#আমার তুমি
পর্ব ১০
#তানিশা সুলতানা
এই মুহুর্তে সায়ানকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে তুলতুলের। বজ্জাত লোক একটা। আজকে ভার্সিটির ফাস্ট ডেকে ছিলো। ওই লোকটার জন্য যেতে পারলো না। সেদিন যদি গন্ডারের মতো ওকে না নিয়ে যেতো তাহলে পা কাটতো না, আর পা না কাটলে তুলতুল আজকে ভার্সিটির যেতে পারতো।
ফাঁকা বাড়ি এখন। ফুপি দাদিমা আর তুলতুল ছাড়া কেউ বাসায় নেই। সুমু আর শান ভার্সিটিতে গেছে। সায়ান অফিসে গেছে।
তুলতুলের এবার কান্না পাচ্ছে। একা একা কি করবে ও এখন?
ফোটাও ভেঙে ফেলেছে ওই বাঁদরটা। ওই বাঁদর টাকে যদি তুলতুল পঁচা পুকুরে চুবানি দিতে পারতো তাহলে ভালো লাগতো।
উগান্ডার বংশধর।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফুপির রুমে যায় তুলতুল। সাহেদা বেগমের চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছেন মমতা বেগম। চোখ জুড়িয়ে যায় তুলতুলের৷ এই দৃশ্য আগে কখনো দেখে নি।
তুলতুলের নিজের মা আর দাদিমার সাথে সব সময় ঝগড়া হয়। দাদিমা ঠেস দিয়ে কথা বলে মাও ছেড়ে দেয় না। সকাল থেকে রাত ওবদি তাদের শুধু ঝগড়াই হয়।
তুলতুলের ইচ্ছে হচ্ছে নিজের মাকে এখানে নিয়ে আসতে। মা দেখুক কিভাবে শাশুড়ীকে ভালো বাসতে হয়।
তুলতুল নিজেকে প্রতিঙ্গা করে ফেলে তুলতুলও নিজের শাশুড়ীর সাথে এই রকম মধুর সম্পর্ক রাখবে। কিন্তু আদৌও কি তা সম্ভব?
ইফাদের মা খুব হিংসুটে আর অহংকারী মহিলা। তিনি কখনোই তুলতুলকে নিজের মেয়ে ভাববে না।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তুলতুল।
এক জীবনে সব চাওয়া পূর্ণ হয় না। ভালো বাবা পেয়েছে ভালো মা পেয়েছে। পরিবারের সবার থেকে ভালোবাসা পেয়েছে। অনেক কিছু পেয়ে গেছে। এবার নাহয় কিছু চাওয়া অপূর্ণ থেকে যায়।
“এক জীবনে সব পেয়ে গেলে আফসোস করবো কি নিয়ে?
থাক না কিছু চাওয়া অপূর্ণ।
যাতে সারাজীবন আহ্মেপ করতে পারি৷ আর দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলতে পারি।
ইসসস যদি পেয়ে যেতাম”
তাচ্ছিল্য হাসে তুলতুল।
“কিরে তুলতুল ওইখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ভেতরে আয় আম্মা।
হাতের ইশারায় সাহেদা বেগম ডাকে তুলতুলকে। মুচকি হেসে এগিয়ে যায় তুলতুল। পা টানটান করে সাহেদা বেগমের পাশে বসে।
” মাথায় তেল নিবা?
এই প্রথমবার মমতা বেগমের কন্ঠ শুনলো তুলতুল। বয়স পেরিয়ে গেছে সওরের বেশি। তবুও কি সুন্দর করে কথা বলে একদম শুদ্ধ ভাষায়। কথায় সুরে মিষ্টি ভরা।
তুলতুল হাসে।
“আপনি দিয়ে দিবেন? আপনি দিয়ে দিলে নেবো।
এক গাল হেসে বলে তুলতুল।
মমতা বেগম একটু হাসি। হাসি বলতে শুধু ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে মাথা নারায়। মানে দিয়ে দেবে।
সাহেদা বেগমও হাসে। সাহেদা বেগমের চুলে চুপচুপে করে নারিকেল দিয়ে বিনুনি করে দেন উনি।
তুলি এটা দেখে ঢোক গিলে। এবার কি তুলতুলকেও এভাবে চুল বেঁধে দেবে?
