#যেদিন তুমি এসেছিলে
পর্ব ৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
‘এভাবে চোরের মতো এদিক-ওদিক কী দেখছ? পালাতে চাইছ? লাভ নেই। গাড়ি লক করা।’
আহনাফের এ কথায় অর্ষার প্রাণপাখি খাঁচা থেকে উড়ে যাওয়ার জোগার। কিন্তু লোকটা কি অন্তর্যামী? মনের কথা পড়তে পারে? না হলে সে কী করে জানল, অর্ষা যে সত্যি সত্যিই পালাতে চাইছে!
পুরনো টেকনিক অবলম্বন করল অর্ষা। ভয়ে কাচুমুচু হয়ে তোতাপাখির মতো বলল,’দুঃখিত। আমি দেখিনি। স্যরি, সত্যিই আমি খেয়াল করিনি।’
‘এই সস্তা শব্দটা বারবার বলবে না তো! বিরক্ত লাগে আমার। কিছু হলেই স্যরি!’
অর্ষা অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে। মানুষ ভুল করলে স্যরি বলবে না তো কী বলবে? ঘড়ির দিকে নজর পড়তেই সে তড়িঘড়ি করে বলল,’আর মাত্র পাঁচ মিনিট আছে। আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। আমি এখন যাই?’
দরজা আনলক করে আহনাফ বলল,’যাও।’
অর্ষা গাড়ি থেকে নেমে যায়। কী ভেবে যেন আহনাফও গাড়ি থেকে নামে। কিন্তু সে তো অর্ষার নামটাই জানে না। কী বলে ডাকবে? কোনো সম্বোধন খুঁজে না পেয়ে বলল,’এইযে? এই মেয়ে?’
সেই গুরুগম্ভীর কণ্ঠটি শুনে অর্ষা দাঁড়িয়ে পড়ে। লোকটার রাগ কমেনি? বকবে নাকি এখানে? সে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আহনাফ কাছে এসে মানিব্যাগ থেকে একশো টাকার দুটো নোট বের অর্ষার হাতে গুঁজে দেয়।
অর্ষা বিস্মিতকণ্ঠে জানতে চায়,’এটা কীসের টাকা?’
‘যাওয়ার সময় যাবে কীভাবে? আহিল তো আর আসবে না। আমিও তো আর তোমায় নিতে আসব না।’
অর্ষা হাসল। হেসেই বলল,’কলেজ থেকে বাড়িতে যেতে আমার দু’শো টাকার প্রয়োজন নেই। দশ টাকা লাগবে মাত্র। সেটাও আমি বন্ধুদের থেকে নিয়ে নেব। এ টাকা আমার লাগবে না। আপনাকে ধন্যবাদ, আজ আমায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য।’ কথাটা বলে সে আহনাফের হাতে টাকাটা গুঁজে একটা দৌঁড় দেয়।
আহনাফ কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এবারও মেয়েটির নাম জানা হলো না। নাম যা খুশি হোক; তাতে তার কী? এত বেশি মাথা ঘামানোর তো কিছু নেই। তাই সে আর বেশি চিন্তা-ভাবনা না করে গাড়িতে গিয়ে বসে।
কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সবটা দেখছিল জুঁই, রেশমি, লামিয়া, আশিক আর দিদার। অর্ষা উপরে আসতেই তিন বান্ধবী ওকে ঘিরে ধরে। অর্ষা ভয় পাওয়ার সাথে সাথে চমকেও যায়।
রেশমি করুণকণ্ঠে বলে,’কিরে? কতদিন ধরে চলছে এসব?’
লামিয়া ন্যাকাকান্না করে জিজ্ঞেস করে,’তুই এমনটা করতে পারলি অর্ষা? তলে তলে এতকিছু? তাও মাত্র একদিনেই?’
জুঁই গম্ভীরকণ্ঠে বলে,’সত্যি করে বল তার সাথে আগে থেকেই তোর ভাবটাব চলছে না তো?’
‘ইয়া মাবুদ! তুই এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলি? আমাদের ভাগ না দিয়ে একাই নিলি?’ আবারও ন্যাকাকান্না করে বলল লামিয়া।
ওরা একের পর এক জেরা অর্ষাকে করেই চলেছে। এদিকে সে ওদের কথার মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। আর বোঝার পূর্বেই ক্লাস শুরু হওয়ার বেল বেজে যায়। তাই সবাই একসাথে ক্লাসে চলে যায়। কিন্তু তিনজনের একজনও ওর সাথে কথা বলছে না। প্রতিদিন চারজন একসাথে এক বেঞ্চে বসলেও, আজ তিনজন ব্যাগ নিয়ে তিন বেঞ্চে গিয়ে বসেছে। ওদের এমন ব্যবহারে হতাশ হয়ে অর্ষা একাই সেই বেঞ্চে বসে পড়ে। ক্লাসের মাঝেই পাশের বেঞ্চের একটা মেয়ে কাগজের টুকরা অর্ষার হাতে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,’আশিক দিয়েছে।’
অর্ষা কাগজটি নিয়ে লুকিয়ে পড়ে। আশিক লিখেছে,’ওদের তিনজনের কথা বাদই দিলাম। আমি আর দিদার কী দোষ করলাম? তুই আমাদের কেন জানালি না?’
সবকিছু মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে তার। সে আড়চোখে একবার আশিক আর দিদারের দিকে তাকায়। ওদেরকে অর্ষার চেয়েও আরো বেশি হতাশ দেখাল। না জানি ওদেরকে না জানিয়ে কত বড়ো ভুল অর্ষা করে ফেলেছে! কিন্তু সেই ভুলটাই বা কী? ভুলটা কী জানার জন্য ও’কে চারটা ক্লাস শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হলো।
টিফিনের সময়েও কেউ অর্ষার সঙ্গে কথা বলল না। মুখ ঝামটা মেরে ক্যান্টিনে চলে যায়। অর্ষাও যায় পিছু পিছু। অসহায়ের মতো মুখ করে বলে,’না বললে বুঝব কী করে? কী করেছি সেটা তো বল।’
দাউদাউ করা অগ্নির মতো জ্বলে উঠে জুঁই বলল,’আহাগো! সোনাগো আমার। এখন ভাঁজা মাছটাই উলটে খেতে জানো না? কী করেছ তুমি বোঝোনা না?’
‘আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না বিশ্বাস কর।’
লামিয়া এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অর্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু’গালে আলতো করে হাত রেখে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে,’জান আমার,ময়নাপাখি বল সব মিথ্যে। বল তার সাথে তোর কোনো সম্পর্ক নেই?’
‘কার সাথে?’
এই প্রশ্নে লামিয়ার রাগ হলেও সে রাগ সংবরণ করে বলল,’আহিলের ভাইয়ের কথা বলছি।’
বোকা-সোকা অর্ষা আকাশ থেকে পড়ল যেন। লামিয়ার হাত সরিয়ে অবাক হয়ে বলল,’তোরা এতক্ষণ উনার কথা বলছিলি? পাগল নাকি তোরা? উনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
মুহূর্তেই সকলের চোখ খুশিতে চকচক করে ওঠে। লামিয়া খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,’আলহামদুলিল্লাহ্, আলহামদুলিল্লাহ্, আলহামদুলিল্লাহ্। ‘
ওর এত খুশি হওয়া আশিকের সহ্য হলো না। সে ব্যঙ্গ করে বলল,’তুই এত খুশি হচ্ছিস কেন? সেই তো রিকোয়েস্ট দিয়ে এখনো ঝু্লেই আছিস।’
‘তাতে তোর কী অসভ্য, বেয়া’দব! তুই বুঝবি না রে, তুই বুঝবি না। পছন্দের মানুষ নিজের হোক বা না হোক, সে সিঙ্গেল আছে জানলেও শান্তি। আমার না হলেও, এটলিস্ট অন্য কারোও তো না তাই না?’
‘সে যে সিঙ্গেল তুই এত শিওর হয়ে বলছিস কীভাবে?’ জিজ্ঞেস করল দিদার।
‘আলবৎ শিওর আমি। ১০০% শিওর। তার আইডি, ইন্স্ট্রাগ্রামে আমি চিরুনি তল্লাশি চালিয়েছি বস! কারও সাথে যদি ইন্টুপিন্টু থাকত তাহলে আমি ঠিক খুঁজে বের করতাম।’
‘গোয়েন্দা টিমে নাম লিখেয়েছিস নাকি?’ বিরক্ত হয়ে বলল আশিক।
‘ধুর না! ক্রাশগুলার জন্য একটু গোয়েন্দাগিরি করা লাগে বুঝেছিস?’
