# আরশিযুগল প্রেম পর্ব ১৯
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব- ১৯
“মুরং” জাতির বাস মূলত বোর্ডিং পাড়াতে হলেও শেরকর পাড়াতেও তাদের অস্তিত্ব চোখে পড়ার মতো। মুরংরা অন্যান্য পাহাড়ী আদিবাসী থেকে খানিকটা ভিন্ন এবং বন্য। এ যুগে এসেও তাদের অধিকাংশই “বাংলা” ভাষা বুঝে না। শুধু বাংলা নয় অন্যকোনো আদিবাসীদের ভাষাও তারা বুঝে না। এমন এক বন্য জাতির সন্তান হয়েও মেমপ্রে কিভাবে স্পষ্ট বাংলায় কথা বলে তা শুভ্রতার কাছে আস্ত এক রহস্য। মেমপ্রেদের টঙ বাড়ির বারান্দার এক কোণে বাঁশের চাটাই-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রতা।
রক্তিম সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। কিছুক্ষণের মাঝেই পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ার আমোদ যেন তার পুরো শরীর জুড়ে। শেষ বিকেলের সূর্যের মতোই আমোদিত শেরকর পাড়ার চারপাশ। পাড়ায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়েই ঘুমের রাজ্যে হারিয়েছিলো শুভ্রতা। তাই এই শেষ বিকালে ঘুম ভেঙে পাড়াজুড়ে উৎসবের আমেজ দেখে বেশ খানিকটা অবাকই হলো সে।
ছবির মতো এই পাহাড়ি পাড়ায় বিশাল এক মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। সেই মঞ্চ সাজানো হয়েছে বাঁশের ছিলকা দিয়ে তৈরি রং-বেরঙের ফুল দিয়ে। মঞ্চের ঠিক নিচে বাঁশ দিয়ে একটা ঘের তৈরি করা হয়েছে। আর সেই ঘেরের মাঝে বাঁধা হয়েছে দু’দুটো গরু। পাহাড়ী মেয়েরা ছোট ছোট কাপড়ে নিজেদের মুড়িয়ে এদিক-ওদিক ঘুরাঘুরি করছে। কেউ কেউ গলায় বাহারী মালা, কানে-খোঁপায় ফুল আর কাঠের চিরুনি লাগিয়েছে। কোমরে পাহাড়ি বিছাও ঝুলতে দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। পায়ে রূপার একধরনের মোটা অলংকার পড়েছে। শুভ্রতার কাছে সবকিছুই ভীষণ নতুন। বিশেষ করে পাহাড়ী ছেলেদের অদ্ভুত সাজে রীতিমতো বিস্মিত সে। শুভ্রতার মনোযোগী দৃষ্টির মাঝেই পাশে এসে দাঁড়ালো সাদাফ। হালকা কেশে দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করে বললো,
—” এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছেন?”
শুভ্রতা ক্ষনিকের জন্য দৃষ্টি ফিরিয়ে আবারও সামনের দিকে তাকালো। বিস্মিত গলায় বললো,
—” এখানে এসব কি হচ্ছে?”
সাদাফ বাঁশের চাটাই দিয়ে বানানো বেঁধিতে হাত রেখে মৃদু হাসলো। সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,
—” এটা মুরংদের একটা বিশেষ উৎসব। অনেকটা আমাদের নবান্নের মতো। আমন ধান ঘরে উঠার পর আমরা যেমন নবান্ন উৎসব করি ঠিক তেমনি জুম চাষ ঘরে উঠার পর ওরা এই উৎসবটি করে। তবে নামটা ভিন্ন। ওদের এই উৎসবের নাম হলো ‘ছিয়াকৃত প্লাট’। ”
সাদাফের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো শুভ্রতা। চোখ-মুখ কুঁচকে বললো,
—” ছয়াকৃত কি?”
—“ছয়াকৃত নয় ছিয়াকৃত প্লাট।”
শুভ্রতা ঠোঁট উল্টে বললো,
—” কি উদ্ভট নাম!”
সাদাফ হেসে ফেললো। শেষ বিকেলের নরম আলোটা তার চোখে-মুখে ল্যাপ্টে থাকায় খুবই চমৎকার দেখালো সেই হাসি। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়েই ব্যাখ্যা করার মতো ভাব নিয়ে বলে উঠলো সাদাফ,
—” তা একটু উদ্ভট বটে। তবে খুব একটাও খারাপ নয়। ছিয়াকৃত প্লাটের বাংলা অর্থ হলো গো-হত্যা উৎসব। মুরং সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব এটি।”
—” গো মানে তো গরু তাই না? তারমানে গরু হত্যা..। আচ্ছা? ওই গরুদুটোকে মেরে ফেলবে এরা?”
