অচেনা পর্ব ৭
আজকে আমার গায়ে হলুদ। নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের আগেরদিন গায়ে হলুদ হওয়ার কথা। কিন্তু মেজচাচীর ইচ্ছা একদিন আগে হবে। এটা নাকি এখনকার “ট্রেন্ড”। ফুপু হালকা আপত্তি করলো। কিন্তু গরমে আর বার বার চুলার পাড়ে গিয়ে তার অবস্থা কাহিল। তার উপরে উনারা হুট করে আমেরিকা থেকে আসায় অনেকগুলো টাকা চলে গিয়েছে। আসার সময় মনে হয় এটা মাথায় ছিলো না অতি উত্তেজনায়। এখন বারবারই ফুপু বলছেন,
“টাকা খরচ করে না এসে টাকাগুলো পাঠিয়ে দিতে হতো। অকারণে বাচ্চাগুলো এত কষ্ট করছে।”
আমি জানি এসব বলার জন্যই বলা। এত টাকা শুধু মাছ-মাংস খাওয়ার জন্য পাঠানো যায় না। তার থেকে ফুপু এসে ভালো হয়েছে। আমাদের খুবই আনন্দ হচ্ছে। ফুপাকে অবশ্য দেখাই যাচ্ছে না। উনি স্পর্শর রুমে থাকছে। ওই রুমে এসি আছে। স্পর্শকে কিভাবে এত কিছুতে ঢোকানো গেলো এটা বুঝছি না। ফুপুদের এয়ারপোর্ট থেকে আনলো, আবার দেখছি এখন বাজারও করে দিচ্ছে। ফুপা তো সারাদিন ওর ঘর থেকে বের হচ্ছে না। বেশ বাড়ির মানুষ মনে হচ্ছে ওকে।
আমি সকাল থেকে গোসল করে বসে আছি। বুঝছি না যে কখন হলুদ হবে। মেজচাচীর ইচ্ছা ছিলো সকাল সকাল হলুদ করার। এটাই নাকি এখনকার “চল”। ছোটচাচীর এটাতে ঘোর আপত্তি। উনার শেখানো নাচের মধ্যে লাইটিং এর একটা ব্যাপার আছে। এই কারণে রাতে হওয়ার দরকার অনুষ্ঠানটা। এদিকে মা আবার হলুদের পর গোসল করাতে চায়। উনি কোন সময় এটা করাবে তা বুঝছে না। তবে এই মুহূর্তে সকাল দশটা বাজে। কারো মধ্যে হলুদ করার আলোচনা ছাড়া কিছু দেখছি না।
লুবনা উঠানের এক কোণায় পাঁচটা গাদা ফুলের মালা নিয়ে বসে আছে। রুনন পাশে দুইটা টেবিল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা আলোচনা করছে স্টেজ কিভাবে করা যায়। আমি ঠিক বুঝছি না গাছের আড়ালে যেখানে স্টেজ করছে সেখান থেকে বাইরে মানুষ দেখবে কি করে।
আমি সকাল থেকে এদিক ওদিক তাকিয়ে রুনি টুনিকে খুঁজছি। গতকাল রাতের আলোচনার ফলাফল শুধু ওরাই জানতে পারে। কিন্তু ওদের কোথাও দেখছি না। রুননকে ডেকে একবার জিজ্ঞেস করলাম। সে বলতে পারলো না। এদিকে মেজচাচী আমাকে ঘরে বসিয়ে রূপচর্চা শুরু করে দিয়েছে। সবুজ জেলের মতো চিনি মেশানো জিনিসটা দিলো। ফেসপ্যাক দিলো। এরপর আবার কি দিয়ে জানি মুখ ঘষাঘষি শুরু করলো। এটা নাকি উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য। মেজচাচী উনার বান্ধবীর কাছ থেকে এনেছে। তার বাসাতে নাকি পড়েই ছিলো। মেজচাচীর এরকম অনেক বড়লোক বান্ধবী আছে। যাদের বাসায় মাঝে মাঝেই মেজচাচী যায় এবং ফিরে এসে সেই বাসায় কি কি পড়ে থাকে তার গল্প শোনায়। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি। মেজচাচীর এক বান্ধবী গত ঈদে দশ বস্তা কাপড় বাতিল করেছে। অথচ সে কোন কেনাকাটাই করে না। এই গল্প আমরা প্রায়ই বিস্মিত হয়ে করি। আমি বসে বসে এসব ভাবছি আর মেজচাচী আমার হাত পা ঘষাঘষি করছেন। হঠাৎ কেন জানি খুব কান্না পেলো। এই যে এত ভালোবাসা এর কোন প্রতিদান কি কখনো দিতে পারবো নাকি কানাডার শীতে বসে ফোনে মাঝে মাঝে ছবি পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করবো!
