#যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব ২২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুলের বাচ্চারা আজ কিছুতেই পড়তে চাচ্ছে না। অর্ষার স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে যায়। স্কুলে থাকতে বৃষ্টি হলে ওরা-ও কখনো ক্লাস করতে চায়নি। আসলে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দে ক্লাসে মন বসতোই না। বান্ধবীরা মিলে জানালার কাছে বসে থাকত। টিচারের অগোচরে জানালার কপাট খুলে রেখে বৃষ্টিতে হাত ছোঁয়াত। কত মধুর ছিল সেই সময়গুলো! এছাড়া তখন ক্লাসেও উৎসব উৎসব একটা ভাব চলে আসতো। বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি যেমন অত্যাবশ্যক খাবার মনে হয় তেমনই; ক্লাসে তখন গান গাওয়াটাও ছিল অত্যাবশ্যক। কেউ গান পারুক আর না পারুক তাও গাইতে হতো। গান না পারলেও তখন সমস্যা ছিল না। বৃষ্টির শব্দের কারণে অত মানুষের কান অব্দি গান যেত-ই না। সকলে তো টিনের চালে পড়তে থাকা বৃষ্টির রিমঝিম শব্দই শুনত।
অনেকদিন বাদে স্কুলের পুরনো সময়গুলো স্মৃৃতিচারণ করে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে অর্ষা। আজ তার ক্লাসেও বাচ্চারা গান গাইছে, হৈ-হুল্লোড় করছে। ওদের মাঝেই যেন নিজের সেই ছোট্ট বেলার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে সে। সেই সাথে দু’হাত ভরে কুড়িয়ে নিচ্ছে অতীতের সুখ, আনন্দগুলো।
স্কুলের দপ্তরি এসে ক্লাসের দরজার সামনে দাঁড়ায়। অর্ষার উদ্দেশ্যে বলে,’ম্যাডাম, আপনের ভাই আসছে দেখা করতে।’
ভ্রুঁ কুঞ্চিত হয় অর্ষার। এই অসময়ে,বৃষ্টির মধ্যে রুহুলের স্কুলে আসার কারণ কী?
অর্ষা বলল,’বসতে দিন। আমি আসছি।’
দপ্তরি চলে যাওয়ার পর অর্ষা ক্লাসের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বলল,’আমি এখনই চলে আসব। তোমরা কেউ বাইরে বের হবে না। আর ক্লাসে একদম চেঁচামেচি করবে না।’
সকলে সমস্বরে বলল,’আচ্ছা ম্যাম।’
‘আচ্ছা ম্যাম’ বললেও যে সবাই দুষ্টুমি, মারামারি, চেঁচামেচি করবে; এমনকি কয়েকজন বাইরেও বের হবে এটা অর্ষা খুব ভালো করেই জানে। সময়টা তো সেও পার করে এসেছে এক সময়।
টিচার রুমে অপেক্ষা করছিল রুহুল। অর্ষাকে ভেতরে যেতে দেখে বলল,
‘বারান্দায় চল।’
অর্ষা আর ভেতরে না গিয়ে বারান্দাতেই গেল। রেলিঙের সাথে দাঁড়িয়ে বলল,’হঠাৎ?’
‘কেমন আছিস?’ জিজ্ঞেস করে রুহুল।
অর্ষা মাথাটা মৃদু নাড়িয়ে বলল,’আলহামদুলিল্লাহ্। তুমি?’
‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ্। কিন্তু একটু সমস্যা হয়েছে। এজন্যই তোর কাছে আসা।’
‘কী হয়েছে?’
‘একটু ঝামেলার মধ্যে আছি। এক মাসে বেশ ঋণ জড়িয়ে পড়েছি। টাকার জন্য মানুষজন চাপ দিচ্ছে খুব।’
‘ঋণ? কী করে ঋণ করলে?’
‘এইতো তোর বিয়ের খরচ, আবার সংসার কত কী!’
