# আরশিযুগল প্রেম .
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
#পর্ব – ৫৮
—-” শুভ্রব তোকে পছন্দ করে? বিয়ে করতে চায়?”
পৃথা মৃদু স্বরে বলল,
—-” জানি না।”
সাদাফের কপালের ভাঁজ আরো খানিকটা গাঢ় হলো। শক্ত গলায় বলল,
—-” জানি না বলতে কি বুঝাতে চাইছিস তুই? একটা ছেলে তোকে আদৌ পছন্দ করে কিনা তা না জেনেই বড় ভাইকে রাতদুপুরে এমন উদ্ভট কথা বলতে এসেছিস। দিন দিন চূড়ান্ত বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস তুই। অনেক হয়েছে নাটক এবার রুমে যা। ব্যাগ গুছিয়ে রাখ, কাল আমি নিজে গিয়ে চট্টগ্রাম রেখে আসবো তোকে। ঢাকায় অনেক পড়াশোনা হয়েছে তোমার। এবার যা পড়াশোনা করার তা চট্টগ্রাম গিয়েই করবে। রুমে যা…”
পৃথা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কাঁপা দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকাল। হাত-পা মৃদু কাঁপছে তার। এতোক্ষণ আবেগের প্রগাঢ়তা আর তীব্র জেদের বশে বড় ভাইয়ের প্রতি ভয়টা জাগে নি পৃথার। আর যতক্ষণে ভয়টা জেগেছে ততক্ষণে অনেক বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছে। ভয়ে চোখদুটো টলমল করছে পৃথার। তিন ভাইয়ের মাঝে এই ভাইটাকেই জমের মতো ভয় পায় পৃথা। পৃথা অসহায় চোখে শুভ্রতার দিকে তাকাল। অস্ফুট গলায় বলল,
—-” ভাবি।”
সাদাফ ধমকে উঠে বলল,
—-” এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার কথাগুলো কি কানে ঢুকে নি তোর? যেতে বলেছি মানে যেতে বলেছি।”
পৃথা কেঁপে উঠলো। সাদাফের রাগ সম্পর্কে ছোট থেকেই অবগত সে। পরিবারের আদরের কন্যা হলেও এই ভাইয়ের কাছে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় সে পায় নি কখনো । শুভ্রতা নরম গলায় বলল,
—-” উফ! বাচ্চা একটা মেয়েকে এমন ধমকা ধমকি করছ কেন, বল তো? বুঝিয়ে বললে হয় না? পৃথা? বনু তুমি ঘরে যাও। আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলব, কেমন?”
পৃথা ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানালো। সেই সাথে মনের কোথাও একটা তীক্ষ্ণ জেদ চেপে বসল। এই শুভ্রব নামক ছেলেটিকে আপন সে করবেই। ছেলেটির এই বিশাল অহংবোধ আর অবহেলার শেষটা সে দেখবেই দেখবে। সাদাফ গমগমে গলায় বলল,
—-” একদম ওকে মাথায় তুলবে না,শুভ্রা। তোমরা, এই ভাবিরা মিলেই মাথা বিগড়াচ্ছ ওর। এই তুই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কানের নিচে থাপ্পড় খেতে না চাইলে রুমে যা।”
পৃথা কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দৌঁড়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। শুভ্রতা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে পৃথার ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখে-মুখে ভয়ানক দুশ্চিন্তার ছাপ।
—-” কি ভাবছো?”
সাদাফের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিলো শুভ্রতা,
—-” ভাইয়া এখনও তনুকে ভুলতে পারি নি। পৃথার ব্যাপারটা ও কিভাবে নেবে বুঝতে পারছি না।
এটুকু বলে থামলো শুভ্রতা। সাদাফের মুখের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,
—-” আচ্ছা? ভাইয়ার জায়গায় তুমি থাকলে কি করতে? মেনে নিতে?”
সাদাফ খানিক ভেবে বলল,
—-” বুঝতে পারছি না। কোনো সিচুয়েশনে না পড়ে সেই সম্পর্কে আগাম মতামত দেওয়া যায় না, দেওয়া উচিতও না। শুভ্রব কষ্ট পাচ্ছে এটুকু আমরা জানি কিন্তু ওর কষ্টটা ঠিক কতটা গভীর তা কিন্তু আমরা কেউ উপলব্ধি করতে পারছি না। ওর জায়গায় থাকলে কি করতাম সেই উত্তর দেওয়ার আগে আমাকে ওর কষ্টটা ওর মতো উপলব্ধি করতে হবে। তা কি সম্ভব, বলো?”
