কলমেঃ আয়েশা সিদ্দিকা (লাকী)
লতা তমাকে তার ঘরে এনে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
— তোকে কতদিন বলেছি যে, তুই রিমার সাথে তর্ক করিসনা তারপরও তুই কেনো কথা শুনিসনা তমা?
— ভাবি তুমি তো যানোই আমি এই অন্যায় কাজ দেখতে পারিনা। কিছু বলতে তো চাইনা, তরপরও সহ্য হয়না। তখন কথা না বলে চুপ থাকতে পারিনা।
— সে তো বুঝলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হলো! মা তোকে তেড়ে মারতে গেলো আবার তোর ভাইয়ের হাতেও মার খেলি। মাঝ খান থেকে রিমা সবার কাছে ভালো সাজলো।
— ভাইয়া মেরেছে তাতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না। হাজার মাইর খেলেও তুমি এবং বড়ো ভাবি কারো সাথেই অন্যায় দেখতে পারবোনা।
তমা আর লতার কথার মাঝে অথৈ এসে ঢুকলো ঘরে। অথৈ তমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— তমা যা হবার হয়ে গেছে। তোমার বড়ো ভাইয়া আসলে তুমি আবার যেনো তাকে এসবের কিছু বলোনা। সে এসব শুনতে পেলে বাড়িতে তুলকালাম বাঁধিয়ে দেবে।
— আচ্ছা বলবোনা। কিন্তু তোমরাও এভাবে অন্যায় গুলো মাথা পেতে নিওনা।
লতা বললো,
— অনেক হয়েছে, অল্প বয়সে খুব বেশি প্রতিবাদী হয়ে গেছো। এখন এই প্রতিবাদ করা রেখে পড়ায় মন দে।
লতা কথাটা বলে তমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলো। অথৈও লতার পিছনে পিছনে চলে গেলো। অথৈ তমার ঘর থেকে বের হতেই রিমা অথৈকে দেখে মায়ের কাছে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— মা, আমি আর আসবোনা এ বাড়িতে। আমি এবাড়িতে এসে থাকি দেখে সেটা কারো সহ্য হয়না। আমাকে যে কারো সহ্য হয়না সেটা মুখে বলে দিলেই তো পারে এভাবে অবহেলা করার কি দরকার!
অথৈ কিছু বলতে যাবে তখন খেয়াল করলো চুলার পাড় থেকে লতা তাকে ইশারা করছে চুপ করে থাকতে। অথৈ আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলে গেলো লতার কাছে।
রিমার কথা শুনে মরিয়ম বেগম বললো,
— তুই আসবি তোর বাপের বাড়ি। সেখানে কে কি ভাবলো আর বললো তাতে কিচ্ছু আসে যায় না।
— অন্য কারো কথা আর কি বলবো! নিজের মায়ের পেটের বোনই তো আমার বিরুদ্ধে। দেখলেনা, তোমার মেয়ে কি ভাষায় কথা বলে গেলো। কতোগুলো কথা আমাকে শুনিয়ে দিলো। সরাসরি বলে গেলো আমি এখানে পড়ে থাকি! সেখানে আমি কি করে থাকি বলো মা?
— তমার কথা বাদ দে তো। ও কি এতো কিছু ভেবে বলেছে নাকি! মুখে আসছে তাই বলে দিয়েছে। ওসব নিয়ে এতো ভাবিসনা তো যা ঘরে যা খাবার হলে আমি ডাক দেবো।
অথৈ চুলার পাড়ে এসে বসতে বসতে বললো,
— আপা, তুমি কিছু বলতে দিলেনা কেনো?
— আমি কোনো অশান্তি চাইনা আপা। এসব আমার একদমই ভালো লাগেনা। আর তাছাড়া তোমাকে উল্টা পাল্টা কথা শুনালে সেটাও আমার খারাপ লাগতো। তখন সহ্য করতে না পেরে হয়তো তাদের কথার জবাব দিয়ে দিতাম। কিন্তু তোমার দেবর ঘরেই আছে। তার মা বোনের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুনলে কি হবে বুঝতেই পারছো। তাই চুপ করে যেতে বললাম।
— মেজো ভাই কি তোমার গাঁয়ে হাত তোলে নাকি?
লতা কোনো কথা না বলে চুপচাপ কাজে মন দিলো। অথৈ এর বলা কথাটা শুনেও না শুনার ভান করলো। অথৈ যা বুঝার বুঝে গেলো তবুও লতাকে বললো,
— কি হলো আপা! কিছু বলছোনা যে?
— কি আর বলবো। চোখের সামনেই তো দেখলে নিজের বোনের গাঁয়ে হাত তুলতে একটুও আটকালোনা তার। সেখানে তো আমি পরের বাড়ির মেয়ে।
— কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে? তুমি মেজো ভাইকে কিছু বলোনা?
