#আমার তুমি
পর্ব ১২
#তানিশা সুলতানা
ইফাদকে দেখে সায়ান কয়েক মিনিট স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিঃসন্দেহে ইফাদ সায়ানের থেকে ভালো দেখতে। দামি গাড়ি করে এসেছে। মুখে গেলে আছে এক চিলতে হাসি। না চাইতেও তুলতুল ইফাদের চোখে চোখ পড়াতে একটু হাসে। যেটা আর সয্য হয় না সায়ানের।
“তুলতুল আমি এদিকে আছি। তোদের কেনাকাটা শেষ হলে আমাকে কল করিস।
বলেই আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না। দ্রুত পা ফেলে চলে যায় সায়ান।
তুলতুল সায়ানের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
” তুলতুল চলো
ইফাদ তুলতুলের হাত ধরে। তুলতুল হাত ছাড়িয়ে নেয়। ইফাদ ভ্রু কুচকে তাকায়।
“কি??
ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে ইফাদ।
” অনেকেই আছে।
আমতা আমতা করে বলে তুলতুল।
“এই তুমি এতো বোরিং কেনো বলোতো? এখানে অনেকেই হাত ধরে হাঁটছে। ইটস নরমাল।
ইফাদ ফোঁস করে শ্বাস নিয়ে বলে।
তুলতুল মাথা নিচু করে থাকে। কিছু বলতে পারে না। কি করে বলবে আপনার ছোঁয়া আমার ভালো লাগে না।
” পাশাপাশি হাঁটছে পারবে? না কি এখানে অনেকে আছে বলে দশ হাত ফাঁকে ফাঁকে হাঁটতে হবে?
বিরক্ত হয়ে বলে ইফাদ।
তুলতুল কিছু না বলে হাঁটছে শুরু করে। ইফাদ আড় চোখে একবার তাকায় তুলতুলের দিকে। ভাগ্যিস মেয়েটার রুপেয়া ফেসে গেছে ইফাদ। নাহলে একে কিছুতেই বিয়ে করতো না। আনরোমান্টিক বোরিং একটা মেয়ে।
তবে ব্যাপার না বিয়ের পর রোমান্টিক বানিয়ে দেবো। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াজ বেবি।
বাঁকা হাসে ইফাদ।
তুলতুলের বুকটা কাঁপছে। সায়ান কি কষ্ট পাচ্ছে? রেগে গেছে? এখন কি নিজের হ্মতি করবে?
চোখ দুটো ভিজে ওঠে তুলতুলের। অদ্ভুত এক বাঁধনে জড়িয়ে গেছে।
মনটাকে শক্ত করে নেয় তুলতুল। একদম নরম হওয়া যাবে না। তিনটে বছর যাবত ইফাদের সাথে তুলতুলের বিয়েটা ঠিক হয়ে আছে। পুরো জেলায় রটে গেছে কথাটা। এখন অন্য চিন্তা মাথায় আনা যাবে না একদম না।
তুলতুল ভুলভাল কিছু করলে বাবা ভীষণ কষ্ট পাবে। বাবা তো হার্টের রুগী। যদি কিছু হয়ে যায়। একদম মেনে নিতে পারবে না তুলতুল।
কালকেই চলে যাবে সায়ানের বাড়ি থেকে।
“যখন মায়া বাড়িয়ে লাভ হয় না,
তখন মায়া কাটাতে শিখতে হয়”
তুলতুল মায়ায় পড়ার আগেই মায়া কাটিয়ে ফেলবে।
“ওই জান
কখন থেকে ডাকছি
ইফাদ তুলতুলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে। তুলতুল চমকে ওঠে। সায়ানের চিন্তায় এতই মগ্ন ছিলো যে ইফাদের ডাক শুনতে পায় নি।
তুলতুল ইফাদের দিকে তাকায়।ইফাদ ভ্রু কুচকে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে ছিলো বিধায় চোখাচোখি হয়ে যায়। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয় তুলতুল। বুকটা ধক করে ওঠে।
” সরি আমি শুনতে পায় নি।
তুলতুল রিনরিনিয়ে বলে।
“ইটস ওকে
চলো আংটি চুজ করতে হবে তো।
” হুমম চলুন
সাহেদা বেগম কল করে তৌফিক রহমানকে।
“ভাই একটা কথা বলতে চাইছিলাম।
“জানিস আজকে আমি খুব খুশি। এখনি ইফাদ ছবি পাঠিয়েছিলো। দেখলাম কতো হাসিখুশি দুজন। একসাথে ছবি তুলেছে। এতোদিন চিন্তায় চিন্তায় থাকতাম তুলতুল মা বোধহয় ইফাদকে নামবে না।
না মানতে পারলে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতো। ইফাদ খুব ভালো ছেলে। এরকম ছেলে লাখে একটা। আমার মেয়েটা বড্ড ভাগ্যবতী। তাই তো এতো ভালো বর পেয়েছে।
শোন বোন কাল ঢাকায় যাবো আমি। বুকের ব্যাথাটা খুব বেড়েছে। চেকআপ করাবো। তোদের বাড়িতে যাবো। কিন্তু থাকবো না। তুলতুলকে নিয়েই ফিরবো।
এক মাসেই এংগ্রেসমেন্ট করার কথা বলছে ইফাদের বাবা। আমিও না করি নি। তিন বছর তো হলো। এবার চার হাত এক করে দেবো।
খুশি খুশি গলায় বলেন তৌফিক রহমান। সাহেদা বেগমের চোখ দুটো ভিজে ওঠে। কি করে শান্তনা দেবেন এখন সায়ানকে? কি বলবে? সায়ান কিভাবে রিয়েক্ট করবে? ছেলেটা ছোট থেকেই ভীষণ জেদি।
” বোন শুনছিস?
