#আমার তুমি
পর্ব ১৯
#তানিশা সুলতানা
তুলতুল আর সুমু পাশাপাশি হাঁটছে। উদ্দেশ্য শপিং মলে যাবে। সায়ান বিছানার ওপর টাকা রেখে চলে গেছে।
ফুপি জোর করে সুমুর সাথে পাঠিয়েছে তুলতুলকে। শপিং কাছেই। তাই দুজন হেঁটেই যাচ্ছে।
তুলতুল নীল থ্রি পিছ পড়েছে। মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়েছে।
“খুব রেগে আমার ওপর?
নিরবতা ভেঙে তুলতুল প্রশ্ন করে সুমুকে। তুলতুল এই বাড়ি আসার পর থেকে এক আবারও সুমু কথা বলে নি তুলতুলের সাথে।
সুমু উওর দেয় না। নিজের মতো হাঁটছে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তুলতুল।
” আমার জায়গায় তুমি থাকলে কি করতে? বাবার সাথে পরিবারের কাছে যেতে না কি পনেরো দিনের পরিচিত একটা ছেলের হাতে হাত রেখে থেকে যেতে?
অবশ্যই তুমি পরিবার বেছে নিতে। আমিও তাই করেছিলাম। তাহলে আমার ভুলটা কোথায়?
তুমি হাসি মুখে বাবার সাথে যেতে আর আমি এক বুক কষ্ট নিয়ে গেছিলাম।
তবে হ্যাঁ আমার মনে দোটানা ছিলো। ইচ্ছে ছিলো না যাওয়ার। কিন্তু তোমার ভাইকে বিশ্বাস করতে পারি নি। যে ছেলে কথায় কথায় আমাকে টর্চার করতো। কি গ্যারান্টি ছিলো যে আমি তার কাছে ভালো থাকতাম?
আমায় পায়ের কাটার দাগ হাতের পোরা দাগ গুলো দেখেছো তো? সবই তোমার ভাইয়ের দেওয়া ছিলো।
তোমার দাদিমার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী। আদো কি তাই?
জন্ম মৃত্যু সব আল্লাহর হাতে। তবুও মানছি আমার ভুল ছিলো।
খুব বড় ভুল হয়েছে আমার। এখন তুমি আমাকে বলতে পারবে তখন আমার কি করা উচিৎ ছিলো?
তোমার কি মনে হয়? আমি যদি সেদিন না যেতাম বাবা ছেড়ে দিতো তোমাদের?
ইফাদের সাথে মিলে পুলিশ কেচ করতো। অলরেডি শান ভাইয়ার গায়ে হাত তোলার জন্য তেড়ে গেছিলো।
তিন বছরের সম্পর্ক ইফাদের সাথে। তিনটা বছর যাবত জেনে এসেছি ইফাদের সাথে আমার বিয়ে হবে। মেনেও এসেছি। কে জানতো ইফাদ এরকম?
তোমার ভাইয়ার জন্য আমার মনের কোনে একটুখানি ফিলিং জড়ো হতে চেয়েছিলো আমি সেটাকেও দমিয়ে রেখেছিলাম। কেনোনা তখন আমি অন্য কারো আমানত ছিলাম।
একটু থামে তুলতুল। সুমু মন দিয়ে শুনছে তুলতুলের কথা।
“তোমার থেকে আমি একটু ছোটই হবো। দেখো তোমার ফ্যামেলি এখনো তোমার বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবে নি। আর আমি আরও তিন বছর আগে থেকে বিয়ে বিয়ে শুনে বড় হয়েছি।
জীবনটা খুব ছোট কিন্তু খুব জটিল। আমি জটিল জীবনটাকে উপলব্ধি করেছি। তুমি করো নি। তোমার ভাইয়া করে নি।
সব সময় নিজের দিকটা ভাবা উচিৎ নয়। অন্যদেরকে নিয়েও ভাবতে হয়।
আমিও মানুষ সুমু। রাগ অভিমান, ভালো লাগা খারাপ লাগা অপমান সবটা ফিল করতে পারি আমি।
এই যে তোমারা আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকো। তোমার ভাইয়া কথায় কথায় বেরিয়ে বেরিয়ে যাও বলে। খুব খারাপ লাগে আমার। কষ্ট হয়। কাঁদতে ইচ্ছে করে। চলে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কোথায় যাবো?