এই পর্যায়ে অর্ষা বলল,’ক্রাশ হচ্ছে অদৃশ্য একটা ফালতু খাবার। খুবই বাজে। এসব বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মন দে।’
দিদার আর আশিক বাদে বাকিরা হেসে ওঠে। রেশমি অর্ষার কাঁধ জড়িয়ে ধরে আদুরেকণ্ঠে বলে,’আমাদের বোকারানী পড়াশোনাটা না তুমিই করো কেমন? না হলে অ্যাসাইনমেন্টগুলো কে করে দেবে বলো? তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না সোনা। আহিলের ভাইয়ের বিষয়টা আমরা দেখে নেব।’
জুঁই আর লামিয়া মুখটিপে হাসে। অর্ষা বলে,’তাই বলে একটা ছেলেকে নিয়ে তোরা তিনজন টানাটানি করবি?’
জুঁই বলল,’হ্যাঁ, করব। প্রয়োজনে আমরা সতীন হব। ছেলেদের তো চার বিয়ে জায়েজ। চার নাম্বার সতীন হিসেবে না হয় তোকেই নেব। কী বলিস সবাই?’
বাকিরা এবার হো হো করে হাসতে শুরু করে। অর্ষার এসব কথাবার্তা একদম ভালো লাগে না। তবুও সে কাউকে কিছু বলল না। দিদার হাসতে হাসতে বলে,’এমন সুযোগ পেলে যে কোনো ছেলে খুশিতে নাচবে। চারটা বউ পাবে! আহা! তার তো সোনায় মোড়ানো কপাল।’
‘তোরা যে উনাকে নিয়ে এসব বলিস, আহিল শুনলে কী ভাববে বল তো?’ বলল অর্ষা।
লামিয়া ভেংচি কেটে বলল,’ধুর! কী বলবে আবার? আমরা কি ওর ভাইকে কিডন্যাপ করব নাকি? আর যদি রাগ করে, তাহলে তুই তো আছিসই। ও’কে বুঝিয়ে বলবি। রাগ ভাঙাবি। বুঝেছিস জানেমন?’
অর্ষা বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না আর। ড্রামাকুইনদের ড্রামা দেখে করুণচোখে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু।
___________
আহনাফ বাড়িতে ফিরে দেখে আহিল বাদে সবাই ঘুম থেকে উঠে গেছে। মেহমান যারা ছিল তাদেরও খাওয়া-দাওয়া শেষ। সবাই এখন বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আহনাফ ওদেরকে গাড়িতে তুলে দিয়ে খেতে বসে। আমেনা বেগম খাবার বেড়ে দিচ্ছিলেন।
আহনাফ জিজ্ঞেস করল,’তুমি খেয়েছ?’
‘না, তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। কোথায় গিয়েছিলি?’
‘একটু কাজ ছিল। তুমিও বসো। আহিল ঘুম থেকে ওঠেনি এখনো?’
‘না।’
‘আচ্ছা থাক। আরেকটু ঘুমাক।’
খেতে খেতে আফরিনকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন আমেনা বেগম। আহনাফ শুধু নিশ্চুপ হয়ে শুনছিল। এক পর্যায়ে আমেনা বেগম প্রায় চেঁচিয়েই বললেন,
‘তোর হাতে কী হয়েছে বাবু?’
আহনাফ কিছুটা বিব্রতবোধ করে। তার বর্তমান বয়স এখন ২৭। এই বয়সে এখনো মা তাকে বাবু বলে ডাকে। এমনকি বাইরের মানুষের সামনেও। এজন্য মাঝে মাঝেই তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। তবে এখন কেউ নেই, সে আর মা ছাড়া। অস্বস্তি লাগার কারণ হচ্ছে হাতে থাকা নখের আঁচড়। সে মাকে কী বলবে?
আহনাফকে নিস্তব্ধ দেখে আমেনা বেগম আরো উতলা হয়ে ওঠেন। বিমর্ষ হয়ে বলেন,’বল না বাবু কী হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি মা। কীভাবে যেন কেটে গেছে।’
তিনি এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে আসেন। আহনাফের হাত সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। আতঙ্কিতস্বরে বলেন,’এটা তো খামচি মনে হচ্ছে। এইযে পাঁচটা নখের দাগ-ই স্পষ্ট। বাবু, সত্যি করে বল তো আসল ঘটনা কী?’
