#অন্যরকম তুমি
পর্ব ৪৩
#তানিশা সুলতানা
তিনশত একুশ বার কল দিছে সাদি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কিন্তু ছোঁয়া রিসিভ করে নি। রিসিভ করবে কিভাবে? ও তো ফোনের কাছে ছিলোই না। ফোন রেখে টই টই করে ঘুরে বেরিয়েছে পুরো এলাকায়। এতদিন পরে আসলো নিজের এলাকায় আর সবার সাথে দেখা করবে না?
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিমের ডালটা দাঁতে গুঁজে বেরিয়েছে। নাজমা বেগম হাজার বার বারণ করেছে কিন্তু শুনে নি৷ মুখটা ধুয়ে কিছু খেয়ে যেতে বলেছিলো সেটাও মানে নি।
টইটই করে ঘুরে আম পেরেছে বেশ কতগুলো। সেগুলোই খেয়েছে। বড়বড় গাছের মগ ডালে উঠেছে। ইসসস কতদিন এসব মিস করেছে। গ্রামে ছোঁয়ার একটা বেস্টফ্রেন্ড আছে রুনা। ছোঁয়ার সেম ইয়ারের। তারও বিয়ে হয়ে গেছে কয়েকমাস আগে। সেও এসেছে। রুনার বিয়ে গ্রামেই হয়েছে। বর মুদি দোকান করে।
রুনাকে সাথে নিয়ে পুকুরের দিকে গেছে। আজকে মনের ইচ্ছে মতো পুকুরের গোছল করবে৷ ওসব বাথটাপে গোছল করে বিরক্ত হয়ে গেছে ছোঁয়া। ওভাবে গোছল করা যায় না কি?
বাড়ির পাশেই ইছামতী নদী। নদীটার দৈঘ্য খুব বড় কিন্তু প্রস্থ ছোট। এখন বর্ষার মৌসুম বলে পানিতে ডুবে গেছে। গ্রীষ্ম কালে শুকিয়ে যায়।
দুজন মিলে নদীতে নেমে পড়ে। নতুন পানিতে অনেক মাছ এসেছে সাথে কচুরি পানা। রুনা বলে সে মাছ ধরবে। ছোঁয়াও সায় দেয়।
ওড়নায় আঁচল বিছিয়ে মাছ ধরতে চেষ্টা করে।
সাদি রাতেও অনেকবার কল দিয়েছে কিন্তু ফোন বন্ধ ছিলো। সারা রাত ঘুম হয় নি। ওই টুকু পিচ্চি মেয়ে সাদির মতো একটা দামড়া ছেলের রাতের ঘুম কেঁড়ে নিয়েছে। মানা যায়?
ফজরের নামাজ পড়ে আবারও কল দিতে থাকে সাদি। তখন ফোন বাজলেও রিসিভ হয় না। তখন থেকেই কল দিয়েই যাচ্ছে। ছোঁয়াকে কল দেওয়ার চক্করে রান্না করার কথা ভুলেই গেছিলো। ফলস্বরূপ না খেয়েই অফিসে যেতে হয়েছে।
এখন বেলা দুটো বাজে। সাদি অফিসের ডেস্কে চেয়ারে মাথা রেখে ফোনের স্কিনে তাকিয়ে আছে৷ লান্সে যাওয়ার কথা থাকলেও যেতে ইচ্ছে করছে না। বউয়ের চিন্তায় উদাসীন হয়ে গেছে। কন্ঠটা না শুনলে গলা দিয়ে খাবার নামবে না।
এবার নাজমা বেগমের ফোনে কল দেয় সাদি।
নাজমা বেগম ছোঁয়াকে খুৃঁজতে বের হয়েছে। বিবাহিত মেয়ের এরকম ধেই ধেই করে ঘুরে বেড়ানো পছন্দ নাও হতে পারে শশুড় বাড়ির লোকদের। তাদের কানে গেলে মেয়েকে নিশ্চয় অনেক কথা শুনাবে।
নাজমা বেগমও কল রিসিভ করে না। সাদির রাগ এখন আকাশ ছুঁই ছুঁই। ওই মেয়ে এবার দু’চারটা চর খাবেই খাবেই।
এবার কল করে সিমিকে। পরিকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে একটু খানি চোখ লেগে গেছিলো সিমির। ফোনের শব্দে চোখ খুলে।
আবারও চোখ বন্ধ করে হাতিয়ে ফোন খুঁজে নেয়। বালিশের নিচে পড়েছিলো। রিসিভ করে কানে রাখে।
“তোমার বোন কই?