বাবা মায়ের ঘাড়ের বোঝা হয়ে গেছিলাম বলে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে।
এখন তোমরা আমাকে অপমান করলেও আমাকে এখানেই থাকতে হবে। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
একটা সম্পর্ক গড়া সহজ নয়। আল্লাহ যখন তোমার ভাইয়ের সাথে আমাকে জুড়ে দিয়েছে তখন আমি প্রাণপণ চেষ্টা করবো তার ভালোবাসা পাওয়ার। সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
আমি গড়াতে বিশ্বাসী ভাঙাতে নয়।
তবে বেশি দিন না। কিছু দিন চেষ্টা করবো। তারপর যদি বিফল হয়। ঠিক চলে যাবো। ফিরবো না।
কথা দিলাম
শপিং মলের কাছে চলে এসেছে ওরা। তুলতুল চোখের পানি মুছে শপিং মলে ঢুকে যায়। সুমুর চোখের কোনও পানি জমে গেছে।
” সত্যিই তো এরকম ভাবে কখনো ভাবি নি। আশিক সামান্য আমার ভাইয়া দের অসুস্থতার সময় পাশে ছিলো না বলে ওর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে দিয়েছি। তাহলে তুলতুল কি ভুল করেছে? তুলতুলও ওর পরিবারকে ভালো বাসে।
সুমু ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে চোখের কোনে জমে থাকা পানি মুছে নেয়।একটু মুচকি হেসে তুলতুলের কাছে যায়।
“চল ওই দিকটায়। ওখানে মেকাপ সুন্দরীর ড্রেসের মতো ড্রেস পাওয়া যায়।
সুমু চোখ টিপে বলে।
তুলতুল একটু চমকে ওঠে। পরে নিজেকে স্বাভাবিক করে।
” এই আমি একটা কিনবো।
আগ্রহ দেখিয়ে বলে তুলতুল।
“অবিএসলি তোকে তো কিনতেই হবে। নাহলে ভাইয়ার মর্ডান গার্লফ্রেন্ডকে টেক্কা মারবি কি করে?
দুজন ঘুরে ঘুরে অনেক কেনাকাটা করে। পুরোটা সময় তুলতুলের মনে হয় কেউ ওকে ফলো করছে। আশেপাশে তাকিয়ে সন্দেহ জনক কাউকে পায় না। মনের ভুল ভেবে পাত্তা দেয় না তুলতুল।
সাহেদা বেগম তখন থেকে মুখ বাঁকিয়ে পায়চারি করছে। মাঝে মাঝে আবার আয়নায় নিজেকে দেখছে। আজকে অফিস লান্সের পরেই ছুটি হয়ে গেছে সোহেল মিয়ার। তিনি বিছানায় বসে বই পড়ছিলেন আর আড় চোখে সাহেদা বেগমকে দেখছেন।
” এই বার বুঝতে পারলে তুলতুলকে কেনো বউ করে এনেছি?
সাহেদা বেগম সোহেল মিয়ার গা ঘেসে বসে বলে।
সোহেল মিয়া চশমা ঠিক করে, বইটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসে।
“বুঝতে পারলাম না তো?
সাহেদা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে।
” ওই যে হাঁটু দেখানো মেয়েটাকে দেখলে না। ওই মেয়েটা কালো জাদু করেছে আমার আব্বাকে। সুযোগ বুঝে গলায় ঝুলে পড়তো। তাই তো সেই দিন ওইভাবে বিয়েটা দিলাম। নাহলে সেদিন পাকা কথা বলে আসতাম। তারপর ধুমধাম করে বিয়ে দিতাম।
“হুমম বুঝলাম।
” কি বুঝলে? তুলতুল মেয়েটা যা গাধা। ও কি পারবে? ওই হাঁটু ওয়ালা মেয়েটাকে বিদেয় করতে?