‘আমি যতটুকু জানি বিয়ের খরচবাবদ সমস্ত টাকা আহিলের বাবা দিয়েছিল।’
‘ঐ টাকায় কি সব হয়েছে নাকি? ধার করতে হয়েছিল না?’
অর্ষা ভাইয়ের চোখের দিকে তাকায়। কেন জানি মনে হচ্ছে রুহুল মিথ্যা বলছে। আর যাই হোক,বিয়ের খরচের জন্য একটা টাকাও সে নিজের পকেট থেকে দেয়নি। বলা বাহুল্য দিতে হয়নি।
সে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,’এখন কী করবে তাহলে?’
‘কী করব? তুই আমাকে সাহায্য করবি।’
‘আমি?’
‘হ্যাঁ। এত বড়ো বাড়িতে বিয়ে হয়েছে। আর ভাইকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারবি না?’
‘তুমি বলতে চাইছ আমি তাদের কাছে টাকা চাইব?’
‘প্রয়োজন হলে তো চাইতেই হবে। তুই টাকা চাইলে ওরা তো আর ফিরিয়ে দেবে না।’
‘দেখো ভাইয়া, আমি তাদের থেকে কোনো টাকা চাইতে পারব না। তোমার যদি খুব বেশি প্রয়োজন হয়, তাহলে ক’টা দিন অপেক্ষা করো। আমি বেতন পেলেই পুরো টাকা তোমায় দিয়ে দেবো।’
রুহুল ক্ষেপে যায়। ধমকে ওঠে সে অর্ষাকে। তার গর্জন বৃষ্টির গর্জনের কাছে নস্যি বলে অর্ষা ব্যতীত অন্য কারও কর্ণকুহর অব্দি প্রবেশ করতে পারেনি।
রুহুল চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’কয় টাকা পাস তুই? সাত হাজার না আট হাজার? ঐ টাকায় আমার কিছুই হবে না। আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে।’
হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে অর্ষা। অস্ফুটস্বরে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,’পঞ্চাশ হাজার!’
‘হ্যাঁ, পঞ্চাশ হাজার। আপাতত বিশ হাজার নিয়ে দে।’
‘আমি কী বলে তাদের থেকে এত টাকা নেব?’
‘যা খুশি কিছু একটা বলবি।’
একটু থেমে সে অর্ষার হাত ধরে। ইমোশোনাল হয়ে বলে,’প্লিজ বনু! আমার দিকটা একটু ভাব। প্রতিদিন মানুষের কথা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। না করিস না সোনা বোন! ভাইকে সাহায্য কর।’
অর্ষা একটুখানি মৌন থেকে বলল,’আচ্ছা। আমায় দু’দিন সময় দাও।’
‘দু’দিন পর দিবি তো?’
‘হ্যাঁ।’
রুহুল অর্ষার গালে হাত রেখে বলল,’আমার লক্ষী বোন। আসছি এখন।’
এরপর সে ছাতা মেলে স্কুল থেকে চলে যায়। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অর্ষা। শ্বশুরের থেকে সে টাকা তো নেবে না। বিয়ের সময় আহনাফের আত্মীয়-স্বজন, মেহমান অনেকেই মুখ দেখে,আদর করে টাকা দিয়েছিল। সব মিলিয়ে ষাট থেকে থেকে সত্তর হাজার টাকা হবে সম্ভবত। সে ঠিক করেছে সেখান থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা রুহুলকে দিয়ে দেবে। ভাই তবুও ভালো থাকুক।
অর্ষা ক্লাসে ফিরে যায়। বৃষ্টিও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। ক্লাস শেষ করে বাড়ির পথে রওনা হয় সে। সব সময়ের মতো আজও রিকশার সংকট দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি হলে রিকশা কি আকাশের চাঁদ হয়ে যায় নাকি আল্লাহ্ মালুম!