অবশেষে রুনি টুনিকে পাওয়া গেলো। তারা ঘেমে নেয়ে একাকার। সকাল থেকে তাদের নাচানাচি হচ্ছিলো। আমি তাদের দেখেই আড়ালে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে গতকাল রাতে কি ঠিক হলো। রুনি খুব স্বাভাবিকভাবে বললো,
“ছোটচাচী বলেছে বিয়েতে এসব হয়। অনেকে অনেক কথা বলে। এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই।”
টুনি সাথে যোগ করলো,
“বড়চাচী বলেছেন ছেলের মা এত ভালো। এত জিনিস দিলো। একটাকা চায়নি। এরকম ছেলে লাখে একটা মিলে। এই ছেলের সাথে জোর করে কথা বলার কিছু নাই।”
রুনি মাথা নেড়ে বললো,
“বড় চাচী বলেছে কোটিতে একটা মিলে।”
“না লাখে একটা বলেছে।”
“না কোটিতে বলেছে।”
ব্যাস দুইবোনের ঝগড়া লেগে গেলো। এরমধ্যে আমাকে শাড়ি পরানো হলো। আমি ছেলেপক্ষের দেওয়া চকচকে কাতান শাড়ি পরেছি। ছোটচাচী আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিলো। লুবনা গাদা ফুল দিয়ে মালা, টায়লা, টিকলি এবং আরও হাবিজাবি কি জানি বানিয়েছে। ফুল বাঁচাতে এবং সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে সে মাঝেমাঝে লাল রঙের কাগজেত ফুল বানিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। স্টেজের ফুল একটু কমে গিয়েছে। কিন্তু তারপরো বিয়ের কন্যা হলো আসল। তার সাজ আগে। তাই সবাই বেজায় খুশি।
বাড়িতে আমার পাশে সবাইকে খুব ম্লান দেখাচ্ছে। মা আর দুই চাচী নিজেদের তুলে রাখা সূতী ভালো শাড়ি পরেছে। ফুপু খুব বিরক্ত হচ্ছে। উনি বছরে দুইবার মাদের ভালো শাড়ি উপহার দেন। কিন্তু বেশি ভালো রাখা শাড়ি উনারা হলুদের দিন নষ্ট করতে রাজি না। ফুপু একাধিকবার বললেন,
“মেয়ের হলুদে ভালো শাড়ি পরবা না তো কবে পরবা? জামদানীগুলো পরো। বড়ভাবী তোমাকে যে হলুদ জর্জেট দিয়েছিলাম ওইটা কোথায়?”
কিন্তু ফুপুর কথা সবাই না শোনার ভান করছে। মেজচাচী একবার বললো শুধু,
“কে না কে যে হলুদ লাগিয়ে দেয় শাড়িতে।”
“আরে কে হলুদ লাগাবে! তোমাদের বিয়ে নাকি। আছেটাই বা কে এই হলুদে!”
লুবনা ফুপুর সাথে অনেকবার সহমত প্রকাশ করেও তেমন লাভ হলো না। ফুপু নিজে অবশ্য একটা ম্যাক্সি পরে বসে আছেন। হলুদ দিতে যাওয়ার সময় উপরে ভালো ওড়না পেচিয়ে নিবেন। গরমে উনার কাহিল অবস্থা। স্পর্শকে ঘর থেকে বের করে উনাকে রাতের বেলাটা থাকতে দিলে ভালো হতো। কিন্তু স্পর্শকে বের করে আমরা রাখবো কোথায়!
