#মেঘে ঢাকা আকাশ
পর্ব ১৪
#আমিনুর রহমান
আস্তে আস্তে স্পৃহা ওইদিনটির কথা ভুলতে লাগল একসময় ভুলেও গেল। কিন্তু কেন জানি আমার ভোলা হল না। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা খুব সহজেই কোনকিছু করে ফেলতে পারে আবার খুব সহজেই সেটা ভুলেও যেতে পারে। কিন্তু আমি তেমন না। আমার একটা জিনিস মনে ধরে গেলে সেটা ভুলতে অনেকটা সময় লাগে অনেকটা কষ্ট হয়। স্পৃহা আমার থেকে হয়তো বা আলাদা তাই তাঁর জিনিসটা ভুলতে তেমন কষ্ট হল না। স্পৃহা যে আমাকে কখনো ভালোবাসেনি কিংবা আমার জন্য তাঁর হৃদয়ে কখনো ভালোবাসার বীজ বপন হয়নি সেটা খুব ভালো করেই আমি বুঝতে পারি। আর হলেও সেটা ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। একজনকে ভালোবাসা অবস্থায় অন্য কোন মানুষের প্রতি কি কখনো ক্ষণিকের জন্য নিজের হৃদয় মন্দিরে ভালোবাসার জন্ম নিতে পারে? হয়তো পারে না কিংবা পারে না। স্পৃহা কি আমাকে ক্ষণিকের জন্য ভালোবেসেছিল যার জন্যই ওমন করে আমাকে আদর দিয়েছিল। তাঁর ভালোবাসাটা সবসময় ওই হাসানের জন্য। আমি তাঁর কেউ না। এমনটাই মনে হয়েছে এতদিনে।
হঠাৎ করেই একদিন আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি,বাঁচব না মনে হয় এরকম অবস্থা হয় আমার। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল,গরমের মাঝেও প্রচন্ড শীত অনুভব করছিলাম। তখন স্পৃহা আমার অনেক যত্ন নিয়েছিল। টানা পাঁচদিন আমি বিছানায় পড়েছিলাম। এই পাঁচদিন স্পৃহা সবসময় আমার পাশে ছিল৷ আমার মনে হয়েছে এবার বুঝি স্পৃহা আমাকে ভালোবাসা শুরু করেছে। আমাকে এমন অবস্থায় দেখে তাঁর ভিতরটা কাঁদে। কারো জন্য যদি কারো ভিতরটা কেঁদে উঠে তাহলে কি সে তাকে ভালোবাসে না? আমাকে সুস্থ করে তোলার জন্য স্পৃহা দিনরাত আমার সেবা যত্ন করে। এই কারণেই আমি অনেকবার স্পৃহার অনেকটা কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আমার অবস্থা এমন হয়েছিল যে নিজ হাতে পানি খাওয়ার মতো শক্তি টুকুও ছিল না। একসময় মনে হয়েছে আমি আর বাঁচব না৷ কিন্তু স্পৃহা আমাকে মরতে দেয়নি। সামান্য জ্বরও যে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে সেটাতে আমার বিশ্বাসে ছিল না কোনদিন। কিন্তু এখন বিশ্বাস না করে উপায়ও নেই। কারণ আমি এই জ্বরের কারণেই মরতে বসে ছিলাম। একবার ভাবলাম বাসায় জানাই আমি খুব অসুস্থ। আবার মনে হলো বাবা মা আমার এমন অবস্থার কথা জানতে পারলে আমার কাছে চলে আসবে। তখন তো তারা স্পৃহাকে দেখে ফেলবে। ভাববে আমি তাদেরকে না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলেছি। কিংবা কপাল খারাপ থাকলে এটাও ভাবতে পারে আমি মেয়ে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকছি,ফুর্তি