সাদাফ মাথা নাড়লো। সাথে সাথেই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো শুভ্রতার। হঠাৎ করেই গরু দুটোর জন্য ভীষণ মায়া লাগতে লাগলো তার। কালো গরু দুটোর মাঝে একটা নিতান্তই বাচ্চা। বাচ্চা গরুটার বড় বড় চোখদুটো ভরা যেন একরাশ অসহায়ত্ব আর ভয়। বাঁশের খাঁচায় বন্ধী থেকে একটু সাহায্য আর দয়ার জন্যই যেন হাঁসফাঁস করছে সে। শুভ্রতার উদাসীনতার কারণটা সাদাফ বুঝতে পারলো কি না বুঝা গেলো না। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে বললো,
—” মূলত এই গরু দুটোকে কেন্দ্র করেই তাদের অনুষ্ঠান। যুগের পর যুগ এভাবেই গো হত্যা করে আসছে ওরা। বর্ষা দিয়ে গুঁতিয়ে গরুকে মেরে, গরুর জিহ্বার প্রথম অংশটুকু কেটে মঞ্চের উপরে ঝুলিয়ে রাখাই তাদের রীতি।”
শুভ্রতা যেন আৎকে উঠলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
—” এতোটা ভয়াবহ ভাবে কেন মারে ওরা? এটা কেমন রীতি?”
সাদাফ শুভ্রতার দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখে-মুখে তীব্র কষ্টের গাঢ় কালো ছাপ। সাদাফ সেই ভয়ার্ত চোখজোড়ায় চোখ রেখে শুভ্রতাকে বুঝতে চেষ্টা করলো। খানিকবাদে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,
—” মুরংদের ধারনা শত শত বছর আগে তাদের দেবতা কলা পাতায় ধর্মগ্রন্থ লিখে গরুর পিঠে করে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে মুরংদের কাছে পাঠিয়েছিলো। সাথে ছিলো পরিধান করার মতো কাপড়। কিন্তু মুরংদের পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই পথিমধ্যে প্রচন্ড ক্ষুধায় সেসব পাতা আর কাপড় খেয়ে ফেলে গরু। যার ফলে মুরংদের কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই এবং পড়ার মতো কাপড়ও সীমিত। দেখছেন না? মেয়েরা কতো অল্প কাপড় পড়েছে আর ছেলেদের শরীরেও কাপড়ের স্বল্পতা।”
শুভ্রতা মঞ্চের আশপাশে ঘুরে বেড়ানো মুরংদের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে মাথা নাড়লো। সাদাফ মৃদু হেসে বললো,
—” মুরংদের ধারনা তাদের এই অভাব অনটনের জন্য দায়ী একমাত্র গরু। তাই প্রতিবছর বিশাল আয়োজন করে গরুকে শাস্তি দিয়ে গরুর জিহ্বা কেটে নেয় তারা।”
সাদাফ-শুভ্রতার কথার মাঝেই সন্ধ্যা নামলো পাহাড়ে। মঞ্চের আশেপাশে জ্বলে উঠলো অসংখ্য মশাল। পাহাড়ী তরুন তরুনীরা নেমে এলো নাচের সাঁজে। প্রতিটি ছেলের হাতে লম্বা বাঁশের চুঙ্গার মতো জিনিস দেখে দ্রুত প্রশ্ন করলো শুভ্রতা,
—” আচ্ছা? ওগুলো কি?”
