#ধারাবাহিকগল্প
#বৃহন্নলার ডিভোর্স
পর্ব ৬
মাহাবুবা বিথী
আপু প্রতিবার পিরিয়ডের পর আমার শাশুড়ী আমাকে বাঁজা মেয়ে বলে গালিগালাজ করে। আমি ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে সেদিন প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছি। তবে আমার একটু ভয় লাগছে। কারণ আমার শাশুড়ী ভীষণ ভয়ঙ্কর মানুষ।
ঝড়ের আগে যেমন প্রকৃতিতে গুমোট পরিবেশের সৃষ্টি হয় তেমনি রুমির শ্বশুরবাড়ির পরিবেশটা থমথমে হয়ে আছে। সবাই রুমিকে এড়িয়ে চলছে। রুমি সেদিন ডিনারের পর রুমে এসে দেখে আবীর ঘর অন্ধকার করে বারান্দায় বসে আছে। তখন রাত এগারোটা বাজে। রুমি ওর সাথে কোনকথা না বলে বিছানায় শুয়ে পড়ে।ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে রুম্মান ঠিক মতো বাড়ি পৌঁছেছে কিনা সেই খবরটা নেয়। হঠাৎ নজরে আসে জারার ভাই রায়হান ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। রুমিএকসেপ্ট করে। তারপর ওনার সাথে টুকটাক কথা বলে। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে ওনার ওয়াইফের সাথে ওনার ডিভোর্স হয়ে গেছে। তখন রুমি উনাকে জিজ্ঞাসা করে,
—-ভাই আপনার কোন পরিচিত উকিল আছে?
রায়হান বললো,
—-আছে। আপনার কেন দরকার?
রুমি বলে,
—আমি আপনাকে সময়মতো জানাবো।
গুমোট দমবন্ধ পরিবেশে রুমির জীবনের সময়গুলো পার হয়ে যায়। খাঁচাবন্দী পাখির মতো মুক্তির উপায় খুঁজে বেড়ায়।
কারণ মাকে যদি বলে ও ডিভোর্স দিবে আবীরকে মা প্রচন্ড ধাক্কা খাবে।এবং সেটা শরীরের উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। আবার মাকে যদি ওর সাথে ঘটা ঘটনাগুলো বলে দিত সেখানেও বিবেকের দংশনে দুমড়ে মুচড়ে যেতো। রুমি পড়ে গেছে উভয় সংকটে।
মাঝে মাঝে রায়হানের সাথে মেসেঞ্জারে রুমির কথা হয়। রুমিও মুক্তির পথ খুঁজে বেড়ায়। ওদের যে নোংরা চেহারা রুমি দেখেছে তারপর ওদের সাথে থাকা রুমির ঠিক না। রুমির ভাল মানসিকতাকে ওরা ওর দুর্বলতা ভেবে নিয়েছে।
যদিও রুমির উপর অত্যাচারের মাত্রাটা একটু কমে আসে। তবে প্রয়োজন ছাড়া রুমির সাথে কেউ কথা বলে না।
এদিকে একদিন রাতে রুমির মা ফোন দিয়ে রুমিকে বলে,
—-তুই কি এর মাঝে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলি?
রুমি বলে
—নাতো।আমারোতো কোন সমস্যা হয়নি যে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কেন হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে?
রুমির মা বলে,
—-তোর চাচার সাথে আবীরের আব্বার ফোনে কথা হয়েছে। উনি জানিয়েছেন, ডাক্তার নাকি বলেছে তোর নাকি বাচ্চা হবে না। তোকে বউ করে এনে ওনারা বড্ড ভুল করেছেন। এর থেকে গ্রাম থেকে উনিশ বা বিশ বছরের অল্প বয়সি মেয়ে আনলে এতোদিনে ওনারা নাতির মুখ দেখতে পারতেন। তোর উপর ওনারা অত্যাচার করছেন নাতো?