তৌফিক রহমান বলে।
“হুমমম
” দাওয়াত এখনই দেবো না বাড়িতে গিয়েই দেবো।
“আচ্ছা
সাহেদা বেগম ফোন রেখে দেয়।
” বউ মা কি হলো? মমতা বেগম বলে।
সাহেদা বেগম শাশুড়ীকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে।
“মা আপনি একটু আমার আব্বাকে সামলে রাইখেন। দোষটা বোধহয় আমারই। ছোট থেকে যা চেয়েছে তাই দিয়েছি। কখনো না পাওয়ার যন্ত্রণা বুঝতে দেয় নি। এখন কি করল সামলাবো ছেলেকে আমি?
মমতা বেগম চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়।
ইফাদের সাথে ঘুরে ঘুরে অনেক কিছু কিনেছে তুলতুল। ইফাদ কিনে দিয়েছে পছন্দ করে। তুলতুল হ্যাঁ না কিছুই বলে নি। শুধু রোবটের মতো ইফাদের পেছন পেছন ঘুরেছে।
বেশ কয়েকটা সেলফি তুলেছে ইফাদ। তুলতুল না করতে গিয়েও পারে নি। কারণ ছেলেটা সেলফি তুলেছে বাবাকে পাঠানোর জন্য। এতে যে বাবা কতোটা খুশি হয়েছে এটা তুলতুলের থেকে ভালো আর কে জানে।
” তুলতুল ভীষণ খিধে পেয়েছে আমার। চলো কিছু খাবো।
তুলতুল এখনো কিছুই বলে না। শপিং মলেই একটা নামি-দামি রেস্টুরেন্টে আছে সেখানেই যায় ওরা।
রেস্টুরেন্টে আজকে একদল সিঙ্গার এসেছে। সেলিব্রিটি সিঙ্গার নয়। সদ্য গান গাওয়া শুরু করে বা সদ্য নাম হচ্ছে এমন সিঙ্গার।
তুলতুল আর ইফাদ এক কোনে গিয়ে বসে।
ইফাদ খাবার অর্ডার দেয়।
সায়ান অন্য পাশে বসেছিলো। আশিক রায়হান রাফি জোনাকি ইভা আর সায়ান। ওরা সবাই সায়ানের ফ্রেন্ড।
রাফি সায়ানের হাতে গিটার দেয়।
“দোস্ত একটা গান ধরে। জমে যাবে ব্যাপারটা। ওই সদ্য বেরে ওঠা সিঙ্গাররা তোর গান শুনে টাসকি খেয়ে যাবে।
বলে জোনাকি। সবাই সায় দেয় জোনাকির সাথে। কলেজ লাইফ ভার্সিটি লাইফে গান গেছে অনেক পুরুষ্কার পেয়েছে সায়ান।
সায়ান কিছু না বলে গিটারটা হাতে নেয়। তুলতুলের দিকে এক পলক তাকায়। মনটা বিষিয়ে ওঠে।
“বল কার কাছে আজ করবো নালিশ?
বাঁচবো কার সাথে?
মন ভাঙা এই গল্প বলে কাঁদবো কার সাথে
তোর স্বভাব গুলোই তোকে আজও ভুলতে দিলো না
মনটাকে আর মনের মানুষ খুঁজতে দিলো না
“
“
আমার যত্নে পোশা আপন মানুষ হইলো রে নিখোঁজ
তোর কারনেই মরছি আমি দেখলি না ফিরে
এতো ভালোবাসা আবার কোথায় পাবি রে?