সিমি হ্যালো বলতে যাবে তর আগেই বাজখাঁই গলায় বলে সাদি।
সিমি এক লাফে উঠে বসে। ফোনের স্কিনে একবার তাকিয়ে আবার কানে নেয়।
“তোমার মাকে কল করলাম রিসিভ করলো না। তোমার বোনকে তো কন্টিনিউ কল করেই যাচ্ছি। নো রেসপন্স।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে সাদি।
” আসলে মা বোনুকে খুঁজতে গেছে৷
সিমি আমতা আমতা করে বলে।
“খুঁজতে গেছে মানে?
সাদির মাথায় রক্ত উঠে যায়। খুঁজতে গেছে মানে কি? কড়া গলায় ধমক দিয়ে বলে সাদি।
সিমি কিছুটা কেঁপে ওঠে।
” আসসসলে বোন সসকালে বেরিয়েছে। আগেও এরকমটা করতো।
রিনরিনিয়ে বলে সিমি।
সাদি খট করে কল কেটে দেয়৷ যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে দুই হাতে চুল খামচে ধরে। রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না।
তারপর চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস টানে।
নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে মায়ের ফোনে কল দেয়। সাবিনা বেগম রান্না করছিলেন৷ ছেলের কল পেয়ে আঁচলে হাত মুছে ফোন রিসিভ করে।
“হ্যাঁ বল
” ভাইয়া এখুনি পাঠিয়ে দাও। এক ঘন্টার মধ্যে সিমির বোনকে আমি আমাদের বাড়িতে দেখতে চাই।
খানিকটা চিৎকার করে বলে সাদি৷ সাবিনা বেগম ঘাবড়ে যায়। হঠাৎ হলো টা কি?
“ওদের তো দুদিন থাকার জন্য রেখে আসছি।
” থাকতে হবে না। অনেক থেকেছে। আর না। এবার নিয়ে এসো। এক ঘন্টা পরে কল করবো। ও এই বাড়িতে না থাকলে আমি কি করবো নিজেও জানি না।
খট করে সাদি কল কেটে দেয়। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সাবিনা বেগম। ছেলের রাগ সম্পর্কে ভালোই ধারণা তার। ছোঁয়ার ওপর খুব রেগে গেছে বুঝতেই পারছে।
ফোনটা রেখে গ্যাস বন্ধ করে সিফাতের রুমের দিকে ছোটে।
সিফাত উপুর হয়ে শুয়ে ছিলো। মেয়েকে ছাড়া কেমন উম্মাদের মতো লাগছে ছেলেটাকে। সকাল থেকে খায়ও নি। ওই বাড়ি থেকেও খেয়ে আসে নি।
“বাবু জেগে আছিস?
