কিছু জোড়া শালিকের গল্প পর্ব ১৪ #অঞ্জলি
লেখিকা : #Lucky_Nova (কপি নিষেধ)
ভয়ে মুখটা শুকিয়ে গেলো সমীর আর নীরার। প্রয়াসের সাথে অঞ্জলী দেবীর কথা হলে শেষ রক্ষা হবে না। ঝামেলায় পড়তে হবে। বড়সড় ঝামেলায়।
“মা, তুমি না অসুস্থ! আমরা বুঝে নিবো তুমি যাও।” তাড়াহুড়ো করে নড়বড়ে গলায় বললেন সমীর।
“আমি তার সাথেই কথা বলতে চাই।” বলেই প্রয়াস সরাসরি এগিয়ে গেলো অঞ্জলির দিকে।
শত চেষ্টা করেও কোনো উপায় করতে পারলেন না সমীর আর নীরা। হাল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হলো বসার ঘরটা থেকে। যাওয়ার আগে প্রয়াসকে লুকিয়ে আড়চোখে শাসিয়েও গেলেন অঞ্জলিকে। বুঝাতে চাইলেন মুখ বন্ধ রাখার জন্য।
কিন্তু অঞ্জলি ধার ধারলেন না। ওরা বের হতেই ঘট করে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন।
আস্তে-ধীরে এগিয়ে গিয়ে বসলেন সোফাতে। প্রয়াস বসলো তার মুখোমুখি।
অঞ্জলি বেশ কিছুক্ষণ সময় ধরে কৃতজ্ঞচিত্তে তাকিয়ে রইলেন প্রয়াসের মুখপানে।
প্রয়াস একটু অপ্রতিভ হয়ে উঠলো ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে।
অঞ্জলি অর্থহীনভাবে মলিন হাসলেন। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলা শুরু করলেন, “তিয়াসার জন্মের কয়েক বছর পরেই ওর মা মারা যায়। ছোটো থেকে বাবার কাছেই মানুষ হয়েছে ও। ওর বাবা, মানে আমার বড় ছেলে অধীর বেঁচে থাকাকালীন কিছুর অভাব পড়েনি আমার তিয়াসার। মেয়ের সব খেয়াল রেখেছিলো ও। শুধুমাত্র মেয়েটা সারাদিন একা থাকবে ভেবে সমীরকে, আমার ছোট ছেলে আর তার বউ, নীরাকে এবাড়িতে জায়গা দিয়েছিলো। ওরাই থাকতে চেয়েছিলো। অধীরও মানা করলো না। থাকতে দিলো। আমার বড়ো ছেলে বেঁচে থাকা অব্দি ওদের ব্যবহার সুন্দর ছিলো। কিন্তু ওদের মনের মধ্যে যে এতটা হিংসা ছিলো তা হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি আমার বড়ো ছেলে। বছর খানেক আগে অধীর মারা যায়। তারপর থেকেই ওরা নিজেদের আসল রূপ দেখাতে শুরু করে। আস্তে আস্তে এই বাড়ি, গাড়ি সমস্তকিছু দখলে নেওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করে। যেহেতু পুরো বাড়িটা তিয়াসার নামে লেখা ছিলো তাই প্রথম প্রথম অনেক ধৈর্য ধরেছিলো ওরা। তাও ব্যবহার দিনকে দিন অনেক বাজে হচ্ছিলো। তারপর যখন সুযোগ বুঝে সব সম্পত্তিগুলো চালাকি করে নিজেদের নামে করে ফেললো তখনি আসল রূপটা সম্পূর্ণভাবে সামনে আসতে লাগলো ওদের। আমি গ্রামে ছিলাম বলে ওদের এসব অমানবিক কাজকর্মের বিষয় কিছু জানতেও পারি নি। বড়ো ছেলের মৃত্যুর পর আমি অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। অসুস্থও হয়ে পড়েছিলাম। সেই অসুস্থতার জন্য আমি গ্রামেই পড়ে ছিলাম। তিয়াসার কাছে যে আসতে চাইনি এমন নয়। কিন্তু আসতে চাইলেই আমাকে ওরা মানা করে দিতো। বলতো সব ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নেই। আমিও বোকার মতো কিছুই বুঝলাম না। একদিন হঠাৎ খুব ইচ্ছে করলো এখানে আসতে। তাই কী মনে করে যেন না বলেই হুট করে চলে এসেছিলাম এখানে। সেদিন যদি না আসতাম তাহলে এসবের কিছুই জানতে পারতাম না। জানতেই পারতাম না মেয়েটার উপর দিয়ে কী যাচ্ছে! আর না দেখতে পারতাম! তবে আমার এখানে আসাতে যে তিয়াসার উপর ওদের অত্যাচার কমলো এমন নয়। আর আমিও এমনই দুর্ভাগা যে তিয়াসার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। কিছু বলতে বা করতে গেলে উল্টো আমাকেই মারতে আসতে চাইতো ওরা। আমি নিরুপায় ছিলাম। একবার ওদের বলেছিলাম ওকে নিয়ে আমি গ্রামে থাকি। সেটাও শুনলো না। গ্রামের জায়গাটাও দখল করে বসে রইলো। আরেকবার ভাবলাম পুলিশকে বলি। চেষ্টাও করলাম। জানালামও। লাভ হলো না। ওরা পুলিশকে টাকা খাইয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে দিলো। উল্টো আমার এভাবে জানিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়েটাকেই আরো ভুগতে হলো। সাথে আমাকেও। ওরা আমাকে আর তিয়াসাকে সহ্যই করতে পারছিলো না। এজন্যই আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে আর তিয়াসাকে শেষ পর্যন্ত একটা জানোয়ার লোকের সাথে বিয়ে দেবে বলে ঠিক করলো ওরা। আমি বুঝতেও পারিনি যে ওই জানোয়ার এতটাই নীচ যে তিয়াসাকে বিয়ের আগেই জোর করতে চাইবে। আমি না থাকলে সেদিন হয়তো মেয়েটাকে শেষই করে ফেলতো জানোয়ারটা। কুলাঙ্গার, লম্পট।”
বলতে বলতে রাগে, ঘৃণায় মুখটা বাজেভাবে কুচকে ফেললেন অঞ্জলি। ভিজে চোখদুটো লাল টকটকে হয়ে উঠলো।
“বাড়িতে ওরা ছিলো। তবুও কেউ একজন মেয়েটার জন্য আগালো না ভাবতে পারো! কতটা নীচে নামলে মানুষ এমনটা করতে পারে! মেয়েটার গায়েই হাত তুললো ওরা। সেদিন মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়েই চলে গেলো। তারপর আর আসে নি। আমি ভেবেছিলাম মেয়েটার বোধহয় কিছু হয়ে গেছে। উল্টোপাল্টা চিন্তা নিয়ে এই কয়েকটা দিন আমি কীভাবে ছিলাম আমি নিজেও জানিনা।” চোখ ছলছল করে উঠলো তার। খুব অসহায় দেখা গেলো মুখখানা।
“এর আগেও নাকি মারধর করলে মেয়েটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতো। তবে পরে ফিরে আসতো। কিন্তু সেদিন আর এলো না। ওই জানোয়ারটা খোঁজাখুঁজিও করলো। পেলো না৷ আমি চাচ্ছিলাম তিয়াসা ফিরুক। কিন্তু ফিরলেই আবার এই নরক যন্ত্রণা যে ওর জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে। এসব ভাবলেই মনে হতো মেয়েটা আর কখনই না ফিরুক।” ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলেন অনবরত।
হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রয়াস। ও ধারণাও করতে পারেনি যে তিয়াসার সাথে দিনের পর দিন এতকিছু হয়ে গেছে।
অঞ্জলি নাক টেনে চোখ মুছলেন শাড়ির আঁচলে। বললেন, “আজ লুকিয়ে ওদের কথা শুনেছিলাম। ওই জানোয়ারটা তিয়াসার জন্য রিপোর্ট লিখিয়েছিলো। সেজন্যই খোঁজও পেয়েছিলো আজ যে তিয়াসা কারো কাছে আছে। হয়তো তোমার কথাই বলছিলো। কথা শুনে বুঝলাম তুমি ওদের হাতে তিয়াসাকে দেওনি। ওকে নাকি পুলিশের ভয়ও দেখিয়েছ। আবার তিয়াসাও নাকি তোমার কাছে থেকে আসতে চায় নি। আসতে চাওয়ার কথাও না। এখানে ওর কেউ নেই। আমি থেকেও নেই। আমি কিছুই করতে পারিনি ওর জন্য।”
বলতে বলতে চোখদুটো ভিজে উঠলো বৃদ্ধার।
“এমন একটা দিন ছিলোনা যেদিন মেয়েটা মার খায় নি। ও কী ক্ষতি করেছে ওদের তা আমি জানিনা। এমন ছেলে আমি পেটে ধরলাম কী করে!” আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি।
বাকরুদ্ধ হয়ে বিবশ চোখে তাকিয়ে রইলো প্রয়াস।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতায় কেটে গেলো।
অতঃপর অঞ্জলি চোখ মুখে একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, “মেয়েটা তোমাকে খুব জ্বালায় বোধহয়! ও একটু মনের মতো কাউকে পেলেই আর ছাড়তে চায় না।”
প্রয়াস আমতাআমতা করলো।
“আমি যে মেয়েটাকে খুব কদর করতাম এমন না। বংশের প্রথম সন্তান হিসেবে বোবা বলে আমি ওকে ঠিক পছন্দ করতে পারি নি।” কথাটা বলতে বলতে মাথা নিচু করলেন অঞ্জলি।
বললেন, “আস্তে আস্তে মেনে নিয়েছিলাম। তবে রুমি, মানে আমার এই ছেলের মেয়েটাকেই বেশি গুরুত্ব দিতাম।”
চোখমুখে অনুশোচনা দেখা গেলো বৃদ্ধার।
হতাশভাবে নিঃশ্বাস ফেলে প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি জানিনা মেয়েটাকে এখন আমি কী করব! এখন তো আমার থাকার জায়গাটাও নেই। মেয়েটাকে নিয়েই বা কোথায় যাব!”
