রোদ-শুভ্রর প্রেমকথন
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
শুভ্র ভাই জাপান থেকে ফিরে আসায় আমার গোষ্ঠীতে ছোট খাটো এক বিস্ফোরণ ঘটে গেলো। কাজিন মহল, ফুপুমহল, চাচিমহল এবং অন্দরমহলের প্রতিটি আলোচনায় শুভ্র ভাই বিষয়ক খবরে হৈ হৈ পড়ে গেলো। বাহুবলী সিনেমার সেই বিখ্যাত প্রশ্নটির মতোই মুখে মুখে চর্চা হতে লাগলো একই প্রশ্ন, ‘শুভ্র জাপান থেকে কেন এলো?’, ‘কেন এলো?’
আমার তখন সংকটাপন্ন অবস্থা। মনের দুঃখে গৃহ সন্ন্যাসী হয়েছি। দরজা, জানালা বন্ধ করে কারো সাথে কথা না বলার কঠিন ব্রতে ব্রতী হয়েছি। এই ব্রত গ্রহণের পেছনে অবশ্য কারণ আছে। এই কঠিন অনুসন্ধানী পরিস্থিতিতে আমি হঠাৎ উপলব্ধি করেছি, আমি শুভ্র ভাইয়ের প্রেমে পড়েছি। যেমন তেমন প্রেম নয়; কঠিন প্রেম। এতোই কঠিন যে, শুভ্র ভাইয়ের নাম শোনামাত্রই গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। মাথার ভেতর ঝিমঝিম এক ব্যথা হচ্ছে। আমি এই জ্বরের আলাদা একটা নাম দিয়েছি। এই জ্বরের নাম দিয়েছি, প্রেমজ্বর। প্রেমজ্বরে ভোগা বড়ো কষ্ট। দুনিয়ার সমুদয় বিপদ-আপদে পড়তে হয়। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। মস্তিষ্ক জুড়ে কী সব অশ্লীল অশ্লীল ভাবনা আসছে। দিনে একশোবার তওবার দোয়া আওড়াতে হচ্ছে। তার থেকেও বড়ো সমস্যা হলো, শুভ্র ভাইকে ব্ল্যান্ড করে, জুস বানিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আরও একটা সমস্যা হয়েছে। এই সমস্যাটা মারাত্মক। প্রেমজ্বরের সাইড ইফেক্ট হিসেবে মাথার ভেতর খুবই বিশ্রী একটা গান সেট হয়ে গিয়েছে। গানটা মস্তিষ্কে ক্যাসেটের মতো দিন-রাত বেজে চলেছে। মস্তিষ্কের বাজাবাজি কখনো-বা মুখেও চলে আসছে। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গাইতে শুরু করছি,
‘ প্রেমে পড়েছে মন, প্রেমে পড়েছে,
অচেনা এক মানুষ আমায় পাগল করেছে!
সে আমার সাথেই চলে, কখনো কথা বলে,
কখনো অনুভবে মিশে আছে মনে হয়।
ভাবে মন আবল তাবল,
লাগেরে পাগল পাগল।
প্রেমে পড়েছে মন, প্রেমে পড়েছে।’
অত্যন্ত সন্দেহভাজন গান। মানসম্মানের মাথা খেয়ে এই সন্দেহভাজন গানটা আমি গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত কম করে হলেও একশোবার গেয়েছি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সুন্দর সুন্দর স্বপ্নদৃশ্যেও আমি খ্যাঁক খ্যাঁক কন্ঠে এই একই গান গাইছি। গানের সাথে নাচ চলছে। নাচের স্টেপ চূড়ান্ত অদ্ভুত। স্বপ্নের মাঝেই আমি বুঝে ফেলেছি, আমি সাবানা-আলামগীরের যুগে চলে গিয়েছি। আমি সাবানা, শুভ্র ভাই আলমগীর। আহা কী নৃত্য! নৃত্যর মাঝে মাঝেই শুভ্র ভাই থমকে দাঁড়াচ্ছেন। চোখ রাঙাচ্ছেন। আমার বেসুরা গানের জন্য ধমকে ধমকে অস্থির করে দিচ্ছেন। আমার বেসুরা গান শুনে নাকি তার কান কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কানের ইনপুট আউটপুট সব ডাউন। একেবারে বিদিগিস্তা অবস্থা। এমন একটা ভয়াবহ স্বপ্ন দেখার পরও আমি খুব উৎসাহ নিয়ে সকাল-দুপুর-রাত এই একই গান গেয়ে চলেছি। মাঝে মাঝে মধ্যরাতে কম্বলে কান-মাথা ঢেকে কম্বলের তলা থেকেই গলা ছেড়ে গান ধরছি। আর প্রতিবারই নীলাপু চমকে চমকে উঠছেন। দুনিয়ার সকল সন্দেহ দু’চোখে নিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে থাকছেন। মোটকথা, প্রেমে পড়ে ভীষণ বিপদে পড়ে গিয়েছি। বিপদে বিপদে নাভিশ্বাস অবস্থা। কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ নয়। বিপদ আরও বাকি আছে। এই নাভিশ্বাস অবস্থাতেই বাবা আরও একটা বিপদ ঘটিয়ে ফেলেছেন। হঠাৎ করেই আদেশ জারি করেছেন, ‘আমাকে এই মুহূর্তে বাড়ি ফিরতে হবে। এসব জ্বর-ঠান্ডা নিয়ে একা থাকতে চাইলে পড়াশোনার পাঠ এখানেই সমাপ্ত। সকল খরচাপাতি বন্ধ।’ বড়োই নিষ্ঠুর আদেশপত্র। আমার প্রেমের পারদ তখন নাইন্টি নাইন ডিগ্রি ফারেনহাইটে চলছে। “শুভ্র ভাই”, নাম শুনলেই ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটে যাচ্ছে। বুকের ভেতর সিডর-আইলা হচ্ছে। জ্বর-টর উঠে শরীরে এইট পয়েন্ট ফাইভ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প বয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে চরপাড়ায় তখন শুভ্র ভাইয়ের জয়জয়কার। আকাশে-বাতাসে শুভ্র ভাইয়ের গন্ধ। বাড়ির আনাচে-কানাচে শুভ্র ভাইয়ের গল্প। চরপাড়া গেলেই পারদে পারদে সংঘর্ষ হয়ে আগ্নেয়গিরি ঘটে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। কিন্তু কিছু করার নেই। আমার এই উর্ধমুখী প্রেম পারদ নিয়ে শুভ্র ভাইয়ের গল্পে ভরা, গন্ধে ভরা পরিবেশে থাকলে যে বিস্ফোরণ টিস্ফোরণ ঘটে বিপদ-আপদ ঘটে যেতে পারে, তা পিতা মহোদয়কে জানানো যাবে না। আর যায় হোক, বাবার সাথে কঠিন প্রেম নিয়ে আলাপচারিতা করা যায় না। সুতরাং, আমি ছল ছল নয়নে, হাসিমাখা বদনে বাবার আদেশ মেনে নিতে বাধ্য হলাম। জামা-কাপড় গোছাতে গোছাতে রাফিয়াকে ফোন দিলাম,
‘ শোন রাফু! একটা ব্লান্ডার রেডি রাখ। আই শয়ার, এই বান্দা যদি ভুল করেও আমার সামনে পড়ে যায়। আমি তাকে ধরে কোনো রকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই ব্লান্ডারে ঢুকাবো। তারপর জুস বানিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলবো। জুস উইদআউট সুগার।’
রাফিয়া বিস্ময়ে ‘হা’ হয়ে গেলো। আমি তার ‘হা’ হয়ে যাওয়া বিস্মিত মুখটা কল্পনা করলাম। ফোন কানে ‘হা’ হয়ে থাকা গোলগাল, সুন্দর একটি মুখ। সুন্দর মুখে যেকোনো সময় মশা-মাছি ঢুকে যেতে পারে। রাফিয়া কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বিস্মিত কন্ঠে শুধালো,
‘ ওকেই! কিন্তু বান্দাটা কে?’
