#গল্প
#একটি ডিভোর্স লেটার
পর্ব ২
দুই মায়মুনার দেখা
ইদানিং বিকেল হলেই মুনার মনটা খারাপ হয়ে যায়, আজকের দিনটাও শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তওসিফের ফোন আসেনি। আজ কত মাস হয়ে গেল ও বাবার বাড়িতে এসেছে, একটা বিতৃষ্ণা নিয়েই চলে এসেছে। তারপরও কেন যেনো মন অপেক্ষা করে তওসিফ ওকে বাসায় ফিরিয়ে নেবার জন্য আসবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নাহ, আর আসবে না ও, সংসারটা হয়ত ভেঙেই যাবে। অথচ বিয়ের প্রথম দিকে তওসিফ কেমন সহজ সরল ছিল। ছোট্ট একটা ভাড়া বাসায় দু’জনের সংসার শুরু, অর্থের টানাটানি ছিল কিন্তু মায়ার কমতি ছিল না। কাজ ফুরোতে না ফুরোতেই তওসিফ বাসায় ফেরার জন্য আকুল থাকত। প্রায় প্রতিদিন ও কিছু না কিছু নিয়ে আসত মুনার জন্য। ওর মায়মুনা নামটা ছোট করে আদর করে মুনা নামে ডাকত।
তারপর হঠাৎ করেই তওসিফ ওর ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে থাকে, সাফল্য হাতের মুঠোয় ধরা দিতে থাকে। একটা সময় ভাড়া বাসা থেকে নিজেদের ফ্ল্যাটে ওঠে। মুনা নতুন করে সংসার গোছাতে ব্যস্ত হতে না হতেই সন্তানের মা হয়, জারিফ আসে। ছেলে, নতুন সংসার নিয়ে এতটাই ও ডুবে ছিল যে তওসিফের পরিবর্তনটা চোখে ধরা পড়েনি। তারপর হঠাৎ একদিন ও দেখতে পেল তওসিফের সেই সহজ সরল মুখটা বদলে কেমন চালাক চালাক একটা ভাব চলে এসেছে। পোষাক পরিচ্ছেদেও কেমন একটা বেশি বেশি সাজানো গোছানো ভাব, কথাতেও তাই। সবকিছু অনেক গোছানো, কিন্তু আগের সেই মায়াটা নেই। মুনার নিজেকেই মনে হতো ও তওসিফের সাথে যেনো ঠিকঠাক মিলিয়ে চলতে পারছে না। নিজের ভেতর ও আরো বেশি করে গুটিয়ে যাচ্ছিল আর তওসিফ যেনো আরো বেশি সরে যাচ্ছিল। আর ও যে সত্যিই ওর জীবন থেকে সরে গেছে তার খবরটা প্রথম পেয়েছিল একটা অজানা নাম্বারের ফোন থেকে। পরে অবশ্য যিনি ফোন করে খবরটা দিয়েছিলেন তাকে চিনতে পেরেছিল, অফিসের অনেক পুরনো পিয়ন, বাবুল। প্রায়ই বাসায় আসত, তওসিফকে দুপুরের খাবার ও নিজেই রান্না করে পাঠাত। সেই বাবুল সেদিন খবরটা জানিয়েছিল, হয়তো ও মানতে পারছিল না। তিন্নি নাম মেয়েটার, ওর অফিসেই কাজ করে। প্রায়ই নাকি ওদের একসাথে দেখা যায়, সেটা যতটা কাজে তার চেয়ে কাজের বাইরেই বেশি দেখা হয়।
মুনা একটু সচেতন হয়, একদিন তওসিফের মোবাইলে কিছু মেসেজ, মেয়েটার পাঠানো ছবি দেখে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। তওসিফকে সে কথা জিজ্ঞেস করেছিল, ভেবেছিল ও ধরা পড়ে যাওয়াতে লজ্জা পাবে। কিন্তু মুনা অবাক হয়ে খেয়াল করে তওসিফ এতটুকু লজ্জিত বা বিচলিত হয় না, উলটো স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, তুমি জেনেছ ভালো হয়েছে, আমি তিন্নিকে বিয়ে করব। তোমার স্থানে তুমি থাকবে। আর তুমি যদি না চাও তাহলে সেক্ষেত্রে ডিভোর্স দেব আমি।
সেদিনের পর মুনা আর থাকেনি, জারিফকে নিয়ে চলে এসেছে বাবার বাড়ি। শুধু ভাবে, অর্থ মানুষটাকে এমন পালটে দিল! বিষন্ন মনে এমন যখন ভাবছিল ঠিক তখনই কলিং বেলটা বেজে উঠে। মুনার বুকটা ধক করে ওঠে, তওসিফ না তো! প্রতিদিনই এমন ভুল ভাবনা হচ্ছে। মুনা তাও আশা নিয়ে যায়, দরজাটা খুলতেই একটা অপরিচিত মুখ, ওর বয়সীই হবে। ওকে দেখেই মেয়েটা জিজ্ঞেস করে, ‘এখানে কী মায়মুনা রহমান থাকেন?’
