প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প .
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|২৯|
বৃষ্টির ধার কমে এসেছে। ঝমঝমে বৃষ্টির গায়ে এখন হাঁপিয়ে উঠার ছাপ। হঠাৎ হঠাৎ থেমে গিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে যেন। ধ্রুব এগিয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে পরিচিতির স্মিত হাসি ল্যাপ্টে বলল,
‘ আরে! নিশিতা? কেমন আছো?’
ধ্রুবর প্রশ্নটা যতটা স্বাভাবিক? নিশিতা ততটাই অস্বাভাবিক রকম স্বাভাবিক দৃষ্টিতে চাইলো। চোখের কোণে বিস্মিত হওয়ার, অপ্রস্তুত হওয়ার লেশমাত্র নেই। ক্ষণিক আগের আতঙ্কটাও কাটিয়ে উঠেছে চোখের পলকে। বহু বহুদিন পর প্রিয় নারীকে দেখে খুব অন্যরকম মনে হলো ধ্রুবর। অপরিচিত মনে হলো। সেই শীতল, ঠান্ডা দৃষ্টি দেখে বুকের ভেতর জেগে উঠল স্বয়ং জীবনানন্দ। অদ্ভুত, বিষণ্ণ সুরে বেজে উঠল জীবনানন্দের কন্ঠস্বর,
‘চোখে তার-
যেন শত শতাব্দীর অন্ধকার!
স্তন তার-
করুণ শঙ্খের মতো দুধে আদ্র- কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’
ধ্রুবর বুক বেয়ে বেরিয়ে এলো চাপা দীর্ঘশ্বাস। চোখে-মুখে অন্যমনস্ক গাম্ভীর্য নিয়ে বলল,
‘ এই রিকশা তো আর যাবে না। তুমি চাইলে আমি তোমাকে পৌঁছে দিতে পারি।’
চির অভিমানিনীর কন্ঠে ধ্রুব উত্তর আশা করেনি। অথচ ধ্রুবকে চমকে দিয়ে অভিমানিনী উত্তর দিলো। ভীষণ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
‘ সমস্যা নেই। সামান্য পথই বাকি, হেঁটে চলে যাব।’
খুব স্বাভাবিক সময়ে যেমন অস্বাভাবিকতা মেনে নেওয়া যায় না? ঠিক তেমনই খুব অস্বাভাবিক সময়ে স্বাভাবিকতার হাওয়া পেলে চমকে উঠতে হয়। আতঙ্কিত হতে হয়। ধ্রুব চমকে উঠলো। বুকের ভেতর তীব্র এক অস্বস্তি দানা বাঁধছে বুঝতে পেরে ভ্রু জোড়া খানিক কুঁচকে এলো। অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
‘ ক্যাম্পাসের সামনের রাস্তায় জল জমেছে। হেঁটে গেলে অসুবিধায় পড়তে হবে তোমায়।’
নিশিতার চোখে-মুখে স্বাভাবিক উদ্বেগ দেখা গেল। একটু ভেবে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল। বলল,
‘ তাহলে বরং একটা রিকশার জন্য অপেক্ষা করি। বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগছে। আমার কোনো তাড়া নেই।’
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া মোম স্নিগ্ধ মুখের দিকে চেয়ে ধ্রুবর বলতে ইচ্ছে হলো,
‘ সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলেও আমার ইচ্ছের বাইরে কোনো রিকশা পাবে না নিশিতা। যতক্ষণ আমি না চাইবো ততক্ষণ কেউ তোমার দিকে চোখ তুলেও চাইবে না। অযথা অপেক্ষা করো না।’
কিন্তু মুখে বলল,
‘ তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে নিশিতা। কথাগুলো বলা খুব দরকার।’