‘ যাকে জুস বানিয়ে খাবো সে।’
‘ সেই তো। খাবিটা কাকে?’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
‘ তোকে।’
জামা-কাপড় গুছিয়ে বাসায় যাওয়ার আগে আগে দরজা-জানালা বন্ধ করে আধাঘন্টার জন্য ঋষি-দরবেশ পর্যায়ে চলে গেলাম আমি। পদ্মাসনে বসে গভীর ধ্যানে মন বেচারার হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করলাম,
‘হে আমার বেয়াদব, জঙ্গলি মন? দয়া করে একটু কন্ট্রোলে থাকিস। এবারের মতো ক্ষেমা দিস। তোর সহস্র বছরের ক্ষুধার্ত হৃদয়কে দুই দিনের জন্য নিরামিষভোজী সন্ন্যাসী বানিয়ে একটু সুস্থ, স্বাভাবিক ব্যবহার করিস। প্লিজ! মনে মনে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যাস না। প্রেমের মরা জলে ডুবে না।’
জঙ্গলি মন আমাকে ভয়াবহ রকম অপদস্ত করে জানালো,
‘ওয়েল, আই উইল ট্রাই!’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকে বিশ্বাস করলাম। বুকের ভেতর বিশাল এক প্রেম পারদ নিয়ে বাবার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। চরপাড়ায়, আমার নিজের বাসার দুই তলায় উঠতেই বিপদসংকেত বেজে উঠলো। রাফিয়া আমাকে দেখেই দৌঁড়ে এসে বললো,
‘ কী সাংঘাতিক একটা কান্ড ঘটেছে জানিস, রোদু?’
আমি চোখ-মুখ শক্ত করে বললাম,
‘ জানি না। জানতে চাইও না। আমার জীবনটাই এখন সাংঘাতিক বিপদের উপর চলছে। নতুন কোনো সাংঘাতিক খবর শুনতে ইচ্ছে করছে না।’
আমার নিস্পৃহ আচরণে রাফিয়া দমলো না। আমার পেছন পেছন আমার ঘর পর্যন্ত এলো। উচ্ছ্বাস নিয়ে বললো,
‘ জানিস? শুভ্র ভাই নাকি পড়াশোনা ছেড়েছুড়ে দেশে চলে এসেছেন। উনার দেশে আসার মুলীভূত কারণ হচ্ছে, মাছ চাষ করা। শুভ্র ভাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ইঞ্জিনিয়ারিং টিঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে মাছের ব্যবসা করবেন। তাজা তাজা মাছ ধরে আত্মীয় স্বজনের বাসায় ডেলিভারি দিবেন।
সবার আগে দিবেন মেজো ফুপার বাসায়। মেজো ফুপা আগেই অর্ডার কনফার্ম করে ফেলেছেন। অর্ডারে কোনো নড়চড় হবে না।’
“শুভ্র ভাই”, নামটা কর্ণ গহ্বরে পৌঁছাতেই আমার প্রেম পারদে উর্ধমুখী-নিম্নমুখী, নিম্নমুখী-উর্ধমুখী ছুটোছুটি পড়ে গেলো । আমি লম্বা একটা দম নিলাম। বুকের ভেতরের জঙ্গলি মনটাকে বড়ো কষ্টে শান্ত করে শক্ত কন্ঠে বললাম,
‘ আমি তোকে একবারও বলেছি, আমি শুভ্র ভাইয়ের খবর শুনতে চাই? উনার ইচ্ছে হলে উনি মাছের ব্যবসা করুক। প্রয়োজনে হাঁড়ি হাঁড়ি মশার ব্যবসা করুক। তাতে আমার বাপের কী? খবরদার, আমার সামনে শুভ্র ভাই, শুভ্র ভাই জপ করবি না। আমার সামনে শুভ্র ভাই, শুভ্র ভাই জপ করা নিষিদ্ধ। মনে থাকবে?’
রাফিয়া কিছু বলতে গিয়েও বিরসমুখে বসে রইলো। অর্থাৎ, শুভ্র ভাই সম্পর্কে খবর তার শেষ হয়নি। খবর আরও বাকি আছে। অনুমতি পেলে, সেই খবরগুলোও সে নির্দ্বিধায় উগরে ফেলতে চায়। আমি রাফিয়ার বিরসমুখের চাহনিকে অগ্রাহ্য করে চোখ-মুখ শক্ত করে বসে রইলাম। মন মেজাজ অত্যধিক খারাপ। রাফিয়া অবশ্য আমার মেজাজ খারাপকে বিশেষ গুরুত্ব দিলো না। দুনিয়ার সকল খবর সে উগরে যেতে লাগলো। কথায়, ইঙ্গিতে একরকম প্রমাণ করে ফেললো এই দুনিয়ায় শুভ্র ভাই ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই। আমরা সবাই গরু। আমি রাফিয়ার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জায়গাটা থেকে সরে এলাম। কিন্তু সরে গিয়েই পড়লাম, আরেক তপোবলের সামনে। বসার ঘরে বসে গল্প করতে করতে রান্নার জোগাড় করছেন আমার চাচি-ফুপুরা। শুভ্র ভাইয়ের দেশে ফেরা উপলক্ষে তারা আপাতত ময়মনসিংহেই অবস্থান করছেন। তাদের কাউকেই দাওয়াত দেওয়া হয়নি। তবুও তারা খুব উৎসাহ নিয়ে থিতু হয়েছেন এবং আমার জীবনটা নাশ নাশ করে যেখানে সেখানে শুভ্র ভাই নিয়ে সমালোচনা চালাচ্ছেন।
“কেন ছেলেটা দেশে এলো? অমুকের ননাসের দেবরের শালীর ছেলে বিদেশে পড়তে গিয়েছে আজ চার বছর। এর মাঝে একবারও দেশে আসার সুযোগ পায়নি। পড়াশোনার খুব চাপ। তাহলে শুভ্র চার মাসের মাথায় চলে এলো কেন? ওখানে কী কোনো কান্ড টান্ড ঘটিয়েছে? কোনো মেয়ে ঘটিত চক্কর? একেবারে চলে এসেছে নাকি আবার যাবে? মেজো দুলাভাই বললো, পড়াশোনা ছেড়ে নাকি মাছের ব্যবসা করবে? ওর মাও নাকি জানতো না আসার কথা? ব্যাপারটা কী? ইত্যাদি ইত্যাদি…. “
চাচি-ফুপুদের মুখে ভাতিজার রঙ-বেরঙের গল্প শুনে আম্মুর মেজাজ তিনশো ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে আছে। যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই ধমকাধমকি করে অস্থির করে ফেলছে। সব মিলিয়ে বাসার অবস্থা উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরির মতোই উত্তপ্ত হয়ে আছে। শুধুমাত্র একজন মানুষের আগমন আমাদের মরা বাড়িটিকে এক পলকে নাট্যশালা বানিয়ে ছেড়েছে। এবং ক্রমাগত তাকে নিয়ে নাটক-সিনেমা চলছে। এই এতো এতো নাটক-সিনেমায় একমাত্র আমিই মূর্তির মতো মর্মাহত মন নিয়ে বসে আছি। আমার মাথায় তখনও ক্যাসেটের মতো বেজে চলেছে, ‘প্রেমে পড়েছে মন। প্রেমে পড়েছে।’ আমার এই মর্মাহত মনকে আরও মর্মাহত করে দিতে দুপুরের আগে আগেই বাসায় এসে পৌঁছালো আপু। আমাকে কোনোরকম প্রতিক্রিয়াহীনভাবে বসে থাকতে দেখে আশ্চর্য হলেন। আপুর বাসায় আসার নিজস্ব একটা নিয়ম আছে। সে টাঙ্গাইল থেকে বাসায় আসার পর ঘন্টাখানেক সময় অত্যন্ত শিশু শিশু ব্যবহার করেন। সেই সময়টাতে দুনিয়ার সবকিছু নিয়েই তার অভিমান হয়। কেউ এক গ্লাস পানি খেলেও অভিমান হয়। তাকে ছাড়া কেন খেলো? আপু খুব অভিমানী কন্ঠে বললো,
‘ আমাকে আসতে দেখেও তুই এমন পাবদা মাছের মতো বসে আছিস কেন? জিজ্ঞেস কর, আমি কেমন আছি?’
