### দাম্পত্য সুখ ১৩ তম পর্ব
### লাকি রশীদ
কিসের আর আমার খাওয়া। শুধু গাড়ি আসতে আসতে আমার শাশুড়ি কে ৫/৬ টেবিল চামচ ভাত খেতে বলি। ভদ্রমহিলা অসুস্থ হলে, আবার আমি কোন পরিস্থিতিতে পড়বো…. বাইরে বেশি না বেরোনোয় আমার মধ্যে এক ধরনের ভীতি ই কাজ করে। উনার বোনপোর কথা মতো নির্দিষ্ট
ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি, উনার বোনঝির অনেক বড় ফাড়া কেটেছে বলা যায়। বয়সে তিনি শাহীনের প্রায় ২ বছরের বড়। কিন্তু,অস্থিচর্মসার রেণু আপা
কে দেখলে ১০ বছরের বড় মনে হয়। উনার এই এক ভাই। বোন কে বিয়ে দিয়েছিলেন বড় গৃহস্থের সাথে প্রায় ৩৫ বছর আগে। ভালো ই চলছিল, কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে উনার যখন বাচ্চা হয়
নি ৫ বছর পর উনার স্বামী আবার বিয়ে করলেন।
ভাইয়ের বৌ উনাকে বিষচোখে দেখেন বলে, উনি
স্বামীর সংসারে থেকে যান। কিন্তু, উনার সতিন এই বয়সেও মিথ্যে কথা স্বামীর কানে দিয়ে,৫ দিন আগে উনাকে মার খাইয়েছে। মাসে এক আধবার
উনি মার খান, কিন্তু এবার পাষন্ড স্বামী উঠোনে শুকোতে দেওয়া চ্যালাকাঠ দিয়ে মেরেছে। পরে, অবস্থা খারাপ দেখে উনার ভাই মজিদ কে ডেকে
এনে ঢাকায় পাঠিয়েছে। আগামীকাল উনাকে ছেড়ে দিবে। উনি সংসারে ফিরতে চান না। ভাই এর সংসারেও ঠাঁই নেই। বাধ্য হয়ে আমার শাশুড়ি কে ফোন দিয়েছেন। আমার হাত ধরে বলছেন,
“তোমার কোনো কাজের লোক লাগবে না। সব কাজ ঘরের আমি করবো। আমি এসএসসি পাশ। তোমার ছোট বাচ্চা থাকলে পড়াতেও পারবো। আমাকে ঘরের মেঝেতে একটু ঠাঁই দাও বোন। তোমার অনেক ভালো হবে”।
এসব দেখলে আমার বুকের ভেতর টা শরতের
কাশবন হয়ে যায়। উথালপাতাল উদাসী হাওয়া
বুকের কাঁপন ধরিয়ে দেয়। এতো কষ্ট !!! বাচ্চা হয়নি বলে, অর্ধেক সাম্রাজ্য কেড়ে নিয়ে, স্বামী সঙ্গ ত্যাগ করিয়ে তবুও শান্তি নেই। স্বামী কে দিয়ে
মারও খাওয়াতে হবে? এ কোন ধাতুতে তৈরি করেছেন সৃষ্টিকর্তা এদের। আমি এসব দেখে বলে
ই ফেলেছিলাম,”আপনি আমাদের সাথে থাকুন,
কোনো চিন্তা নেই আপনার”। কিন্তু বোকা নদী তো
চালাক হয়ে গেছে। বুঝে গেছে একদম সহজে পাওয়া জিনিসে, মানুষের কোনো ভক্তি থাকে না।
তাই, শাশুড়িকে নিয়ে বারান্দায় এসে বলি,”কি করবেন দেখুন। একজন মানুষকে হুট করে এই
রকম ভাবে জায়গা দেয়া কি ঠিক হবে”? আমার শাশুড়ির চোখ দিয়ে পানি ঝরছে,” এই মেয়েটা তাহলে কই যাবে বৌমা? ও তো মরে যাবে স্বামীর
সংসারে গেলে? ও আমার কাছে থাকুক”। ভেতরে
ঢুকে মজিদ ভাইকে বাসার ঠিকানা দিয়ে বললাম,
“কালকে উনাকে এই ঠিকানায় দিয়ে যাবেন। রেণু
আপা এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবেন”। সাথে আনা ১০০০/ টাকা দিয়ে আসি উনাকে।
এসব করে, বাসায় ফিরতে ফিরতে ই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সকালে খাবার পর আর কিচ্ছু খাইনি, এ
ছাড়া ওয়ার্ডের রোগীদের চিৎকার, চেঁচামেচি শুনে
আমার মাথা যেন ঘুরাচ্ছে। বাসায় ফিরে দেখি,
শাহীন ভাত খাচ্ছে,বন্যা পরিবেশন করছে আর বুয়া মাছ কাটছে। শাহীন আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করছে,”কি ব্যাপার? তোমরা কোথায় গিয়েছিলে”?