শুভ্রতা কয়েক সেকেন্ড স্বামীর স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। সেই নিঃশ্বাসের সাথেই ভেসে এলো তীব্র দুঃশ্চিন্তার গন্ধ, হাজার খানেক প্রশ্ন। শুভ্রতার অন্যমনস্ক মুখের দিকে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হঠাৎই শুভ্রতাকে কোলে তুলে নিলো সাদাফ। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠলো শুভ্রতা। সাদাফের গলাটা শক্ত করে ধরে উদ্বেগ মাখা গলায় বলল,
—-” একি! কি করছ? পড়ে যাব।”
সাদাফ বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
—-” আপনার বরের গায়ে যথেষ্ট জোর আছে ম্যাডাম। বউ-বাচ্চা দু’জনকে একসাথে কোলে উঠাতে পারবে সে। বুঝলেন?”
শুভ্রতা হাতের বাঁধনটা আরো খানিকটা শক্ত করে মৃদু হাসলো। সাদাফের বুকে মাথা রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সাদাফ শুভ্রতাকে কোলে নিয়েই বারান্দায় লাগানো ঝুলাটাই গিয়ে বসল। হালকা দোল খেতে খেতে একের পর এক কথার পসরা সাজাতে লাগল। শুভ্রতা এক ফাঁকে হু হা উত্তরও দিলো না। ঘোর লাগা চোখে সাদাফের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই সুপুরুষ যুবকটা তার স্বামী ভাবতেই সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। মনের এক কোণায় উথলে উঠলো দলা বাঁধা কান্না। শুভ্রতাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকালো সাদাফ। গম্ভীর গলায় বলল,
—-” আবার কি ভাবছ? এই অবস্থায় এতো দুশ্চিন্তা করতে নেই রে বাবা। শরীর খারাপ করবে তো।”
শুভ্রতা জবাব না দিয়ে আবারও সাদাফের বুকে মাথা রাখলো। চোখ ফেঁটে গড়িয়ে পড়ল জল। কাতর গলায় বলল,
—-” আমার না খুব কান্না পাচ্ছে, জানো? মনে হচ্ছে, আর কতদিনই বা বাঁচবো? ত্রিশ অথবা চল্লিশ বছর? এরপর আর কখনো এই চোখ মেলে তোমাকে দেখা হবে না। তোমার বুকে মাথা রাখা হবে না। আমার ভীষণ কষ্ট লাগছে। এই ত্রিশ-চল্লিশ বছরের জন্য তোমাকে পেয়ে একদমই মন ভরছে না আমার। একদমই না। তোমাকে আরো চাই। অনেক অনেক বেশি চাই।”
শুভ্রতার অল্প কিছু কথা সাদাফের বুকে প্রগাঢ় অনুভূতির ঢেউ হয়ে হানা দিলো। শুভ্রতাকে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
—-” বাচ্চাদের মতো কাঁদছো কেন শুভ্রা? তুমিই না বলতে? তোমার আমার আরশিযুগল প্রেম। আরশিযুগল প্রেম কি এতো সহজে হারিয়ে যায়? যায় না। প্রেম হারিয়ে যাওয়ার মতো কোনো বস্তু নয় শুভ্রা। পৃথিবীর সৃষ্টিকাল থেকে প্রেম ছিলো, আছে, থাকবে। শুধু হারিয়ে যাব আমি-তুমি, আমরা সবাই। হারিয়ে যাবে সকল প্রেমিক-প্রেমিকার দল। তবে, প্রেমটা কিন্তু থেকেই যাবে। এই পৃথিবীতে যতদিন প্রেম থাকবে আমি ততদিন তোমাতে মত্ত হবো শুভ্রা। তোমার আমার আরশিটাকে জড়িয়ে রাখব। দৃষ্টির আড়াল থেকেও ভালোবাসবো। তুমি বাসবে না?”