আমি চোখ তুলে চাইলাম। মন খারাপ করা কন্ঠে শুধালাম,
‘ তুমি কেমন আছো?’
আপু তার থেকেও মন খারাপ করা কন্ঠে উত্তর দিলো,
‘ তুই এমন মন খারাপ করে প্রশ্ন করছিস কেন? খুশি হয়ে প্রশ্ন কর।’
আমি খুশি হতে পারলাম না। আপুর বাসায় আসা মানেই ঘর শেয়ার করা আর দিন-রাত একই প্রশ্নের জ্বালাতনে আত্মাহুতি দেওয়া। আমি উদাস কন্ঠে বললাম,
‘ তুমি কোথা থেকে টপকালে হঠাৎ? তোমার না পরশু সেমিস্টার ফাইনাল? এই সময়ে বাসায় কী কাজ?’
আপু মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময় নিয়ে বললো,
‘ বাসায় এমন একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে আর আমি আসবো না?’
আমি আশ্চর্য হলাম। বাসায় কী ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যেতে পারে, চিন্তা করার চেষ্টা করলাম। চিন্তা সফল হলো না। কোনো মর্মান্তিক ঘটনা মনে পড়ছে না। বিভ্রান্ত কন্ঠে বললাম,
‘ মর্মান্তিক ঘটনা?’
আপু খুব স্বাভাবিক স্বরে বললো,
‘ তো? শুভ্র ভাই হুট করে সব ছেড়েছুড়ে দেশে চলে এলো। ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে মাছের ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো এটা মর্মান্তিক ঘটনা না?’
আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। ‘যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া-পড়শীর ঘুম নাই’ প্রবাদটির অর্থটাও বেশ ভালো রকমভাবে বোধগম্য হলো। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে আপুর ভাষ্যমতে ‘পাবদা’ মাছের মতো পড়ে রইলাম। মন-মেজাজ ভালো নেই। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। থেকে থেকেই কান্না কান্না কষ্ট হচ্ছে। সেই কষ্টটাকেই আবার স্কচটেপ দিয়ে আটকে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে বুকের ভেতর। আমি ভীষণ চুপিচুপি অনুভব করলাম, আমার খুব শুভ্র ভাইয়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। আদুরে বিড়াল ছানাটির মতোই ল্যাপ্টে থাকতে ইচ্ছে করছে উনার বুকের কাছে। আবার অন্য একটা মন প্রাণপণ উনাকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। এই দুই সত্তার দ্বন্দ যুদ্ধে আমি বড়ো দিশেহারা বোধ করলাম। চোখ-মুখ খিঁচে বন্ধ করে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম। আজ সারাদিন বিছানা না ছাড়ার কঠিন প্রতিজ্ঞা নিলাম। কিন্তু প্রতিজ্ঞা বেশিক্ষণ টিকলো না। ঘড়ির কাটা দুপুর গড়িয়ে বিকেলের গন্ডীতে পা রাখতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে একে একে আলিফ ভাই, অদুত ভাই, রাতুল ভাই, মিলাত ভাই, মিথি আপু, চয়ন ভাইয়া সকলেই এসে উপস্থিত হলো। আলিফ ভাইয়ের প্রফের প্রস্তুতি, অদুত ভাই আর আপুর সেমিস্টার পরীক্ষা, রাতুল ভাইয়ের ক্লাস-ল্যাব ফেলে এভাবে ছুটে আসতে দেখে বিষয়টাকে কিঞ্চিৎ মর্মান্তিক বলেই বোধ হলো।
সব কাজিনদের উপস্থিতিতে মাস কয়েক আগের মরা মরা বাড়িটা যেন হৈ হৈ করে উঠলো। বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে বাহারি রান্নার সুবাস। ফিসফিস আলোচনা। হৈ হৈ চিৎকার আর হাসির কলকল ধ্বনিতে মনে হলো বহু বছর পর মৃত্যুপুরীতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলো। একটি মানুষের নামেই যে কী দৃঢ় প্রাণশক্তি! সে প্রাণশক্তিতে আমি বড়ো আশ্চর্য হলাম। পেটের ভেতর গুড়গুড় ধ্বনি উঠলো। বুকে কী অসহ্য ব্যথা! আমি জানি না। আমি বুঝি না। আপনারা বলুন, প্রেমে পড়া মানেই কী মর্মান্তিক মর্মকথা? পৌষের সকালের মতো হুহু বিষণ্ণ বাতাস বয়ে যায় আমার মনে। এই গোটা পৃথিবীকে থমকে দিতে ইচ্ছে হয়। বুকের ভেতর প্রেম প্রেম অদ্ভুত এক দুঃখ-সুখের মিশ্রণ নিয়ে আমার এই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে হয়। কখনো-বা মেরে ফেলতে ইচ্ছে হয় সেই প্রাণশক্তিতে ভরপুর, নষ্ট কথা বলা মানুষটিকে। তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে অথবা তার ঘর্মাক্ত পাঞ্জাবির কলার চেপে প্রবল প্রতাপে ঘোষণা করতে ইচ্ছে হয়, ‘আপনি শুধু আমার! আমার! আমার! আমিহীন পৃথিবী আপনার জন্য নিষিদ্ধ, মনে থাকবে?’ আমার এই ছেলেমানুষি কথায় কী হেসে ফেলবে সে? নাকি মাথা পেতে নিবে সকল সকল অন্যায় শর্তের ফর্দ? তাকে নিয়ে ভাবতে বসেও আমার বুক হাহাকার করে কান্না পেলো। আমি দু’হাতে মুখ চেপে আচমকা হু হু করে কেঁদে উঠলাম। বাড়িতে এতো মানুষ। এসময় এই কান্না, এতো প্রশ্ন এতো লজ্জার! তবুও যেন আর কোনো উপায় খুঁজে পেলাম না। সুপ্ত আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা গেলো না। বিস্ময় আর হতাশা নিয়ে আবিষ্কার করলাম, এই মুহূর্তে আমার শুভ্র ভাই ছাড়া আর কাউকে সহ্য হচ্ছে না। কারো কথা ভালো লাগছে না। কারো আহ্লাদ ভালো লাগছে না। একদম অযথায় শুভ্র ভাইকে আমার খুন করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমার মৃদু ফোঁপানোর আওয়াজে ছুটে এলো আপু। অবাক হয়ে বললো,
‘ কী হয়েছে?’
আপুর প্রশ্নে ভেতরে ভেতরে লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেও কান্নার গতি বেড়ে গেলো আমার। এই বিশ্রী প্রেম অসুখে আমি অতিষ্ঠ হয়ে বললাম,
‘ তুমি যাও তো আপু। আমার সব অসহ্য লাগছে। আমাকে কোনো প্রশ্ন করবে না।’
আপু বিনা বাক্যব্যয়ে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই হন্তদন্ত হয়ে এলেন আম্মু। আর তার পেছন পেছন আমার পুরো গোষ্ঠী। ঘরে এসেই আম্মু উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালেন,
‘ জ্বর বেড়েছে বাবু। বেশি খারাপ লাগছে?’