আমি বলি,”মা কে জিজ্ঞেস করো”। কাপড় পাল্টে
নামাজ আদায় করে,প্লেটে ভাত বাড়ি। শাহীন ভাত
খেয়ে এখন বন্যার দেয়া চা খাচ্ছে। মাসিক ৫০০/ টাকা বাড়তি পাবার লোভে,বন্যা আমার কাছে থেকে চা বানানো শিখে নিয়েছে। সুতরাং, শাহীনের সমস্যা হচ্ছে না।
বন্যা কে বলি,”দাদু কে জিজ্ঞেস করে দেখ ভাত খাবে কি না। খেলে আসতে বল্”।
শাহীন একা একা আমাকে খেতে বসতে দেখে, মনে হয় খুব অবাক হয়েছে। হেসে বলল,”তোমার
কি ভীষণ খিদে পেয়েছে”? আমি সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে বলি,”কেন গৃহিণীদের কি খিদে লাগতে নেই না কি”? মৃদু স্বরে বলে,”আমি কিছু বললেই এরকম বাঁকা করে উত্তর দাও কেন? আমি কি বলেছি, খিদে লাগতে নেই”? আমি এসব কানে না তুলে বন্যাকে গলা তুলে ডেকে বলি,”কি রে কোথায় গেলি? তোর দাদু কি বলেন, খাবেন”? ও বলে,”না দাদু চা খাবে বলেছে”। বললাম,”বুয়াকে চা দিয়েছিস্”? না করাতে আমি, বুয়া ও আমার শাশুড়ি কে চা দিতে বলি। বন্যা এবার স্পষ্টতই বিরক্ত,”এইমাত্র বাবার ও আমার জন্য বানালাম। তোমরা আসছো, ফোন দিলে তো
সবার জন্য একসাথে বানাতাম। বারবার চুলার পাশে যেতে আমার ভালো লাগে না”।
আমি সুযোগ পেয়ে বলি,”তাহলে মা যে ১৮ বছর ধরে, দিন নেই রাত নেই চুলার পাশে কাটালো, মায়ের কেমন লাগে দেখো”। বন্যা কি সব বিড়বিড় করতে করতে চা বানাতে রান্নাঘরে গেছে। শাহীন
আমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে বলল,”পরিবর্তন যখন কারো মাঝে আসে, তখন পাশের লোকের
বুঝতে একটু সময় লাগে। কিন্তু, তোমার পরিবর্তন
এতো দ্রুত হচ্ছে যে, ভীষণ চোখে লাগছে”। আমি
প্লেট হাতে নিয়ে দাড়িয়ে বলি”একদিন বলেছিলাম
না, ক্ষোভ জিনিস টা বড় সাংঘাতিক খারাপ বস্তু”।
তার অবাক দৃষ্টির সামনে আমি কিচেনে চলে যাই। বুয়া দেখি মাছ কাটা শেষ করে ফেলেছে।এই সামান্য মাছের জন্য, কতো স্বার্থপরতা !!! আজ দেখি আর, আবদার নেই,ফ্রেশ মাছ ভেজে দাও। নরম জমিতে আচড়াতে বড় সুখ। এক নম্বর এর হারামী পুরুষ মানুষ”।
বুয়া চা খাচ্ছে, বললাম,” কিচেন টা একটু ডেটল দিয়ে মুছে যাও”। আমি ভেবেছি, শাহীন হয়তো রেষ্ট নিতে চলে গেছে। এখন দেখি, জায়গায় ই বসে আছে। বুয়ার টাকা এনে দিয়ে,চা খেয়ে আমি সোজা বিছানায়। বুঝতে পারছি শাহীন এসে পাশে