নিশিতা চমৎকার হাসলো। সাথে সাথেই ক্লান্তি কাটিয়ে আবারও ঝমঝম করে ঝরতে লাগলো শরতের ঠান্ডা বৃষ্টি। নিশিতার গায়ের গোলাপি জামার অর্ধেকটা ভিজে গেল। ধ্রুব নিশিতার গায়ের দিকে চাইলো না। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো নিশিতার চোখে। বুকের ভেতর দলা বেঁধে থাকা অপরাধবোধটা নিশিতাকে বলতে না পারলে যে বাঁচা যাচ্ছে না। এই বৃষ্টি, প্রিয় নারীর ভেজা সৌন্দর্য কোনো কিছুই মনে ধরছে না। তার কেবল শান্তি চাই। অনুশোচনা থেকে; মন থেকে লুকিয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়া ক্লান্তি থেকে। নিশিতা কপালের উপর আড়াআড়ি হাত রেখে দৌঁড়ে গেল একটি ছাউনির নিচে। ধ্রুব বুকের ভেতর ঢিপঢিপ এক অস্বস্তি নিয়ে ছাউনির দিকে এগিয়ে গেলো। চোখদুটোতে অন্যমনস্ক বিষণ্ণতা। ধ্রুব পাশে দাঁড়াতেই ওড়নার ভেজা আঁচল দিয়ে মুখ মুছলো নিশিতা। বড়ো শান্ত, স্বাভাবিক তার ব্যবহার। কোথাও কোনো ক্ষোভ নেই, রাগ নেই, অভিযোগ নেই। ধ্রুবর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীকে চির অভিমানিনী, চির চন্দ্রত্রপা বলার উপায় নেই। ভেজা আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে নিজে থেকেই কথা বলল নিশিতা। চমৎকার হেসে বলল,
‘ মানুষ নিয়ে আমার নিজস্ব একটা লজিক আছে। সেই লজিক অনুযায়ী, আমি আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোকে ভালোবাসার থেকেও শ্রদ্ধা করি বেশি। এই লজিকের দ্বিতীয় ধাপে তারা আছেন, যারা আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ নয় অথচ আমি তাদের মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করি। আর তৃতীয় ধাপে আছে তারা যাদের আমি কখনো শ্রদ্ধা করতে পারি না। অথবা একসময় শ্রদ্ধাটা এসেছিলো নদীর জোয়ারের মতোন তারপর আচমকা তান্ডবে শুকিয়ে গিয়েছে মধ্য গ্রীষ্মের খরার মতোন। রাগ ভাঙানো যায়, অভিমান ভাঙানো যায় কিন্তু অশ্রদ্ধা ভাঙানো যায় না। তাই বোধহয় তৃতীয় ধাপের মানুষগুলোর সাথে আমার কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। তাদের কথা শুনতে ইচ্ছে হয় না। তাদেরকে দেখতেও ইচ্ছে বোধ করি না। আমি মানুষকে অশ্রদ্ধা করতে খুব অপছন্দ করি। তৃতীয় ধাপের মানুষগুলোর উপর আমার অশ্রদ্ধার ছায়া পড়ুক তা চাই না বলেই তাদেরকে আমি এড়িয়ে চলি। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তৃতীয় ধাপের মানুষগুলো বোকা হয়। তারা বিষয়টা বুঝতে পারে না। অভিমান বা রাগ ভেবে ভুল করে। বিষয়টা খুবই বিরক্তিকর। মানুষের কী এতোটা বোকা হওয়া উচিত অফিসার?’
ধ্রুব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অপ্রত্যাশিত অপমানে থমথমে হয়ে উঠলো মুখ। পরিচিত পৃথিবীটা যেন দোলে উঠে শুধাল, ‘এতো! এতোটাই নিকৃষ্ট সে?’ নিশিতা হাসিমুখে বলল,
‘ আমার লজিকটা কী আপনার পছন্দ হয়েছে অফিসার? লজিকটা বুদ্ধিমানদের জন্য। আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। লজিকটা আপনার পছন্দ হওয়ার কথা।’