সাদাফ নিরলস ভাবে জবাব দিলো,
—” ওগুলো হলো প্লুং। পাহাড়ীদের বানানো নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র। অনেকটা আমাদের বাঁশির মতো কাজ করে এই প্লুং।”
শুভ্রতা জবাব দেওয়ার আগেই তুমুল শব্দে বেজে উঠলো এই প্লুং। তার সাথে সাথে নাচে মত্ত হলো তরুন তরুনীসহ সবাই। নাচ শুরু হতেই বেশ উৎসাহ নিয়ে নড়েচড়ে দাঁড়ালো শুভ্রতা। ওদের নাচের ঢংটা বেশ পছন্দ হলো তার। মেয়েরা হাত ধরাধরি করে তাল মিলিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের সামনে সামনে প্লুং বাজিয়ে এগিয়ে আসছে ছেলেরা। ছেলেমেয়েরা মুখোমুখি এগিয়ে-পিছিয়েই প্রদক্ষিণ করছে বাঁশের মঞ্চ। সেই সাথে ধীর পায়ে প্রদক্ষিন করছে মুরং বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও। ওদের নাচ আর বাদ্যের তালে তালে খুশি হয়ে বলে উঠলো শুভ্রতা,
—” বাহ। দারুন তো।”
সাদাফ মৃদু হাসলো। অন্ধকারে ঢাকা পাহাড়ী রাতে মশালের লালটে আলোয় মুগ্ধতাময় রমনীকে দেখতে ব্যস্ত সে। মশালের কম্পিত আলোগুলো শুভ্রতার চোখে মুখে পড়ায় অদ্ভুত এক মায়া ভর করেছে তার ঠোঁটে। শুভ্রতার মৃদু হাসিতে আগুনের শিখাগুলোও যেন কেঁপে কেঁপে হেসে উঠছে বরংবার। শুভ্রতাকে এখন আগুনের কম্পিত শিখা বলেই বোধ হচ্ছে সাদাফের। যে শিখা শুধু পুড়ায়। পুড়িয়ে শেষ করে দেয় বিন্দু বিন্দু অনুভূতিগুলো। রাত বাড়ার সাথে সাথেই প্লুং আর নাচের তেজ বাড়লো। তার সাথে বাড়লো আদিবাসীদের ভীর। সাদাফ-শুভ্রতা আরো একটু সরে গিয়ে ফাঁকা স্থান দেখে দাঁড়ালো। মঞ্চের দিকে চোখ রেখেই হঠাৎই প্রশ্ন করলো শুভ্রতা,
—” আচ্ছা? আপনার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি কে?”
শুভ্রতার হঠাৎ এমন প্রশ্নে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো সাদাফ। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
—” মা। একজন প্রিয়ের কথা বলতে হলে মা। নয়তো পুরো ফ্যামিলি।”
শুভ্রতা মৃদু হেসে বললো,
—” কে কে আছে আপনার পরিবারে?”
—” মা,বাবা, দুটো বড় ভাই, দু’জন ভাবি আর একটা ছোট বোন।”
শুভ্রতা এবার নড়েচড়ে দাঁড়ালো। বনিতা করে বললো,
—” আর কেউ নেই? “
সাদাফ কপাল কুঁচকে বললো,
—” আর কেউ বলতে?”
শুভ্রতা আমতা আমতা করে বললো,
—” না। মানে.. থাকে না? চাচা-চাচি, দাদা-দাদি হেন তেন।”
সাদাফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। শুভ্রতা কি জানতে চাইছে বুঝতে পেরে মুখ টিপে হাসলো। গম্ভীর মুখে বললো,
—” ও আচ্ছা। না নেই। চাচা-চাচি হেন তেন নেই।”
শুভ্রতা নিচের ঠোঁট কামড়ে বললো,
—” আর কেউ নেই? না মানে….প্রিয় কেউ?”
সাদাফ নিজের হাসি আটকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে বললো,
—” বললাম তো, প্রিয় হলো মা।”
শুভ্রতা এবার বিরক্তি নিয়ে তাকালো। এই মুহূর্তে সাদাফের চুলগুলো টেনে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, ” আপনি একটা গবেট!” নিজের বিরক্তি দমন করে পাশ ফিরে তাকাতেই হঠাৎ মনে পড়েছি ভাব নিয়ে বলে উঠলো সাদাফ,
—” ওহ্! একটা বউ ও আছে।”
“বউ আছে” কথাটা শুনেই চোখ বড় বড় করে তাকালো শুভ্রতা। সাদাফের গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা জানার জন্য এতো জিগ্যেসাবাদ করার পর আস্ত একটা বউ বেরিয়ে আসবে কল্পনাও করে নি সে। মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ে অনেকটা কাঁদো কাঁদো ভাব নিয়ে সাদাফের দিকে তাকালো। শুভ্রতাকে মুখ কালো করতে দেখে বেশ মজা পেলো সাদাফ। অন্যদিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,
—” সে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়া আর কেউ নেই।”
সাদাফের কথাটা বুঝতে পেরেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো শুভ্রতা। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লজ্জায় লাল হয়ে পেছন ফিরে তাকালো সে। শুভ্রতার লজ্জা দেখে হেসে ফেললো সাদাফ। নৃত্যারত তরুণীদের দিকে ভাবাবেগশূন্য চোখে তাকালো। কিছুক্ষণ পর পাশ থেকে শুভ্রতাকে বিরবির শুনে কপাল কুঁচকে তাকালো সে। শুভ্রতা বাঁশের খুঁটিতে নখ খুঁটে খুঁটে বলছে,
—” অর্পন ঠিক বলে সব পুরুষ মানুষ এক টাইপ। অসহ্যকর।”
সাদাফ কপালটা আরো একটু কুঁচকে নিয়ে বললো,
—” আমায় কিছু বলছেন?”