আহনাফ পড়ে গেছে বিপাকে। সে মাকে কী বলবে? আহিলের বান্ধবী খামচি দিয়েছে? ইশ! একটা মেয়ে তাকে খামচি দিয়েছে এটা সে মাকে কী করে বলবে? আর মা-ই কী ভাববে! কীভাবে নেবে বিষয়টা।
আমেনা বেগমও কম যান না। তিনি দুশ্চিন্ত চিত্তে এক পলকে তাকিয়ে আহনাফের মুখাবয়ব লক্ষ্য করছেন। এক সময়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,’বাবু, তুই কি প্রেম করছিস?’
আহনাফ নিশ্চুপে তখনও খাবার খাচ্ছিল। মায়ের এহেন প্রশ্নে নাকমুখ দিয়ে খাবার বের হওয়ার জোগার। সে কাঁশতে শুরু করে। আমেনা বেগম দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে আহনাফের পিঠে হাত বুলাতে শুরু করেন।
পানি পান করে আহনাফ কিছুটা ধাতস্থ হয়। নাকমুখ, গলা, বুক জ্বলছে। সে তো মায়ের সাথে এত ফ্রি নয়। শুধু মা কেন, কারও সাথেই সে এত ফ্রি নয়। সেখানে অবলীলায় মায়ের সাথে প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে কথা বলাটা তার দিক থেকে সমুচিত নয়। মা-ও তো নাছোড়বান্দা। তিনি ফের বললেম,’বল না বাবু, তুই প্রেম করছিস?’
আহনাফ এবার কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,’না, মা। এখন কি আমার রিলেশন করার বয়স আছে?’
‘এভাবে বলছিস কেন? আমার ছেলে কি বুড়ো হয়ে গেছে?’
‘না, হোক। তবে আমার মনে হয়, এখন আর আমার এসব রিলেশন করার সময় নেই। আর সঠিক সময় এলে বিয়ে করব বলেছি তো?’
তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,’তাহলে কোন মেয়ে খাঁমচি দিয়েছে?’
বিরক্তের মাত্রা বাড়ছে আহনাফের। সব রাগ গিয়ে পড়ছে ঐ মেয়ের ওপর। মান-ইজ্জত আর কিচ্ছু বাকি রাখল না। সে সম্পূর্ণ খাবার না খেয়েই নিজের ঘরে চলে যায়। এদিকে ছেলের মতিগতি, মনোভাব কোনোটাই আমেনা বেগম ঠিক বুঝতে পারছেন না।
.
.
কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরে জামা-কাপড় পাল্টাচ্ছিল অর্ষা। তখন ঘরের দরজায় টোকা পড়ে। অর্ষা ভেতর থেকেই জিজ্ঞেস করে,’কে?’
‘আমি। দরজা খোল।’ দরজার অপর প্রান্ত থেকে বলল কুসুম।
অর্ষা তড়িঘড়ি করে জামা-কাপড় পাল্টে দরজা খুলে দেয়। কুসুম বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,’দরজা খুলতে এতক্ষণ সময় লাগে?’
‘কাপড় পাল্টাচ্ছিলাম ভাবি।’
কুসুম কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল,’তোর শাড়িটা দে।’
অর্ষা অবাক হয়। তার নিজের শাড়ি তো দূরে থাক বাড়িতে পরার জন্য তিন সেট থ্রি-পিস ছাড়া আর কোনো জামা-কাপড় নেই। উঠিয়ে রাখার মধ্যে রয়েছে একটা বোরকা আর দু’টো ভালো জামার সেট। ভাবি তাহলে শাড়ি চাচ্ছে কীভাবে?
অর্ষাকে নির্বাক, নিস্তব্ধ দেখে কুসুম ধমক দিয়ে বলল,’দাঁড়িয়ে আছিস কেন চুপচাপ? শাড়িটা দে।’
‘কোন শাড়ি ভাবি? আমার তো কোনো শাড়ি নেই।’
‘গতকাল রাতে যেই শাড়িটা পরে এসেছিলি সেটাই আমায় এখন দিয়ে দিবি। আমার শাড়িটা তো ছিঁড়েই ফেললি পোড়ামুখি!’