মুনা ওর সার্টিফিকেটের নামটা শুনে একটু থমকায়, তারপর মাথা নেড়ে বলে, ‘জ্বি, আমিই মায়মুনা রহমান, ডাক নাম মুনা। আপনি?’
মেয়েটা হেসে বলে, ‘আমিও মায়মুনা রহমান, আপনাদের পাশের বিল্ডিংয়েই থাকি। ভেতরে এসে একটু বসতে পারি?’
মুনা একটু অবাক হয়, বাহ, একই নামের আরেকটা মেয়ে, মজা তো! মুনা এবার হেসে বলে, ‘প্লিজ আসুন না।’
এমন সময় একটা কচি গলা শোনা যায়, ‘আম্মু, বাবা এসেছে?’
মুনা একটু অপ্রস্তুত হয়, তারপর সেই কচি গলার ছোট্ট ছেলেটা কাছে আসতেই মুনা বলে, ‘না জারিফ সোনা, তোমার একটা আন্টি, সালাম দাও।’
মায়মুনা ছোট্ট ছেলেটার মুখের দিকে তাকায়, তিন চার বছর বয়স হবে হয়ত। কী মায়া মুখটায়, আহারে বাবার জন্য বাচ্চাটার নিশ্চয়ই মন খারাপ হয়। এমন একটা বাচ্চা রেখে মানুষ কী করে এত পাষান হয়! আর মুনা নামের মেয়েটার মুখটাতে কেমন একটা অদ্ভুত সারল্য আছে, বিষাদ আছে। কেমন করে ও ডিভোর্স লেটারের এমন ভারী খামটা তুলে দেবে?
মায়মুনা বসতে বসতে বলে, ‘আমি এই কলোনীতে এসেছি মাত্র কয়েক বছর, আপনাকে দেখিনি অবশ্য।’
মুনা সহজ গলায় বলে, ‘এটা আমার বাবার বাড়ি, বিয়ের পর আসলে কমই আসা হয়। এবার অবশ্য অনেক দিন আছি। আচ্ছা, আপনি আমার নাম জানলেন কী করে? আর আমি এ বাসাতেই থাকি সেটাই বা জানলেন কী করে?’
মায়মুনা এবার ভীষণ বিপদেই পড়ে যায়, কী করে যে কথাটা বলবে। একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘আসলে আপনার একটা চিঠি ভুল করে আমার ঠিকানায় চলে এসেছিল। উম, আমি কী আপনার সাথে একটু একা কথা বলতে পারি? আপনার বাবা মা তো বাসায়, ওনাদের সামনে বলতে চাচ্ছি না।’
একটা অজানা আশংকায় মুনার বুকটা কেঁপে ওঠে, ঠোঁটটা কামড়ে বলে, ‘আপনি বলুন, বাবা মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছে।’
মায়মুনা ভেবে পায় না কথাটা কী করে শুরু করবে, আমতা আমতা করে বলে, ‘আচ্ছা, আপনার স্বামির নাম কী তওসিফ?’
বুকটা চলকে ওঠে, এই মেয়ে না জানি আবার কোন খবর নিয়ে এসেছে। শুকনো মুখে বলে, ‘হ্যাঁ, কিন্তু কেনো বলুন তো?’
মায়মুনা একটু চুপ করে ভাবে, তারপর হ্যান্ডব্যাগ থেকে খামটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘এই চিঠিটা আপনার।’
মুনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার তাকায়, তারপর চিঠিটা হাতে নিয়ে চোখ বোলায়। মুহুর্তেই শুকনো চোখটা ভিজে ওঠে মনের অজান্তেই, তিরতির করে ঠোঁটটা কাঁপতে থাকে। মায়মুনা এবার পাশে গিয়ে বসে একটা হাতে ওকে জড়িয়ে ধরতেই মুনা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। দূর থেকে জারিফ দৌড়ে এসে অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। অবুঝ ছেলেটাও এবার মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
মায়মুনার নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে, দোষটা যেনো ওর। ঠিক কী বলে এই পরিস্থিতিতে সান্ত্বনা দেওয়া যায় ওর জানা নেই।
মুনা একটু স্বাভাবিক হতেই, নাক টেনে বলে, ‘সরি, আপনি কিছু মনে করবেন না। আসলে আপনার সাথে আজই প্রথম পরিচয়, অথচ আপনাকে খুব আপন মনে হয়েছে। আমাদের সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছিল না, এই চিঠিটা আসবে সেটা মনের কোণে ছিল।’
মায়মুনা একটু হাহাকার করা গলায় বলে, ‘কিন্তু, সম্পর্কটা কী কোনোভাবেই ঠিক করা যায় না?’