আম্মুর একটুখানি প্রশ্রয়মাখা কন্ঠে আমার দুনিয়া ভেঙে কান্না পেলো। আমি হাত থেকে মুখ সরিয়ে দুই হাতে আম্মুর কোমর চেপে বুকে মুখ গুঁজলাম। কাঁদতে কাঁদতে আমার হেঁচকি উঠে গেলো। আম্মু আমার কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে গজগজ করতে লাগলেন,
‘ জ্বরে গা’টা পুড়ে যাচ্ছে। এই রুহি তোর বাপকে ডাক। সকালবেলা বলেছিলাম একটা ডাক্তার দেখিয়ে আনতে। অথচ তার কোনো হেলদোল নাই। নিজের ছেলেমেয়েদের প্রতি কোনো নজর নাই, নেমেছে গোষ্ঠীর ভবিষ্যত উদ্ধার করতে। বের করবো আমি তার গোষ্ঠীর উদ্ধার। আমি আর আমার মেয়েরা তো নদীতে ভেসে এসেছি। সারাটা জীবন এমন একচক্ষুপনা আমার ছেলেমেয়েদের সাথে।’
সেদিন যে আমি কেনো এতো কান্নাকাটি করলাম সে উত্তর আমার জানা নেই। কান্নার পরের সেই ভয়াবহ মাথাব্যথা আমাকে সে বিষয়ে ভাবার ফুরসৎ-ও অবশ্য দেয়নি। আমি কান্নাকাটি করে দুর্বল শরীরে বিছানা নিলাম। কেউ আমায় খুব একটা জ্বালালো না। কেবল আলিফ ভাই বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘ শুভ্র ভাই কিন্তু ঠিকই বলে রোদু। তুই আসলেই একটা ডিস্টার্ব। কই ভাবলাম সবাই মিলে একটু হৈ চৈ করবো ওমনি তোর জ্বর উঠে অজ্ঞান হয়ে যেতে হলো। একেবারে কেঁদেকেটে অস্থির। এখন একটু হৈ হৈ করলেই বড়ো মামী ঝাড়ু দিয়ে কেলাবে। যন্ত্রণা!’
আমি প্রত্যুত্তরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। রাতে রাফিয়া ঘুমুতে এলে ওকে শুধালাম,
‘ কখনো প্রেমে পড়েছিস রাফিয়া?’
রাফিয়া ফোন স্ক্রল করছিলো। অবাক হয়ে বললো,
‘ আমি তো প্রতিদিনই প্রেমে পড়ি।’
‘ ওমন প্রেম না। খুব শক্ত প্রেম। যে প্রেমে তোর দিন-দুনিয়া সব অসহ্য লাগবে। তার কথা ভাবলেই মাথা ঘুরবে। মনে হবে, সে তোকে ছেড়ে কিছুটা দূরে গেলেই দমবন্ধ হয়ে মরে যাবি?’
রাফিয়া চোখ গোল গোল করে চাইলো। ভেবে বললো,
‘ ধুর! ওমন হয় নাকি? তবে সব প্রেমেই প্রথম কিছুদিন তাকে ছাড়া অন্ধ অন্ধ মনে হয়। তারপর চেনা পরিচয় হয়ে গেলে ধীরে ধীরে অন্ধ অন্ধ ভাবটা কমে আসে।’
আমি নিরাশ কন্ঠে বললাম,
‘ তোর প্রেম তাহলে ভালো প্রেম। আমি বোধহয় খুব খারাপ ধরনের প্রেমে পড়েছি রাফিয়া। আমি তাকে অনেকগুলো বছর ধরে জানতে জানতে আচমকা তার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। এখন আমার দমবন্ধ লাগছে। সেই লোকটাকে দিন-রাত চোখের সামনে বসিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে। অযথা কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মন খারাপ লাগছে। সবকিছু কেমন অসহ্য অসহ্য লাগছে।’
রাফিয়া আমার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো,
‘ ইয়া মা’বুদ! তুই প্রেমে পড়েছিস? সিরিয়াসলি! তোর মাঝে প্রেমে পড়ার মতো কোনো সরঞ্জাম আছে? কার প্রেমে পড়েছিস তুই? আল্লাহ! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না।’
আমি বিরক্ত হয়ে ধমক দিলাম,
‘ চুপ! চেঁচাচ্ছিস কেন? বিষয়টা যদি কেউ জানে তাহলে কিন্তু তোর খবর আছে। তোর বয়ফ্রেন্ডের লিস্ট ধরিয়ে দেব মেজো কাকির হাতে।’
রাফিয়া গলার স্বর নিচু করলো। ফোন ফেলে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বললো,
‘ আরে ধুর! আমি কাকে বলবো? বল না! বল না! কার প্রেমে পড়লি তার নাম বল না? আমি ভীষণ এক্সাইটেড। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।’
‘ পৃথিবীর সব ছেলেকে যেন চিনে বসে আছিস তুই? নাম বললেই চিনে ফেলবি?’
রাফিয়া মন খারাপ করা কন্ঠে বললো,
‘ না চিনলেই নাম শোনা যাবে না?’
আমি বললাম,
‘ না। শোনা যাবে না।’
রাফিয়া উৎসাহ নিয়ে বললো,
‘ আচ্ছা, বেশ! নাম না বললি। কী করে প্রেমে পড়লি সেটা তো বল?’
আমি অসহায় দৃষ্টিতে চাইলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ জানি না রে। হঠাৎ করে সব এলেমেলো হয়ে গেলো। এমন নয় যে তাকে আমি প্রথম দেখেছি, প্রথম জেনেছি। সে আমার অনেক দিনের চেনা। তারপর আমাদের মাঝে খুব দূরত্ব এলো। তারপর যখন আবার কাছাকাছি এলাম। আমার মনে হলো আমার পৃথিবীটাই যেন থমকে গেলো। এটা যে কেমন অনুভূতি বলে বুঝানো যাবে না।’
রাফিয়া অবাক হয়ে আমার কথা শুনছিলো। কৌতূহল নিয়ে বললো,
‘ তোর প্রেমের কথাটা সে জানে?’
আমি মাথা নাড়লাম। রাফিয়া খুশি হয়ে শুধালো,
‘ বলবি কবে?’
আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ বোধহয় কোনোদিনও না।’
রাফিয়ার চোখ কপালে উঠলো এবার,
‘ সেকি! কেন?’
‘ বললে সে খুব হাসবে। হাসতে হাসতে মরে যাবে। আর যখনই সুযোগ পাবে তখনই খোঁচাবে। এই ধরনের মানুষকে প্রেমের কথা বলা যায় না।’
রাফিয়া হতাশ হয়ে বললো,
‘ তাহলে তুই অপেক্ষা কর। হয়তো সে তোকে প্রপোজ করবে?’
‘ সেই সম্ভবনাও নেই।’
‘ কেন? সেই লোকের কী গার্লফ্রেন্ড টার্লফ্রেন্ড আছে নাকি?’
আমার মাথায় একটু দুষ্টুমি খেলে গেলো। চোখে-মুখে হতাশ ভাব ফুটিয়ে তুলে বললাম,
‘ উঁহু। গার্লফ্রেন্ড নেই কিন্তু বউ আছে। লোকটা বিবাহিত। বউ ছাড়া কিছু বুঝে না। আমি প্রপোজ করলে তাদের সংসারে ফাটল ধরবে না?’
রাফিয়ার এবার বিস্ময়ে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। সে চিৎকার করে বললো,
‘ ইয়া মা’বুদ! তুই শেষমেশ একটা বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়ে গেলি রোদু! ইয়া আল্লাহ!’
পরমুহূর্তেই সে খুব মর্মাহত কন্ঠে বললো,
‘ আমার তোর জন্য এতো খারাপ লাগছে! কী দরকার ছিলো একটা বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়ার?’