ধ্রুব কোনো উত্তর দিতে পারলো না। নিস্পন্দ চোখে চেয়ে দেখলো গোলাপি জামা গায়ে একটি মেয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। ঝমঝমে বৃষ্টিতে তার জামা ভিজে যাচ্ছে। মেয়েটা আচমকা থেমে জুতো খুলে ফেললো। কাদামাখা জুতো হাতে নিয়ে মেয়েটি তার মোমের মতো ফরসা পায়ের দিকে চেয়ে চেয়ে হাঁটছে। শরতের বৃষ্টিতে তার মোম রঙা পা’দুটোতে ফোঁটা ফোঁটা বর্ষণ যে পৃথিবীর সবথেকে মধুর দৃশ্য, তা বোধহয় মেয়েটি জানে। মেয়েটি আরও অনেক কিছুই জানে। মেয়েটির সাথে সাথে ধ্রুবও জানে, এই চমৎকার মেয়েটির সাথে আর কক্ষনো দেখা হবে না তার। তার বুকে জমে থাকা অনুশোচনার আগুন কখনো নিভবে না। দলা পাকানো কথাগুলো বুকে বেঁধে রাখতে রাখতে ধ্রুবর বুক ব্যথা হবে। এই তীব্র বুক ব্যথা ধ্রুবকে বয়ে বেড়াতে হবে সারাটা জীবন। ধ্রুব হঠাৎ খেয়াল করলো বৃষ্টির ঠান্ডা জলের সাথে সাথে এক ফোঁটা আগুন গরম জলও ছিটকে পড়লো তার গালের উপর। এই প্রথম ধ্রুবর অভিমান হলো। আবিরের মতো মুখ ভার করতে ইচ্ছে হলো না। খুব লজ্জার ব্যাপার হলো, ভীষণ অভিমানে ধ্রুবর কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হলো। ধ্রুব হঠাৎ কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে রেইনকোটটা খুলে ফেলে খুব ধীর পায়ে এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। শরতের জলে ভিজে গেল ধ্রুবর শ্যামলা সৌম্য দেহ। প্রশস্ত কাঁধ। মাঝারি করে ছাঁটা চুল। বৃষ্টির শীতলতা ধ্রুবর ভেতরটাকে শীতল করতে পারলো না। হাত নেড়ে খুব মৃদু কন্ঠে কনস্টেবলকে বলল,
‘ যেতে দিন ওকে। লেট হিম ফ্রী।’
দৈত্যের মতো বিশাল কনস্টেবল তখন ছোকরা রিকশাচালকের কলার চেপে শাসাচ্ছিল। স্যারের হঠাৎ বোল পরিবর্তনে অবাক হলো। তার থেকেও বেশি চমকালো ধ্রুবর চেহারা দেখে। ওমন সুন্দর চেহারার হঠাৎ এমন বেহাল দশা হলো কী করে? ছোকরাটাকে দুটো দানবীয় ঝাঁকি আর ভয়ানক চোখ রাঙানি দিয়ে ছেড়ে দিয়ে ধ্রুবর দিকে চাইলো কনস্টেবল। কাঁচুমাচু, অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
‘ আপনি ঠিক আছেন স্যার? অসুস্থ দেখাচ্ছে।’
ধ্রুব উত্তর দিলো না। কনস্টেবলের প্রশ্ন সে আদৌ শুনতে পেয়েছে কিনা বুঝা গেল না। অন্যমনস্ক, শান্ত হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। রেইনকোটটা বেখেয়ালে কোলের উপরই রেখে দিলো। যেন নিশ্চল, সর্বশান্ত এক মানুষ। ক্ষনিক আগেই হারিয়ে ফেলেছে বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। কনস্টেবল ড্রাইভিং সীটে বসে অনেকটাক্ষণ স্যারের পরবর্তী আদেশের জন্য অপেক্ষা করলেন। অথচ ধ্রুবর মুখে ‘রা’ নেই। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কী এতো ভাবছে কে জানে? অনেকটাক্ষণ অপেক্ষা করে সাহস নিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেললেন মধ্যবয়স্ক কনস্টেবল,
‘ কোথায় যাব স্যার?’