শুয়েছে। কিছু বলছি না দেখে বলল,”এদিকে ফিরো তো। তোমার সাথে কথা আছে”। আমি পাশ
ফিরতেই দেখি,জড়িয়ে ধরার মতলব। আমি বলি,
“কাল রাতে আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম,উত্তর টা “দিবো/ দিচ্ছি” করে এতো
টা সময় নিলে, কি ব্যাপার বলো তো”? এবার বলছে,”কোন প্রশ্ন? সপ্তাহে কোনদিন আমি থাকব,
সেটাই তো? সে ব্যাপারেই তো কথা বলতে এলাম।
কিন্তু, আগে একটু আদর করে নেই তোমাকে”। আমি ঝট্ করে জায়গা থেকে সরে বলি,”এসব
ভুজুং ভাজুং দিয়ে তুমি আমাকে অনেক ঠকিয়েছ
শাহীন। তোমার এসব ফাঁদে আমি আর পড়ব না”।
এবার সে মৃদু হেসে বলল,”একটা সন্ধি করি তাহলে? তোমার কথাও থাকুক, আমার কথাও থাকুক, মাসের প্রথম ও তৃতীয় শনিবার তোমার।
আমার মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ শনিবার। ঠিক আছে”? আমি মাথা নেড়ে বলি,”না হবে না। আমার চারটা শনিবার ই চাই”। শাহীন এবার হাত বাড়িয়ে ডাকছে,”তুমি আমার কাছে এসো নদী। আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি”। আমি শাহীনের সব চালাকি বুঝি। এসব আহ্লাদ দেখিয়ে মন অন্য
দিকে সরাতে চায়। কঠিন স্বরে বলি,”আমি কাছে গেলে কি, তোমার কথা বদলে যাবে না কি”? আমি জানি এবার আস্তে আস্তে সে তার স্বরুপে
ফিরে আসবে। মুখটা কঠিন করে বলল,”বেশি বেশি করছো এবার নদী। এতো বাড়াবাড়ি ভালো নয় কিন্তু। মাসে ২টা ছুটির দিন পাচ্ছ,তাও তুমি খুশি না, কি ব্যাপার বলো তো”?
আমি বললাম,”কিসের কি ব্যাপার? কি বলতে চাও, খুলে বলো”। সে মাথা চুলকে বলল,”আমার বন্ধু আবরার আজ বলেছে,দেখ এটা পরকিয়া
কেস কি না”। আমি এ পর্যায়ে চেঁচিয়ে বলি,”তুমি যাকে পরামর্শের জন্য বলেছো,সে নিজেই এমন খারাপ কাজে লিপ্ত। সে তোমাকে এসব বলাই তো
স্বাভাবিক”। এই সময় রাফি বাইরে থেকে মা মা ডাকছে। দরজা খুলে দেখি, দুজনে দাঁড়িয়ে আছে। রাহি এমন ভাবে গলা জড়িয়ে ধরে আছে, মনে হচ্ছে, কতো বছর পর দেখা হয়েছে। বন্যা ফাজলামি করছে,”ছোটভাই তোমাকে কি ফুপা
জোর করে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে, এভাবে কাঁদছ
কেন”?