দেখ মা কোন কিছু গোপন করিস না। আমি মনে হয় নিজ হাতে তোর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম।
রুমি বলে,
—-আমার কপালে যা লেখা আছে তাই হবে। তুমি শুধু শুধু নিজেকে দোষারোপ করছো। আমার শাশুড়ী মাঝে মাঝে একটু সমস্যা করছে। তবে কোন সমস্যা হলে আমি তোমাকে জানাবো।তবে তুমি এসব নিয়ে বেশী চিন্তা করো না। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজের শরীরের দিকে খেয়াল রেখো।
মায়ের সাথে কথা বলে রুমি ফোনটা রেখে দেয়।
এরপর রায়হানের সাথে দেখা করার জন্য মেসেজ পাঠায়।
আপু পরদিন আমি দুপুর বারোটার দিকে আমার শাশুড়ীকে জানিয়ে চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হই।তারপর আমরা দুজনে বসুন্ধরা মার্কেটে দেখা করি। ল,ইয়ার তো অনেক আছে। তবে আমি একজন মহিলা ল,ইয়ার খুঁজেছিলাম যার কাছে সহজভাবে আমার কথাগুলো বলতে পারি। রায়হান ভাই আমাকে বলে,
—-চিন্তা করবেন না আমি শীঘ্রই আপনাকে একজন ভালো উকিলের খোঁজ দিব।
এরপর সন্ধার দিকে বাসায় ফিরে আসি। তখন আমার শাশুড়ী দরজা খুলে দেয়। উনি নিজে আমাকে কিছু বলে নাই। তবে আবীরকে দিয়ে আমাকে চরমভাবে অপমান করে। কারণ আবীরের আমার তখন অনেক দূরত্ব তৈরী হয়ে গেছে। এক বাসায় থেকেও ওর সাথে আমার কথা হয় না। ও আর আমি একঘরে আলাদা বিছানায় শুই। ও সোফায় ঘুমায় আমি ঘুমাই খাটে। আমি আবীরকে বলেছি খাট যেহেতু আমার বাবার বাড়ি থেকে দিয়েছে আমি খাটেই ঘুমাবো। যাই হোক ও আমাকে অপমান করার সুযোগ হাতছাড়া করলো না। আবীর আমাকে বলে,
—-তোমার নাগরের সাথে চলে গেলেই পারতে। আবার আমার কাছে ফিরে আসলে কেন?
আমি বললাম,
—-কি আজে বাজে কথা বলছো? আমি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেছিলাম।
আবীর বলে,
—-আমাকে কচি খোকা পাওনি। যা বলবে তাই বিশ্বাস করবো। নিজেকে বেশী চালাক ভাবো তাই না। বসুন্ধরা মার্কেটে কার সাথে সময় কাটালে।
আমি বললাম,
—-চাকরির ইন্টার ভিউ দিতে গিয়ে উনার সাথে আমার দেখা হয়। তাই ওখানে একটু বসে কথা বলেছিলাম
আবীর বলে,
—-আমার সব জানা আছে। ডেট ঠিক করে ডেটিং এ গিয়েছো। চরিত্রহীন মেয়ে কোথাকার !
এমন সময় শাশুড়ী ফোঁস করে বলে,
—-আমি এরকমটা হবে আঁচ করেছিলাম। এইজন্য সাব্বিরকে নিষেধ করেছি যেন ওর সাথে কোন কথা না বলে।
আমি আমার শাশুড়ীকে বলি,
—-আপনারা যেমন নোংরা মানুষ তেমনি আপনাদের নোংরা মন।
আমার কথা শুনে শ্বশুর তেড়ে এসে বলে,
—-তা নোংরা মানুষের সাথে এখনও পড়ে আছো কেন? কে থাকতে বলেছে তোমাকে?
আমি সে রাতটা কোনরকমে পার করি।আর এটাও বুঝে নেই ওর আমার মোবাইল চেক করে।যাইহোক মোবাইলের পাসওয়ার্ড চেইঞ্জ করলাম। রায়হান ভাই ওই রাতে আমাকে আপনার বাসার ঠিকানাটা দিয়ে দেয়।
আমি আসার আগে আবীরের মেডিকেল রিপোর্টের ছবি তুলে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আবীর চলে আসার কারনে সম্ভব হয়নি।
পরদিন বাসা থেকে বের হয়ে আপনার বাসায় চলে আসি।ছ,মাস আগে যেদিন আপনার বাসায় এসেছিলাম সেদিনকার কথা। তারপর এখান থেকে বাসায় চলে যাই।
আপু আমি আর একটা কারনে বাসা থেকে চলে যাই কারন আমার মনে হয়েছে ওরা যে কোন সময় আমাকে মেরে ফেলতে পারে। তারপর আমার মাকে বলবে আমি আত্মহত্যা করেছি।
আমি বললাম,
—-তোমার এরকম মনে হবার কারণ কি?