শুভ্রতা ফিরে তাকালো। জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো,
—” নাহ। আপনাকে কিছু বলছি না। আসলে আমার একটা ফ্রেন্ড আছে অর্পন। ও সবসময় বলে, ‘সব পুরুষরা এক টাইপ। মেয়ে দেখলেই হুশ থাকে না টাইপ।’ ওই কথাটাই বিশ্লেষণ করছিলাম আরকি। কথাটা সত্য নাকি মিথ্যা।”
সাদাফ বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
—” নিজে পুরুষ হয়ে পুরুষদের নিয়ে এমন কথা বলে আপনার ফ্রেন্ড? স্ট্রেঞ্জ।”
শুভ্রতা অবাক হয়ে বললো,
—” অর্পন পুরুষ হবে কেন?ও তো একটা মেয়ে। আমার ফ্রেন্ড। ওর নাম অর্পি ফেরদৌসী। আমরা ফ্রেন্ডরা ‘অর্পি’ নামটিকে একটু উলটে পালটে বানিয়ে দিয়েছি অর্পন।”
সাদাফ কিছুক্ষণ ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো। মৃদু গলায় বললো,
—” আপনার কেন মনে হয় আমি মেয়ে দেখলে হুঁশ থাকে না টাইপ পুরুষ?”
সাদাফ যে শুভ্রতার পয়েন্টটা ধরে ফেলবে বুঝতে পারে নি শুভ্রতা। সাদাফের প্রশ্নে আড়চোখে একবার তাকিয়ে অকপটে বলে ফেললো সে,
—” আদিবাসী মেয়েদের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকলে যে কেউ তাই মনে করবে। তারওপর তাদের ড্রেসআপটাও খুব একটা প্রসংশনীয় নয়।”
সাদাফ ভ্রু কুঁচকালো। সে আদিবাসী মেয়েদের দিকে কখন তাকালো তা মনে করার চেষ্টা করছে সে। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
—” মেমপ্রে আপনার শোয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে। খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ুন। কাল আমাদের ফেরার দিন। সকাল সকাল বেরুতে হবে। আর মনে করে পেইনকিলার খেয়ে নিবেন। আপনার ব্যাগের সাইডেই রেখে দিয়েছি। পা নিশ্চয় ব্যাথা করছে খুব।”
সাদাফের কথা শুনেই পা ব্যাথার কথা মনে পড়লো শুভ্রতার। জীবনের প্রথম এতোটা হেঁটেছে সে। হাত-পা সবই যেন ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। কিন্তু সাদাফ কি করে বুঝলো? এখনও তো এই ব্যাপারে কিছু বলে নি সে।
____________________
কাল সারাদিন পাহাড়ি চড়াই-উতরাই পারি দেওয়ার পর বিছানায় গা এলাতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলো শুভ্রতা। কিন্তু হাতে কারো ঝাঁকি পড়ায় নিমিষেই ঘুম ছুটে গেলো তার। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে সাদাফের মুখটাই চোখে পড়লো প্রথম। সাদাফ ঠোঁট নেড়ে কিছু একটা বলছে। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় সাদাফের কোনো কথায় কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না তার। শুভ্রতা একবার চোখ বন্ধ করে কপাল কুঁচকালো। কয়েক সেকেন্ড পর আবারও চোখ মেলে তাকালো সে। সাদাফের কন্ঠটাও বেশ পরিষ্কার শোনাচ্ছে এবার,
—” শুভ্রতা? ওঠুন…জলদি ওঠুন।”
শুভ্রতা চোখ পিটপিট করে চারপাশে তাকিয়ে বললো,
—“কয়টা বাজে? মাত্রই তো ঘুমালাম। এখনই ডাকছেন কেন?”
