায় বসে আকাশ-পাতাল ভেবে
ভেবে রাত পার করে দিয়েছিল।
গত চার বছরে রিয়া একটা বিষয় খুব ভাল বুঝতে পেরেছে, রায়না বাবা-হীন হয়ে বড় হচ্ছে।
অন্য বাচ্চাদের মতো স্বাভাবিক জীবন সে পাচ্ছেনা।
রিয়া দেখেছে, ওর বান্ধবীদের বাচ্চারা কতো আবদার-আল্লাদ করে তাদের বাবাদের কাছে।
আত্মীয়-স্বজনদের মাঝেও এসব দেখেছে।
বাবারা কত আদর করে তাদের বাচ্চাদের
আবদার মেটায়।
রায়না খুব গাড়ীতে করে ঘুরতে ভালবাসে।
অথচ, রিয়ার পক্ষে রায়নার এই ইচ্ছে পূরণ করা সম্ভব নয়। এখন রিয়া যেভাবে রায়নাকে মানুষ করছে,
আশিক পাশে থাকলে রায়না আরো অনেক
স্বচ্ছলভাবে মানুষ হতো।
গত এক বছরে রায়না মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গ
পেয়েছে। কিন্তু রায়না তো তার বাবাকে সবসময় কাছে পেতে চায়।
সে তার বাবাকে বলেছে,বাবা তুমি আমাকে আর মাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও।
আশিক বলেছে,মা তুমি আরো একটু বড় হও।
রিয়া আশিকের এই উত্তরের মানে বোঝেনি।
হয়তো রায়না বড় হলে সব বুঝবে এটায় বোঝাতে চেয়েছে।
আশিকের সঙ্গে ডিভোর্সের পর থেকেই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব,প্রতিবেশী এবং অফিস কলিগ সবার নানারকম কথা আর প্রশ্নে জর্জরিত হতে হতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে রিয়া।
ডিভোর্সী শুনলেই মানুষ সহানুভূতির চোখে তাকায়।
বিশেষ করে রায়নার দিকে কারো কারো অতিমাত্রায় সহানুভূতি দেখলে, রিয়ার খুব ছোট মনে হয় নিজেকে। সহৃ করতে পারেনা।
অনেকেই নতুন করে জীবন শুরু করার কথাও বলেছিল। রিয়া কিছুতেই ভাবতে পারেনা।
আশিককে ছাড়া অন্য কারো কথা ভাবেনি কখনো।
রায়না ছাড়া কারো কথা ভাবেনা রিয়া।
তাই নতুন করে কিছু শুরু করা হয়নি রিয়ার।
বাবা-মা এরকম একটা খবর শুনে খুশী হয়েছিলেন।
তারা রিয়া আর রায়নার ভবিষ্যৎ ভেবে সব সময় দুঃচিন্তা করেন.. মন খারাপ করেন।
মা কান্না-কাটি করেন।
বাবা বলেছিলেন,আর বেশী ভাবিস না মা।রায়নার কথা ভেবে সব কিছু মিটিয়ে নে এবার।
মার তো এক কথা, আশিক যখন মেয়ের জন্য ফিরেছে তখন তুমিও একটু মানিয়ে নাও।
এক বিকেলে ইভা এসে হাজির।
সারা বিকেল রিয়া আর রায়নার সঙ্গে কাটিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় রিয়ার হাত ধরে বললো,
রাজা,রানী আর রাজকন্যা কি একসঙ্গে থাকবে ?
ইভার হাতটা নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে রিয়া গভীর মমতা জড়ানো গলায় বললো, থাকবে !
রাতে ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিয়ে তাকিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বললো, আমি তোকে তোর রাজ্য ফিরিয়ে দেবো.. যেখানে ভালবাসার অজস্র মনি-মুক্তা ছড়ানো আছে..তুই দু’হাত ভরে কুড়িয়ে নিস !!
চলবে…
বিচ্ছেদ পর্ব ১-১০