আরশিযুগল প্রেম .
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব- ১৬
আলুথালু শরীরে কাঁথা পেঁচিয়ে এক হাতে কপাল চেপে বসে আছে শেফা। মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে তার। কাল রাতে ঘুম না হওয়ার জন্যই হয়তো এই মাথা ব্যাথার শুরু। শেফা ঘাড় ফিরিয়ে পাশে তাকালো। বালিশে মুখ গুঁজে উল্টো হয়ে শুয়ে আছে আরাফ। কাঁথার বেশির ভাগই পড়ে আছে তার পেটের নিচের দিকটাই। যার ফলে, বাকি শরীরটুকুই উদোম। শেফা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে আরাফের ওপর কাঁথাটা মেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হোটেলের ব্যালকণিতে লাগানো কাঁচের দরজা ভেদ করে অল্পবিস্তর আলো এসে পড়ছে মেঝেতে। ঘাড়ে পড়ে থাকা চুলগুলো ঝুঁটি করতে করতে ব্যালকণির দরজাটা ঠেলে দিতেই হালকা ঝিরিঝিরি পাহাড়ী বাতাসে উম্মাদ হয়ে উঠলো শেফার মন। সকালের সূর্যটা মাত্রই পাহাড়ের গা ঘেঁষে জেগে উঠছে। নিস্তব্ধ এই পাহাড়ী শহরটা যেন পাখির কিচিরমিচিরে হয়ে উঠেছে তারুণ্যে মত্ত। শেফা ব্যালকণির রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। ঠোঁটের কোণে বিস্ময়াবিষ্ট মিষ্টি হাসি ফুটলো তার। এই পঁচিশ বছরের জীবনে এতোটা সুন্দর সকাল তো কখনো দেখা হয় নি তার। ছবির মতো ঝকঝকে গাঢ় সবুজ পাহাড়। দূরের রক্তিম আকাশে ছোট ছোট পাখির উড়ে চলা। ঝিরিঝিরি বাতাস! হঠাৎ করেই অচিন্তনীয় এক ভাবনা খেলে গেলো শেফার মনে। শহরপ্রেমি শেফা মনেপ্রাণে চাইতে লাগলো, এই স্বচ্ছ কাঁচের সকালটা যেন এখানেই থেমে যায়। পাখিগুলো যেন এভাবেই উঁড়ে চলে নিরন্তর। আর সূর্যটাও যেন অভিমানী মুখ করে এভাবেই ঝুলে থাকে পাহাড়ের ওই কোল ঘেঁষে। ওয়াশরুমে পানি পড়ার শব্দে কপাল কুঁচকে রুমের দিকে তাকালো শেফা। ওয়াশরুমে কে? আরাফ কি ওঠে গেছে? শেফার ভাবনার মাঝেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে কাঁচের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো আরাফ। পরনে কালো রঙের থ্রি-কোয়াটার আর গলায় ঝুলানো সাদা তোয়ালে। শেফা খুব মনোযোগ দিয়ে আরাফের মুখের দিকে তাকালো। আরাফ তার আঁকাবাঁকা দাঁতের হাসি দিয়ে বললো,
—” কি দেখছো?”
শেফা উত্তর দিলো না। হয়তো আরাফের প্রশ্নটা তার ব্রেন পর্যন্ত পৌঁছালো না। কানের কাছেই ঘুরেফিরে হারিয়ে গেলো কোনো অচেনা গন্তব্যে। শেফা উত্তর না দেওয়ায় তার দিকে দু’পা এগিয়ে গিয়ে আবারও প্রশ্ন করলো আরাফ,
—” কি হলো? কি দেখছো এভাবে? ফ্রেশ হবে না?”
শেফা চোখ ফেরালো। দূরের ওই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,
—” শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। মাথা ব্যাথা করছে। শরীরটাও ব্যাথা করছে। ফ্রেশ হতে ইচ্ছে করছে না।”
আরাফ মজা করে বললো,
—” আমি হেল্প করি?ফ্রেশ হতে?”