রাহির বাবা বন্যার জন্য অনেক খাবার দিয়েছেন। আমাদের জন্যও বক্স ভরে ভরে এসেছে। এতো বার বলেছি,”এতো খাবার দিবেন না ভাই। কে খাবে এসব”? কে শোনে কার কথা !!! বন্যা চাইনিজ খাবার ভালবাসে,তাই ওর জন্য দামী রেষ্টুরেন্টের সব চাইনিজ আইটেম উপস্থিত। মেয়ে তো বাবা কে ছাড়া কিছু খায়না। শাহীন কে রুম থেকে ধরে নিয়ে এসেছে। শাহীন ওকে বারবার বলছে,”এই ঘন্টা দেড়েক আগে ভাত/চা খেয়ে গেলাম, এখন আবার খাবো কিভাবে মা”?
বন্যা এসব কানে ই তুলছে না,”তাহলে শুধু স্যুপ খাও বাবা। গরম আছে”। আমি এবার বকা দেই,”খিদে নেই, খাবে কি ভাবে? এক কথা বারবার ঘ্যানঘ্যান করছিস্ কেন বলতো”? শাহীন আমার দিকে তাকিয়ে বলে,”সেটা না হয় আমরা বাপ মেয়ের উপরেই ছেড়ে দাও। কই রে বন্যা,এক বাটি স্যুপ দে তো”। মেয়েও এবার খুশি খুশি স্যুপ বাড়ছে।
শাহীন আমার দিকে তাকিয়ে বলল,”তুমি খাবে না? সত্যি ই বেশ মজার থাইস্যুপ। গরম গরম এক
চামচ খেয়ে দেখো”…….বলেই আমার দিকে তার বাটি বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার আগের ধমকে ওরা
বুঝে গিয়েছিল, বাবা মার মধ্যে কিছু একটা নিয়ে
ঝামেলা চলছে। এবার শাহীনের কথায় মজা পেয়ে ফাজিল রাফি বলল,”এভাবে না, তুমি মাকে
খাইয়ে দাও”। রাহি আবার এই সময়ের ফটো তোলার জন্য, মোবাইল নিয়ে রেডি। আমি বলি,
“এখানে কি কোনো সিনেমার স্যুটিং হচ্ছে না কি?
বাবা মার সাথে এ আবার কোন ধরনের ঢং “!!!
রাফি বলছে,”বাবা মা এখন বন্ধুদের মতো ই। ঠিক আছে, মা তুমি জায়গায় বসে থাকো। বাবা তুমি মায়ের পাশের চেয়ারে এসে বসো। এখন খাওয়াও
তো”। শাহীনও হেসে হেসে স্যুপের চামচ আমার মুখে এগিয়ে দিচ্ছে।
রাতে ইচ্ছে করে কিছুটা দেরি তে রুমে ঢুকেছি। পরের দিন শাহীনের অফিস, ঘুমিয়ে পড়ুক। আস্তে
আস্তে বালিশে মাথা লাগাতেই, ওর বলিষ্ঠ দুই বাহূ দিয়ে আমাকে বুকের ভেতর নিয়ে গেছে। কানে কানে বলছে,”এ বয়সে এতো রাগ করা কি ভালো”? আমি দুহাতে এ মিথ্যে, ঠুনকো মায়াজাল ছেড়ার উদ্দেশ্যে বলি,”বৌ পরকিয়া করে এমন সন্দেহ করেও আবার বুকে নাও কিভাবে? কান খুলে শোনো শাহীন, আমি এতোটাও সস্তা না কিন্তু। ভালোয় ভালোয় ছেড়ে দাও বললাম”। সে অবাক হয়ে বলে,”আরে আমি তোমাকে কোথায়
সন্দেহ করলাম? আবরার আমাকে বলেছিল,এটা
শুধু বললাম”। আমি রেগে বলি,”আমাকে উল্টো পাল্টা বুঝাবে না, আমি কি বাচ্চা নাকি? এসব তোমার কারেক্টারলেস বন্ধু কে গিয়ে বুঝাও”।
শাহীন কে আমি ভালো মতো ই চিনে গেছি। সময় সময় সে তার ধারালো নখ ও দাঁত বের করে। তার
মনমতো সবকিছু চললে,সে খুব খুশি। তার মতের বাইরে গেলেই নখ/ দাঁত বের হয়, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা বেড়ে যায়, এসব করে “কিছু ই হয়নি”এমন একটা ভাব করে, আদর দিয়ে সব সমস্যা মেটাতে চায়। হাসি,কান্নার মিশেলে তৈরি
অদ্ভুত এক শব্দ আমার মুখ দিয়ে বের হয় তখন। আগে বুঝতাম না, ভাবতাম “ভালো তো বাসে,
একটূ মানিয়ে নেই না হয়”। কিন্তু, একবার অবাধ্য
হলে যে সব ভালবাসা শেষ,তা কে বুঝেছে?