” মা আমার আম্মাকে এই তেল দিয়েন না। আমি প্যারাসুট বেলি ফুল তেল এনে দিচ্ছি। আর হালকা করে দিয়েন।
মমতা বেগম মাথা নারায়।
সাহেদা বেগম তেল এনে দেয়। উনি পরম যত্নে গল্প করতে করতে মাথায় তেল মালিশ করে দেয় তুলতুলের। উনি কথা বলতে জানে এটা তুলতুল নতুন আবিষ্কার করলো।
কিভাবে সায়ান বড় হয়েছ? ছোটবেলায় সায়ান পড়ে গেছিলো। শানের কবে জ্বর এসেছিলো। সায়ান কবে না খেয়ে ছিলো এই সবই ছিলো গল্পের টপিক।
“কতটা ভালোবাসলে মানুষ এসবও মনে করে রাখতে পারে। নাতিনাতনিদের যে উনি প্রাণের থেকেও বেশি ভালো বাসে এটা তুলতুল বুঝে গেছে।
মাথায় তেল নেওয়াতে ভালোও লাগছে এখন।
দাদিমার সাথে গল্প করতে করতে সময় পেরিয়ে যায়।
সাহেদা বেগমের সাহায্যে গোছল সেরে নেয় তুলতুল। ফুপি অনেক বলেছে খেয়ে নিতে তুলতুল খাচ্ছে না। অপেক্ষা করছে সুমু শান আসার। ওরা আসলে এক সাথে খাবে।
আজকে বৃহস্পতিবার সায়ানের হাফ ডে ছিলো তাই একটার মধ্যেই ছুটি পেয়ে যায়।
একদম বাসায় এসে খাবে বলে বাইরের কিছুই খায় নি সায়ান।
সাহেদা বেগমের ফোনটা অনবরত বেজে যাচ্ছে।
” তুলতুল দেখ না কে ফোন করলো?
হাত জোড়া কাজ সাহেদা বেগমের। দুপুরের খাবার বানাচ্ছে উনি।
তুলতুল সাহেদা বেগমের রুমে গিয়ে দেখে বাবা কল করেছে।
মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে তুলতুলের।
“হ্যালো বাবা
ফোনটা কানে নিয়ে বলে তুলতুল।
” মামনি কেমন আছিস?
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি?
” হুম ভালো। তোমার ফোন কি হয়েছে?
“হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে বাবা।
” তো নতুন ফোন নাও। ইফাদ কখন থেকে কল করছে তোমায়।
মুখটা কালো হয়ে যায় তুলতুলের। বুক চিড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে তুলতুলের।
“হুমমম
ছোট করে বলে তুলতুল।
” ইফাদ ঢাকা গিয়েছে। কাল তোমার সাথে দেখা করবে।
চমকে ওঠে তুলতুল।
“বাবা আমার
” কোনো কথা না। বিয়ের কেনাকাটা করবে কাল। সকাল সকাল ইফাদের সাথে বেরিয়ে পড়বে। আমি বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দেবো।
তোমার তো ফোন নষ্ট। তো আমি সায়ানের বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দেবো।
এতোখন ভালো ছিলো। সায়ান নামটা শুনেই কলিজা শুকিয়ে যায় তুলতুলের।
সায়ান জানলে তো কেলেংকারী বাধিয়ে দেবে।
ঢোক গিলে তুলতুল।
“বাবা ওনার বিকাশে টাকা দিতে হবে না।
রিনরিনিয়ে বলে তুলতুল।
” দিতে হবে কি হবে না সেটা আমি বুঝে নেবো। কাল নতুন ফোন কিনবে তুমি।
“আচ্ছা
তুলতুল আস্তে করে বলে।
” কি করো তুমি? খেয়েছো? নিজের খেয়াল রাখছো তো তুমি?
“হুমমম
” একদম লাফালাফি করবে না। সাবধানে থাকবে।
“তাজ কি করে?
” কথা বলবে তোমার সাথে।
“দাও
তারপর তুলতুল মা ভাই দাদি সবার সাথে অনেকখন কথা বলে।
বাবার সাথে কথা বলার পর থেকেই তুলতুলের মন খারাপ হয়ে যায়।
দুপুরে খাবার খাওয়ার সময় চুপচাপ খাবার খায় তুলতুল। সুমু এটা ওটা বলছে তুলতুল শুধু হু হা বলছে।
” তুলতুল আমার রুমে আয়।
সায়ান খাওয়ার মাঝেই হুট করে হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে।
কেঁপে ওঠে তুলতুল। মুখে ভাত পুরতে গেছিলো হাত থেকে ভাত পরে যায়।
মাথা নিচু করে ফেলে।
“তুলতুল আম্মা তোর রুমে যাবে কেনো?