রুমি বললো,
—-আপু একবার তো আমার শ্বশুর আমার চাচাকে বললো,ডাক্তার বলেছে আমার বাচ্চা হবে না এটাও যেমন মিথ্যা কথা ছিলো তেমনি আমার আর এক চাচার কাছে বলেছে আমি নাকি মানসিক প্রতিবন্ধী। যে কোন মূহুর্তে আত্মহত্যা করতে পারি। সেই চাচার সাথে উনি বাইরে দেখা করে এই কথাগুলো বলেছে।
আমি বললাম,
—তখনি আমাকে তোমার ডিটেইল বলা উচিত ছিলো।
রুমি বললো,
—-আপু আপনি বলেছিলেন ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে।
আমি বললাম,
—-আমিতো তোমার জীবনের এই ঘটনাগুলোর কথা জানতাম না। তোমার এতো দেরী না করে আরোও আগে এসে ডিভোর্স ফাইল রেডী করা উচিত ছিলো।
রুমি বললো,
—-আসতে চেয়েছিলাম। আম্মুর জন্য আসতে পারিনি। তার এক কথা একটু মানিয়ে নিলেই পারতি। আর আবীরকে চিকিৎসা করালে ও সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারতো। আম্মুকে বোঝাতে পারছিলাম না যে ওরা মানুষ হিসাবে খুব জঘন্য প্রকৃতির। আম্মুর কথা হচ্ছে ওদের ছেলের যদি এতোই সমস্যা থাকে তাহলে বিয়ে দেওয়া তো দরকার ছিলো না। যেঁচে ছেলের বিয়ে দিয়ে কেন এই ঝামেলায় ওরা নিজেদের জড়াবে। আর আম্মুর একটা মাইল্ড অ্যাটাক হয়। আম্মুকে নিয়ে কিছুদিন ব্যস্ত ছিলাম। এদিকটায় মাথা ঘামাতে পারিনি। আসলে আমার শাশুড়ী তার এই ছেলেকে বিয়ে দিয়ে প্রমান করতে চেয়েছিলেন উনার ছেলে সুস্থ স্বাভাবিক।উনি সন্তান স্নেহে এক ক্রেজি ভয়ঙ্কর মহিলা।
আমি বললাম,
—-তুমি আর ও আগে এসে মামলা করলে এতোদিনে সবকিছুর সুরাহা হতো। আর ওদেরও শাস্তি পাওয়া দরকার।
রুমি বললো,
—-আমাদের আত্মীয়স্বজন বললো আমি ডিভোর্স দিয়ে দিলে দেনমোহর থেকে শুরু করে কোনকিছু পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। আর আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ। এখনও আমার বিয়ের দেনাগুলো রয়ে গেছে।আমি যদি আমার গয়না আর দেনমোহরের টাকাগুলো পাই ওগুলো দিয়ে ঋণ গুলো শোধ করে দিবো। আর না পেলে আম্মু আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমার জীবনের যা ক্ষতি হয়ে গেলো তাতো আর কোনভাবে পূরণ হবার নয়।
আমি বললাম,
—-এটা ভুল ধারণা। তুমি ভিকটিম। অবশ্যই তুমি আইনের আশ্রয় নিতে পারতে।
রুমি বললো,
—-আমি চলে আসার পরে আমার শ্বশুরশাশুড়ী সবার কাছে বলে বেড়াতে লাগলো, আমার পরকীয়া ছিলো তাই আমি তার হাত ধরে পালিয়েছি। আমার এই খবর পেয়ে আমার ভাইও চলে আসে। আমার চাচা ভাইয়া থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজনের প্রতিবাদে ওরা একটু নিজেদের সামলে নেয়।কিন্তু এক সপ্তাহ আগে আমার নামে অভিযোগ দায়ের করে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়।
চলবে……..