চিন্তার ছাপ সাহেদা বেগমের চোখে মুখে।
সোহেল মিয়া একটু হাসে।
“এতো চিন্তা করছো কেনো? তুলতুল তো গাঁধা কিন্তু তুমি তো খুব চালাক। তুমি নাহয় শিখিয়ে পড়িয়ে দিও।
” কি যে বলো না?
শাশুড়ী হয়ে ছেলের বউকে শেখাবো কি করে ছেলের সাথে ভাব জমাবে?
“হ্যাঁ শেখাবে।
” খারাপ বলো নি। ভাবছি বলবো তারাতাড়ি একটা পুচকু আনতে। সারাদিন একা একা ভালো লাগে না। একটা পুচকু আসলে সঙ্গী পাবো।
“ঠিকই বলেছো। আমার রিটার্নের পরে আমিও তো বেকার থাকবো তখন আমিও তোমাদের সাথে যোগ দিতে পারবো।
রাত দশটা বাজে এখনো সায়ানের আসার নাম নেই। সবাই নিশ্চিত সায়ান ওই পাখির সাথেই আছে। তুলতুল খাবার গুলো টেবিলে গুছাচ্ছে। সুমু তুলতুলের নতুন কেনা জামাকাপড় গুলো পড়ে পড়ে দেখছে। সাহেদা বেগম তুলতুলকে সাহায্য করছে। শান বাসায় নেই। এক বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে গেছে।
” মা খাবো আমি। তোমার ছেলের জন্য আর অপেক্ষা করতে পারবো না।
সুমু ঠাস করে চেয়ারে বসে পড়ে। বেচারার সন্ধায় খিদে পেয়েছিলো এখনো খাবার পেলো না।
“হুমম আমিও খাবো। তোর বাবাকে ডাক। তুলতুল তুই সায়ান আসলে খেয়ো নিস।
শাশুড়ীর কথা শুনে তুলতুল বড়বড় চোখ করে তাকায়। ওনার যে ভাব ওয়ালা ছেলে সে না কি তুলতুলের সাথে খাবে। আজকে আর তুলতুলের খাওয়া হলো না।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তুলতুল।
সবাই খেয়ে যে যার রুমে চলে গেছে। সবাই যেতেই তুলতুল খাওয়া শুরু করে দেয়। ওই লোকটার জন্য না খেয়ে বসে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। বজ্জাত লোক একটা।।
পাখির সাথে খেয়ে আসবে সে।
খাওয়া শেষ করে তুলতুল রুমে যায়। কালকে তো ঘুমনোই হয় নি। বেলকনির ফ্লোরে কি ঘুমানো যায়। আজকে কি করবে? আর যাই হোক বেলকনিতে থাকা যাবে না। তাহলে?
খাটের এক পাশে শুয়ে পড়বে? সায়ান এসে যদি একটা লাথি দিয়ে খাট থেকে ফেলে দেয়?