সে কাদা-পানির মাঝে খুব সাবধানে পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তার অপজিট থেকে হঠাৎ কারও ডাক শুনতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটি ছেলে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসে।
একগাল হেসে অর্ষাকে বলে,’আমায় চিনতে পেরেছ? আমি হাফিজ।’
অর্ষা মৃদু হেসে বলল,’হ্যাঁ। কেমন আছো?’
‘আমি তো আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো বলো?’
‘আমিও ভালো।’
‘হঠাৎ করে তোমার কী হয়েছে বলো তো?’
‘কই! কিছু না তো।’
‘কিছু না হলে এমন উধাও হয়ে গেছ কেন? শো-রুমে আসো না। কেয়া আপুরও কোনো খোঁজ নেই। তোমায় অনেক খুঁজেছি জানো। ফোন নাম্বারও নেই যে যোগাযোগ করব।’
অর্ষা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’আমি তো ফোন ব্যবহার করতাম না।’
‘ওহ, হ্যাঁ! স্যরি ভুলে গেছিলাম। এবার বলো, কাজে কেন আসো না?’
একটুখানি সময় চুপ করে থেকে অর্ষা বলল,’আমার বিয়ে হয়ে গেছে।’
হাফিজ একটু থমকাল। মুখের হাসিটা যেন মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল তার। তবুও সে মিথ্যে হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘মজা করছ?’
‘না, মজা কেন করব? সত্যিই বলছি।’
‘হঠাৎ করে বিয়ে! কীভাবে কী? আমি তো কিছুই বুঝতেছি না।’
একটু সময় নিয়ে অর্ষা সংক্ষেপে বিস্তারিত সব বলল। সব শুনে মন খারাপ হয়ে যায় হাফিজের। কিছু বলার মতো ভাষাও খুঁজে পাচ্ছে না।
অর্ষা হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’অন্য একদিন কথা হবে হাফিজ। ঐযে ঐ স্কুলটা দেখছ? আমি এখন ওখানেই জব। একদিন সময় করে এসো।’
‘হুম।’
‘আজ তাহলে আসি? আল্লাহ্ হাফেজ।’
‘সাবধানে যেও।’
অর্ষা মৃদু হেসে হাঁটা ধরে। হাফিজ নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নত করে। বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সেও হাঁটা ধরে। মেয়েটা ভীষণ বোকা! একবারও বুঝতে পারল না, হাফিজের মনে তার জন্য সুপ্ত এক অনুভূতি ছিল। সেই অনুভূতির লাগাম টানতে হবে এবার অতিসত্বর।
.
.
জহির চৌধুরীর শরীর খুব একটা ভালো নয়। বেশ কয়েক দিন ধরেই তিনি বাড়িতে রেস্ট নিচ্ছেন। তার বদলে অফিসের দেখভাল করছে এখন আহিল। আহিল এখনো অদক্ষ। তাই তাকে সম্পূর্ণ সময় গাইড করছে অফিসের বিশ্বস্ত ম্যানেজার। আজকাল আহিলও বিজি অফিস নিয়ে।
অর্ষা সরাসরি আগে জহির চৌধুরীর রুমে যায়। তিনি টিভিতে নিউজ দেখছিলেন।
‘কেমন আছেন এখন?’ ভেতরে যেতে যেতে বলল অর্ষা।
তিনি টিভি অফ করে বললেন,’ভালো আছি মা। বসো। একি! ভিজে গেছ তো অনেকটা।’
‘ও কিছু না। মাত্রই তো এলাম তাই।’
‘বৃষ্টির মধ্যে ভিজে আসার কী দরকার ছিল? ফোন করতে আমায় ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিতাম।’
‘আপনি অস্থির হবেন না তো। আমি একদম ঠিক আছি।’
‘এখন ঠিক আছো। পরে না-ও থাকতে পারো। যদি জ্বর চলে আসে? ফোন গিফ্ট করলাম পছন্দ হয়নি?’
‘কী যে বলেন! পছন্দ কেন হবে না?’
‘তাহলে ফোনের ব্যবহার কেন করছ না? ফোন দাওনি কেন?’