শুভ্রতা জবাব দেয় না। সাদাফের বুকের শার্টটা খামচে ধরে বুকে মুখ গুঁজে। কয়েক সেকেন্ড পর পর কেঁপে কেঁপে উঠে তার নরম শরীর। সাদাফের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে। দোলনার গতি বাড়িয়ে দিয়ে, শুভ্রতাকে বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে রাখে সে। দোলনার বাতাসে শুভ্রতার খোঁপা খুলে অবাধ্য চুলগুলো এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে। শেষ হেমন্তের হিম ধরা রাতে ঝিম ধরে থাকে বারান্দায় লাগানো গাছ। রিক্ত চোখে তাকিয়ে দেখে দোলনায় খেলারত ভালোবাসময় দম্পতির মধ্যরাতের চন্দ্রবিলাস।
___________________
দীর্ঘ রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটেছে মাত্র। ব্যস্ত নগরীটা ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে প্রাণোবন্ত। ঝকঝকে পাকা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইউক্যালিপটাস গাছের ডালগুলোতে একটি দুটো চড়ুই পাখির আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। নর্দমার নিকটে একদল কাক তারস্বরে কা কা করছে। শুভ্রতা রান্নাঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাবার হাত ধরে লাল জামা গায়ে ছোট্ট একটা বাচ্চা ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায়। সাত তলার উপর থেকে ভীষণ অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাদের। ভীষণ পুচকো আর চ্যাপ্টা দেখাচ্ছে। শুভ্রতা নিজের মনে হেসে রান্নার কাজে ব্যস্ত স্বামীর দিকে তাকাল। অনুযোগের স্বরে বলল,
—-” তুমি আমায় ভীষণ বিরক্ত করছ তুতুনের আব্বু। রান্নাঘরটা যে মেয়েদের সেক্টর জানো না? তবুও রোজ সকালে এখানে এসে হানা দাও কেন বলো তো? তারওপর কি ছাইপাস ভর্তাভার্তি করো। মাছ-মাংস কি ফ্রিজে সাজিয়ে রাখবে?”
শুভ্রতার কথায় হাসে সাদাফ। ‘তুতুনের আব্বু’ কথাটাই বুকের ভেতর উথলে উঠে প্রগাঢ় এক আবেগ। চোখের সামনে ভেসে উঠে ছোট্ট ছোট্ট হাত আর ছোট্ট শরীরের মিষ্টি একটা মুখ। সাদাফের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে। বিরবির করে বলে, ‘ কবে আসবে আমাদের তুতুন,শুভ্রা? কবে ওকে কোলে নিয়ে পৃথিবী দেখব আমি? সে কি আমার খুশি, আমার আনন্দ বুঝতে পারছে, শুভ্রা?’ সাদাফকে চুপ থাকতে দেখে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকাল শুভ্রতা। ধৈর্য্যহারা গলায় বলল,
—-” কিসব বিরবির করছ? উত্তর দিচ্ছ না কেন? আর কতদিন খাবে এই আলো, করলা আর ডাল ভর্তা?”
সাদাফ মৃদু হেসে বলল,
—-” যতদিন মাছ-মাংসের গন্ধে শুভ্রণীর বমিভাব বন্ধ না হবে ততদিন।”
—-” আমার একার জন্য বাসায় মাছ-মাংস রান্না বন্ধ করে দেবে, এটা কেমন কথা? তোমার নাহয় খেতে ইচ্ছে করে না কিন্তু পৃথা? ওকে এটলিস্ট খেতে দাও।”
—-” ওর জন্য রেস্টুরেন্ট থেকে এনে দেব, সমস্যা নেই। কিন্তু রান্না ঘরে ওসব রান্না চলবে না।”
শুভ্রতা বিরক্ত গলায় বলল,
—-” তুমি যে দিন দিন বউ পাগল হয়ে যাচ্ছ, বুঝতে পারছ? এইবার চট্টগ্রাম গেলে, তোমার সেই দূরসম্পর্কের দাদিরা নির্ঘাত বলে বেড়াবে আমি তাদের ছেলেকে তাবিজ কবজে বশ করে ফেলেছি। আমি আসলে মন্ত্রপুত ডাইনী।”
সাদাফ এবারও হাসলো। প্রেগনেন্সি জনিত কারণে বেশকিছুদিন ধরেই মুড সুয়িং হচ্ছে শুভ্রতার। মাঝে মাঝেই উদ্ভট, অযৌক্তিক কথা দ্বারা নিজের বিরক্তি প্রকাশ করছে। কিছুক্ষণ পর সেই কথার রেশ ধরেই ইনিয়ে বিনিয়ে দুঃখ প্রকাশ করছে, সরি বলছে। সাদাফের হাসিতে রাগটা আরো বাড়ল শুভ্রতার। চেতে উঠে বলল,
—-” হাসছ কেন? আমি কি হাসির মতো কিছু বলেছি।”
সাদাফ জবাব দিলো না। হাতদুটো ভালো করে ধুয়ে নিয়ে তোয়ালেতে হাত মুছলো। ডানহাতে শুভ্রতাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
—-” আমি একদমই বউ পাগল হচ্ছি না, তুতুনের আম্মু। আমি তো বাচ্চা পাগল হচ্ছি।”
কথাটা বলেই বামহাতটা শুভ্রতার পেটের উপর রাখলো সাদাফ। ভীষণ ছেলেমানুষী গলায় বলল,
—-” ও আমাকে শুনতে পায় শুভ্রা? কবে আসবে ও?”