শেষ পর্যন্ত আমার গায়ে হলুদ খুব ভালোভাবে সম্পন্ন হলো। বাইরে স্টেজ করার অনেক চেষ্টা করেও করা গেলো না। লুবনা, চামেলি, স্পর্শ আর রুনন মিলে অনেক উপায় বের করার চেষ্টা করলো। কিন্তু সমস্যা হলো বাসায় দুইটা সোফা সেটের টেবিল আছে আর সোফা আছে দুই পিস তাও এক সিটের। এটা দিয়ে স্টেজ কিছুতেই বানানো গেলো না। স্পর্শ কয়েকবার অবাক হয়ে রুননকে বললো,
“সোফা সেটের টেবিল দুইটা কেন? সোফাগুলো কোথায়?”
রুনন উত্তর দিতে পারলো না। কারণ পুরো ঘটনা ওর জন্মের আগে। সে জন্ম থেকে এটুকু সম্বলই দেখছে।
তবে বড় ঘরে স্টেজ করা হলো। খাটের পেছনে তিনটা মালাকে কেটে ঝালরের মতো লাগানো হলো। লুবনা আগেই রুনি টুনিকে দিয়ে কাগজের উপর লাগিয়ে রেখেছিলো যে “রাবেয়ার হলুদ সন্ধ্যা”। সেইটা লাগানো হলো। চামেলি “সন্ধ্যা” শব্দটা নিয়ে কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলো। কিন্তু অন্য সবাই খুশিই হলো স্টেজ দেখে। বাড়ির মানুষেরা মিলে বেলা বারোটায় হলুদ শুরু হয়ে দেড়টায় শেষ হয়ে গেলো। মেজচাচীর আইফোনধারী আত্মীয় আসলো না। কিন্তু স্পর্শ তার আইফোন দিয়ে ছবি তুলে দিলো কিছু। চামেলি পুরো সময় পাশে দাঁড়িয়ে নির্দেশনা দিলো কিভাবে কোন ছবি তোলা উচিৎ। আমার বড় মামী অতি উৎসাহের সাথে রান্নাবান্না করে নিয়ে চলে এসেছেন। উনি আগেই বলে রেখেছিলো যে হলুদের খাওয়াটা উনি আনবেন। সবাই বেশ খুশি হয়েছিলো এটা নিয়ে। উনি পায়েস এনেছেন সামনে দেওয়ার জন্য। আবার ছেলের বাসায় পাঠানোর জন্য একটা ফলের ডালাও সাজিয়ে এনেছেন। বড় মামী এসে অনুষ্ঠানটা জমিয়ে দিলো। আমার মা চাচীরা কেউ কাঁদলো না। উনি আমাকে হলুদ দেওয়ার সময় খুনখুন আওয়াজ করে কাঁদলো, আমার গালে চুমু দিচ্ছে এরকম পোজে ছবি তুললো। তারপর আবার দুইশ টাকার নোট আমার হাতে গুজে দিলো। রুমকি পুরো সময় মুখ ভার করে বসে থাকলো। হলুদও দিলো না। তার পায়ের ব্যথাটা নাকি বেশি। বিয়ের কাজে বাড়ির সব মানুষও এদিক ওদিক আছে। সবমিলিয়ে দশজনের উপস্থিতিতে আমার গায়ে হলুদ হয়ে গেলো। হলুদের পর শুরু হলো নাচ। এতদিন নাচানাচির পর দেখা গেলো রুনি টুনির একটা মাত্র নাচ মনে আছে। তারা দুইজন সম্পূর্ণ দুইভাবে একসাথে নেচে দেখালো। রুনন মাঝে মাঝে সানগ্লাস পরে এসে মাঝখানে কিছু একটা করলো। শ্রাবণ পুরো সময় পাশে দাঁড়িয়ে নাচলো। এই হলো হলুদের পর নাচ। কিন্তু এরপর শুরু হলো আসল নাচ। বড়মামী জোর করে ছোটচাচী আর মেজচাচীকে নিয়ে কিছুক্ষণ নাচলো। লুবনা তাদের দেখে ধেইধেই শুরু করলো। শ্রাবণ রুনন মনের আনন্দে নাচের মধ্যে ঢুকে গেলো। তাদের দেখতে খুবই ভালো লাগছে। ফুপু দুইটা পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছে ওদের। একটা হলুদে পরবে আরেকটা বিয়েতে। নতুন জামা পরার আনন্দ একেবারে ঝরে পরছে। রুনি টুনিকেও অবশ্য খুব ভালো লাগছে। ওরা দুইজন শাড়ি পরেছে। এই শাড়ি ওদের খালাতো বোনদের কাছ থেকে আনা। কি যে সুন্দর লাগছে ওদের! যতবার তাকাচ্ছি আমার চোখে কেন জানি পানি চলে আসছে।