আমি উদাস কন্ঠে বললাম,
‘ কেউ কী শখ করে প্রেমে পড়ে? হয়ে যায়।’
রাফিয়া চূড়ান্ত মর্মাহত হয়ে ঘোষণা করলো সে দুইদিনের জন্য শোক পালন করবে। প্রেমিককে ফোন করে খুব কঠিন কন্ঠে জানিয়ে দিলো, আগামী দুইদিন খবরদার কোনো ফোন টোন করবে না। এই দুইদিন ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ।
পরেরদিন সকালবেলা আমার ঘুম ভাঙলো প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়ে। বাড়ির হাওয়ায় তখন ভাপা আর চিতইয়ের সুঘ্রাণ। ডানপাশের জানালাটা খোলা। শীতের সকালের সোনালু রোদ্দুর এসে পড়ছে বিছানায়। ঘরের বাইরে থেকে চাপা হৈ হুল্লোড় কানে আসছে। চারপাশে আনন্দ আনন্দ সুবাস। উৎসব উৎসব গন্ধ। আমি আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলাম। কান্না আর অতিরিক্ত ঘুমে ফোলা ফোলা চোখদুটো বার কয়েক পিটপিট করে ছড়ানো ছিটানো চুলগুলো খোঁপা করতে নিতেই দৌঁড়ে এলো আদিবা। জানালো,
‘ আজকে অনেকগুলো পিঠা বানানো হয়েছে। এত্তো বড়ো হাঁড়ি ভরে গেছে। অদুত ভাইয়া, আলিফ ভাইয়া আর রাতুল ভাইয়া পিঠা কমপিটিশন করছে। যে হেরে যাবে তার সব চুল কেটে তাকে পাগলা আলম বানিয়ে দেওয়া হবে। ছোট মামা নতুন ব্লেড কিনে এনেছে। তুমি তাড়াতাড়ি এসো। তোমাকে বড়ো মামী পিঠা খাওয়ার জন্য এক্ষুনি ডাকছে।’
আমি মৃদু হেসে মাথা নাড়লাম। আদিবাটা দেখতে দেখতেই কত বড়ো হয়ে গিয়েছে। একটানা এতোগুলো কথা বলতে শিখে গিয়েছে। আদিবা আমাকে কথাগুলো বলে যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই ছুটে বেরিয়ে গেলো; তার প্রতিযোগিতা পেরিয়ে যাচ্ছে। আমি বালিশের আশপাশ হাতড়ে ওড়না খুঁজতেই ফোনের উপর হাত পড়লো। একদম শব্দহীনভাবে ফোন বাজছে। মামানি কল করছেন। আমি ফোন তুললাম। মামানি হন্তদন্ত হয়ে বললেন,
‘ তোর বর যে দেশে ফিরে দরজা-জানালা বন্ধ করে অনশন করছে জানিস?’
মামানির আচমকা এমন সম্বোধনে হোঁচট খেলাম আমি। মৃদু কেশে প্রসঙ্গ পাল্টালাম,
‘ তোমার ছেলে নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে মাছ ব্যবসায়ী হয়ে যাচ্ছে মামানি? আত্মীয় স্বজনের বাসায় বাসায় মাছ ডেলিভারি দেওয়ার জন্য অর্ডারও নিয়ে ফেলেছে? তুমি তো ইঞ্জিনিয়ারের মা থেকে ডিরেক্ট মৎস্য ব্যবসায়ীর মা হয়ে গেলে মামানি। তোমার অনুভূতি কেমন?’
মামানি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিরক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ আর বলিস না। এই ছেলের যন্ত্রণায় আমি অতিষ্ঠ। দুনিয়ার সব নাটক ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহমান। পরশু কী করেছে জানিস? বাসায় ঢোকার সময় দারোয়ানকে বলে এসেছে, জাপানে নাকি ভীষণ মশা কিন্তু কয়েল নেই। তাই সে কয়েল কিনতে এসেছে। এক বস্তা কয়েল কিনে জাপান গিয়ে কয়েলের ব্যবসা করবে। দারোয়ান আবার ওর কথা বিশ্বাসও করেছে।’
মামানির কথার ধরনে খিলখিল করে হেসে ফেললাম। মামানি বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘ হাসবি না। সত্যিই আমি বুঝে পাই না কী খেয়ে পেটে ধরেছিলাম একে। একেবারে হাড়ে মাংসে বজ্জাত। পরশু বাসায় ঢুকেই দরজা লাগিয়েছে। দরজায় একটা সাইনবোর্ড টানিয়ে বলেছে, “তোমার সাথে তিনদিন পর কথা হবে আম্মু। এই তিনদিন শুধু ঘুম। এই তিনদিনে কোনো ডাকাডাকি চলবে না। খাওয়া-দাওয়া সব হবে তিনদিন পর।” তুই একবার চিন্তা করে দেখ ছেলের কান্ড! এদিকে আমার আর তোর মামুর প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। ছেলের হঠাৎ হলো কী? চিন্তা করে করে অস্থির হয়ে যাচ্ছি আর সে তিনদিনের অনশনে নেমেছে। তিনদিনের আগে কথা বলা যাবে না। এই বজ্জাতের বাচ্চা কাচ্চা ওর মতো হলে কী হবে তুই ভাবতে পারছিস?’
এবারও খিলখিল করে হেসে উঠলাম আমি। হাসতে হাসতে চোখে জল চলে এলো। মামানি কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে নিজেও হেসে ফেললেন। স্নেহের কন্ঠে বললেন,
‘ এতো পাগল আমার ছেলেটা! আচ্ছা, শোন। তুই কোথায় আছিস রে? জলদি জলদি আমাদের বাসায় চলে আয়। তোর মা বললো, তোর ফুপু চাচিরা সব শুভ্রর খবর শুনে এসেছে? ভেবেছি তোর ফুপু-চাচিদের, তোদের আর সুরাইয়াদের একসাথে আজ দুপুরের দাওয়াত দেবো। তুই এখনই চলে আয় তো। অনেক কাজ।’
আমি একবার মাথা ঘুরিয়ে আয়নার দিকে চাইলাম। শুভ্র ভাইয়ের বাসায় শুভ্র ভাইয়ের সামনে যাওয়ার কথা শুনেই কন্ঠ শুকিয়ে এলো। মুখ কাচুমাচু করে বললাম,
‘ আমার খুব জ্বর আর মাথাব্যথা মামানি। আমি বরং আপুকে যেতে বলি? আমি গেলে তোমাকে একটুও সাহায্য করতে পারবো না। উল্টো আরও কাজ বাড়বে।’
মামানি অসন্তুষ্ট কন্ঠে বললেন,
‘ তোকে একবারও বলেছি এসে সাহায্য করতে হবে? তুই আমার সামনে বসে থাকবি। বেশি খারাপ লাগলে রুমে শুয়ে থাকবি। তবু আয়। কতদিন আসিস না। তোকে মনে পড়ছে।’
মামানিকে মুখের উপর ‘না’ করার শক্তি আমার না থাকায় আমি বড়ো দিশেহারা বোধ করলাম। হতাশ কন্ঠে বললাম,
‘ আমি বাসায়। আম্মু এই অসুস্থ শরীর নিয়ে যেতে দিবে না মামানি।’
‘ সে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আমি তোর মাকে রাজি করাচ্ছি। তুই রেডি হ।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লাম। ফোনটা নামিয়ে রেখে আয়নার দিকে চেয়ে রইলাম। এই কয়েক মাসের অযত্নে ব্রুণে ঢাকা মুখ, রুক্ষ চুলে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বহুদিন পর সাজতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সেজেগুজে, শাড়ি পরে মামুদের বাসায় যাওয়া? তাও আবার শুভ্র ভাই থাকা অবস্থায়? কদাপি নহে! বাবা-মা কাঁচা খেয়ে ফেলবেন আমায়। তাছাড়া, ব্যাপারটা সন্দেহজনকও বটে! বুকের ভেতর থেকে আবারও উঠে এলো এক দলা দীর্ঘশ্বাস।
আমি যখন মামুদের বাসায় এসে পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে বোধকরি দশটা কী সাড়ে দশটা বাজে। মামানি রান্না ঘরে কাজ করছিলেন। আমি সোজা রান্নাঘরে গিয়ে কেবিনেটের উপর পা গুটিয়ে বসলাম। মামানি তাড়াহুড়ো করে বললেন,
‘ আহা, ভেজা ছিলো। মুছে বসবি তো?’