সাদাফ হেসে বললো,
—” মাত্র? ৬ ঘন্টা ধরে ঘুমোচ্ছেন। সে যায় হোক, এবার জলদি উঠুন তো। উঠুন…”
শুভ্রতা ঠোঁট ফুলিয়ে ওঠে বসলো। ঝুঁটি করে রাখা চুলের অধিকাংশই বেরিয়ে এসে পড়েছে তার মুখের দুপাশে। অগোছালো ঘুমু ঘুমু মুখে শুভ্রতাকে ভীষণ আবেদনময়ী লাগছে সাদাফের কাছে। সাদাফ একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে আবারও তাড়া দিলো,
—” জলদি ওঠুন না রে বাবা।”
শুভ্রতা আলসেমি ভরা পায়ে, ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে সাদাফের পেছন পেছন ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। চারদিকটা ঘন কুয়াশায় ছেয়ে আছে। ঠিকঠাক সকাল না হওয়ায় চারপাশটা ঝাপসা শুভ্রতায় ঘেরা। শুভ্রতা চোখ পিটপিট করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সাদাফ শুভ্রতার হাত ধরে পাহাড়ের একদম পূর্বদিকের কোণায় গিয়ে দাঁড়ালো । শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে আলতো গলায় বললো,
—” নিচে তাকান শুভ্রতা।”
সাদাফের কথামতো নিচের দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পড়লো শুভ্রতা। উত্তেজনায় ঠোঁট দুটো আলাদা হয়ে গেলো আপনা আপনি। তাদের থেকে এক হাত নিচেই শরৎ এর মেঘের মতো পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘে ভেসে বেড়াচ্ছে অবলীলায়। পাহাড়ের চূড়াগুলো ঢেকে আছে ঘন সাদা মেঘে। মাঝে মাঝে সাদা মেঘ ভেদ করে একটা দুটে সবুজ গাছ চোখে পড়ছে। এটা যেন এক অভিব্যক্তিহীন সৌন্দর্য। পাহাড়ের কোলে ভেসে বেড়ানো মেঘের ভেলা। উহুম বেলা নয়…এ তো সমুদ্দুর। মেঘের সমুদ্দুর। এমন অযাচিত সৌন্দর্যে মাতাল হয়ে শরীর কাঁপতে লাগলো শুভ্রতার। চোখদুটো টলমল করে উঠলো। কাঁপা কাঁপা গলায় কোন রকম বললো,
—” মেঘ! ওগুলো মেঘ? মনে হচ্ছে নিচে আস্ত একটা আকাশ! ”
সাদাফ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
—” শুধু ওগুলো নয়। আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন এটাও মেঘের রাজ্য। মেঘকন্যারা আপনাকে ছুঁয়ে আছে শুভ্রতা।”
শুভ্রতা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে চারপাশে তাকালো। যেগুলোকে সে কুয়াশা ভেবেছিলো সেগুলো আসলে কুয়াশা নয় মেঘ! শুভ্রতা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। খুব দ্রুত চোখদুটো বন্ধ করে নিলো সে। সাথে সাথেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোটা জল। চোখদুটো মেলে দু’হাতে মুখ চেপে ধরে বলে উঠলো সে,
—” এতো সুন্দর কেন প্রকৃতি? এতোটা সুন্দর কেন হবে তারা? কেন? আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি সাদাফ সাহেব। পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
সাদাফ মৃদু হাসতে লাগলো। মেঘে ঢাকা রূপকথার রাজ্যে অসম্ভব মায়াবতী এক তরুনী চোখে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাদাফের কাছে এই প্রকৃতির চেয়ে এই মেয়েটাকেই বেশি সুন্দর লাগছে। একদম রূপকথার মতো সুন্দর। শুভ্রতা আনন্দ দিশেহারা হয়ে হাত বাড়িয়ে মেঘ ছুঁয়ে দেখছে তো আবার বিস্ময়ে মুখ চেপে ধরছে। চোখ থেকে অনর্গল পানি পড়ছে তার। সাদাফ খানিকটা দূর থেকে এই দৃশ্যটা ভালো করে মনের মাঝে গেঁথে নিয়ে শুভ্রতার খানিকটা কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো। শুভ্রতা আকুতি মাখা চোখে তাকিয়ে বললো,
—” এই মারাত্মক সুন্দর জায়গাটা থেকে কখনো যেতে চাই না আমি। কখনো না।”
শুভ্রতার এই আকুতি, এই আনন্দ যেন বুকে গিয়ে লাগলো সাদাফের। শুভ্রতার মেঘে ভেজা এলোমেলো চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো, ” আমিও আপনাকে ছাড়তে চাই না শুভ্রতা। কখনোই না।”
#চলবে…