শেফা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই হুহা করে হেসে উঠলো আরাফ। গলায় ঝুলানো তোয়ালেটা শেফার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে মুচকি হাসি নিয়ে বললো,
—” ওয়াশরুমে গরম পানির সার্ভিস আছে। একটা হট শাওয়ার নাও দেখবে ভালো লাগবে। সাদাফের কাছে সবসময় সব ধরনের মেডিসিন থাকে। নাস্তা করে একটা পেইনকিলার খেলে দেখবে ব্যাথাটাও অনেকটা কমে গিয়েছে।”
শেফা কিছু বললো না। এই মুহূর্তে একদমই ফ্রেশ হতে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। মাথা ব্যাথা, শরীর ব্যাথা সব মিলিয়ে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। বিছানায় শুয়ে একটা লম্বা ঘুম দিতে পারলে ব্যাপারটা মন্দ হতো না।
_____________________
রেস্টুরেন্টের এক কোণে একটা চারকোনা টেবিল ঘিরে বসেছে তারা চারজন। সবাই চুপচাপ রুটি চিবুচ্ছে। সকালটা সুন্দর হলেও কেমন একটা ভ্যাপ্সা গরম চারপাশে। শুভ্রতা রুটির টুকরো মুখে দিয়ে রেস্টুরেন্টের ছোট্ট জানালা ভেদ করে বাইরে তাকালো। চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
—” আজ বেশ গরম। মনে হয় বৃষ্টি হবে।”
আরাফ মুখের পানিটুকু গিলে নিয়ে বললো,
—” আকাশ তো একদমই পরিষ্কার। তবে, বৃষ্টি হলেও খুব একটা খারাপ হয় না। আমাদের সাদাফের কিন্তু বৃষ্টি খুব প্রিয়। বিশেষ করে মেঘলা আকাশ।”
শুভ্রতা আড়চোখে সাদাফকে দেখে নিয়ে আবারও খাবারে মনোযোগ দিলো। শেফা প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে ঠোঁট উল্টালো,
—” বৃষ্টি ভালো লাগে? আমার তো একদমই বিরক্ত লাগে। চারদিকে কেমন প্যাঁচপ্যাচ কাঁদা থাকে, ছি!”
সাদাফ মুচকি হাসলো। টিস্যুতে মুখ মুছে নিয়ে বললো,
—“আজকে যে গরম আমার মনে হয় আমাদের এখনই বের হয়ে যাওয়া উচিত। বেলা বাড়লে রোদের তাপটাও বেড়ে যাবে।”
শুভ্রতা উৎসাহ নিয়ে বললো,
—” আমরা প্রথমে কোথায় যাবো নীলাচল নাকি মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র?”
—“নীলাচলই আগে যাবো।”
শুভ্রতা আবারও কিছু বলতে নিলে সাদাফ তাকে থামিয়ে দিলো। শুভ্রতা কি প্রশ্ন করতে পারে সেটা বুঝতে পেরেই হয়তো বললো,
—” এখান থেকে নীলাচল পর্যন্ত চাঁদের গাড়ি করেই যাবো আমরা। ওটাই বেশি সুইটেবল হবে, শুভ্রতা।”
শুভ্রতা ছোট্ট করে বললো,
—“ওহ্।”
শেফার মাথা আর শরীর ব্যাথার উপসর্গটা বাড়ছে বৈ কমছে না। এই গরমে এখান থেকে নীলাচল যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও জাগছে না তার মনে। কিন্তু সবার এতো উৎসাহকে ভেস্তে দিতেও বিবেকে বাঁধছে তার। তাই একরকম জোর করেই নিজেকে রাজি করালো সে। প্ল্যান মোতাবেক একটা চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলো নীলাচলের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণ যাওয়ার পরই সূর্যটা যেন তেতে উঠলো। গরমে অস্থির হয়ে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে উঠলো সবাই। নীলাচলে গিয়ে টিকেট কাটার পর শুভ্রতার পাশে এসে দাঁড়ালো সাদাফ। তাদের থেকে একটু পেছনেই আরাফের ডান হাত জড়িয়ে ধরে ধীর পায়ে হাঁটছে শেফা। সাদাফ বাম হাতে ঘামে ভেজা চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলে দিতে দিতে বললো,
—” নীলাচলের আসল সৌন্দর্য দেখার জন্য বর্ষাকাল বেস্ট। পাহাড় আর মেঘের অন্য এক রাজ্যের দেখা মেলে তখন। অন্যান্য সিজনে খুব সকাল অথবা রাতে। আর আমরা এর কোনটাতেই আসি নি। অর্থাৎ, আসল সৌন্দর্যটা মিস করে গেলেন শুভ্রতা।”
শুভ্রতা চোখ পিটপিট করে তাকালো। চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে ভারি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
—” এটা কিন্তু ঠিক না। সেই প্রথম থেকে এটা সেটার বর্ণনা দিয়ে লোভী করে তুলছেন আমায়। কিন্তু লোভ মেটানোর সময় বলছেন তা সম্ভব নয়। এখন যদি রাতের নীলাচল দেখতে চাই নিশ্চয় বলবেন, এটা সম্ভব নয় শুভ্রতা।”
সাদাফ হেসে ফেললো। ঘামে ল্যাপ্টে যাওয়া শার্টটা টেনে ঠিক করে নিয়ে হাতা গোটাতে গোটাতে বললো,
—” আমার হাতে থাকলে অবশ্যই দেখাতাম, শুভ্রতা।”
শুভ্রতা কপট রাগ নিয়ে বললো,
—” সম্ভব নয় কেন?”