‘আমি এতকিছু ভাবিনি তখন। এখন আপনি একটু রিল্যাক্স হোন তো।’
‘আমার আর রিল্যাক্স! সবকিছু কেমন যেন হয়ে গেল। বড়ো ছেলেটা একটু খোঁজ-খবরও নেয় না। আমি ফোন করলেও রিসিভ করে না।’
এ কথার পিঠে অর্ষার কিছু বলার নেই বলে সে চুপ হয়ে যায়। জহির চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন,
‘তুমি যাও তাড়াতাড়ি জামা-কাপড় পালটে নাও। পরে কিন্তু ঠান্ডা লেগে যাবে।’
‘যাচ্ছি।’
‘যাচ্ছি নয়, এখনই যাও। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে-দেয়ে আসো। তারপর গল্প করব বাপ-বেটি মিলে।’
অর্ষা মুচকি হেসে বলল,’আচ্ছা।’
সে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংরুমে খেতে আসে। আমেনা বেগম ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
অর্ষা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,’আপনি এখনো খাননি?’
‘ক্ষুধাই লাগে না। কী করি বলো তো!’
‘এভাবে তো আপনিও আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’
তিনি আর কিছু বললেন না। অর্ষা সন্তর্পণে জানতে চাইল,’মন খারাপ?’
‘না, ঠিক আছি। তুমি খাও।’
অর্ষা আর কিছু না বলে চুপচাপ খাওয়া শুরু করে। তবুও মনের ভেতর একটা খুতখুতানি রয়েই যায়। খাওয়া শেষ করে তিনি চলে যাওয়ার পর অর্ষা রেণুকে জিজ্ঞেস করে, সে কিছু জানে নাকি।
উত্তরে রেণু হতাশ হয়ে বলে,’বড়ো ভাইজানের চিন্তায় এমন অবস্থা হইছে।’
টেবিল গুছিয়ে সে আবার শ্বশুর-শাশুড়ির রুমের দিকে যায়। আমেনা বেগম জহির চৌধুরীকে বলছিলেন,’এভাবে কী হয় বলো তো? ছেলে বাউণ্ডুলে হয়ে বিদেশে পড়ে আছে। মেয়েটা এখানে ছন্নছাড়া জীবন কাটাচ্ছে। এটা কি সংসার? এভাবে কি ওরা কখনো কেউ কাউকে বুঝতে পারবে?’
‘আমরা কী করতে পারি?’ জানতে চাইলেন জহির চৌধুরী।
‘অর্ষাকে আহনাফের কাছে পাঠিয়ে দেই?’
‘ও কি রাজি হবে? তাছাড়া হিতে যদি বিপরীত হয়?’
‘বিপরীত কী হবে? অর্ষা একবার আহনাফের কাছে গেলে আহনাফ তো আর ও’কে তাড়িয়ে দেবে না। অন্তত আহনাফ এটা কখনোই পারবে না। এই কাজ আমার ছেলে করবে না।’
জহির চৌধুরী চিন্তিত হয়ে বললেন,’এমনটাই সম্ভবত করা উচিত। নয়তো দুজনের জীবনই নষ্ট হয়ে যাবে। আমি তো ভাবছি অর্ষা রাজি হবে কিনা এই নিয়ে।’
‘বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই রাজি হবে।’
‘আচ্ছা দেখছি। আমি কথা বলব ওর সাথে।’
লুকিয়ে কারও কথা শুনতে হয় না। তবে এ কথাগুলো অর্ষা না শুনেও থাকতে পারেনি। তার কৌতুহলী মন তাকে এখানেই আটকে রেখেছিল। দরজার আড়াল থেকে এ সমস্ত কথা শুনে সে আর ভেতরে যায়নি। নিজের রুমে চলে গেছে।
কিছুক্ষণ রুমে পায়চারি করে ম্যাসেঞ্জারে ‘গ্যাঞ্জাম পার্টির’ গ্রুপে ভিডিয়ো কল করে অর্ষা। একে একে সবাই জয়েন হয়।
আশিক প্রথমেই তার অবান্তর কবিতা দ্বারা কথোপকথন শুরু করে। বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে বলে,
‘অর্ষা তোর দু’চোখে কেন দুশ্চিন্তার বর্ষা?’