আমি পাত্তাহীন কন্ঠে বললাম,
‘ ধুর! লাগবে না।’
মামানি তাওয়ায় রুটি উল্টে দিয়ে আমার দিকে চাইলেন। কিয়ৎক্ষণ স্থির চেয়ে থেকে ফ্রিজ থেকে আচারের কৌটা এনে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ খেতে থাক। জ্বর মুখে ভালো লাগবে।’
আমি খুশিতে ঝুমঝুম করে কেবিনেটের উপর থেকে একটা চামচ তুলে নিলাম। মামানি মুহূর্তেই খাবার-দাবারে ভর্তি একটা থালা আমার সামনে রেখে বললেন,
‘ তোকে আজ অন্যরকম লাগছে।’
আমি হাসলাম,
‘ অন্যরকম কেমন? খুব বিশ্রী? মুখে কত ব্রণ হয়েছে দেখেছো? চুলের অবস্থাও জঘন্য।’
মামানি দ্রুত হাতে রুটি উল্টে দিয়ে সিংকের বাসনে হাত দিলেন। হেসে বললেন,
‘ তবু সুন্দর লাগছে। আগে খুকি খুকি লাগতো। এখন বড়ো বড়ো লাগছে।’
আমি হাসলাম। মামানি আচমকা প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
‘ আমি কখন তোর মামুর প্রেমে পড়েছিলাম জানিস?’
আমি উৎসাহ নিয়ে চাইলাম৷ মামানি বাসন ধুতে ধুতে বললেন,
‘ বিয়ের এক বছর পর। তার আগে আমার তার প্রতি, সংসারের প্রতি গভীর মায়া ছিলো। প্রেম ছিলো না। তারপর একদিন হুট করেই উপলব্ধি করলাম আমি তোর মামুর প্রেমে পড়েছি। কঠিন প্রেম। তোর মামুকে সেদিন আমার মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সবথেকে অসাধারণ একজন মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে অসাধারণ পুরুষের প্রেমে পড়ায় আমার এতো আনন্দ হচ্ছিলো! আমি সেদিন কালো রঙের একটা শাড়ি পরেছিলাম। তোর মামা তখনও পড়াশোনা করে। বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা শেষে বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যায়। আমি খুব ভেবে রেখেছিলাম, তাকে আমার প্রেমের কথা জানাবো। কিন্তু আমার কী হলো কে জানে। দরজাটা খুলে ঘর্মাক্ত মানুষটিকে দেখেই আমি তাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেললাম। তোর মামু আতঙ্কে অস্থির। বারবার জিজ্ঞেস করছেন, কী হয়েছে? কী হয়েছে? আমি আর প্রেমের কথাটা বলতে পারলাম না। আজ পর্যন্ত এই কথাটা বলতে পারিনি তোর মামুকে।’
আমার চোখ অকারণেই টলমল করে উঠলো। হাতের চামচটা থেমে গেল। আমি চোখ নামিয়ে বললাম,
‘ আমার কান্না পাচ্ছে মামানি।’
মামানি হাসলেন। আদুরে কন্ঠে বললেন,
‘ এই কান্নাটা এতো সুন্দর! তোকে এই কান্নায় খুব আদুরে লাগছে। তোর কান্না দেখে আমারও কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।’
আমি ‘চোখে জল, মুখে হাসি’ ধরনের মুখভঙ্গি করে চাইলাম। হেসে বললাম,
‘ মামানি আমার শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছে। যে শাড়িটা তুমি পরেছিলে। ঠিক সেই শাড়িটা। সেই কালো শাড়ি পরে আমি টানা দুই ঘন্টা কান্নাকাটি করবো।’
মামানি এবারে শব্দ করে হেসে ফেললেন। মামানির কালো শাড়ি আর চোখে গাঢ় কাজল পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই আমি মনে মনে বললাম,
‘ মামানি তুমি কী জানো, তোমার মতো ভালো কেউ হয় না?’
মামানি বোধহয় আমার কথা বুঝলেন। পেছন থেকে আয়নার ভেতর দিয়েই আমার দিকে চাইলেন। ঠোঁটের কোণে স্নেহমাখা হাসিটা বিস্তৃত হলো। সেই হাসিটা যেন নীরবে বলে গেলো,
‘ আমার মতো ভালো কেউ হোক তা আমি চাই না।’
আয়নার ভেতরে দু’জন দু’জনের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই আমাদের দু’জনের চোখের কোণে জল জমলো। পৃথিবী বুঝলো কি-না জানি না। তবে আমরা বুঝলাম, আমরা উভয়ই একজন পুরুষকে কত গভীরভাবেই না ভালোবাসি। আমাদের ভালোবাসার রূপ আলাদা। কিন্তু রঙ যেন একই। ওই একই পুরুষের দূরত্ব আমাদের অস্তিত্বকে দু’রকমভাবে কাঁপিয়ে তুললেও কেঁপে উঠি আমরা দু’জনেই। একজনের অশ্রুতে মাতৃত্বের তৃষ্ণা লেখা। আরেকজনের অশ্রুতে তীব্র প্রেম। আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকাতে আটকাতেও এক হাতে মুখ চেপে ফুপিয়ে উঠলাম। মামানি প্রথমে আমাকে জড়িয়ে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজেই কেঁদে উঠলেন হাউমাউ করে। আমি মামানির কান্নারত মুখের দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলাম। একজন মায়ের তার ছেলের প্রতি দুর্বলতার কী স্বচ্ছ জলছবি দেখা গেলো সেই অশ্রুজলে।
মামানির যৌবনের সেই কালো শাড়ি গায়ে জরিয়ে, চোখে গাঢ় কাজল, কপালে ছোট্ট টিপ আর দু’পায়ে ঝুমঝুম নুপুর বাজিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম পুরো বাসা জুড়ে। কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে শহর দেখলাম। পিচ ঢালা রাস্তা, রিকশা, পাশের বিল্ডিংয়ের বারান্দায় ফোঁটা ছোট্ট গোলাপের কুঁড়ি। অলস মনে কিছুক্ষণ আকাশও দেখলাম। তারপর আচারের বয়াম হাতেই নুপুরে ঝুমঝুম শব্দ তুলে পৌঁছালাম শুভ্র ভাইয়ের ঘরের দরজার সামনে। শুভ্র ভাইয়ের দরজায় ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব’ এর বিশাল সাইনবোর্ড পাওয়া গেলো। আমি সাইনবোর্ডটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে দরজা খুলে উঁকি দিলাম ভেতরে। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দরজা-জানালা বন্ধ, আলো নেভানো। আমি বিড়ালের মতো সাবধান পায়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। অন্ধকারটা চোখে সয়ে যেতেই বহুবার দেখা ঘরটা আবারও ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বই তাকের বইয়ের নামগুলো পড়ার চেষ্টা করলাম। তারপর গিয়ে দাঁড়ালাম পড়ার টেবিলের সামনে। শুভ্র ভাইয়ের পড়ার টেবিলের উপর ঝিনুকের তৈরি তিনটি ব্রেসলেট পাওয়া গেলো। আমি ব্রেসলেটগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। তারপর বাচ্চাদের মতো সবগুলো ব্রেসলেট একইসাথে একই হাতে পড়ে ফেললাম। আচারের বয়ামটা টেবিলে রেখে টেবিলের উপর পা ঝুলিয়ে বসে ব্রেসলেটগুলোর ঝিনুকে ঝুনঝুন শব্দ তুলতেই এক গাদা বই-খাতার মাঝে পাওয়া গেলো একটা আলতার কৌটো। আমি সরু চোখে চাইলাম। এই লোক তো দেখি ভারি চরিত্রহীন। মামানিকে জানাতে হবে, তার ছেলের পড়ার টেবিল থেকে ভুরভুর করে মেয়েলি জিনিস বেরুয়! আমি আলতার কৌটোটা খুলে ব্রেসলেট পরা হাতে আলতা পরার চেষ্টা করলাম। আমার নুপুর আর ব্রেসলেটের ঝুমঝুম, রিনঝিন শব্দে কম্বলের ভেতর থেকে মাথা বের করে ঘুমু ঘুমু চোখে চাইলেন শুভ্র ভাই। চোখ-কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলেন অনেকটাক্ষণ। যেন ঠিক বুঝতে পারছেন না, কী হচ্ছে? বেশ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকার পর আমার দিকে চোখ রেখেই বিছানার পাশের টেবিলে হাত বাড়িয়ে একটা কলম নিয়ে ছুঁড়ে মারলেন আমার শরীরের উপর। আমার আলতা দেওয়া এমনিতেও হচ্ছিলো না। ল্যাপ্টে যাচ্ছিলো বারবার। শুভ্র ভাইয়ের আচমকা ঢিলে আলতা দিয়ে রাঙা হয়ে গেলো ব্রেসলেটের সাদা সাদা ঝিনুক। আমি ক্ষুব্ধ চোখে চাইলাম। বিরক্ত হয়ে বললাম,
‘ কী সমস্যা আপনার শুভ্র ভাই? এভাবে ছুড়াছুড়ি করছেন কেন? আপনার জন্য যে আমার ব্রেসলেট নষ্ট হয়ে গেলো, এখন? আপনি কিনে দিবেন?’