হলুদ শেষ হবার পর সবাই ঝাপিয়ে পরে খাওয়া শুরু করলো। বড় মামী খিচুড়ি, আলু ভর্তা, গরুর মাংস আর সালাদ নিয়ে এসেছে। বড় ভাইয়া আর শিবলী ভাই আগেই খেতে বসেছে। ভাইবোনরা সব চেটেপুটে খাওয়ার পর বড়রা অতি কষ্টে নিজেদের আনন্দ সংবরণ করে চেহারা স্বাভাবিক করে খেতে বসলো। বহুদিন পর আমাদের বাসায় আনন্দ ফূর্তি হলো এরকম। সব শেষ করে রাতের বেলা আমার মায়ের মনে পড়লো যে আমাকে বিশেষ গোসল দেওয়ানো হয়নি। এইটা নিয়ে বাসায় বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি হলো। আমার কেন যেন মনটা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। প্রতিটি হাসি বুকে কাটার মতো বিধছে। মনে হচ্ছে যে এই হাসিগুলো ছেড়ে থাকতে পারবো তো!
বড়মামী যাবার সময় আরেকদফা আমাকে জড়িয়ে কাঁদলো। উনি নিজেই উনার বাড়ি থেকে আমার বিয়ে দিতো। কিন্তু বজলুর বিয়ে আর অসুস্থ শ্বশুরের দেখাশোনা করে উনি কুল পায় না এই গল্প অনেকবার করে সবাইকে শুনতে হলো। রুমকি অবশ্য থেকে গেলো আবারও। কিন্তু তার মুখ থেকে কালোভাব সরলো না। সে একটু পর পর রেগে রেগে আমাকে বললো,
“এইসব চামেলি আপুর মতো মেয়েদের আমার একটুও পছন্দ না। ছেলে দেখলেই গায়ে পরা একটা স্বভাব।”
রেগে মুখ গোজ করে সে ছোট চাচীর ঘরে বসে বাকি দিনটা কাটালো।
আগামীকাল অনেক ব্যস্ততা এই চিন্তা করে সবাই আজকে দেরি করে ঘুমাতে গেলো। অনেকদিন আমাদের বাসায় কেউ একদিনে এত কাজ করেনি। তাই একসাথে সব কিভাবে হবে তা নিয়ে হুলুস্থুল বেধে গেলো। আগামীকাল আমার সংগীত, মেহেদি, গোসল হবে। ওদিকে বাবারা চার ভাইবোন যাবে ছেলের বাসায়। এই প্রথম ছেলের সাথে দেখা তাই ফুপাকে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করা হলো। কিন্তু ফুপা লম্বা করে কাজের অজুহাত দেখিয়ে দিলো। আমার মা-চাচীরাও কেউ রাজি হলো না। অদ্ভুত ব্যাপার আমার যে ছেলের সাথে দেখা করা বা কথা বলা দরকার এইসব কেউ ভাবছে না। সবশেষে ছোটচাচী আর মেজচাচী আমার বিয়ে নিয়ে গর্ব করতে করতে আলোচনা শেষ হলো। উনাদের গর্বের কারণ হলো অনেকেই নাকি উনাদের বলেছে যে তোদের যে “দিন আনি দিন খাই” অবস্থা তাতে কি আর এসব নাচানাচি মানায়। কিন্তু এখন ছবি দেখলে ওদের চোখ “ট্যারা” হয়ে যাবে। মেজচাচা আর ছোটচাচা এই কথা শুনে আনন্দে খুবই হাসলো। সবাই অন্যদের চোখ “ট্যারা” করতে পারার আনন্দ নিয়ে ঘুমাতে গেলো।
(চলবে)