রেশমিও বলল,’কী হয়েছে রে অর্ষা? মন খারাপ নাকি তোর?’
দিদার বলে,’মুখটা ওমন করে রাখছিস ক্যান? দুলাভাই কি ডিভোর্স দিছে?’
লামিয়া ধমক দিয়ে বলে,’হারা’মজাদা! লা’ত্থি খাবি। ফালতু কথা বলস ক্যান?’
‘ঐ খাড়া আহিল কই? ব্যাটায় দেখি দশ ঘণ্টা আগে একটিভ ছিল। অফিসেই থাকে নাকি দিন-রাত?’ বলল আশিক।
জুঁই সবাইকে থামিয়ে বলল,’তোরা থাম তো। অর্ষাকে বলতে দে কী হইছে।’
এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেয়ে অর্ষা বলল,’সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেছি।’
‘বিস্তারিত বল কী হয়েছে।’
শ্বশুর-শাশুড়ির বলা কথাগুলোই সে বন্ধুদের বলে। সব শুনে ওরাও সায় দেয়। ওরাও অর্ষাকে বুঝিয়ে বলে সম্পর্কটাকে অন্তত একটা সুযোগ যেন দেয় সে। বন্ধুরা এতভাবে বোঝালেও অর্ষার মন দোনোমনা করছিল।
________
দু’দিন পরের কথা। অর্ষা স্কুলে থাকতেই রুহুল ফোন করে। ভাই সচারচর তাকে ফোন করে না। সে তো টাকা যা চেয়েছিল দিয়েছে, তাহলে এখন আবার হঠাৎ ফোন কেন?
সে ফোন রিসিভ করার পর রুহুল অন্য কোনো প্রসঙ্গে না গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,’তোর স্কুল ছুটি কয়টায়?’
‘তিনটায়।’
‘ছুটির পর বাসায় আসিস। তিয়াসের খুব জ্বর। তোর কথা বলতেছে সকাল থেকে।’
তিয়াস অসুস্থ শুনে বুকটা কেঁপে ওঠে অর্ষার। সে জিজ্ঞেস করে,’হঠাৎ করে জ্বর আসলো কীভাবে?’
‘আর বলিস না, সারাক্ষণ পানি নিয়ে খেলে। তোর ভাবি কাজ করছিল তখন বৃষ্টিতে গিয়ে ভিজেছে।’
‘ডাক্তার দেখিয়েছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা আমি ছুটির পর বাসায় যাব। ক্লাসে আছি এখন। রাখছি।’
‘আচ্ছা ঠিকাছে।’
ফোন রাখলেও মনে শান্তি পাচ্ছিল না অর্ষা। ছোটোবেলা থেকে তিয়াসকে সে রেখেছে। তিয়াসও মায়ের চেয়ে কম ভালোবাসে না অর্ষাকে। পুত্রতুল্য তিয়াস অসুস্থ শুনে মাতৃমন কষ্টে ছেঁয়ে যায় অর্ষার। কোনো রকম সে ক্লাসটা শেষ করে প্রিন্সিপালের থেকে ছুটি নিয়ে নেয়। এভাবে অস্থিরতার সাথে ক্লাস নেওয়া মুশকিল। বাড়ি যাওয়ার আগে সে কিছু ফলমূল আর তিয়াসের পছন্দের চকোলেট নিয়ে নেয়।
বাড়ি গিয়ে দেখে তিয়াস খুব কান্না করছে। কুসুম ও’কে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।
অর্ষাকে দেখে কুসুম তিয়াসের উদ্দেশ্যে বলল,’ঐ দেখো কে এসেছে।’
তিয়াস এক পলকের জন্য কান্না থামিয়ে বাড়ির মূল ফটকের দিকে তাকায়। অর্ষাকে পেয়ে তার কান্না পুরোপুরি থেমে যায়। অর্ষাও ততক্ষণে কাছে এসে পড়েছে। সে হাত বাড়িয়ে তিয়াসকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে।
আহ্লাদী হয়ে বলে,’কী হয়েছে আমার বাবাটার? আমার সোনা বাবা কান্না করে কেন?’