দুইবার একই প্রশ্ন করার পর যেন ঘোর কাটলো ধ্রুবর। ক্ষীণ চমকানো চোখে চাইলো। হঠাৎ যেন কিছু বুঝতে পারছে না এমন বিভ্রান্ত তার দৃষ্টি। তারপর মৃদু অথচ জলদগম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ বাসায় চলুন।’
কনস্টেবল কোনোরকম প্রত্যুত্তর না করে গাড়ি ঘুরালো। তাদের চির গম্ভীর স্যারকে এমন এলোমেলো দেখে সে কিছুটা স্তম্ভিত, বিস্মিত।
এমন ভরা সকালে ভাইকে বাড়ি ফিরতে দেখে অবাক হলো আবির। দরজা খুলে দিয়ে সরে দাঁড়াতে পর্যন্ত ভুলে গেলো সে। ভাইয়ের ভেজা ঝপঝপে পোশাক। শুকিয়ে যাওয়া মুখ। শূন্য, অন্যমনস্ক দৃষ্টি দেখে চোখের পলকে আত্মা কেঁপে উঠলো তার। ধ্রুব শান্ত চোখে চেয়ে একটু বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ কী ব্যাপার? দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? ভেতরে যেতে দে।’
আবির কলের পুতুলের মতো সরে দাঁড়ালো। তার পিঠের উপর চড়ে গলা জড়িয়ে থাকা ছোট্ট প্রাণ কল্পও যেন বুঝে গেল কোথাও একটা গন্ডগোল আছে। বড়ো ভাইয়াকে এই সময়ে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছে কখন। ধ্রুব এই প্রথম ভাইদের দিকে নজর দিলো না। গাড়লের মতো হেঁটে গেল নিজের শোবার ঘর পর্যন্ত। ভেজা রেইনকোটটা অন্যমনস্ক মনে বিছানার উপর রাখলো। তারপর নিজেও বসে পড়লো ভেজা কাপড়ে। স্তব্ধ, স্থির মূর্তির মতো বসে থাকা ভাইয়াকে দরজার বাইরে থেকেই লক্ষ্য করতে লাগল দুই ভাই। দু’জনের কারোরই ভেতরে ঢুকার সাহস হচ্ছে না। আবার ভাইকে এভাবে ছেড়ে যেতেও মন মানছে না। আবিরের একবার বলতে ইচ্ছে হলো,
‘ ভাইয়া পোশাকটা পাল্টে নাও। এই সময়ে জ্বরে পড়লে ভুগতে হবে খুব।’
কিন্তু বলে উঠতে পারলো না। মনের কোথাও একটা খুব করে বুঝতে পারলো, ভাইয়ার বুক ভরা মনের জ্বর। এই মারাত্মক জ্বরকে পৃথিবীর কোনো বৃষ্টির পানিই অতিক্রম করতে পারবে না। আবিরের বুকটা জ্বলে উঠল অসহ্য যন্ত্রণায়। তার ভাইয়া! তার ভাইয়ার এতো কষ্ট কেনো? কী হয়েছে তার সাথে? কে দিলো তাকে এতো কষ্ট? সেই মানুষটার প্রতি ঘৃণায় বুক ভরে উঠলো আবিরের। থম ধরা মন নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়লো দরজার কাছের মেঝেতে। তাকে দেখে দেখে কল্পও বসে পড়লো লক্ষ্মী ছেলে হয়ে। তার আজ দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বড়ো ভাইয়ার কাছে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে শুধু। বড়ো ভাইয়া যে তার দিকে একবার তাকালোও না? কল্প বড়ো ভাইয়ার মতোই গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। অনেক অনেকটাক্ষণ হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে থম ধরে বসে থেকে কী মনে করে মাথা তুলে দরজার দিকে চাইলো ধ্রুব। ততক্ষণে গায়ের তাপে শুকিয়ে গিয়েছে পোশাক। ধ্রুব দুই ভাইকে দরজার পাশে পা ছড়িয়ে বসে থাকতে দেখে আশ্চর্য হয়ে বলল,
‘ কী ব্যাপার?’