মুনা একটা বিষন্ন হাসি হাসে, বলে, ‘সেটা তো আমার হাতে নেই, তওসিফ তো আর চায় না এই সম্পর্কটা।’
মায়মুনা একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘আমি একটু আপনার স্বামির সাথে কথা বলতে চাই। তার আগে আপনি কী আমাকে বলবেন কেন এই পর্যায়ে আসল। আর আমার মনে হয় আমরা সমবয়সী, আমাকে তুমি করেই বলো।’
মুনা চোখটা মুছে একটু হাসে, ‘কেন জানি তোমাকে আসলেই আপন মনে হচ্ছে। একজন কাউকে তো বলতে না পারলে মনটা হালকাও হবে না।’
এরপর মুনা একে একে সব বলে, তওসিফের পালটে যাওয়া, তিন্নির সাথে জুড়ে যাওয়া, সব। মায়মুনা যতই শোনে ও ততোই অবাক হতে থাকে। ওর কাছে প্রথমে মনে হয়েছিল, ওর বাচ্চা নেই তাই বুঝি ফয়সাল ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছিল। অথচ এদের একটা ফুটফুটে বাচ্চা আছে, তার মুখের দিকেও তওসিফ তাকাল না? এমন করে লোকটা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ল? একটা সন্তানের জন্য ওর আর ফয়সালের কী দারুণ অপেক্ষা, আর লোকটা সেটা পেয়েও এমন করে দূরে সরে যাচ্ছে? যতটুকু ও বুঝতে পারল, অন্তত মুনার ভাষ্যমতে, তওসিফ একটা মোহে পড়ে গেছে।
মুনার জীবনকথা যখন শেষ হয় তখন একটা দীর্ঘ নীরবতা নেমে আসে। মায়মুনা ওর হাত ধরে বলে, ‘মুনা, আমি একবার চেষ্টা করতে চাই। তুমি আমাকে তোমাদের বাসার ঠিকানাটা দাও, আর ওই তিন্নি নামের মেয়েটার ফোন নাম্বারটা, যদি থাকে।’
মুনা দ্বিধান্বিত চোখে তাকায়, তারপর বলে, ‘কী হবে এসব করে বলো তো। তওসিফ ফিরে আসবে না, অনেকবার এটা নিয়ে কথা কাটাকাটি, ঝগড়াঝাটি হয়েছে। ও ফেরেনি, ফিরবেও না।আর এখন তো ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েই দিয়েছে।’
মায়মুনা মাথা নেড়ে বলে, ‘তাও আমি একবার ওদের সাথে কথা বলতে চাই। একটু বুঝতেও চাই কেনো মানুষ এমন করে।’
মুনা একটা কষ্টের হাসি হাসে, ‘আমিও বুঝিনি, মানুষ কেন এমন করে। তুমি বুঝতে পারলে আমাকে একটু জানিও। আর এই নাও ওর ঠিকানা। তিন্নির মোবাইল নাম্বারটা আছে আমার কাছে, ওর সাথে আমি কথা বলেছিলাম, দেখাও করেছিলাম। হ্যাঁ মেয়েটা বেশ সুন্দর, ধারালো চেহারা। তওসিফের সাথে মানায় খুব, একই পথের মানুষ যেনো ওরা।’
মায়মুনা ওর দুঃখবোধটা টের পায়, ওর হাতে একটা চাপ দিয়ে বলে, ‘আচ্ছা শোন, আপাতত এই চিঠির কথা কাউকে বলো না, আমাকে অন্তত কয়েকটা দিন সময় দাও। আমি তো বাসায় সারাদিন একাই থাকি, তুমি জারিফকে নিয়ে অবশ্যই চলে আসবা, প্রতিদিন। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু ভালো কেক বানাই।’
মুনা এবার হাসে, বলে, ‘অবশ্যই যাব। আর তুমি একটু বসো, একটু চা অন্তত করে নিয়ে আসি।’
দুইজন মায়মুনা একটা কষ্ট ভাগ করে নিয়ে চায়ে চুমুক দিতে থাকে। প্রথম যে মায়মুনা, সে ভাবছে তার পরবর্তী সাক্ষাৎ, তিন্নি বা তওসিফের সাথে কেমন হবে, ওদের কী ও বোঝাতে পারবে? আর আমাদের দ্বিতীয় মায়মুনা, মানে মুনা, ও ভাবছে এরপরের জীবনটুকু একাই চলতে হবে, সামনে আবার নতুন আরেকটা জীবনযুদ্ধ।
চলবে…..
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর