কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৭
তাহলে ফুফুও এই খু*নের সাথে জড়িত নাকি ফুফু নিজেই খু*নি? এ কেমন অদ্ভুত মায়াজাল!
পিছন ফিরে আমাকে দেখে ফুফু চমকে উঠলো। তড়িঘড়ি করে কানের দূলটা লুকিয়ে রাগী গলায় বললেন,
” একি! এখানে কি করিস তুই?”
” দাদি আপনাকে ডাকছে।”
” আচ্ছা ঠিক আছে আসছি। তুই যা।”
ফুফুর ঘর থেকে বেরিয়ে মা’য়ের কাছে গেলাম। মা তখন বড্ড ব্যস্ত।
” মা একটা কথা ছিলো। “
” তুই কি কাজের সময় ছাড়া অন্য সময় দেখিস না? আচ্ছা তাড়াতাড়ি বল কি বলতে চাস। “
” তামিম ভাইরা সকলে মিলে ইফতার বিলি করবে, আমাকেও ওঁদের সাথে থাকতে বলেছে। তাই তোমাকে জানালাম। “
” ভালো কাজে যোগ দিতে চাইছো, আমার কোন আপত্তি নেই। তবে তোমার আব্বুর কাছে বলে নিও। “
” ঠিক আছে। “
এক দৌড়ে মসজিদে চলে গেলাম। একটু হলেই ইফতার শুরু হয়ে যেত। নামাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরে দেখালাম আব্বু সোফায় বসে আছে।
” আসসালামু আলাইকুম আব্বা। একটা কথা ছিলো। “
” ওয়ালাইকুম আসসালাম, বলো কি বলবে।”
” তামিম ভাইরা ইফতার বিলি করবে, আমিও ওদের সাথে কাজ করতে চাই। “
” হ্যাঁ, তামিমও কথাটা বলেছে আমাকে, ঠিক আছে করতে পারো। তবে অতিরিক্ত রোদে ঘুরে শরীর খারাপ করবে না। “
” আচ্ছা ঠিক আছে। “
রাতের খাওয়া শেষ করে পড়তে বসেছি। বেশ খুশি খুশি লাগছে, তামিম ভাইদের সাথে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে আব্বা। তবে এক অদ্ভুত চিন্তা ভর করে আছে মাথায়। ফুফুর কাছে ওই কানের দূল কি করে আসলো? তাহলে কি ওঁরা দু’জন মিলে ছোট্ট তিন্নিকে খু*ন করেছে? ছোট থেকে ফুফুকে দেখে আসছি, উনি বদরাগী, একগুয়ে সম্ভবের হলেও মনের দিক থেকে বেশ নরম। ছোট বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে, তাছাড়া খু’নের মতো এতো বড় অপরাধ করতে সাহস করবে না। তবুও ফুফুকেই সব থেকে বেশি স”ন্দে”হ হয় আমার।
বইয়ের পাতায় আঁকিবুঁকি কেটে চলেছি, পড়তে ইচ্ছে করছে না। ঈদের আগে আর বই নিয়ে বসা হবে না। তাই বাধ্য হয়ে পড়তে হচ্ছে। সারাদিনের কাজ শেষে বই পড়া, তিন্নির খু”নিদের খোঁজ করা, আমার শরীর এতোটা পেরে উঠবে না। তাই আজ একটু বেশি করে পড়ে রাখবো। বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসলাম। ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়ে গেল। অনেক রাত পর্যন্ত পড়েছি। ঘড়িতে তখন প্রায় ৩টা বাজে। সেহেরি খেয়ে আসলাম মাত্র, শুয়ে পড়বো এমন সময় মা ডাকতে এলেন।
” মাত্র খাওয়া শেষ করলাম মা। তুমি গিয়ে খেয়ে নাও।”
” রোজ তুই একা একা খেয়েনিস কেন রে? আমাদেরও তো ডাকতে পারিস। “
” এরপর থেকে ডাকবো। সারারাত পড়েছি, খিদে পেয়েছিল তাই খেয়ে নিয়েছি একা একা, এখন শান্তিতে ঘুমাতে দেও। “
সেহেরি খেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। স্বপ্নে দেখলাম, তিন্নি আমাকে ডাকছে।
” এই যে বাদশা ভাই, এতো বেলা করে ঘুমাচ্ছ কেন?”
” তোর কি সবকিছুতে সমস্যা? “
” ভাইয়া!”
” জ্বি বল। “
” জানো আমার গোলাপ ফুল খুব পছন্দ। তুমি আমার বাড়ির পাশে গোলাপের চারা লাগিয়ে দিবে?”
” আমার ঘুম নষ্ট করে উনি গোলাপ গাছ লাগতে এসেছে। “
” একটু দিলে কি হয় শুনি? আমি তো বাচ্চা মেয়ে। “
তিন্নি গাল ফুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে দিবে। কিছু একটা বলতে যাবে এর মধ্যে কিছু পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। এতো সময় মনে হচ্ছিল তিন্নি জীবিত। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, পানির গ্লাস হাতে নিয়ে মনে পড়লো আমি রোজা। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম পৃথিবী আলোয় ভরে গেছে। অগত্যা গ্লাসটা জায়গা মতো রেখে দিলাম। হাত মুখ ধূয়ে ফ্রেশ হয়ে গোলাপ চারা খুঁজতে বের হলাম। পকেটে একশ টাকার একটা নোট পড়ে আছে। খুচরো টাকাগুলো দিয়ে একটা নোট বানিয়েছি, না হলে খরচ হয়ে যায়। টাকাগুলো একটা বিশেষ কাজের জন্য রেখেছি না হলে বাজার থেকে গাছ কিনে আনতাম।
গোলাপ গাছ জোগাড় করতে তেমন সমস্যা হলো না। সবুজদের বাড়িতে নানান ফুলের গাছ আছে। ওদের বাড়ি থেকেই চারটা ডাল নিয়ে এসেছি। এগুলো মাটিতে পুঁতে দিয়ে একটু যত্ন করলেই হবে। কবরের একপাশে সারি দিয়ে গাছগুলো লাগাবো। বাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে তিন্নির ক*ব*রের কাছে গেলাম। তিন্নির ক’ব’র’ অনেকটা বাগানের ভিতরে, সকলে রাস্তার পাশে ক*ব*র দিতে বলেছিল কিন্তু তিন্নির মা’য়ের ইচ্ছে তিনি সবসময় মেয়েকে চোখের সামনে দেখতে চায়, তাই বাধ্য হয়ে তিন্নিদের বাড়ির পাশে ক*ব*র দেওয়া হয়েছে, গাছপালার সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেকটা বাগানের মতো দেখায়।
ক*ব*রের পাশে গিয়ে মাটিতে দুই কোপ দিতে না দিতে সিরাজুল কাকা সেখানে হাজির হলেন। রাগী গলায় বললেন, “একি তুমি এখানে খোঁড়াখুঁড়ি করছো কেন?”
” আসলে কাকা গোলাপ গাছ লাগতে এসেছিলাম। “
” ক*ব*রের উপর গাছ লাগিয়ে কি হবে? এসব কুসংস্কার কোথায় পাও বলো তো?”
” তেমন কিছু না, রাতে স্বপ্ন দেখেছি তিন্নি আমাকে গোলাপ গাছ লাগাতে বলেছে, তাই এসেছিলাম। “
” এই ছেলে তোমার এখানে এসব গাছ লাগালো চলবে না। যাও এখান থেকে। “
” অদ্ভুত তো। আপনার কি সমস্যা? “
” কোন সমস্যা নেই, ক*ব*র খোঁড়াখুঁড়ি করেছিলে তাই বললাম। “
” ক*র*র খুঁড়ছি না। এইতো পাশেই লাগাবো। “
সিরাজুল কাকা বেশ ভালোমতো জায়গাগুলো দেখে নিলেন, তারপর চুপচাপ আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। গাছ লাগালো শেষ করে বাড়িতে ফিরলাম। সিরাজুল কাকার ব্যবহার কেমন যেন লাগল, আচ্ছা কবরের ভিতর কিছু নেই তো? যে ভাবেই হোক দেখতে হবে আমাকে। উনি কখন বাড়ি দিয়ে যায় সে-ই অপেক্ষায় রইলাম।
সকাল দিয়ে রাস্তার পাশে বসে আছি। কখন সিরাজুল বাড়ি দিয়ে বের হবে আর আমি আমার কাজ শেষ করবো। বেলা তিনটে নাগাদ উনি বের হলেন। ব্যাস! আর দেরি করলাম না। দৌঁড়ে তিন্নির ক*ব*রের কাছে চলে গেলাম। হাত দিয়ে কবরের মাটি সরাতেই পলিথিনের প্যাকেটে কিছু জিনিস দেখতে পেলাম। সাদা রঙের গুঁড়ি। টিভিতে দেখেছি এগুলো ড্রা*গ*স! আমি শতভাগ নিশ্চিত এগুলো এখানে সিরাজুল রেখেছে। তাহলে সিরাজুল মা*দ*কচক্রের সাথে জড়িত। এই লোকটার সমস্যা আছে আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। মাটি দিয়ে ক*ব*রটা ঢেকে দিলাম, যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে।
” একি বাদশা, তুই এখানে? “