দিলে দেবে তবুও তুলতুল খাটেই ঘুমবে। এই খাটে সায়ানের যতটা অধিকার আছে তুলতুলেরও ঠিক ততটাই অধিকার আছে।
এক বুক সাহস নিয়ে তুলতুল খাটের দিকে এগিয়ে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত একটা বেজে গেছে। এত রাত ওবদি কি করছে ওই মেয়েটার সাথে? ফালতু ছেলে। আগে তো বলতো তুলতুল আমি তোকে ছাড়া বাঁচবো না এখন বলছে পাখি আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবে না। কিছু দিন পর আবার নতুন কাউকে জুটিয়ে তাকেও একই কথা বলবে। ক্যারেকটার লেস একটা।
সায়ানকে বকতে বকতে তুলতুল একপাশে শুয়ে পড়ে। মার্ডার হয়ে গেলেও আজকে খাট থেকে নরবে না।
বেলকনির দরজাটা খোলা রেখে তুলতুল। মধ্য রাতের হাওয়াটা দারুণ লাগে তুলতুলের। আহহা শরীর ছুঁয়ে একদম মনের ভেতর ঢুকে যায়।
তুলতুল চোখ বন্ধ করে হাওয়া অনুভব করছে।
হঠাৎ বেলকনির দরজায় কেউ ঢিল ছুঁড়ে মারে। হকচকিয়ে যায় তুলতুল। এক লাফে উঠে বসে। বুকটা দুরুদুরু করছে। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
একদম দরজার সামনে গিফটের পেপারে মোড়ানো একটা বক্স দেখতে পায় তুলতুল।
বুকে থু থু দিয়ে আস্তে আস্তে খাট থেকে নামে। টিপে টিপে পা ফেলে দরজা ওবদি যায়।
বক্সটা হাতে নেবে তখনই দেখতে পায় কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হেলমেট। পাশের বাসায় গেইটের কাছে লাইট জ্বালানো। সেই লাইটের আলোতে ওই মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে। কে এই লোকটা?
তুলতুল তাকাতেই ফ্লাইন কিছ ছুড়ে দেয়।
তুলতুল বড়বড় চোখ করে তাকায়।
লোকটা হাত নারিয়ে বিদায় জানানোর পরই ওই লাইটটা বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তাটা অন্ধকারে ঢেকে যায়।
ভয় পেয়ে যায় তুলতুল। বক্সটা হাতে নিয়েই তারাহুরো করে দরজা বন্ধ করে দেয়।
দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে তুলতুল। এসব কি হচ্ছে? কে ওই লোকটা?
টেবিলের ওপর থেকে পানি নিয়ে ঢক ঢক করে এক বোতল পানি খেয়ে ফেলে। তারপর ওড়না দিয়ে ঘাম মুছে জোরে শ্বাস নেয়।
গিফটের বক্সটা খুলে।
বক্সটা খুলতেই তুলতুলের চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায়। দুই ঠোঁটের মাঝখানে কিঞ্চিত ফাঁকা হয়ে যায়।
একটা সুন্দর পায়েল সাথে ছোট একটা ছুড়ি।
আর কিছুই নেই।
কে হতে পারে লোকটা? এরকম গঠনের লোক তো তুলতুল আগে কখনো দেখে নি।
আর ছুঁড়িটাই কেনো দিলো?
কি রহস্য?
বড় কোনো ঝড় আসছে কি?
ভয়ে তুলতুলের মুখটা চুপসে যায়।
আজকে সাধারণত সায়ানের পাঁচটার দিকে ছুটি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু পাঁচ লাখ টাকার হিসাব মেলাতে না পেরে ছুটি হয় না। হিসেব মেলাতে মেলাতে নয়টা বেজে যায়। সেখান থেকে বের হওয়ার পর জানতে পারে সায়ানের কলিগ আবির অসুস্থ। তার o+ রক্ত লাগবে। সায়ানের o পজেটিভ রক্ত হওয়াতে সেখানে যায় তাকে রক্ত দিতে।
রক্ত দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দুইটা বেজে যায়।
প্রচন্ড ক্লান্ত সায়ান। দুপুরে খাওয়া হয় নি। রাতেও খাওয়ার সময় পায় নি।
বাসায় ফিরে কোনো দিকে না তাকিয়ে ড্রেস চেঞ্জ না করেই বিছানায় শুয়ে পড়ে সায়ান। তার পাশে যে কেউ ঘুমচ্ছে এটা সে খেয়ালই করে নি। পাঁচ মিনিটেই ঘুমিয়ে পড়ে সায়ান।
চলবে……