সাদাফ চোখ ফিরিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকালো। শুভ্রতা সাদাফের এই গাঢ় চাহনীতে চোখ রাখতে না পেরে চোখ ফেরালো। মুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে গেলো দুটো মানুষ। অথচ, দু’জনের হৃদস্পন্দন যেন ছুটছে একই গতিতে। দু’জনের মনেই চলছে একই বাসনা। একই আশা। দুদিন আগেও যে ভয়ে তটস্থ থাকতো শুভ্রতা আজ হঠাৎ সেই ভয়টাকেই নিজের করে পেতে ইচ্ছে করছে তার। সাদাফ নিজের অধিকার নিয়ে সামনে দাঁড়াবে এমন ভয়ে একসময় কাঁটা হয়ে থাকলেও আজ সেই অধিকারটা খাটানো হচ্ছে না বলেই বিরক্ত হচ্ছে শুভ্রতা। সাদাফ কি একবার মিথ্যেমিথ্যিও বলতে পারে না যে,” শুভ্রতা? আপনি আমার স্ত্রী। আপনার উপর সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার। আমি চাইলেই নীলাচলের মধ্যরাতের সৌন্দর্য দেখাতে পারি। দেখাতে পারি নতুন ভোর।” শুভ্রতা বেখেয়ালি মনেই পাহাড়ের একদিকটাই গিয়ে দাঁড়ালো। চারপাশে তাদের মতোই বেশ কিছু টুরিস্ট ছবি তোলায় মেতে উঠেছে। হঠাৎ পাশ থেকে কথা বলে উঠলো সাদাফ,
—” শুভ্রতা? এই জায়গাটুকুকে বলে ‘লা রং’।”
সাদাফের মুখে এমন একটা নাম শুনে কপাল কুঁচকে তাকালো শুভ্রতা। বিরবির করে বললো,
—” লা রং? এটা আবার কেমন না…”
এটুকু বলতেই থেমে গেলো শুভ্রতা। সামনের সারি সারি পাহাড় দেখে হঠাৎই যেন থমকে গেলো সে। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো,
—” এতো সুন্দর! মনে হচ্ছে নীল আকাশটা যেন পাহাড়গুলোর গায়ে ল্যাপ্টে আছে। ওখানে গেলেই মুঠোয় নেওয়া যাবে বিশাল আকাশের নীল নীল টুকরো।”
শুভ্রতার বিস্ময় দেখে হাসলো সাদাফ। শুভ্রতার পাশে রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো।
—“এজন্যই জায়গাটার নাম নীলাচল। পাহাড়ের গায়ে অদ্ভুত সুন্দর এক নীল আঁচল।”
শুভ্রতা কিছু বলবে তার আগেই পাশ থেকে বলে উঠলো কেউ,
—” সাদাফ দাদা না?”
সাদাফ সচেতন চোখে তাকালো। রোদের তেজে তার গম্ভীর চোখগুলো খানিকটা কুঁচকে নিয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখার চেষ্টা করলো। দু’সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকেই ঠোঁটে মুচকি হাসি খেলে গেলো তার। উল্লাসিত কন্ঠে বললো,
—” আরে! মেমপ্রে?”
ছেলেটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জড়িয়ে ধরলো সাদাফ। ছেলেটির ছোট ছোট খাঁড়া চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বললো,
—” তুমি এখানে?”