সাদাফের বাচ্চামো প্রশ্নে হেসে ফেললো শুভ্রতা। হাসিমুখে বলল,
—-” মাত্র তো তিনমাস। অতো অধৈর্য্য হলে চলে? তিনমাসের তুতুন কিছু শুনতে পায় না। পেলেও শুধু তার আম্মুকে শুনতে পায়, বাবাকে নয়।”
সাদাফ কপাল কুঁচকে তাকাল। ক্ষুন্ন গলায় বলল,
—-” কেন? শুধু আম্মুর কথা কেন শুনবে? বাবার কথাও শুনতে হবে।”
কথাটা বলে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসলো সাদাফ। শুভ্রতার পেটে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
—-” তুতুন সোনা? বাবার কথা শুনতে পাও তুমি? বাবা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে সোনা। তাড়াতাড়ি চলে এসো, আমরা দু’জন মিলে অনেক অনেক খেলনা কিনবো। বাবা লাভ ইউ সোনা।”
উন্মুক্ত উদরে সাদাফের ঠোঁটের আন্দোলনে কেঁপে উঠলো শুভ্রতা। সাদাফ ওর কোমর চেপে ধরে চোখ রাঙাল,
—-” এই? একদম নড়বে না। আমি তুতুনের সাথে কথা বলছি, দেখছো না? বাপ-ব্যাটার কনভারসেশনে বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করবে তো খবর আছে।”
শুভ্রতা চোখ-মুখ খিঁচে বলল,
—-” উফ! আমার সুড়সুড়ি লাগছে তো। রান্নাঘরে এসব কি? ওইতো পৃথা আসছে।”
‘পৃথা’ নামটা শুনেই তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াল সাদাফ। শার্টের কলার ঠিক করে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে উঁকি দিলো বাইরে। বসার ঘরের আশেপাশে পৃথাকে দেখতে না পেয়ে বিরক্ত চোখে শুভ্রতার দিকে তাকাল সাদাফ। শুভ্রতাকে ঠোঁট টিপে হাসতে দেখেই গম্ভীর গলায় বলল,
—-” মিথ্যুক। তোমাকে না বলেছি? আগামী এক বছরের জন্য এসব মিথ্যা টিথ্যা নিষিদ্ধ তোমার জন্য। পরে দেখা যাবে, আমার বাচ্চা মায়ের পেটে বসে বসে মিথ্যা বলা শিখছে। আরেকবার মিথ্যা বললে মাইর চলবে।”
শুভ্রতা মুখ ভেঙালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নরম গলায় বলল,
—-” পৃথার বোধ হয় মন খারাপ। কাল শুধু শুধু অতো বকলে। গিয়ে একটু ডাকো না প্লিজ। তোমার উপর অভিমান করে ঘর থেকেই বেরুচ্ছে না।”
সাদাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—-” অভিমান নয় ভয়েই দরজা খুলছে না। ওকে বাসার কেউ শাসন করে না বললেই চলে। আমাকে দেখেই যা একটু ভয় পায়। এই ভয়টুকু ওর জন্য খুবই প্রয়োজন। এমনিই এতো জেদী ও এই ভয়টুকু না থাকলে ওকে সামলানোটাই মুশকিল হয়ে যাবে।”
শুভ্রতা জবাব দিল না। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসটাকে পুঁজি করে নিজের ভাইয়ের কথা ভাবছে সে। এই ঝগড়ুটে ভাইয়াটার জন্য আজ একটু বেশিই মন কেমন করছে তার।
______________________
বন্ধ দরজার এপাশটায় রাত-দিন বোঝার উপায় নেই। মাথার উপর হাই ভোল্টেজের ইলেক্ট্রিক বাতি। দরজা, জানালায় মোটা পর্দা টানা। এখানে সেখানে দু’একটা আধ পোড়া সিগারেটের টুকরো। টেবিলের উপর ঘুমের ঔষধের খালি প্যাকেট। বিছানাময় বইয়ের ছড়াছড়ি। ঘরময় সিগারেটের কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়া। মেঝের উপর ক্লান্ত দেহটা ঝিম ধরে বসে আছে। ঘুমের ঔষধের প্যাকেটগুলো একের পর এক খালি করে দেওয়ার পরও সপ্তাহব্যাপী ঘুম হচ্ছে না। চোখবন্ধ করলেই ভেসে আসছে এক জোড়া স্নিগ্ধ চোখ ব্যস ঘুম শেষ আর বুকের ভেতর কেমন করা ব্যাথাটার শুরু। পাশে রাখা এস্ট্রেতে সিগারেটের আধ পোড়া টুকরোটা ফেলে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুভ্রব। ঠিক সেই সময়ই দরজার করাঘাত কানে এলো। শুভ্রব কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
—-” কে?”