পরদিন মজিদ ভাই রেণু আপাকে রেখে গেলেন।
আমার শাশুড়ি বললেন,”বিছানা বড় আছে ও আমার সাথে থাকবে বৌমা”। উনাকে চা,নাস্তা দিলাম। শরীরের উপর এতো অত্যাচার,নির্মল হাসি টুকু কেড়ে নিতে পারেনি। এক ফাঁকে উনি কিচেনে গিয়ে আমাকে বললেন,”শোনো বৌ, আমি সবকিছু কাজ পারি। যা দেখিয়ে দিবে,পারব
ইনশাআল্লাহ। আমাকে বিদায় করে দিও না। আমি রান্নাও পারি”। আমি উনার হাত ধরে বলি,
“মন দিয়ে শুনুন, আমি কি বলি। বৌ ডাকতে হবে না, নদী বলে ডাকবেন। চিন্তা করবেন না, এখানে ই থাকবেন। আপাতত রান্না করতে হবে না, আমি আস্তে আস্তে আমার শাশুড়ির খাওয়া দাওয়া,
ঔষধ আপনাকে বুঝিয়ে দিব। একটা নম্বর দিবো,
মায়ের শরীর খারাপ হলে ঔ নম্বরে আপনি ফোন দিয়ে এম্বুলেন্স আনাবেন। আমি যে এসব বলছি,
তা আপনার ও আমার মধ্যে থাকে যেন”।
রেণু আপা হয়তো ভেবেছেন, এখানে থাকতে হলে নদীর কথা শুনতে হবে। বারবার মাথা নেড়ে সব কথায় হু হু করছেন। আমার বুকটা আবার কাশফুলের রাজ্য হয়ে যায়, উথালপাতাল উদাসী হাওয়ায় দুলতে থাকে। হাত ধরে বলি,”এই এক সপ্তাহ আপনি রেষ্টে থাকবেন। কোনো কিছু করতে
হবে না, শরীর আগে পুরোপুরি ঠিক হোক”। বুয়া
এতোক্ষণ ধরে দেখছিল, উনি চলে যেতেই হতাশ হয়ে বলে,”ভাবী, তাইলে তো মনে লয় আমারে
ছাইড়া দিবাইন”। আমি বলি,”উনি কাজ করতে এখানে আসেন নি বুয়া। তোমার ভাইয়ের আপন খালাতো বোন। তুমি যেভাবে কাজ করছিলে, করতে থাকো”। আমি মনে মনে ভাবছি,রেণু আপা কে শিখিয়ে পড়িয়ে দেখি, সময়টা কে আমি আদৌ ধরতে পারি কি না।
ছেলেদের রেজাল্ট বের হলো। দুজনের টাই অনেক ভালো। এখন দুজনের মনেই ভয়, মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় টিকবে কি না,আর টিকলে ঢাকায় মায়ের পাশে থাকতে পারবে কি না। আমি বূঝতে দেই না, কিন্তু সেই একই ভয় তো
আমারও। রেণু আপা শরীর এখন ভালো। উনার
ক্যাচ করার ক্ষমতা অসাধারণ। যা কয়েক দিন দাঁড়িয়ে থেকে বুঝিয়ে দিয়েছি, খুব নিখুঁত ভাবে তা করছেন। আমার শাশুড়ির আবার ভালো লাগে নি, উনার হাতে ঔষধ খাওয়া। শাহীনকে মনে হয় বলেছেন, শাহীন আমাকে বলে,”মা বোধহয় তোমার হাতেই ঔষধ খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন”।
আমি বলি,”আমি তো পরের মেয়ে।১৮ বছর ধরে আপন হতে পারিনি। রেণু আপা তো উনার আপন
বোনঝি, তাহলে খেতে সমস্যা কোথায়? উনি খুব