করে বেড়াচ্ছি। বাবা মা হলেও তো তারা মানুষ। আর মানুষ যা দেখে তাই বিশ্বাস করে অন্তত সত্য মিথ্যা পরখ করার আগ পর্যন্ত কিন্তু ততদিনে নির্দোষ মানুষটাকে ভুক্তভোগী ঠিকই হতে হয়। যেমনটা একবার আমি হয়েছিলাম। কাজেই অবস্থা অনেক খারাপ হলেও আমি বাবা মা কিংবা আমার বোনকে আমার এমন মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার খবরটা জানালাম না।
প্রায় চৌদ্দদিন পর আমি পুরোপুরি সুস্থ হলাম। আমার অসুস্থতা যে স্পৃহা আর আমাকে আগের থেকে অনেকটা ক্লোজ হতে সাহায্য করছে সেটা আমি বুঝতে পারি। একদিন রাতে দেখলাম স্পৃহা কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে । আমি খুব স্পষ্ট শুনতে পেলাম সে কাকে যেন বলছে।
“আমি আসলে হাসানকে ভালোবাসি নাকি ওকে ভালোবাসি আমি অনেকটা কনফিউজড। ওর সাথে আমার সময় কাটাতে অনেক ভালো লাগে,ওর সাথে থাকলে আমার মন হয় না আমি খারাপ থাকি। আমি হাসানের সাথে কোথাও একা যেতে সাহস পাই না,ইচ্ছে হয় না। কিন্তু ওর সাথে ঠিকই আমি যেকোন জায়গায় যাওয়ার সাহস পাই। ও যখন আমার পাশে থাকে তখন আমি হাসানকে খুব একটা মনে করতে পারি না৷ কিন্তু হাসানের সাথে থাকলে ঠিকই ওকে আমার মনে পড়ে৷ ও যেদিন আমাকে আর হাসানকে রেখে চলে আসল সেদিন সারাদিন আমি হাসানের সাথে থেকেও ওকে খুব মিস করেছি। মনে হয়েছে ও আমার সাথে থাকলে কতই না ভালো লাগত৷ অথচ হাসান আমাকে সেদিন কত সুন্দর সুন্দর জায়গায় ঘুরিয়ে দেখাল আমার মন ভরল না। এতকিছুর পরেও মনে হয় আমি যদি হাসানকে ভালো না বাসি তাহলে আমি প্রতারক হব, বেইমান হব। একজনকে ভালোবাসা অবস্থায় অন্য কাউকে ভালোবেসার মতো অপরাধ করেছি আমি। আমার ওর সাথে থাকতে ভালো লাগে ওকে আমি ভালোবাসি কিনা সেটা বুঝতে পারি না৷ এমন কেন হয় আমার সাথে? আমি কেন বুঝতে পারি না? আচ্ছা এমন কি কারো সাথে হয়? একজনকে ভালোবাসা অবস্থায় অন্য কারো প্রতি ভালো লাগা ভালোবাসার সৃষ্টি হয়? এটাতো অন্যায়। আমি কি সেই অন্যায়টাই করছি না? হাসানকে আমি কথা দিয়েছি সবসময় ওর পাশে থাকবো আমি,কখনো ছেড়ে যাব না। আর এখন আমার অন্য একটা মানুষের সাথে থাকতে ভালো লাগে। আমি তো ভালোবাসার মানুষের কাছে কখনোই একজন প্রতারক প্রেমিকা হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই না। আমি আমার ভালোবাসার মানুষের বিশ্বাসটা ধরে রাখতে চাই। হাসান আমাকে অনেক বিশ্বাস করে বলেই একটা ছেলের সাথে একছাদের নিচে এক বাসায় আমাকে থাকতে দিয়েছে। আর আমি কিনা তাঁর বিশ্বাসটাই ভাঙতে শুরু করেছি।”