সাবিনা বেগম সিফাতের পাশে বসে গায়ে হাত দিয়ে বলে। সিফাত জেগেই ছিলো৷ পরিকে চোখের সামনে না দেখলে ঘুমও চোখে ধরা দেয় না।
মায়ের ডাকে ঘুরে মায়ের কোমর জড়িয়ে কোলে মাথা রেখে শয়। মুচকি হাসে সাবিনা বেগম।
“সাদু কল করেছিলো। এক ঘন্টার মধ্যে ছোঁয়াকে এই বাড়িতে নিয়ে আসতে বলছে।
সিফাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উনি।
” আমি জানতাম এমনটাই হবে। আমি যখন ওই বাড়িতে আসছিলাম তখন দেখলাম ছোঁয়া নিমের ডাল দাঁতে গুঁজে লুকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আজ দিন থাকতে বাড়িতে ঢুকবে না সেটা আমার জানা।
মুচকি হেসে বলে সিফাত। সাবিনা বেগমও হাসে। অবাক হয়ে যায় উনি এরকম উড়নচণ্ডী মেয়ে তার ছেলের সাথে শহরের এক ঘরে পরে থাকে। যেখানে সে নিজের খেয়াল খুশি মতো চলতেও পারে না। থেকে থেকে ছেলের ধমক। সবটা সয্য করে কেম৷ন পরে আছে ওনার সংসারে।
“আচ্ছা দেরি করিস না। তোর ভাইকে তো জানিস। আবার চলে না আসে বাড়িতে। নিয়ে আয় মেয়েটাকে।
সাবিনা বেগম তাড়া দিয়ে বলে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিফাত উঠে বসে। সাবিনা বেগম চলে যায়। সিফাত গায়ে শার্ট জড়িয়ে বাঁকা হাসে।
পুরো গ্রাম খুঁজে অবশেষে ইছামতী নদীতে থেকে ছোঁয়াকে খুঁজে যায় নাজমা বেগম। কান টেনে বাড়িতে নিয়ে আসে। দুটো মাছ ধরেছে ছোঁয়া। একটা টাকি আর একটা পুঁটি। ভীষণ খুশি ছোঁয়া। রুনাকে মাছ দিয়ে দিতে চাই ছিলো। তারপর আবার মনে মনে কিছু চিন্তা করে দেয় নি।
সাবিনা বেগম বাড়িতে ঢুকতেই সাদি কল করে। ছোঁয়ার কান ছেড়ে দিয়ে উনি রান্না ঘর থেকে ফোন নিয়ে রিসিভ করে
” ও বাড়িতে এসেছে।
সাদি নরম গলায় জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ বাবা। এখন নিয়ে আসলাম।
ছোঁয়া মাছ দুটো ওর খেলনা পাতির প্লেটে রেখে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সাদি কল করেছে বুঝতে দেরি হয় না। এক গাল হেসে মায়ের থেকে ফোন টেনে নেয়।
“হ্যালো সাদু বেবি আমি আজকে ইছামতী নদী থেকে দুটো মাছ ধরেছি একটা টাকি আর একটা পুঁটি। ভীষণ কিউট দেখতে৷ কিন্তু সাইজে খুব ছোট। আপনি বাড়িতে আসলে আপনাকে করলা দিয়ে রেঁধে খাওয়া মাছ দুটো কেমন?
ছোঁয়ার কথা শুনে হা হয়ে যায় সাদি জীবনেও টাকি আর পুঁটি মাছ খায় নি সে। দেখলেই কেমন লাগে।
সাদি চুপচাপ ছোঁয়ার কথা শুনে উওরে কিছুই বলে না। ছোঁয়া ফোনটা মায়ের হাতে দিয়ে রুমে চলে যায়।
তিনটার সময় সিফাত আসে। পরি আর ছোঁয়াকে নিয়ে যাবে। ছোঁয়া কান্না করে দেয়। এখানে কয়েকদিন থাকবে ভেবেছিলো। কিন্তু ছোঁয়ার কান্নায় কারো মন গলে না। সবাই চাই ছোঁয়া চলে যাক। একরাশ অভিমান জমা হয়।
পরি তো সিফাতের কোল থেকে নরছেই না। কতখন পরে বাবাকে দেখলো। সিমি তাকিয়ে আছে সিফাতের দিকে৷ কই ওকে তো নেওয়ার কথা বললো না। তাহলে কি ওকে নেবে না?
বুকটা কেঁপে ওঠে ওর। মেয়ে ছাড়া থাকবে কি করে?
ছোঁয়া যা পরেছিলো তাই পরে হাতে ব্যাগ নিয়ে ওদের সামনে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বাবা বাড়িতে নেই। দোকানে গেছে। বাড়ি ফিরতে রাত হবে।
নাজমা বেগমের চোখ দুটো ভরে আসে। আঁচলে মুখ গুঁজে দরজার কাছে এগিয়ে যায়।
” আমি আমিও যাই ওদের সাথে?
সিমি রিনরিনিয়ে বলে। নাজমা বেগম কিছু বলবে তার আগেই সিফাত বলে
“ওমা আপনি যাবেন কেনো? বিয়ে তো এখনো অনেক দেরি।
অপমানে গা রি রি করে ওঠে সিমির। সিফাত আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পরিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়৷ পরির জামা কাপড়ও নেয় না।
নাজমা বেগম কোনো কথাই বলতে পারে না। সুযোগই দেয় না।
চলবে