দরজার ওপাশ থেকে রিনিঝিনি কন্ঠে উত্তর এলো,
—-” ভাইয়া আমি। শুভি।”
শুভ্রতার কন্ঠটা কানে যেতেই তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াল শুভ্রব। সিগারেটের এস্ট্রেটা বিছানার নিচে ঠেলে দিয়ে দ্রুত হাতে পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দিলো সে। ধীর পায়ে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা খুলে দিয়ে হেসে বলল,
—-” এই ভরদুপুরে পেত্নী?”
শুভ্রতা ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে বলল,
—-” ভেতরে আসতে পারি?”
—-” বাপরে! অনুমতি নেওয়া শুরু করলি কবে থেকে, শুনি?”
—-” যেদিন থেকে তুই হাসি-মজা ভুলে গম্ভীর হয়ে গেলি।”
শুভ্রব মুচকি হাসলো। দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল,
—-” ভেতরে আয়। এতো কঠিন কঠিন কথা কোথা থেকে শিখছিস? বরের মাইর টাইর খেয়েই কি এই উন্নতি?”
শুভ্রতা ঘরের ভেতর পায়চারি করতে করতে নাক শিটকালো।
—-” সিগারেট খাচ্ছিলি ভাইয়া? সিগারেটের গন্ধে আমার বমি পায়।”
শুভ্রব তাড়হুড়ো করে ফ্যানের সুইচ অন করলো। অপ্রস্তুত হেসে বলল,
—-” ভার্সিটি থেকে এলি নাকি? ক্লাস টাস খুব বেশি ফাঁকি দিচ্ছিস আজকাল। তোর বরকে বলব দাঁড়া।”
শুভ্রতা মুখ ভেঙিয়ে বলল,
—-” বলো যাও। আমার বর আমায় বকে টকে না। তার আস্ত একটা অংশীদার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখন তার কাছে আমার সাতখুন মাফ।”
শুভ্রব চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
—-” ইশরে! বেচারা সাদাফ ভাইকে নিশ্চয় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খেয়ে ফেলছিস তুই। সাদাফ ভাইকে আগেই বলেছিলাম, আর যায় করুন আমার বোন নামক পেত্নীকে বিয়ে করবেন না। দেখতে যেমন পেত্নী। আচরণও তাই।”
শুভ্রতা নাক-মুখ ফুলিয়ে তাকাল। কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে বিছানায় পড়ে থাকা বইয়ের দিকে ইশারা করে বলল,
—-” এতো বই? এতো বই পড় তুমি?”
শুভ্রব হেসে বলল,
—-” এবার বিসিএস দেব ভাবছি। তুই পেত্নী হলে কি হবে? আমার মামনীটা তো একদম পরী হবে। মামুর কাছে ওর সব আবদার গ্রেন্টেট। ও আসার আগে মামুর একটা পার্মানেন্ট জব চাইই চাই।”
শুভ্রতা মুখ কালো করে বলল,
—-” ধুর! আমার এখন নিজের বাচ্চাকেই হিংসে হচ্ছে।”
শুভ্রব হেসে ফেলল। ছোট্ট শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
—-” তুই ভালো আছিস বুচি?”
