#আমার তুমি
পর্ব ১৪
#তানিশা সুলতানা
গাজিপুর বড় শপিং মলের কাছে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ইফাদ করে তৌফিক রহমান শপিং মলে গেছেন। বাড়ির সবার জন্য কিছু কিনতে। তুলতুলকে অনেক জোর করলেও ও যেতে নারাজ। তাই ওনারা বাধ্য হয়েই তুলতুলকে রেখেই চলে গেছে।
তুলতুল জানালা দিয়ে ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনের মধ্যে কু গাইছে। শপিং মলের সামনের বড় কড়ই গাছে একটা কাক বসে কা কা করছে।
কাকের ডাকটা কলিজায় গিয়ে বিঁধছে তুলতুলের। এ যেনো এক অশুভ সংকেত। যদিও তুলতুল এসবে বিশ্বাসই না। তবুও কেনো জানি আজকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে কাটা তুলতুলকেই উদ্দেশ্য করে কিছু বলছে। কিন্তু তুলতুল সেটা বুঝতে পারছে না।
আচ্ছা সায়ান ঠিক আছে তো?
বুকের পা পাশে হাত দেয় তুলতুল। ওই মানুষটার যেনো কিছু না হয়। পৃথিবীর সব সুখ ওই মানুষ টার হোক।
ওই বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরে আর কাঁদে নি তুলতুল। মনকে বুঝিয়েছে। আশা ছাড়ে। অগাধ বিশ্বাস আবার সবটা ঠিক হয়ে যাবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
“যে তোমার নয় তাকে শত শক্তি দিয়েও
ধরতে রাখতে পারবে না…..
তাই আমিও দুরে চলে গেলাম।
হোক না সেটা অনিচ্ছায়,
তবে ভেবো না আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি
আমি বিশ্বাস করি,
একদিন আবার সবটা ঠিক হয়ে যাবে।
আমি তোমার #আমার তুমি হয়ে থেকো যাবো
ইনশাআল্লাহ
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তুলতুল।
ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয় সবটা। আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর নাইলে কারো শক্তি নেই সবটা ঠিক করার।
দুই ছেলে আর মা কে আইসিসিউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিন জন মানুষেরই জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। কোনো বাবা মায়ের পহ্মেই এটা মেনে নেওয়া সম্ভব না। কিন্তু সাহেদা বেগম শক্ত হয়ে বসে আছে। কাঁদছেন না উনি। যেনো পাথর হয়ে গেছে।
খুব ইচ্ছে কাউকে দোষী বলার। কাউকে ইচ্ছে মতো কথা শুনিয়ে নিজেকে একটু শান্তনা দেওয়ার।
কিন্তু কাকে দোষ দেবে?
তুলতুলকে না কি নিজের ভাগ্যকে?
ভাগ্যে এমনটা ছিলো বলেই এমনটা হয়েছে। তুলতুল তো শুধুমাত্র একটা নমুনা।
তবে এমনটা না হলেও পারতো।
এক্সিডেন্ট করার পরেই ট্রাকটা পালিয়ে যায়। রাস্তায় থাকা মানুষরা শানকে দেখতে পায়।
রাস্তায় কর্মরত মানুষরা শানকে ধরে হাসপাতালে এনেছে। সায়ানের ফোনের কল লিস্ট থেকে নাম্বার খুঁজে সুমুকে কল করে। ভাগ্য ক্রমে শানকে ওই হাসপাতালেই আনা হয় যেখানে সায়ান আর মমতা বেগম ছিলো।
সুমু বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। যখন শুনেছে শান এক্সিডেন্টে করেছে তখন থেকে আরও ভেঙে পড়েছে। কলিজার টুকরো দুই ভাইকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে নিজেকে সামলাতে পারছে না।
“ওই মেয়েটা কোনোদিনও ভালো থাকবে না।
সোহেল মিয়ার কথা শুনে কেঁপে ওঠে সাহেদা বেগম। এতখন পাথরের মতো বসে থাকা মানুষটা ডুকরে কেঁদে ওঠে।
” এটা তুমি কি বলছো? এভাবে বলো না।
সোহেল মিয়ার মুখ চেপে ধরে বলে সাহেদা বেগম।
উওর দেয় না সোহেল মিয়া। হাসপাতালের করিডোরে হাঁটু মুরে বসে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে।
কালকেও তো সবটা ঠিক ছিলো আজকে কেনো সব তছনছ হয়ে গেলো? এটা কি হয়ে গেলো? কেনো হলো এমনটা?