তিয়াস কিছু বলে না। শুধু ঠোঁট ফোলায়। এক্ষুণী আবার কেঁদে দেবে দেবে ভাব। অর্ষা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,’ওলে আব্বুটা! কান্না করে না। দেখো ফুপি তোমার জন্য কী এনেছি।’
সে চকোলেটগুলো দেখায় তিয়াসকে। এবার সে হাসে। চকোলেট নিয়ে খাওয়া শুরু করে। কুসুমের দিকে বাকি ফলমূলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলে,’এগুলো ভেতরে নাও ভাবি।’
কুসুম প্যাকেটগুলো নিয়ে ভেতরে গেল। অর্ষা তিয়াসকে নিয়ে বারান্দাতেই রইল। কিছুক্ষণ বাদে কুসুম ফলমূল কেটে আনে। মোড়া এগিয়ে দিয়ে বলে,’বসে খেয়ে নে আগে।’
‘আমার এখন খিদে নেই ভাবি।’
‘ফল খেলে পেট ভরবে না। তোর ভাই যে বলল তিনটায় আসবি। তাই আর কিছু রান্নাও করিনি আমি। ঘরে সকালের রান্না করা ইলিশ মাছের তরকারি শুধু।’
‘স্কুল তিনটা বাজেই ছুটি হয়। তিয়াস অসুস্থ শুনে আমি আগেই ছুটি নিয়ে এসে পড়েছি।’
‘আচ্ছা বোস এখন। ফল খেতে থাক আমি তরকারি গরম করি।’
‘আমি এখন কিছুই খাব না ভাবি।’
কুসুম অবশ্য ওর কথা শুনল না। তরকারি গরম করে চুলায় ভাত বসাল। ভাত বসিয়ে অল্পবিস্তর তিয়াসকে নিয়ে গল্প বলল। ভাত রান্না শেষে ডিম ভাজি করে বলল,
‘তিয়াসকে আমার কাছে দে। তুই হাত-মুখ ধুয়ে আয়।’
কুসুমের হঠাৎ এমন পরিবর্তনে অর্ষা অবাক না হয়ে পারল না। অবাক যেমন হয়েছে, তেমন খুশিও হয়েছে। সে এত বেশি ইমোশোনাল যে, চোখে পানিও চলে এসেছে। তিয়াসকে নেওয়ার জন্য কুসুম হাত বাড়ালেও তিয়াস গেল না।
অর্ষা ও’কে কোলে নিয়েই মুখ ধুয়ে খেতে বসল। নিজের সাথে সাথে তিয়াসকেও খাইয়ে দিচ্ছে।
কুসুম পাশেই বসে ছিল। বলল,’আহনাফের কী খবর? কবে আসবে বলছে কিছু?’
‘না। আমার সাথে কথা হয়নি।’
‘কী বলিস! যাওয়ার পর একবারও কথা হয়নি? এমন হলে সংসার চলবে কীভাবে।’
অর্ষা নিশ্চুপ। কুসুম বলল,’যা হোক, তোর ভাইকে এতগুলো টাকা দিলি কোত্থেকে? তোর শ্বশুর দিছে?’
‘না। ওগুলো বিয়েতে ঐ বাড়ির আত্মীয়-স্বজন, মেহমানরা আমায় দিয়েছিল।’
‘ও।’
একটু থেমে কুসুম ফের বলল,’তোর গলার চেইনটা তো সুন্দর। কে দিয়েছে?’