অর্ষার মন খারাপ হয় ভীষণ। ভাবি শাড়িটা যখন চেয়েছে, তখন সে নিশ্চয়ই দেবে। কিন্তু একটু ভালোভাবে কি চাওয়া যায়নি? মা মারা যাওয়ার আগে তার সঙ্গে ভাবির সম্পর্ক ছিল আপন বোনের মতো। কেউ বুঝতই না তারা ভাবি-ননোদ! আর মা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাবির আমূল পরিবর্তন চলে আসে। বুকচিরে তার দীর্ঘকায় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বাবা-মায়ের রেখে যাওয়া পুরনো আমলের আলমারির তাক থেকে শাড়িটা বের করে আনে সে।
কুসুম শাড়িটা প্রায় ছিনিয়েই নিল। যাওয়ার আগে বলে গেল,’আমি বাবুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। ঘরে খাওয়ার কিছু নেই। রান্না করে রাখিস। ওখান থেকে এক জায়গায় যাব। আসতে দেরি হবে আমার।’
অর্ষার এবার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত সে তেমন কিছুই খায়নি। ভেবেছিলে বাড়িতে ফিরে দুটো ভাত খাবে, সেই সৌভাগ্যটাও তার নেই! আগে রান্না করতে হবে, তারপর খেতে হবে। পেটটা খিদেয় চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সে খিদেয় ঢকঢক করে দু’গ্লাস পানি পেটের ভেতর চালান দিয়ে দিল। এতে অল্প সময়ের জন্য হলেও যদি পেটটাকে একটু মানানো যায়! তবে পেটের চাহিদা মিটল না। সে ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল। শরীর, হাত-পা দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। তবুও সে রান্না করার জন্য রান্নাঘরে যায়।
সেই সময়ে উঠোন থেকে আহিলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,’অর্ষা আছিস?’
অর্ষা দৌঁড়ে বাহিরে আসে। আহিলকে দেখে ভীষণ খুশিও হয়। তবে আহিলকে দেখাচ্ছিল মনমরা। সে এখনো আফরিনের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
অর্ষা প্রায় হেসেই বলল,’কীরে তোর এই অবস্থা কেন?’
‘তুই ফ্রি আছিস? আমার কিছু ভালো লাগছে না। চল একটু বাইরে থেকে আসি।’
আহিলকে সে প্রত্যাখান করতে পারল না। বলল,’পাঁচ মিনিট বোস। আমি বোরকা পরে আসি।’
বারান্দা থেকে একটা চেয়ার উঠানে দিয়ে সে আবার ঘরে চলে যায়। আহিল মনমরা হয়ে চেয়ারে বসে থাকে।
_________
আকাশে ভীষণ মেঘ করেছে। সন্ধ্যার অন্ধকার আর আকাশের ঘনকালো মেঘ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। একটু বাদেই ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামবে। কেয়া বসের থেকে ছুটি নিয়ে নিয়েছে। বৃষ্টি একবার আরম্ভ হলে গাড়ি পাওয়া মুশকিল। বাড়ি ফিরতেও সমস্যা হবে।
কেয়া বাড়ি ফেরার জন্য সবকিছু গোছগাছ করছিল তখন শো-রুমের মালিক এসে জিজ্ঞেস করে,’রেডি হয়ে গেছ?’
কেয়া মুচকি হেসে বলল,’জি বস।’
‘একটু পরে যাও। একটা কাস্টমার এসেছে। দেখো সে কী কী নেবে।’
কেয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলল,’জি আচ্ছা।’ তার কাজই তো এটা। সেখানে ইচ্ছা আর অনিচ্ছার কী আছে। সে কসমেটিক্সের সাইডে যায়। এক সুদর্শন ছেলে ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। কেয়া শুধু এইটুকুই শুনল,’চিন্তা করিস না। তোর দেওয়া লিস্ট দেখিয়েই সব নেব। হ্যাঁ, ঠিক আছে।’
কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিল কেয়া। ফোন রাখতেই সে সুমিষ্টি হাসি প্রদান করে বলল,’কী নেবেন স্যার?’
আহনাফ পেছনে ফিরে কেয়াকে দেখে চমকে যায়। সেই সাথে মনে মনে একটু খুশিও হয়। সেদিন অর্ষাকে বাঁচানোর জন্য অকারণেই মেয়েটাকে তার ভালো লাগে। সে মৃদু হেসে ফোন থেকে লিস্ট বের করে বলল,’লিস্টের সবকিছু।’
কেয়া লিস্ট থেকে একে একে সবকিছু বের করছিল। এরমাঝে বৃষ্টিও শুরু হয়ে যায়। সবকিছু বের করা শেষ হলে কৌতুহলবশত কেয়া জিজ্ঞেস করে,’এতকিছু কার জন্য?’