ছেলেটি হাসলো। শুভ্রতা বেশ মনোযোগী হয়ে ছেলেটির মুখের দিকে তাকালো। চ্যাপ্টা নাক, গায়ের রং খানিকটা ময়লা, চুলগুলো ছোট ছোট, মোটা ঠোঁটে ঝুলে আছে অল্পবিস্তর হাসি। ছেলেটার মাঝে উপজাতি উপজাতি ভাবটা বিশেষভাবে চোখে পড়ছে শুভ্রতার। শুভ্রতার ভাবনার সুঁতো কেঁটে উত্তর দিলো ছেলেটি,
—” এখানে গাইডের কাজ করি দাদা। আপনি তো অনেকদিন পড়ে এলেন বান্দরবান।”
সাদাফ হালকা হেসে মেমপ্রের কাঁধ ঝাঁকিয়ে শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—” ও হচ্ছে মেমপ্রে। বান্দরবানের স্থানীয়। আমি যতবারই তাজিংডং এর চূড়ায় গিয়েছি ততবারই আমার সাথে ছিলো মেমপ্রে। অসাধারণ একটা ছেলে।”
সাদাফের খোলাখোলি প্রশংসায় কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলো মেমপ্রে। লজ্জাময় চেহারায় একবার মাথা নিচু করলো। শুভ্রতা বিস্ময় নিয়ে বললো,
—” যতবার মানে? কতবার গিয়েছেন তাজিংডং?”
সাদাফ স্বাভাবিক গলায় বললো,
—” সে তো হবেই সাত আট বার।”
শুভ্রতা চোখ বড় বড় করে তাকালো। মেমপ্রে শুভ্রতাকে ইশারা করে বললো,
—” উনি কি বৌদি দাদা?”
মেমপ্রের প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো সাদাফ। শুভ্রতাকে লজ্জা আর অস্বস্তিতে মাথা নিচু করতেই তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো সাদাফ,
—” ও আমার বন্ধুর শালিকা। শালি বুঝো তো? আমি বোঝাতে চাইছি উনি আমার ভাবির বোন।”
মেমপ্রে বুঝতে পেরে মাথা ঝাঁকালো। সাথে সাথেই অচেনা এক বিষাদ যেন ঘায়েল করলো শুভ্রতার মন। সাদাফ কি মেমপ্রের প্রশ্নে “হ্যাঁ” বলতে পারতো না? নিজের এমন বাচ্চামো অভিমানে নিজেই অবাক হলো শুভ্রতা। সেই সুযোগে বিনম্র কন্ঠে বলে উঠলো মেমপ্রে,
—” দাদা? আমাদের একটা নতুন ঘর তুলেছি এবার। জুমের চাষও ভালো হয়েছে। আপনাকে বলেছিলাম না? ঘর করলে নিমন্ত্রণ দিবো। আজকে চলুন না। আমিও বাড়ি যাচ্ছি আজ। যাবেন দাদা?”
—” অন্য একদিন যাবো মেমপ্রে। আজ আমার সাথে আরো তিনজন আছেন। তারমাঝে দু’জনেই মেয়ে। তাছাড়া অতোদূর যাওয়াটা ওদের জন্য টাফ হয়ে যাবে।”
শুভ্রতা কৌতূহলী হয়ে বললো,
—” কোথায় আপনাদের বাড়ি?”
—“শেরকর পাড়া। তাজিংডং এর ঠিক নিচে আমাদের পাড়া।”
শুভ্রতা আর কথা বাড়ালো না। তাজিংডং এখান থেকে ঠিক কতোটা দূরে জানা নেই তার। মেমপ্রে অনুরোধের সুরে বললো,
—” চলুন না দাদা। কতোদিন হলো ওদিকটাই যান না আপনি। কাল আমাদের পাড়ায় একটা উৎসব আছে। আপনি গেলে আমি খুব খুশি হবো দাদা। যেতে একটু কষ্ট হবে কিন্তু জায়গাটা যে কতো সুন্দর তা তো জানেনই আপনি।”
সাদাফ হেসে মাথা নাড়লো। এপাশ ওপাশ তাকিয়ে আরাফকে ডেকে মেমপ্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। মেমপ্রের প্রস্তাবটা ওকে জানাতেই বললো শেফার শরীর খারাপ ট্রেকিং করে অতটা যেতে পারবে না। সাদাফও আশাহত হলো। নয়তো তাজিংডং পাহাড়টাই ঘুরে আশার লোভটা তার শরীরেও চাড়া দিয়ে উঠছিলো খুব। সাদাফের মনোভাবটা বুঝতে পেরেই প্রস্তাব রাখলো আরাফ,
—” তুই কিন্তু মেমপ্রের সাথে যেতেই পারিস সাদাফ। শেফার শরীরটা খারাপ ওর একটু রেস্ট দরকার। তাছাড়া এমনিতেও তো দিনের বেশির ভাগ সময় হোটেলেই থাকি আমরা। তুই চলে যা…আমরা হোটেলেই ওয়েট করবো। ফেরার দিন একসাথে ফিরলেই তো হবে। দু’দিনের মাঝে ফিরতে পারবি না ওখান থেকে?”