‘ফুপি।’
‘ওহ। ভালোই তো জিনিস, টাকা-পয়সা পেয়েছিস।’
অর্ষা কৃত্রিম হাসে। সন্ধ্যা অব্দি এই বাড়িতে থেকে তিয়াসকে ঘুম পাড়িয়ে অর্ষাও বিদায় নেয়। শ্বশুরবাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল বলে, দেরি করে আসায় তারা কোনো দুশ্চিন্তা করেনি।
নাস্তার টেবিলে বসে অনেক ভেবে-চিন্তে আমেনা বেগম এবং জহির চৌধুরী অর্ষার সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার প্রসঙ্গ তোলেন।
জহির চৌধুরী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলেন,’দেখো মা, আমরা কিন্তু তোমাকে জোর করছি না। শুধু রিকোয়েস্ট করছি। রিকোয়েস্ট যে রাখতেই হবে এমনও কোনো কথা নেই। তোমার ইচ্ছে না হলে যাওয়ার দরকার নেই।’
চামচ দিয়ে চায়ের কাপে চা নাড়ছিল অর্ষা। আর চুপচাপ কথা শুনছিল। এই মানুষগুলোর প্রতি সে ভীষণ কৃতজ্ঞ। এছাড়া ঐ মানুষটার প্রতি তার কোনো টান কিংবা অনুভূতি না থাকুক, কাগজে-কলমে তো সে তার স্বামী হয়। তার জন্য না হয় সে সুইজারল্যান্ড গেল-ই।
সে চামচ পিরিচের ওপর রেখে মৃদু হেসে বলল,’আমি যাব।’
আমেনা বেগম কিংবা জহির চৌধুরী কেউই ভাবতে পারেনি অর্ষা যে রাজি হবে। অর্থাৎ অর্ষার সম্মতি তাদের নিকট অপ্রত্যাশিত ছিল।
জহির চৌধুরী সন্তুষ্টচিত্তে অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন,’এই সপ্তাহের মধ্যেই আমি তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।’
______
‘আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে
তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালবেসে।’
গাড়িতে শ্রেয়া ঘোষালের এই গানটি চলছিল। অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি আসে অর্ষার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার। সে অনেক বেশি নার্ভাস ফিল করছে। বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। যাওয়ার ডেট এত দ্রুত ফিক্সড করা হয়েছিল যে বন্ধুদের সাথে দেখা করারও সুযোগ হয়নি। এখন তো একেকজন একেক জায়গায় আছে। ওদের ফিরতেও সময় লাগবে। তাই দেখা হলো না।
এয়ারপোর্ট পৌঁছে ইমিগ্রেশন অব্দি অর্ষাকে এগিয়ে দিলেন জহির চৌধুরী। সবকিছু বারবার করে বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই প্রথম অর্ষা বাংলাদেশের বাইরে কোথাও যাচ্ছে। একদিকে যেমন ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা কাজ করছে, অপরদিকে বেশ ভয়ও লাগছে।
প্লেনে ওঠার পর ভয়ের সাথে নার্ভাসনেসও কাজ করছে। তার মতো আরো অনেক বাঙালিই আছে এখানে। তবে এখানে যে যার মতো। অর্ষার চোখ আটকায় এক কাপলের দিকে। তারা অর্ষার অপজিটে বসেছিল। দুজনে বেশ খুনসুটি করছে। এই দৃশ্য দেখে অর্ষার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। সে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে পড়তে শুরু করে।
বেশ কিছুক্ষণ পর পাশের সেই কাপল মেয়েটির হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায় অর্ষার পায়ের কাছে। অর্ষা ফোনটি তুলে দেয়।
মেয়েটি হেসে বলে,’থ্যাঙ্কিউ।’
অর্ষাও মৃদু হেসে বলল,’ওয়েলকাম।’
‘তুমি একা?’ জানতে চাইল মেয়েটি।
অর্ষা ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নাড়াল। মেয়েটি বলল,’ওহ। কোথায় যাচ্ছ?’