সাহেদা বেগম ভ্রু কুচকে বলে।
” কথা আছে বলেই যেতে বলেছি।
ভাতের প্লেট ফ্লোরে ছুঁড়ে মেরে বলে সায়ান।
ভয়ে সিঁটিয়ে যায় উপস্থিত সবাই। তুলতুলের চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে।
সাহেদা বেগম চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকে।
“ভাই এটা কি করলি তুই? কি ধরনের ব্যবহার এটা?
মমতা বেগম চোখ পাকিয়ে বলেন।
” সরি দাদু। সরি মা আর হবে না এমন।
সায়ান মাথা নিচু করে বলে হনহনিয়ে চলে যায়।
তুলতুল এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। হাত না ধুয়েই সায়ানের পেছনে দৌড় দেয়। বুক কাঁপছে তুলতুলের। যদি সায়ান আবারও নিজের হ্মতি করে বসে?
এটা কিছুতেই হতে দেবে না তুলতুল।
“দিনদিন ভাইয়া কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে।
শান অফসোসের সুরে বলে।
” কেমন জানি হচ্ছে যাচ্ছে কি? আমার আব্বা একটুও বদলায় নি। আর বদলাবেও না। কিছুতেই বদলাতে দেবো না আমি। সব চাওয়া যখন পূরণ করতে পেরেছি। এখন তুলতুলকে চাওয়াটাও আমি পূরণ করবো।
চল এখন থেকে লেগে পড়ি আমরা।
যে করেই হোক তুলতুলকেই আমার আব্বার বউ বানাবো।
এক গাল হেসে বলে তুলতুল।
“আমার সাথে কে কে থাকবে?
প্রশ্ন করে সাহেদা বেগম।
” আমি আছি
সুমু হাত উঁচু করে বলে।
“আমিও আছি
সুমুর মাথায় গাট্টা মেরে বলে শান।
” আমিও আছি।
মমতা বেগম গম্ভীর কন্ঠের বলে।
“তাহলে কাল ইফাদ না কি টিফাদ তার সাথে ঘুরতে যাবি?
সায়ানের রুমের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছে তুলতুল। সায়ান তুলতুলের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বলে।
তুলতুলের মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
” ববাবা বলেছে। আমি তো বাবা কে না বলতে পারি না।
রিনরিনিয়ে বলে তুলতুল।
“তাহলে তুই যাচ্ছিস?
সায়ান তুলতুলের সামনে হাঁটুতে ভাজ দিয়ে দাঁড়িয়ে তুলতুলের মুখের দিকে ঝুঁকে ভ্রু কুচকে বলে।
” হুমম যেতে হবে।
সায়ান ফোঁস করে শ্বাস নেয়।
“লাস্ট বার জিজ্ঞেস করছি। যাবি?
” হুমমমম
“ওকে যা
বলেই তুলতুলের কোমর জড়িয়ে ধরে সায়ান। বড়বড় চোখ করে তাকায় তুলতুল সায়ানের দিকে। নাহহহ আজকে সায়ানের চোখে মুখে রাগ নেই। বরং চোখে মুখে হাসছে লোকটা। ভীষণ অবাক হয় তুলতুল।
এটা কি ঝড়ের পূর্ব লহ্মণ?
” তোকে আর আটকাবো না আমি।
তুলতুলের কানে ফিসফিস করে বলে সায়ান।
চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করপ ফেলে তুলতুল।
বাঁকা হাসে সায়ান।
তুলতুলের ডান গালে কামড় বসিয়ে দেয়।
ব্যাথা পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে তুলতুল। সায়ান ছেড়ে দেয়।
রক্ত বেরিয়ে গেছে গাল থেকে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে তুলতুলের।
সায়ান এক গাল হাসে।
“এবার আমিও দেখি তুই তোর হবু বরকে কি বলিস?
” ভীষণ খারাপ আপনি। সব সময় আমাকে কষ্ট দেন।
মনে মনে বলে তুলতুল। কিন্তু মুখে বলার সাহস নেই।
চলবে……..