শুভ্রতা হাসলো। নরম গলায় বলল,
—-” তুমি ভালো আছ?”
—-” ভালো থাকবো না কেন? বেশ আছি। সামনের মাসে বাবা রিটায়ার করবেন। বাবা রিটায়ার করার আগেই নিজের জন্য একটা চাকরী বাকরি খুঁজছি। রাত-দিন পড়াশোনা করছি। ভালো না থেকে উপায় আছে?”
শুভ্রতা হুট করেই বলল,
—-” বিয়ে করে ফেলো না ভাইয়া। জীবনটা তো কারো জন্য থেমে থাকে না।”
শুভ্রব হাসল। শুভ্রতা উঠে গিয়ে শুভ্রবের পায়ের কাছে মেঝেতে বসতে নিতেই খপ করে ধরে ফেলল শুভ্রব। নিজে উঠে শুভ্রতাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল,
—-” পাগল হয়েছিস? এখন তো একটু কেয়ারফুল হতে পারিস নাকি?”
শুভ্রতা কাতর স্বরে বলল,
—-” পৃথাকে বিয়ে করে নাও ভাইয়া। পৃথা ভালো মেয়ে। ও তোমাকে বিয়ে করতে চায়।”
শুভ্রব কপাল কুঁচকে বলল,
—-” পৃথা? পৃথা কে?”
শুভ্রতা অবাক হয়ে বলল,
—-” আমার ননদ। পৃথাকে চিনো না তুমি?”
শুভ্রব মাথা নাড়িয়ে বলল,
—-” ওহ আচ্ছা। চিনি। চিনি মেয়েটাকে। নামটা মনে ছিলো না।”
শুভ্রতা ব্যস্ত গলায় বলল,
—-” বিয়ে করবে, ভাইয়া?”
শুভ্রব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—-” আমি ভালো আছি।”
—-” একা একা ভালো থাকা যায়?”
—-” একা কোথায়? তুই আছিস তো। চোখ বন্ধ করলেই পেত্নীর মতো ঘাড়ে চাপিস।”
শুভ্রতা ক্ষুণ্ণ গলায় বলল,
—-” ধুর! মজা করবে না তো ভাইয়া। আমি সিরিয়াস। সারাজীবন কি ঘাড়ে চাপার জন্য আমি বেঁচে থাকবো নাকি? ডেলিভারির সময় কতশত ইন্সিডেন্ট হয়ে যায়। একটা বিয়ে করে নাও না ভাইয়া।”
শুভ্রব হেসে ফেলে বলল,
—-” এতো বিয়ে বিয়ে করছিস কেন বল তো? আমার শান্তি তোর সহ্য হচ্ছে না? বললাম তো, ভালো আছি। ওসব বিয়ে টিয়ে আমার শরীরে রুচবে না।”
—-” সঙ্গীহীন ভালো থাকা যায়?”
—-” ছোটাচ্চু তো ভালো আছে। তাহলে আমি কেন থাকব না?”
শুভ্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—-” প্লিজ ভাইয়া। আমার জন্য।”
শুভ্রব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
—-” দুপুরে খেয়েছিস? চল আজ একসাথে খাই।”
শুভ্রতা টলমলে চাহনী দিয়ে বলল,
—-” একবার ভেবে দেখা যায় না?”
—-” সাদাফ ভাইকে বলে এসেছিস? ভাই চিন্তা করবে না তো আবার?”
—-” ভাইয়া!”
—-” খেতে চল।”
শুভ্রতা নিজের পরাজয়টা মেনে নিয়ে তীক্ষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে বসে থেকে ভাইয়ের সাথে উঠে দাঁড়াল। বুকের ভেতর প্রচন্ড ব্যথা করছে শুভ্রতার। ব্যথাতুর মনটা কাতরতায় উন্মুখ হয়ে ভাবছে, তার হাসি-খুশি ভাইটা এতোটা পাল্টে গেলো কি করে? তনয়াটা ভীষণ স্বার্থপর। ভীষণ ভীষণ স্বার্থপর। তার ভাইটাকে কেমন আগাগোড়া নিঃশেষ করে দিয়ে গেল। কি দরকার ছিলো ভাইয়ের জীবনে আসার? না আসলে কি চলত না?
#চলবে….