‘সুইজারল্যান্ড।’
‘আমরাও সুইজারল্যান্ড-ই যাচ্ছি। আমি একচুয়ালি জানতে যাচ্ছি, সুইজারল্যান্ডের কোথায় যাচ্ছ?’
‘আমার হাজবেন্ড থাকে ওখানে।’
‘আই সি! আমরা যাচ্ছি হানিমুনে। বাই দ্য ওয়ে, আমি যুথিকা।’ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল মেয়েটি।
অর্ষাও হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল,’অর্ষা।’
অর্ষা খেয়াল করেছে ছেলেটি যুথিকার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। যুথিকা একবার সেদিকে তাকিয়ে বলল,’বড্ড ঘুমপাগল আমার বর! আবার এমনিতেও কয়েকদিন ধরে বেশ জার্নি করা হয়েছে তো, তাই তেমন ঘুমাতেও পারেনি।’
অর্ষা নিরব থেকে হাসল শুধু। যুথিকা তার বিয়ের গল্প বলল, বাংলাদেশে কোথায় থাকে, কোথায় কোথায় ঘুরেছে সব গল্প করছে অর্ষার সাথে। অর্ষারও শুনতে খারাপ লাগছে না। এটলিস্ট তার সময় তো কাটছে!
প্লেন ল্যান্ড করার পর এয়ারপোর্টেও দুজনের গল্প চলল। অবশেষে যুথিকা ওর হাজবেন্ডকে নিয়ে বিদায় নেয়। এদিকে ইমিগ্রেশন পার হয়ে চারপাশে অর্ষা আহনাফকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। জহির চৌধুরী বলেছিলেন, অর্ষা পৌঁছেই এয়ারপোর্টে আহনাফকে পাবে। কিন্তু তাকে তো কোথাও পাওয়া যাচ্ছে। এত আলোকসজ্জার মাঝে রাত কত হয়েছে সেটাও সে জানে না। আরেকটু এগিয়ে যেতেই ব্যস্তভাবে সামনে আসা এক ছেলের সাথে ধাক্কা লাগে অর্ষার। লাগেজটি হাত থেকে ছিটকে পড়ে। সেই সাথে স্লিপ খেয়ে নিজেও পড়ে যায়।
ছেলেটি ততক্ষণে সামনে এগিয়ে গেলেও আবার পেছনে আসে। অর্ষার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,’আ’ম সো স্যরি।’
অর্ষা ব্যথায় মুখটা বিকৃতি করে একাই উঠে দাঁড়াল। লজ্জিত ভঙ্গিতে একবার আশেপাশেও তাকাল। না, বাংলাদেশের মানুষজনের মতো এরা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে নেই।
এদিকে অর্ষা হাত না ধরে একাই উঠেছে বলে ইগোতে লাগে সামনে থাকা ছেলেটির। সে তীক্ষ্ণভাবে অর্ষাকে নোটিশ করে। ব্লু জিন্সের সাথে সাদা রঙের একটা কামিজ পরা। গলায় ওড়না ঝুলানো। পায়ে সাদা কেডস্। গায়ের রঙ শ্যামলা। দেখেই মনে হচ্ছে বাঙালি। বাঙালি একটা মেয়ে তার মতো চকোলেট বয়কে এভাবে অগ্রাহ্য করল? স্ট্রেঞ্জ! নিজে নিজেই এসব ভেবে বিস্মিত হয় হেলেন। সে তো এসেছিল বাংলাদেশ থেকে আসা তার ভার্সিটির এক বান্ধবীকে রিসিভ করতে। হুট করে যে এখানে এই অঘটন ঘটে যাবে তা কে জানত?
সে ব্যাপারটিকে আর না ঘাটিয়ে অর্ষাকে আবার স্যরি বলে চলে গেল। অর্ষাও লাগেজটি তুলে নিয়ে সামনে এগোতে থাকে। তার দু’চোখ শুধু আহনাফকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
চলবে…