শুভ্র ভাই থতমত চোখে চেয়ে রইলেন। কিয়ৎক্ষণ অবাক চোখে চেয়ে থেকে লাফিয়ে উঠে বসলেন। বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
‘ তুই সত্যি সত্যি আমার টেবিলের উপর উঠে বসে আছিস?’
আমি একবার টেবিলের দিকে দৃষ্টি দিয়ে উনার দিকে চাইলাম। হালকা মাথা নেড়ে জানালাম, সত্যি সত্যি বসে আছি। শুভ্র ভাই হাত বাড়িয়ে আলো জ্বালালেন। সন্দিহান কন্ঠে বললেন,
‘ তোর পা কই? পা নাড়া দেখি।’
আমি আমার নুপুর পরা পা নাড়িয়ে ঠোঁট উল্টালাম। অবাক হয়ে বললাম,
‘ এইযে আমার পা।’
‘ এবার হাত নাড়া।’
আমি চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে বললাম,
‘ না।’
শুভ্র ভাই হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলেন। বিভ্রান্ত হয়ে বললেন,
‘ এই পৃথিবীতে আর কোনে জায়গা নেই? তোর আমার কলিজার উপর উঠেই বসে থাকতে হবে কেন? তাও আবার এই অন্ধকার ঘরে? আমি যদি হার্ট অ্যাটাক করে মরে যেতাম?’
আমি বিরক্ত চোখে চাইলাম। কোনো রকম উত্তর না দিয়ে টেবিল থেকে লাফিয়ে নামলাম। পেছনে ফিরে আচারের বয়ামটা হাতে নিয়ে একবার কটমট চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে চাইলাম। শুভ্র ভাই বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন। আমি দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েও আবারও এক পা পিছিয়ে এসে বাম হাতটা উঁচু করে ইশারায় ব্রেসলেটগুলো দেখালাম। বললাম,
‘ এগুলো আমার না?’
বিভ্রান্ত শুভ্র ভাই বিভ্রান্ত চোখে চেয়ে রইলেন। বিস্ময়ে হা হয়ে যাওয়া মুখে মাথা নাড়লেন। আমি ডান ভ্রু’টা উঁচু করে ব্রেসলেটগুলোর দিকে তাকালাম। খুব ভাব নিয়ে বললাম,
‘ ওহ, থেংকিউ!’
শুভ্র ভাই কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। আমার থেকে চোখ সরিয়ে একবার টেবিলের উপর চাইলেন। তারপর আবারও চোখ সরিয়ে আমার দিকে চাইলেন। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আলতা রাঙা হাতে শাড়ির কুঁচি সামলে বড়ো আয়েশি ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলাম। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ পরই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। এদিক-ওদিক চেয়ে কিছু খুঁজতে খুঁজতেই সোফায় বসে থাকা আমার উপর দৃষ্টি স্থির করলেন। একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। আঙুলের ডগা দিয়ে চুলগুলো গোছাতে গোছাতে আমার সামনের সোফায় এসে বসলেন। আমি মুখ ভর্তি করে আচার খাচ্ছিলাম। শুভ্র ভাই আচারের বয়ামটা ছিনিয়ে নিয়ে গলার স্বর উঁচু করে বললেন,
‘ আম্মু, অন্য বাড়ির মেয়েটা আমাদের বাসায় কী করে?’
শুভ্র ভাইয়ের গলা শুনে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন মামানি। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘ তুই নাকি তিনদিনের আগে ঘর থেকে বেরুবি না? তোর তিনদিন শেষ?’
শুভ্র ভাই আমতা আমতা করে বললেন,
‘ অন্য বাড়ির মেয়ে এসে ভূতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা বাড়ি। বাড়ি পাহারা দিতে হবে না? আমি ঘুমিয়ে থাকলে বাড়ি পাহারা দিবে কে? আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ সারাদিন আর ঘুমাবো না। বাইরের কেউ যদি এসে দেখে অন্য বাড়ির মেয়ে আমাদের বাসায় এসে এমন করে আচর খাচ্ছে। কী ভাববে?’
মামানি বিরক্ত চোখে চেয়ে বললেন,
‘ ফাজিল।’
শুভ্র ভাই আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালেন। আমার মাথায় অযথায় চাটি মেরে বললেন,
‘ আম্মু আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি, খেতে দাও।’
মামানি সেকথার উত্তর না দিয়ে গলার স্বর উঁচিয়ে বললেন,
‘ বালতির কাপড়গুলো একটু বারান্দায় মেলে দে তো রোদু।’
আমি শুভ্র ভাইকে মুখ ভেঙিয়ে বালতি নিয়ে বারান্দার দিকে সরে পড়লাম। সব কাপড় মেলে ফিরে আসার আগমুহূর্তে শুভ্র ভাইয়ের প্যান্টের পকেটটা বেশ ভারী ভারী মনে হলো। হাত ঢুকাতেই বেরিয়ে এলো ভিজে ধুমলে মুচরে যাওয়া কাগজের ঢিলা। আমি কাগজের ঢিলাটা হাতে নিয়ে রুমে এলাম। কোনো কাজ না থাকায় বহু ধৈর্য নিয়ে কাগজটা খোলার চেষ্টা করলাম। অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেলো। অনেক জায়গায় লেখা ল্যাপ্টে গিয়েছে। ইস্ত্রি দিয়ে শুকানোর পর বুঝা গেলো এটা একটা স্ট্যাম্প করা খাম। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা কাগজের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বহু চেষ্টা চরিত করে বুঝলাম, এ এক চিঠি। চিঠিটাকে ইস্ত্রি দিয়ে যতটা সম্ভব ঠিকঠাক করে চোখের সামনে মেলে ধরলাম। প্রথমবারে কিছুই বুঝলাম না। দুই তিনবার পড়ার চেষ্টা করার পর ধীরে ধীরে বোধগম্য হতে লাগলো। বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করলাম চিঠিটা আমার নামেই লেখা। তবে চিঠিটা আমার কাছে পৌঁছালো না কেন? আমি চিঠিটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। তাতে ল্যাপ্টে যাওয়া অক্ষরে একের পর এক শব্দ বুনা,
” রোদপাখি,
আমি তোর সাথে ভীষণ অভিমান করেছি। আমি যখন এই দেশে পা রাখলাম? ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন মানুষের মাঝে শ্বাস নিতে লাগলাম? আমার সবার প্রথম তোর কথা মনে পড়েছে। বারবার মনে হচ্ছিল, আমাকে ছাড়া বোধহয় তুই ভালো থাকবি না। তোর নিজের দেশটাও বোধহয় তোর এমনই অচেনা ঠেকবে। কিন্তু তুই’ই বল, তাই কী হয়? আমি অবুঝ নই। সবই বুঝি। কিন্তু দূরত্ব, একাকীত্ব মানুষকে বড়ো অভিমানী করে। প্রিয় কারো যত্ন পাওয়ার জন্য খুব ছেলেমানুষী লোভ জাগে। কষ্ট দেয়। তাই আমি তোকে ভুলে প্রাণপণে মাকে মনে করার চেষ্টা করলাম। তুই তো জানিস না। কিন্তু আমি জানি। আমার আম্মু আস্ত একটা জাদু। আমি যেখানেই থাকি না কেন চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে ফেলতে পারি, এই মানুষটা কেবল মাত্র আমার সুখের জন্য বাজি ধরে ফেলতে পারে গোটা পৃথিবী। মানুষের সাইকোলজি খুব অদ্ভুত। তারা প্রিয় মানুষের চোখে জল সইতে পারে না। আবার তারাই প্রিয়র চোখে নিজের জন্য জল দেখে আনন্দিত হয়। তাই বোধহয়, এই অচিনপুরে বসে, মা আমার জন্য কাঁদে জেনে, আমার কেন যেন খুব একটা কষ্ট হয়নি। বরং আমার এই কষ্টের জীবনটা একটু সহজ হয়েছে। মনে হয়েছে, বহু ক্লান্তির পরও এই পৃথিবীতে কেউ একজন আমার অপেক্ষায় রয়েছে। অপেক্ষা জিনিসটা খুব সুন্দর। একমাত্র অপেক্ষায় পারে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে। প্রিয় কারো অপেক্ষা। প্রিয় কারো ভালোবাসা পাওয়ার অপেক্ষা!