‘আমার বোনের জন্য।’
কেয়া হেসে বলল,’লাকি সিস্টার।’
প্রত্যুত্তরে আহনাফও একটু হাসল।
সব কসমেটিক্স প্যাক করে কেয়া বলল,’পেমেন্টটা সামনে করে দিন স্যার।’
‘থ্যাঙ্কিউ।’
‘মোস্ট ওয়েলকাম। আবার আসবেন।’
‘ইন-শা-আল্লাহ্।’
আহনাফ কাউন্টার সেন্টারে যাওয়ার পর কেয়াও বসকে বলে শপ থেকে বেরিয়ে যায়। তবে লাভের লাভ কিছুই হয় না। বাইরে একটা গাড়িও নেই। সে ছাতা নিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে গাড়ির জন্য চাতকপাখির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আহনাফ পেমেন্ট করে বের হয়ে কেয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে,’যাননি এখনো?’
কেয়া চিন্তিতস্বরে বলল,’গাড়ি পাচ্ছি না।’
আহনাফ দোটানায় পড়ে তাকিয়ে রইল। সে তো কেয়াকে তেমনভাবে চেনেও না। আর কেয়াও তাকে চেনে না। সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়ে লিফট্ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়াটা কি ঠিক হবে? যদি বিষয়টা অন্যভাবে নেয়? দোনোমনা করে অবশেষে বলেই ফেলল,’আপনি চাইলে আমি আপনাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিতে পারি।’
কেয়া সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে তাকায়। বিশ্বাস করবে কি করবে না ভাবছে। কেয়ার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে আহনাফ বলল,’আমরা কোনো না কোনোভাবে কিন্তু পরিচিত।’
কেয়া ভারী অবাক হয়ে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,’কীভাবে?’
‘আহিল নামে কাউকে চেনেন?’
‘হ্যাঁ, অর্ষার ক্লাসমেট।’
আহনাফ মনে মনে বলে,’ওহ আচ্ছা! মেয়েটার নাম তাহলে অর্ষা।’ কিন্তু মুখে বলল,’আমি আহিলের বড়ো ভাই।’
কেয়া এবার খুশি হয়। বিপদের সময় তো কাউকে পাওয়া গেল! সে হেসে বলল,’তাই নাকি? তাহলে তো খুবই ভালো হলো।’
‘চলুন তবে।’
দুজনে গিয়ে গাড়িতে ওঠে। ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার দরুণ আহনাফ বরাবরের মতো চুপ থাকে। অন্যদিকে ক্লান্ত থাকার কারণে কেয়াও চুপচাপ বসে থাকে। বাড়ির সামনে গিয়ে কেয়া বলে,’ভেতরে আসুন। চা খেয়ে যান।’
‘আজ নয়। অন্য একদিন।’
‘শিওর?’
‘ইন-শা-আল্লাহ্।’
কেয়া হেসে বলল,’ঠিক আছে।’
এরপর সে ছাতা নিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়। আহনাফ জানালার কাচ নামায়। কেয়া বাড়ির মূল ফটকের সামনে গিয়ে কেয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। আহনাফও সেদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। অর্ষাকে বৃষ্টির মধ্যে উঠানে দাঁড় করিয়ে কুসুম বারান্দায় দাঁড়িয়ে বড়ো লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে; আর অর্ষা চুপচাপ দাঁড়িয়ে কান্না করছে। মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার। তড়িঘড়ি করে সে গাড়ি থেকে নামে। ইতিমধ্যে কেয়া দৌঁড়ে ভেতরে গেছে।
কেয়ার সাথে আহনাফও দৌঁড়ে ভেতরে যায়। কেয়া কুসুমের থেকে লাঠিটা নেওয়ার জন্য জোড়াজুড়ি করতে থাকে। অর্ষা সরছে না দেখে আহনাফ ক্ষোভে ওর দু’বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,’সত্যিই পাগল তুমি? এভাবে দাঁড়িয়ে মার খাচ্ছ কেন?’
পরক্ষণেই সে টের পায় অর্ষার গায়ের তাপমাত্রা অনেক বেশি। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। সে আচমকা অর্ষাকে এক হাতে জড়িয়ে কেয়াকে বলে,’ওকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।’
চলবে…