” আসলে কাকি মা গোলাপ গাছ লাগিয়েছি, ওগুলোতে পানি দিতে এসেছিলাম। “
” এই ভর দুপুরবেলা পানি দিলে গাছ বাঁচবে না। “
” আচ্ছা। “
কাকিমা এগিয়ে এলেন, কাছে এসে আমার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, তারপর নিজের মতো করে ঘরে চলে গেলো। যাওয়ার আগে স্পষ্টভাবে দেখলাম উনার চোখে পানি জমেছে।
চারটার দিকে তামিম ভাইদের সাথে বের হলাম, সকলের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে ইফতার বিলি করছি। একদম ফ্রি-তে দান করছি ব্যাপারটা এমন না। সকলের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের পরিবারের লোক সংখ্যা অনুযায়ী ইফতার বুঝিয়ে দিচ্ছি, বিনিময়ে পাঁচ টাকা দাম নিচ্ছি। মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকদের মান অক্ষুন্ন রাখার জন্যই এ পরিকল্পনা। জানি না কতটা সফল হতে পেরেছি।
ইফতার বিলি করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। তামিম ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম, ” ভাইয়া তিন্নিদের বাড়িতে ইফতার দিয়ে আসি। আমাকে দুই প্যাকেট খাবার দিন। “
” তোর বাড়ির জন্যও নিয়ে নে, অনেক বেঁচে গেছে। এগুলো শুধু শুধু নষ্ট হবে। “
” আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে দিয়ে দেন। “
” আমাদের সাথে ইফতারটা করে গেলেও পারতে।”
” না ভাই সমস্যা নেই, অন্যদিন করবো। আজ একটু কাজ আছে আমার। “
তামিম ভাইয়ের থেকে প্যাকেটগুলো নিয়ে সাইকেলে উঠে বসলাম। এই ইফতারে বাহানায় তিন্নিদের বাড়িতে ঢুকতে হবে। বিনা কারণে বারবার ওই বাড়ি যাওয়া উচিত হবে না। তাহলে সিরাজুলের স*ন্দে*হ হতে পারে। কিন্ত বিধিবাম! গেটের কাছে সিরাজুলের সাথে দেখা,
” এই ছেলে কোথায় যাচ্ছো? “
” জসিম কাকাদের ইফতার দিতে। “
” এদিকে দেও, আমি দিয়ে দিবো। “
” আচ্ছা নেন। “
উনার হাতে খাবারগুলো দিয়ে বাড়িতে চলে এলাম। নানান পদের খাবার দেখে সবাই খুব খুশি। ইফতার শেষ বাড়িতেই নামাজ শেষ করলাম। মা’য়ের মোবাইল নিয়ে মানিককে কল দিলাম।
” কি রে এতো রাতে কল! কি অবস্থা? সব ঠিক আছে? “
” তোর এই প্রশ্ন করা স্বভাব কখনো যাবে না। হ্যাঁ সবকিছু ঠিক আছে। তোর আব্বু কি সকালে বাড়িতে থাকবে?”
” হ্যাঁ নয়টা পর্যন্ত থাকবে। তোর কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?”
” না, এখন রাখছি। “
“আচ্ছা। “
একে একে সব সূত্র মিলাতে লাগলাম। এখন পর্যন্ত তিন্নির খু*নের আসল কারণ জানা যায়নি। তবে কে বা কারা খু*ন করতে পারে এ ব্যাপারে আমি বেশ নিশ্চিত। ফুফু অথবা সিরাজুল, দুইজন মিলিতভাবে নয়তো একা। এ ছাড়া অন্যকারো খু*নি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু খু*নের কারণ কি হতে পারে! এতো সবকিছু মাঝে এক অদ্ভুত চিন্তা উদয় হলো আমার কাকি মা খুন করেনি তো আবার! কাকি মা’য়ের হাবভাব খুব একটা ভালো লাগছে না, এইতো গতকাল দেখলাম উনার ঘরবাড়ি খুব সুন্দর করে সাজানো, গোছানো। যার মেয়ে মা*রা যায়, তাঁর কি সংসারের প্রতি এতো খেয়াল থাকতে পারে? সেদিন সিরাজুল আর কাকি মা’য়ের ঘনিষ্ঠ দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। যতদূর দেখেছি কাকি কখনো আব্বুর সামনে আসেনি, বাইরের লোকের সাথে তেমন কথা বলে না। সে-ই মানুষ কি দূর সম্পর্কের ভাইকে জড়িয়ে ধরবে? ধোঁয়াশা কাটাতে গিয়ে আরো জড়িয়ে ফেললাম মনে হয়।
চলবে