একটু পরে পরপর তিনটে ইমারজেন্সি কেবিনের লাইট বন্ধ হয়ে যায়। দৌড়ে এগিয়ে যায় সোহেল মিয়া আর সাহেদা বেগম। বিষন্ন মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন ডাক্তার।
ডাক্তারকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না কারোরই।
শান মাথায় খুব গুরুতর আঘাত পেয়েছে। হাঁটা চলা করতে পারবে না অনেকদিন। কবে কথা বলতে পারবে এটাও ডাক্তার শিওর বলতে পারছে না।
সায়ান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে এখন ভালো আছে।
কিন্তু মমতা বেগম আর পৃথিবীতে নেই।
দুনিয়া থেমে যায় সাহেদা বেগমের আর সোহেল মিয়ার।কি করবে অসহায় দুজন বাবা মা বা অসহায় দুজন সন্তান। এই মুহুর্তে ওনাদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কেউ নেই। কাঁধে হাত রেখে বলার মতো কেউ নেই যে “ভেঙে পড়ো না সবটা ঠিক হয়ে যাবে”
সাহেদা বেগমের এই মুহুর্তে পরিবারকে খুব দরকার। দুই ভাই দুই ভাই ওনারা। এখনো মা বাবা বেঁচে আছে।
হাউমাউ করে কাঁদছে সুমু সোহেল মিয়া আর সাহেদা বেগম। সায়ানের এখনো ঙ্গান ফেরে নি।
ডাক্তার ঘুমের ঔষধ দিয়েছে ওকে। কাল সকালের আগে আর ঘুম ভাঙবে না।
কেউ চিরকাল পৃথিবীতে থাকবে না। জন্ম যখন নিয়েছি মৃত্যুর স্বাদ অবশ্যই ভোগ করতে হবে। তবুও আমরা প্রিয়জনের মৃত্যু সয্য করতে পারি না। দম বন্ধ হয়ে কান্না আসে। কিন্তু আমরা বুঝতেই চায় না কান্না করলে ওই মানুষটা আর ফিরবে না।
দুই ছেলেকে হাসপাতালে রেখে মায়ের লাশটা নিয়ে মানিকগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সাহেদা বেগম আর সোহেল মিয়া। সুমুকে রেখে যায় ভাইদের খেয়াল রাখার জন্য।
সুমুরা যেখানে ভাড়া থাকে সেই বাড়িওয়ালার মেয়ে নিশা আর ছেলে শোভন সুমুর সাথে থেকে যায়। ওনারা যখন জানতে পেরেছে শান আর সায়ানের তখনই ছুটে চলে এসেছে।
শেষ পর্যন্ত পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকে দেখে সুমুর কান্নার গতি বেরে যায়।
আজকে কোথায় গেলো আশিক? কেনো আসলো না ও? ও কি জানে না? কিন্তু সুমু তো ওকে কল করেছিলো রিসিভ করে নি। অনেক গুলো টেক্সট করেছে। রিপ্লাই পায় নি।
বিপদ দেখে পালিয়ে গেলো?