প্রয়াস তাকালো তার দিকে।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো ক্যান্ডেল। দুইহাত একত্রে ধরে কচলা কচলি করতে লাগলো অনবরত। এই পরিবারের লোক যেনো শুনেই ছাড়বে যে ইভানের সাথে ওর গভীর রকমের সম্পর্ক সত্যিই আছে।
“সারাদিন সময় নেই আমাদের। আমি শুধু এটাই জানতে চাই যে মিথ্যা কথা কোন সাহসে বলছো তুমি?” ইশারা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
“মা, ঠান্ডা হও। এভাবে অচেনা কাউকে বকাঝকা করা ঠিক না।” চাপা স্বরে বলল ইমন।
খেঁকিয়ে উঠলেন ইশারা।
“কীসের ঠান্ডা হবো আমি? এই মেয়েকে এখন ওর বাসার ঠিকানা বলতে বল। আমার সংসারে অশান্তি বাঁধিয়ে কাউকে শান্তিতে থাকতে দেবো না আমি। আমিও দেখি এই মেয়ে কি করে পার পেয়ে যায়।” বলেই কঠোর নজরদারিতে তাকালেন ক্যান্ডেলের দিকে।
ক্যান্ডেল খানিক ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো।
“ভালোয় ভালোয় বলো। এতক্ষণ যথেষ্ট সময় দিয়েছি আর দেবো না।”
জয়িতা তটস্থ হয়ে তাকালো ইমনের দিকে। ইমন মুখ দিয়ে বিরক্তসূচক শব্দ বের করলো।
এতক্ষণে মুখ খুললো ক্যান্ডেল। মিনমিন করলো,
“আমাদের মধ্যে সত্যিই কিছু নেই।”
হতভম্ব হয়ে গেলেন ইশারা।
আবীর মুখার্জি ভ্রুকুটি করে তাকালো ক্যান্ডেলের দিকে।
“আপনারা সত্যিই ভুল বুঝছেন আমাদের। আম…”
“যথেষ্ট হয়েছে তোমাদের মিথ্যে বলা।” কর্কশ গলায় বলে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন ইশারা।
চমকে উঠলো ক্যান্ডেল।
ইমন এগিয়ে এসে ইশারাকে ধরতে চাইতেই হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিলেন তিনি। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন, “আমার সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছু। ওরা কি ভেবেছে আমি কিছুই বুঝিনা? ধরা পড়ে যাবার পরেও কীভাবে বলছে যে আমি ভুল দেখেছি?”
“মা, শোনো..।”
“কতটা সাহস হলে এমন কাজ করেও ওরা বড়োমুখ করে কথা বলে!” শান্ত হওয়ার বদলে উলটো ব্যগ্র হয়ে উঠলেন ইশারা।
ইমন বেজার বিপদে পড়ে গেলো। তার মায়ের জেদ সমন্ধে সে অবগত। সে যা ভেবেছে সেটাই সঠিক, এটা না শোনা পর্যন্ত সে থামবে না। সে একবার যা ধারণা করবে সেটা যে ভুলও হতে পারে তা সে কখনই মানবে না। তোলপাড় হয়ে গেলেও না।
এদিকে ইভানও একরোখা।
ওর মুখ থেকে একবার যেহেতু বের হয়েছে ও কোনো দোষ করেনি, মানে ও করেনি। এখন যা-ই হয়ে যাক না কেনো ওর কথার নড়েচড় হবে না।
অর্থাৎ আজকের এই বিবাদের নিষ্পত্তি হবে বলে মনে হয় না।
“সবটা স্বীকার করে ঠিকানা বলো তাড়াতাড়ি।” গমগমে গলায় বললেন ইশারা।
বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো ক্যান্ডেল। এমন লোক এজীবনে দেখে নি সে। যা শুরু করেছে তাতে আজ বাড়ি ফিরতে পারার সম্ভাবনা একদমই নেই বললেই চলে।
“চুপ করে আছো কেনো?” ধমকে উঠলেন ইশারা।
চকিতে তাকালো ক্যান্ডেল। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে চাওয়ার আগেই ইভান এসে ওর হাতের কবজি চেপে ধরলো।
হকচকিয়ে উঠলো ক্যান্ডেল।
অন্যরা আকাশ সমান অবাক হয়ে তাকালো ওদের দিকে। তবে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্যান্ডেলকে সবার সামনে থেকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেলো ইভান।
সর্বোচ্চ হতবাক হয়ে গেলেন ইশারা। ওরা বেরিয়ে যাবার কয়েক সেকেন্ড পরেই ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন তিনি।
ছেলে তার পুরোপুরিই বিঘড়ে গেলো বোধহয়!
(লেখিকা লাকি নোভা)
(গল্প কপি করা নিষেধ)
(চলবে…)