আমি স্পৃহার মুখ থেকে নিজের সম্পর্কে এমন কথা শুনে খুব অবাক হলাম না। কারণ এই কয়েকদিনে স্পৃহাকে দেখে বিষয়টা আমি একটু হলেও বুঝতে পেরেছি। সে আসলে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে৷ ওইদিন হাসান না আসার কারণে আমাদের দুজনকে কি একটা অবস্থায় না পড়তে হয়েছিল। যদিও অবস্থাটা আমার জন্য খারাপ ছিল না৷ আমি মনে প্রাণে চেয়েছিলাম এমন কিছু হোক। পরে যখন হাসান স্পৃহাকে বলেছিল তাঁর একটা কাজ ছিল,সে কারণেই আটকে গিয়েছিল তাই আসতে পারেনি তখন স্পৃহা বিষয়টা চেপে গিয়েছিল৷ সে হাসানকে একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করেনি কেন সে ফোন করে জানায়নি সে আসতে পারবে না। কিন্তু স্পৃহা তেমন কিছু হাসানকে বলেনি। খুব সাধারন ভাবেই নিয়েছে স্পৃহা বিষয়টাকে। অথচ সে হাসানের ওপর অনেক রাগ করতে পারত,অনেক অভিমান করতে পারত। কিন্তু এসবের কোনকিছুই সে করেনি। এসব কি প্রমাণ করে না স্পৃহা আমার প্রতি একটু হলেও দুর্বল? আমি যদি একটু বেশি আশা করি তাহলে হয়তো স্পৃহা আমাকে ভালোও বাসে। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশা একটু বেশিই থাকে। আর আমি যদি ভুল না ভাবি তাহলে এই কয়েকটা দিনের ব্যবধানে স্পৃহা নামক সুন্দর মনের মেয়েটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।
আমি স্পৃহার সব কথায় শুনলাম কিন্তু অপর পাশের মানুষটা আসলে কে সেটা আঁচ করতে পারলাম না। অবনি নয়তো? এমন নাতো গোপনে গোপনে আমার বিষয়টা স্পৃহা অবনির সাথে অনেক আগেই শেয়ার করেছে? অবনি ছাড়া সে আর কার সাথে কথা বলবে? আমার জানামতে তো তাঁর এসব কথা বলার মতো অবনি ছাড়া আর কেউ নাই। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। অবনি ছাড়া অন্য কোন বন্ধু কিংবা বান্ধবীর সাথেও কথা বলতে পারে সে। কারণ সুন্দরী মেয়েদের বন্ধু বান্ধবীর অভাব হয় না। তবে স্পৃহার তেমন কোন বন্ধু বান্ধবীকে আমার চোখে পড়েনি কখনো। সে কারণেই হয়তো মনে হলো সে অবনির সাথেই কথা বলছে। আমার অনেক সময় স্পৃহার ওপর অনেক রাগ হয়৷ এত ভালোবাসার পরেও কেন সে আমার ভালোবাসাটা বুঝতে পারে না? আমি আর আমার সৃষ্টিকর্তা জানে আমার ভালোবাসার মাঝে কোন ফাঁক নেই শুধু স্পৃহা জানে না। আমি তাকে কখনো জানাতেও চাই না। সে যদি আমাকে কখনো সত্যিই ভালোবাসে তাহলে সে আমার ভিতরটাকে উপলব্ধি করবে,আমার কাছে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করবে। আমি তাঁর চোখের জল মুছে দিয়ে তাঁর কপালে আলতো করে একটা চুমু একে দিব। আমি জানি না এমন কোন দিন আমার জীবনে আসবে কি না তবে সত্য এটাই আমি এমন একটা দিনের জন্য প্রতিনিয়ত অপেক্ষা করি। আমি বুঝতে পারি না কেন সে আমাকে রেখে হাসানের কাছে যেতে চায়? আবার যখন আমি নিজেকে স্পৃহার জায়গায় নিয়ে ভাবি তখন মনে হয় স্পৃহার কোন ভুল নেই। কারণ আমার আগে সে হাসানকে ভালোবেসেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হাসান সম্পর্কে সে এখনও অনেক ভালোই জানে,খারাপটা এখনো জানতে পারেনি। তাহলে সে আমাকে রেখে হাসানকে ভালোবাসলে দোষটা কোথায়? আমি তো কোন দোষ দেখি না।