সাদাফ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
—” দু’দিনের আগেই ফেরা যাবে কিন্তু তোদের রেখে…”
আরাফ হেসে বললো,
—” আরে ব্যাটা। যা তো….ঘুরে আয়। আমরা তো এখানেই আছি। সমস্যা নাই।”
মুহূর্তেই মুখটা কালো হয়ে গেলো শুভ্রতার। তারমানে, সাদাফ দু’দিনের জন্য চলে যাবে? দু দুটো দিন দেখা হবে না তাদের? তাছাড়া একা একা হোটেলে বসে কি করে সময় কাটাবে সে? ওদের কথার মাঝেই কথা পারলো শেফা,
—” আচ্ছা, সাদাফ ভাই? আপনার সাথে শুভ্রতাকে নেওয়া যায় না? ওর ও এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানোর খুব শখ। বলতে গেলে এক নাম্বারের প্রকৃতিপ্রেমি।”
শেফার প্রস্তাবে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠলো শুভ্রতার চোখে-মুখে। কিন্তু সাদাফ দ্বিধান্বিত চোখে তাকালো,
—” উনি অতোদূর আমার সাথে একা যাবেন? ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যায় ভাবি। তাছাড়া ওখানে মেয়ে…”
সাদাফকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো শেফা,
—” নিশ্চিন্ত থাকুন ভাইয়া। আরাফের কাছ থেকে আপনার ব্যাপারে যতটুকু শুনেছি তাতে আপনাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। আর যায় হোক, আমার বোনের কোনো ক্ষতি আপনি হতে দিবেন না। মেয়েটার ট্রাভেলিং এর শখ প্রচুর কিন্তু বাসা থেকে এলাউ করে না। এবার যেহেতু চান্সটা পেয়েছে কাজে লাগাক। ওকে সাথে নিন ভাইয়া।”
সাদাফের সুপ্ত মনটাও যেন শুভ্রতার জেদ ধরে বসলো। শুভ্রতার সঙ্গ তো সেও চায় কিন্তু….এই দ্বিধাটুকুও যেন হালকা পাতলা নাড়া দিলো মনে। একবার শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বললো,
—” উনার শরীর তো দুর্বল। শেরকর পাড়া পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রচুর ট্রেকিং করতে হবে। এতোটুকু কি হাঁটতে পারবেন উনি?”
শুভ্রতা ফট করেই বলে উঠলো,
—” পারবো। প্লিজ….আমিও যাবো সাথে।”
—” আপনি সিউর? বান্দরবানের অনেক গহীনে যেতে হবে। প্রচুর হাঁটতে হবে। পথে কিন্তু জোঁকের ঝামেলাও পোঁহাতে হবে।”
শুভ্রতা উত্তেজিত হয়ে বললো,
—” হোক জোঁক। তবু যাবো। আমার এডভেঞ্চার খুব ভালো লাগে। আর সেই এডভেঞ্চার যদি পাহাড়ে হয় তাহলে তো কথায় নেই। উফফ্ না জানি কতো সুন্দর হবে জায়গাটা।”
সাদাফ নিজের মনে হাসলো। এই পাগলীটাকে সৌন্দর্যে পাগল করতে হলেও সাথে নেওয়া চাই-ই চাই। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো হালকা নাস্তা করে দশটার বাসে থানচির পথে রওনা দেবে তারা। তারপর সেখান থেকে শেরকর পাড়ার উদ্দেশ্যে ট্রেকিং শুরু। আরাফ আর শেফা ওদের জন্য এখানেই অপেক্ষা করবে। আজ ২৭ তারিখ,সাদাফরা ২৯ তারিখ রবিবার বিকেলের মধ্যে এখানে এসে পৌঁছেবে। তারপর রাত দশটার বাসে সবাই মিলে ফিরে যাবে ঢাকা।
#চলবে….