জানলে আগে এই প্রিরিতি এতোরে কাঁদায়।
যেজন যারে ভালোবাসে সে তারে হারায়
(নিজ দায়িত্ব শুনে নিবেন)
তুলতুল সায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। কি সুন্দর গাইছে লোকটা। চোখ দুটো বন্ধ করে আছে তাইতো এভাবে দেখতে পারছে। নাহলে তো জড়তাই কাটতো না।
চোখের কোনে আপনাআপনি পানি চলে আসে তুলতুলের।
গান শেষ সবাই করতালি দেয়।
ইফাদ নিজেও হাত তালি দেয়। হাত ইতালির শব্দ হুমম ফেরে তুলতুলের। চোখ ফিরিয়ে নেয়। সবার অগোচরে চোখের পানি মুছে নেয়।
“কি ভালো গান গায় তোমার কাজিন। ইন ফিউচার অনপক বড় হবে।
ইফাদ খাবার মুখে পুরে বলে।
” আমি বাড়ি যাবো
“ওকে যাও
আমি আজ থাকবো এখানে। ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দেবো। তোমার কাজিনের সাথে একটা ফোন কিনে দিও।
পৌঁছে ফোন দিও
সাবধানে যেয়ো। আমি খাবার প্যাক করে দিতে বলেছি। নিয়ে যেয়ো।
” আচ্ছা
বলে তুলতুল আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না। উঠে হনহনিয়ে চলে যায়।
ইফাদ বাঁকা হাসে।
“আমার আদরের বউ
পাশাপাশি বসে আছে সায়ান আর তুলতুল। কিছুখন আগেই ফোন কিনে একটা পার্কে এসে বসেছে দুজন।
সায়ান তুলতুলের সামনে হাঁটু মুরে বসে।৷ তুলতুলের হাত দুটো মুঠোয় পুরে নেয়। চমকায় তুলতুল। কিছু বলে না। হাত দুটো ছাড়াতেও চায় না।
” তোকে ভীষণ ভালোবাসি রে তুলা। ভীষণ ভালোবাসি। তোকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আছে। আমি নিজেকে কল্পনা করতেও পারি না। আমি থাকতে পারবো না তোকে ছাড়া।
প্লিজ তুই আমাকে ছেড়ে যাস না। দয়া কর একটু। কখনো তোকে বকবো না। মারবো না। তুই যা বলবি তাই করবো। তোকে আমি ছাড়তে পারবো না রে।
সায়ানের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়াচ্ছে। ছেলেরা না কি কাঁদে না। তাদের না কি কাঁদতে বারণ। কিন্তু সায়ান তো দিব্যি কাঁদছে।
তুলতুলের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। মনের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে শক্ত করে তুলতুল।
সায়ানের হাতের ভাজ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়।
“সরি ভাইয়া। আমি অন্য কারো বাগদত্তা। আপনাকে এক্সেপ্ট করবো কি? আমাকে হ্মমা করবেন।
স্পষ্ট গলায় বলে তুলতুল।
” এমনটা বলিস না তুলতুল। আমি মরে যাবো রে। এমন করিস না।চল না দুরে কোথাও চলে যাই। অনেক দুরে। এক সাথে বাঁচবো দুজন।
তুলতুল সায়ানের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। স্তব্ধ হয়ে যায় সায়ান। চোখে মুখে আগুন জ্বলছে তুলতুলের।
উঠে দাঁড়ায় তুলতুল। সায়ানের থেকে বেশ খানিকটা দুরে গিয়ে দাঁড়ায়।
“কিসের ভালোবাসা? আপনার যোগ্যতা আছে আমাকে ভালোবাসার। দেখলেন তো আমার হবু বর কে। আপনার থেকে সব দিক থেকে ভালো। তে আমি কেনো তাকে ছেড়ে আপনার কাছে আসবো? ফাজলামি পেয়েছেন? আপনি মানুষ? আপনি তো মানুষকে রেসপেক্টই করতে পারেন না। শুধু পারেন জোর করতে।
একদম জোড় করবেন না আমার সাথে। এতোদিন চুপ ছিলাম বলে অবলা ভাববেন না। আপনাকে আমার জাস্ট সয্য হয় না। চোখের সামনে থাকলে বোরিং লাগে।
নেক্সট টাইম আমার সামনে আসবেন না আপনি। আমার বাবার পছন্দই বেস্ট। ভালোবাসি আমি ইফাদকে। ওকেই বিয়ে করবো আমি। ক্লিয়ার?
আর কখনো কুকুরের মতে আমার পেছনে লেগে থাকবেন না। মিনিমাম একটুকু লজ্জা থাকলে আমার সামনে আর আসবেন না। ঘৃণা হয় আমাকে দেখলে আমার। পৃথিবীর সব থেকে বেশি যদি আমি কাউকে ঘৃণা করে থাকি তাহলে সেটা আপনি।
চিল্লিয়ে কথা গুলো বলে চলে যায় তুলতুল। সায়ান স্তব্ধ হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
তুলতুলের বলা কথা গুলো কানে বাজছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চোখে অন্ধকার দেখছে।ধাপ করে বসে পড়ে তুলতুল।
“টাকা চিনে গেছিস তুলতুল।
সালার আমিই বোকা। জোড় করে ভালোবাসা আদায় করতে চেয়েছিলাম। অধিকার দেখিয়ে মনে জায়গা করে নিতে চেয়েছিলাম।
আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো
” জোর করে পাগলামি করে শুধু পাগল উপাধি পাওয়া যায়
কারো ভালোবাসা না,,
সায়ান ওখানেই বসে থাকে।
তুলতুল একাই বাড়ি চলে যায়। কারো সাথে কোনো কথা বলে না। বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
এভাবে না বললে সায়ান কখনোই তুকতুলের পেছন ছাড়তে না এটা জানে তুলতুল।
চলবে
…