— কি হবে বলে? সেই গন্ডগোল মারামারি, আর তার মা বোনের কানে গেলো তো আরও আগুনের মধ্যে ঘি ঢালে। তাই আমার মনে হয় লোক জানাজানির চেয়ে চুপ থাকাই ভালো।
অথৈ এর আর কিছুই বুঝতে বাকি রইলোনা। মনে মনে ভাবলো এসব কিছুর মধ্যে সত্যিই আমি কপাল করে একটা স্বামী পেয়েছি। এজন্যই আপা সেদিন বলেছিলো আমি কপাল করে সুমনের মতো একটা স্বামী পেয়েছি। আজ নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।
রান্না শেষ হলে মরিয়ম বেগম এসে সবাইকে খাবার বেড়ে খেতে দিলেন। সুমন আজ সকালে উঠে বাইরে গেছে কি যেনো কাজের জন্য। তাই মরিয়ম বেগম অথৈকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— বড়ো বউ, তুমি সুমনের খাবার নিয়ে ঘরে ঢাকা দিয়ে রাখো। সুমন আসলে ওকে খেতে দিবে।
— আচ্ছা মা।
সুমনের খাবার নিয়ে অথৈ ঘরে চলে গেলো। ঘরে এসে অথৈ বসে বসে ভাবছে এ বাড়ির মানুষ গুলো সব কেমন যেনো! একেকজন একেক রকম। সব থেকে বড়ো কথা এরা বাড়ির বউকে বাড়ির কোনো সদস্য হিসাবেই ধরেনা। এরা এমন কেনো? আমারও তো দুটো ভাইয়ের বউ আছে কিন্তু মাকে তো কখনও এমন করতে দেখিনি। আমাদের বাড়িতে সবার যেমন অধিকার বাড়ির বউদেরও ঠিক তেমনটাই অধিকার। কারো উপর কোনো বাধ্যতা মূলক নিয়ম নেই। অথচ এ বাড়িতে পুরুষদের জন্য এক নিয়ম, বাড়ির মেয়েদের জন্য এক নিয়ম, বাড়ির বউদের জন্য আরেক নিয়ম। এ কেমন নিয়ম এখানে! এদের বেড়াজালে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে মাঝে মাঝে। কিন্তু সুমন পাশে আছে বলে তবুও মাঝে দম ছেড়ে বাঁচতে পারি। কিন্তু মেজো আপা! ওই মানুষটা কি করে বেঁচে আছে! মানুষ হয়তো সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু হজম করে মানিয়ে নিতে শিখে যায়। কিন্তু সেই সময়টা পার করা যে কতোটা কঠিন তা এবাড়িতে আসার পর বুঝতে পারছি।
অথৈ ঘরে আসার কিছুক্ষণ পরই সুমন আসলো। অথৈ বিছানার এক পাশে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। সুমন ঘরে ঢুকে অথৈকে এভাবে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
— কি ব্যাপার অথৈ, এভাবে বসে আছো কেনো? মন খারাপ?
অথৈ সুমনের দিকে তাকিয়ে বললো,
— কই না তো। মন খারাপ হবে কেনো!
— তাহলে এভাবে চুপচাপ বসে আছো যে! তাই ভাবলাম হয়তো মন খারাপ।
— না, মন খারাপ না। তুমি হাত মুখ ধুঁয়ে এসে খেয়ে নাও।
— বাড়ির সবাই খেয়েছে? তুমি খেয়েছো?
— বাড়ির সবাই খাচ্ছে। না আমি খাইনি সবার খাওয়া শেষ হলে তবেই আমি আর আপা খাবো।
— বাড়িতে কি কিছু হয়েছে?
অথৈ কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। কারো কাছ থেকে কিছু শুনেছে নাকি! তা না হলে তো হুট করে একথা জিজ্ঞেস করার কথা না। অথৈ ভয়ে ভয়ে জবাব দিলো,
— কই কিছু হয়নি তো!
— তাহলে এমন চুপচাপ হয়ে বসে ছিলে যে।
— কাজ ছিলোনা তাই বসে ছিলাম।
— আচ্ছা ঠিক আছে, এসো খেয়ে নাও।
— তুমি খেয়ে নাও আমি পরে আপার সাথে খেয়ে নিবো।
–কাল কি বলেছিলাম তোমাকে? তোমাকে তো বলেছিলামনা আমার সাথে খাবে তারপর আবার গিয়ে লতার সাথে খেয়ে নিবে। এসে খেতে বসো।
অথৈ আর কথা না বাড়িয়ে খেতে বসলো আর মনে ভাবছে,
একই মায়ের পেটের পাঁচ ভাই বোন অথচ তাদের মধ্যে কোনো কিছুতেই মিল নেই। মেয়েদের মধ্যেেও একজন আরেকজনের থেকে আলাদা। আবার ছেলের মধ্যেও তাই। একজন তার বউ কে কতো সম্মান করে ভালোবেসে সাথে করে নিয়ে খাচ্ছে। অথচ আরেক ভাই, তার বউ খেলো কি খেলো সে খোঁজও রাখেনা। ছোটো ছেলের সাথে সেভাবে কথা হয়নি তাই ও কেমন মানসিকতার মানুষ তা এখনও জানিনা।
জানিনা এদের সাথে জীবনের বাকিটা পথ কিভাবে চলবো। যদি সুমন এভাবে আমার পাশে থাকে তাহলে হয়তো সব বাঁধা বিপত্তি পার করে ওর হাত ধরে সারাটা জীবন চলতে পারবো। তা না হলে যে কি হবে ভাবতেও পারিনা। সুমনের দিকে তাকিয়ে অথৈ মনে মনে বললো, তুমি এভাবেই আমার পাশে থেকে সবসময়।
চলবে….
( রিয়েক্ট কমেন্ট করে পাশেই থাকবেন আশা করি।)