ঠিক করে খাওয়ান, তারপরও তোমার ঠিক মনে না হলে, অফিস থেকে এসে খাইয়ে যেতে পারো”।
আপাতত মাসের ১ম ও ৩য় শনিবার আমার ছুটি।
এক শনিবার কাঁকনের বাসায় কাটিয়েছি। মিমি ও
সাবরিনাও এসেছে। খুব মজা হয়েছে। ওরা গুনে
দেখলো এই ৩ মাসে মোট ১৮ টা গল্প লিখেছি। সবচেয়ে কম লাইক যেটাতে,সেটা দেড় হাজারের উপর লাইক। সাবরিনা ও মিমি দুজনেই লিখে। আগামী মাসে রাজশাহীতে দুদিনের জন্য সাহিত্য
সভা আছে। কাঁকন সহ ওরা তিনজন ই যাচ্ছে। আমাকে যাবার জন্য খুব করে ধরেছে। বলেছি,
যাবো ইনশাল্লাহ। বাসায় বলিনি,সময় মতো বলব
ভেবেছি।
সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে দেখা গেল,
রাফি সিলেট ওসমানী মেডিকেলে ও রাহি ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে ই রাফির মন খারাপ ও রাহি খুশিতে আত্মহারা হয়ে নাচছে। শাহীন সবার সামনে রাফিকে বুঝাচ্ছে,
“ষ্টুডেন্ট লাইফে এটা খুব ই স্বাভাবিক ব্যাপার রাফি। সবাই এই ৫/৬ টা বছর কষ্ট করে, তারপর আবার মায়ের কাছে ফিরে আসে”। রাফি তার স্পষ্ট স্বরে বলল,”আমি তো আমার জন্য ভাবি না
বাবা, মায়ের জন্য ভাবি। তুমি আর দাদু মিলে, মা কে একদম আলুর দম বানিয়ে ফেলবে তখন”।
শাহীন এবার রেগে গেছে,”মানে? তোর মা তো একমাস ধরে, ইচ্ছে মতো ই চলছে। দুই শনিবার বের হচ্ছে,তোর ফুপুর ঘাড়ে দাদুর সব দ্বায়িত্ব দিয়ে গল্প লিখছে। আমি কিছু বলেছি, না আমার মা কিছু বলেছে? তারপরও তোরা আমাদের দিকে
আঙ্গুল তুলিস কেন”?
রাফি এবার বলে,”গল্প ই তো লিখছে বাবা, খারাপ কিছু তো করছে না। মায়ের এক জীবন তো রান্না
ঘরে ই কাটলো। শুধু কি রান্না না কি, আমাদের পড়ালেখা,স্কুল,টিউশন, তোমার সবকিছু খেয়াল করা,আর সবচেয়ে বড় কাজ দাদুর বাক্যবাণ সহ্য
করেও তাকে পাহারা দেয়া। এতো কিছুর পরেও,
নাক সিটকানো।মা যে স্বাভাবিক আছে,এটাই বড় কথা”। আমার শাশুড়ি এবার বলছেন,”হ্যা তোমার মা ই তো একা এগুলো করেন।আর কেউ করে না
তো”। রাফি কেটে কেটে বলে,”করে অনেকেই। কিন্তু, তোমার মতো শাশুড়ি খুব কম দুর্ভাগা দের ই জোটে”। এবার আমার শাশুড়ি তার বিখ্যাত সে
কান্না শুরু করেছেন। শাহীন আমার দিকে তাকিয়ে সামাল দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। আমি সেই চেষ্টা করছি না বলে, ধীরে ধীরে তার চোখমুখ রুঢ়
হচ্ছে। আমি একদম পাত্তা দিচ্ছি না।
(চলবে)
.