কেউ কোনো উত্তর দিলো না। কারো থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে শক্ত কন্ঠে ধমক দিয়ে উঠল ধ্রুব,
‘ এখানে বসে আছিস কেন? আশ্চর্য! ঘরে যা।’
এবারও কারো মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। কল্প একবার আবিরের মুখের দিকে চেয়ে ধ্রুবর দিকে চাইলো। নিজের ছোট মনের বিশাল ইচ্ছেকে সে খুব গুরুত্বের সাথে গুরুত্ব দিলো। ছোট ছোট পায়ে ধ্রুবর দিকে এগিয়ে গিয়ে বড়ো বড়ো চোখ মেলে চাইলো। দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে খুব গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ কোয়ে।’
ধ্রুব চোখ তুলে কল্পর মুখের দিকে চাইলো। তাদের তিন ভাইয়ের চেহারাই মায়ের মতো হয়েছে। গায়ের রঙও অনেকটা সেরকমই। কিন্তু কল্পর গায়ের রঙ হয়েছে বাবার মতো। টকটকে হলুদ ফরসা। চোখদুটোতে টলমলে আস্ত দুটো বিল। বড়ো ভাইয়া তাকে কোলে নিতে অসম্মতি জানাতে পারে বা এমন কিছু হতে পারে তা সে কখনো বিশ্বাস করতে শেখেনি। ধ্রুবর মনটা আষাঢ়ের কালো মেঘের মতো থম ধরে থাকলেও কল্পর এই সরল বিশ্বাসটা ভাঙতে ইচ্ছে হলো না। হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো তাকে। কল্প বরাবরের মতোই দুইহাতে গলা জড়িয়ে কাঁধে মুখ গুজল। ধ্রুবর জড়িয়ে ধরা হাতদুটো ক্রমশই শক্ত হতে লাগল। এই ছোট্ট দেহটাতেই যেন ভরসা খুঁজছে একবিন্দু। কল্প কী বুঝলো বুঝা গেল না। ভাইয়ের হাতের জোরে সে কোনো আপত্তি করলো না। বরং আরও শক্ত করে গলা জড়িয়ে মুখ গুজল ঘাড়ে৷ ততক্ষণে আবিরও এসে বসেছে ধ্রুবর পায়ের কাছে। ধ্রুবর কোলের উপর মাথা রেখে দুই হাতে কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলল,
‘ ভাইয়া তুমি কেমন আছো?’
ধ্রুবর চোখদুটো লাল হয়ে উঠল এবার। জবাব না দিয়ে অন্যমনস্ক স্বরে শুধাল,
‘ আমায় ভালোবাসিস আবির?’
‘ বাসি।’
‘ শ্রদ্ধা করিস?’
‘ ভালোবাসার থেকেও বেশি।’
ধ্রুবর লাল চোখদুটো টলমল করে উঠলো,
‘ আমি কী খুব খারাপ মানুষ আবির?’
আবির এইবার মুখ তুলে চাইল। ভাইয়ের হেরে যাওয়া মুখটির দিকে চেয়ে গোটা পৃথিবীর প্রতিই রাগে জ্বলে উঠলো বুক। কোনো বাচ্চামো নয়। একেবারে নিরেট পুরুষ মানুষের গলায় খুব শান্ত কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ যে এই কথা বলার সাহস রাখে তাকে আমি ঠান্ডা মাথায় খুন করবো ভাইয়া।’
ধ্রুব প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। কিন্তু বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। আজ বোধহয় বৃষ্টি নামার দিন। সেই বৃষ্টির সাথে সাথেই ধ্রুব জীবনে এই প্রথমবারের মতো নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলো না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল কল্পর ছোট্ট শরীরকে আঁকড়ে ধরে। তার যে বুকে ব্যথা। এই বুক ব্যথা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে সারাজীবন। এই গল্প কেউ জানবে না। ধ্রুব নিজের বিবেকের কাছে অস্বচ্ছ থেকে যাবে সারাজীবন। একটা অপ্রকাশিত গল্প বেঁধে রাখতে হবে মেরুদণ্ড বরাবর। এই গল্প ভরা অশ্রদ্ধার মোড়ক। এই মোড়কে বড়ো জ্বালা। নিশিতা তাকে আমৃত্যু এই জ্বালা বওয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেলো। এই দায়িত্ব যে কতো ভারী নিশিতা কী জানে না? বড়ো ভাইয়ার আচমকা বাঁধ ভাঙা কান্নায় কল্প আতঙ্কে আরও শক্ত করে চেপে ধরলো তার গলা। অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মতো ল্যাপ্টে রইলো তার গায়ে। যেন ভাইকে বুঝাচ্ছে, ‘এইতো কল্প আছি। ভয় কী?’ আবির ভেতরে ঢোকার সময় দরজায় ছিটকানি তুলে দিয়েছিলো। ভাইয়ের কান্নায় সে মাথা তুলে তাকাল না। ভাইয়ের কোলে মুখ চেপে চুপচাপ বসে রইলো। মনে মনে বুঝলো, এই ভাইয়ার শেষ কান্না। এরপর এই মানুষটাকে কেউ কখনো কাঁদাতে পারবে না। এই বন্ধ ঘরের অপ্রকাশিত গল্পটা আর কেউ জানবে না। কোনোদিনও না।
# চলবে….