আশিকের প্রতি মনের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি হয় সুমুর।
মমতা বেগমের বরাবরের ইচ্ছে ছিলো স্বামীর পাশে নিজের কবরটা হবে। মায়ের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়েই নিজেদের বাড়ির দিকে ছোঁটে ওনারা। অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়েছিলেন তিনি।
সায়ানের জন্মের পর সায়ানকে বুকে আগলে রেখেছেন। স্বামী হারানোর ব্যাথাটা সায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে ভুলে গেছিলেন।
মমতা বেগমের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটা কানাডা থাকে। একদিনের মধ্যে সে আসতে পারবে না। শেষ বার মায়ের সামনে থেকে দেখতে পারে না তিনি। শুধু দুর থেকে ভিডিও কলেই দেখেছে।
তুলতুল গ্রামে গিয়ে একদম শান্ত হয়ে গেছে। যদিও তুলতুল আগেও শান্ত ছিলো। সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথা বলে না। ইফাদ ডিরেক্টলি না করে দিয়েছে পড়ালেখার ব্যাপারটা। বলে দিয়েছে আর পড়তে হবে না তুলতুলকে।
মা প্রাইমারি স্কুলের টিচার। বাবা হাই স্কুলের টিচার। শিক্ষি বাবা মায়ের সন্তান হওয়ার পরও বাবা মা শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারলো
দাদির কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিলো তুলতুল। দাদি তুলতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
“তুই খুব ভাগ্যবতি রে ছেমড়ি। এতো ভালো বর পাচ্ছিস।
তুলতুল তাচ্ছিল্য হাসে।
” যদি আমি ভাগ্যবতী হয় তাহলে বলবো
এমন লাইফ যেনো কারোর না হয়…
বলেই তুলতুল এক দৌড়ে চলে যায়।
আয়শা বেগম তুলতুলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
পনেরো দিন চলে গেছে। শান এখন কথা বলতে পারে। কিন্তু বেশিখন বসে থাকতে পারে না। হাঁটতে পারে না। সায়ান পুরোপুরি সুস্থ।
একদম পাল্টে গেছে সায়ান। গম্ভীর, প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথা বলে না।
কথায় কথায় হাসে না। যেনো হাসতেই ভুলে গেছে সায়ান।
দাদিমার মৃত্যুটা আরও বেশি দাগ কেটে গেছে সায়ানের মনে।
শানকে এখনো জানানো হয় নি দাদিমার মৃত্যুর খবরটা।
শান আর সুমুর পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছে। সুমুর চোখের নিচে কালি জমে গেছে। পনেরো দিনে অনেকটা শুকিয়ে গেছে।সায়ান দুই ভাই বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।
যখনই শান একটু খানি বসে ঢলে পড়ে যায় সুমু কেঁদে ওঠে। শান মুখে খাবার নিয়ে যখন গিলতে পারে না সুমু হাউমাউ করে কাঁদে। দাদিমার কথা মনে পড়লেও কেঁদে ওঠে। ঘুমের ঘোরেও সায়ান ভাইয়া বলে চেঁচিয়ে ওঠে।
সোহেল মিয়া অফিসে গেছেন। সাহেদা বেগম রান্না করছে।
সায়ান ঘুমন্ত দুই ভাই বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
“আমার বোনকে মানসিক রোগী বানিয়েছিস তুই। আমার ভাইকে মৃত্যু যন্ত্রণা উপভোগ করিয়েছিস। আমার দাদিমাকে মেরে ফেলেছিস।
আমাদের জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছিস। এখন তোকে আমি ভালো থাকতে দেবো?
মরণ হয়ে আসবো তোর শহরে। আমাকে যতটা কষ্ট দিয়েছিস তার থেকেও তিনগুণ বেশি কষ্ট দেবো তোকে।
প্রতিটা সেকেন্ডে তোকে মৃত্যু যন্ত্রণা উপভোগ করাবো আমি।
এতোদিন আমার ভালোবাসা দেখেছিস। এখন ঘৃণাটাও দেখবি।
বিয়ে করাচ্ছি তোকে। এমন বিয়ে করাবো না সারা দুনিয়া মনে রাখবে বেইমান + হিরো ইফাদের বিয়ের কথা।
হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে সায়ান।
চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে রক্ত জমেছে। কপালের রগ টানটান হয়ে ফুলে উঠেছে। নাকটা ফুলিয়েছে।
সেবা মিলিয়ে ভীষণ ভয়ংকর লাগছে সায়ানকে।
চলবে
.