আমার এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে আমি সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা উপলব্ধি করেছি, তা হলো, আমি খুব শক্ত মনের মানুষ। আমার জীবনে এমন একটি দিনও কাটেনি যেদিন আমি ভালো ছিলাম না। খারাপ সময় এসেছে। হতাশ হয়েছি। ক্লান্ত হয়েছি। কিন্তু কখনো মনে হয়নি, আমি ভালো নেই। কিন্তু আজকাল আমি ভালো থাকতে পারছি না। এখানে আমার ভালো লাগছে না। এই দেশ, এই পরিবেশ, এই মানিয়ে নেওয়া, নতুন বন্ধুরা এবং তুই। কোনোকিছুই আমার সহ্য হচ্ছে না। তোকে অসহ্য লাগতে লাগতেও বিতৃষ্ণ হয়ে গিয়েছি। বারবার মনে হচ্ছে, তোর বোধহয় আমাকে মনে পড়ছে। তুই বোধহয় ভালো নেই। এ বড়ো ছেলেমানুষী চিন্তা-ভাবনা। আমি ভালো নেই বলে তুইও ভালো থাকবি না এমন কোনো নিয়ম তো বিধাতা লিখে দেননি। আমি মানুষ হিসেবে খুব একটা উদার নই। আমি ভালো নেই অথচ তুই ভালো থাকবি এটা আমি হতে দিতে পারি না। অথচ অন্য একটা মন বারবার ভুল করে চেয়ে ফেলে, পৃথিবীর সব শান্তি তোর হোক। পৃথিবীর সকল ভালো থাকার নিমন্ত্রণ পত্রগুলো কেবল তোর দুয়ারে হানা দিক। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাক তবু তুই ভালো থাক। তোর ভালো থাকা আমি সহ্য করতে পারি না। তোর খারাপ থাকা আমার আরও অসহ্য লাগে। উফ! ভালোবাসাটা এতো বিশ্রী কেন, রোদপাখি?
শুভ্র
০৫ অক্টোবর ২০২১…”
আমি চিঠির তারিখটা দেখে অবাক হলাম। চিঠিটা শুভ্র ভাইয়ের জন্মদিনের দিন লেখা হয়েছিলো। স্ট্যাম্পও করা হয়েছিলো। তবে কেন পাঠাননি শুভ্র ভাই? অভিমানে? তার জন্মদিন আমার মনে ছিলো না বলে? অথচ আমার জন্মদিনটাতে ঠিক ঠিক যুদ্ধ জয় করে ফেললেন উনি। সব মান-অভিমান, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ফেলে ছুটে এলেন হাজার হাজার মাইল দূর থেকে। আমি নষ্ট হয়ে যাওয়া চিঠিটা হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। শীতের হিমেল হাওয়ায় উড়ে গেলো আমার কেশরাশি। আমি আকাশের দিকে মুখ করে চোখদুটো বন্ধ করতেই নাকের কাছে ভেসে এলো শুভ্র ভাই, শুভ্র ভাই সুঘ্রাণ। মামানির যে অনুভূতিটা হয়েছিলো বছর ত্রিশেক আগে। সেই একই সাজসজ্জা; সেই একই শাড়ির আঁচল উড়িয়ে আমিও অনুভব করলাম সেই একইরকম আনন্দ। পৃথিবীর সবথেকে অসাধারণ পুরুষটির প্রেমে পড়ার আনন্দে আমার শরীর কেঁপে উঠলো। মামানির মতোই সেই মানুষটিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হলো। ফিসফিস করে বলে ফেলতে ইচ্ছে হলো, ‘ভালোবাসি’। আমার ভাবনার মাঝেই মামানির ডাক পড়লো। ঘর থেকে বেরুতেই মামানি শুভ্র ভাইকে ডেকে আনতে বললেন। আমি একটা ঘোরের মাঝেই শুভ্র ভাইয়ের ঘরে গেলাম। শুভ্র ভাই শার্ট পরছিলেন। অতিরিক্ত ঘুমের কারণে তার চোখদুটোতেও অল্প ফোলা ভাব। শার্টের আস্তিন গোটাতে গোটাতে আমার দিকে চাইলেন। ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
‘ কী অবস্থা ছকিনার মা? একটু আগে টেবিলের উপর বসে যে আমার টেবিল ফাটিয়ে ফেলেছিস তার জরিমানা কে দিবে? তোর কিপ্টা বাপ? তোর বাপ তো টেবিলের দাম শুনেই দাঁত লেগে পড়ে যাবে। এখন উপায়?’
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়লাম। শুভ্র ভাই আমার নির্লিপ্ত চোখ-মুখ দেখে বললেন,
‘ আমার কথা তোর বিশ্বাস হলো না? তোর ধারণা আমি মিথ্যে অপবাদ লাগাচ্ছি? শোন, দ্য শুভ্র তোর মতো রাষ্ট্রদ্রোহী না। আমি সব সময় সত্য সত্য কথা বলি। বিশ্বাস না হলে আয় দেখাই কোথায় ফেটেছে।’
শুভ্র ভাই আমার সামনে থেকে সরে টেবিলের দিকে যেতে নিতেই খপ করে উনার শার্টের কলার চেপে ধরলাম আমি। উনি বিস্মিত চোখে একবার আমার হাত তো একবার আমার মুখের দিকে চাইলেন। অবাক হয়ে শুধালেন,
‘ কী ব্যাপার? কী হচ্ছে?’
আমি উনার সুডৌল বিস্মিত মুখের দিকে চেয়ে থেকে আচমকা উনাকে জড়িয়ে ধরলাম। উনি চমকে উঠলেন। কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বিস্মিত, হতভম্ব মুখে স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন। উনার কলার ধরে রাখা হাতটা এবার আরও শক্ত হলো। আমি পায়ের গোড়ালিতে ভর করে, একটু উঁচু হয়ে, উনার কাঁধের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললাম,
‘ আপনি শুধু আমার। মনে থাকবে?’
শুভ্র ভাই উত্তর দিলেন না। থমকে যাওয়া হাওয়ায় উনার হৃৎস্পন্দনের গতি কী তীব্র শোনাচ্ছে! এই শীতের সকালেও উনি কুলকুল করে ঘামছেন। দীর্ঘক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে আমার থেকেও ফিসফিস করে বললেন,
‘ আই সয়ার, আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে রোদপাখি।’
শীতের থমকে যাওয়া হাওয়া আর সোনালি রোদ্দুরও যেন একই সাথে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘প্রিয় প্রেম, তুমি এতো সুন্দর কেনো, বলো দেখি?’
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/