আমার ধারণা ভুল হল না। পরের দিন সকালে পেরিয়ে বিকেলবেলা আমি বুঝতে পারলাম রাতে স্পৃহা অবনির সাথেই কথা বলছিল। যখন এটা জানতে পারলাম তখন একটু ভয় হল আমার। এমন তো না অবনি আমার বিষয়টা অনেক আগে থেকেই জানে। স্পৃহা তাকে অনেক আগেই জানিয়েছে আমার কথা। সেজন্যই কি অবনির মায়ের মৃত্যুর দিন স্পৃহা আর আমাকে একসাথে দেখে খুব একটা সারপ্রাইজড হয়নি অবনি? রাতে স্পৃহাকে যতটা আপসেট দেখছিলাম এখন ততটা মনে হচ্ছে না। অনেকটা স্বতস্ফুর্তই মনে হচ্ছে তাকে। স্পৃহা যখন আমাকে বলল।
“অবনির বিয়ের ঠিক হয়েছে। দুইদিন পর বিয়ে আমাদেরকে যেতে বলেছে। ছেলে ডাক্তার। ওর বাবা চলে যাওয়ার আগে ওর বিয়েটা দিয়ে যেতে চান৷ ওর বাবা চাচ্ছে না অবনি একা একা থেকে একাকিত্বের যন্ত্রণা ভোগ করুক। তাই এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হচ্ছে ওর।”
অবনির বিয়ের কথা শুনে অনেক ভালো লাগল। আমি ভেবেছিলাম সে আমার জন্য এত ফোন করত কিন্তু না সে তাঁর মায়ের জন্য আমাকে এত অনুরোধ করতো। অনেক আগে অবনি আমাকে ভালোবাসতে চাইলেও এখন চায় না। এর থেকে ভালো লাগা আর কি হতে পারে আমার জন্য? আমিও যে চাই মা হারা মেয়েটা কারো ভালোবাসার মন্দিরে দেবি হয়ে বেঁচে থাকুক। অবনি কি তাহলে স্পৃহাকে আমার কথা বলেছে? হয়তো বলেনি কারণ নিজের মায়ের সম্পর্কে তো আর কেউ ইচ্ছে করে কারো কাছে খারাপ কিছু বলতে যাবে না। সবসময় নিজের আপনজনদের অপরাধ গুলো আমরা সবার কাছ থেকে লুকাতে চাই। কাউকে বুঝতে দিতে চাই না তাদের কুকর্ম গুলো। যদিও আমার ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন হয়। আমি যখন স্পৃহাকে বললাম।
“আমাদের এই বিয়েতে যাওয়া উচিত হবে না। ওখানে তো আপনার ফ্যামিলির সবাই আসবে। আমাদের ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাজেই আপনি অবনিকে না বলে দিন।”
তখন স্পৃহা কিছুটা লাজুক হেসে বলল।
“আরে নাহ,তেমন কিছু হবে না। অবনি আমার খুব কাছের কেউ না। অনেক দূরের একজন। তবে ওর সাথে আমার সম্পর্কটা অনেক আগে থেকেই ভালো৷ ও আমার সম্পর্কে সব জানে বাট কখনো আমার বাসায় বলেনি। আর অবনির বাবা বিয়েটা খুব যে অনুষ্ঠান করে দিচ্ছে তাও না। খুব আপনজন ছাড়া কাউকে ইনভাইট করবে না৷ আমার পরিবারের কেউ আসার কোন সম্ভাবনা নেই। এমনটা হলে অবনি আমাকে বিয়েতে যেতে বলত না। কাজেই আমাদের কোন সমস্যা হবে না। আপনাকেও যেতে হবে আমার সাথে। অবনি আপনাকেও যেতে বলছে।”
চলবে………..