# আরশিযুগল প্রেম .
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব – ৬২
সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। ব্যস্ত শহরটা কনে দেখা আলোয় বড় মায়াময় দেখাচ্ছে। শুভ্রব বড় রাস্তার পাশে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। হাতে আজ সিগারেট নেই। গায়ে অফিসের ভদ্র পোশাক। এইতো, তিন মাস হলো চাকরীতে ঢুকেছে শুভ্রব। মনের যন্ত্রণাটাকে ক্ষণিকের তরে ভুলার জন্য রাত-দিন পরিশ্রম করে চলেছে। সারাদিন অফিসে খেটে সারারাত বই নিয়ে বসে থাকছে। না, এই নিমকহারাম মনটাকে আর এক সেকেন্ডের বিরতিও দিতে চায় না সে। শুভ্রব কপাল কুঁচকে একটা রিকশা ডাকল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বোনটির দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” চল। একা উঠতে পারবি? আমি হেল্প করব?”
শুভ্রতা মৃদু গলায় বলল,
—-” পারব।”
শুভ্রতার উত্তরটা কানে আসার পরও শুভ্রতাকে আলতো হাতে ধরল শুভ্রব। শুভ্রতাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে পাশে গিয়ে বসল। শুভ্রতার প্রেগনেন্সির আজ সাত মাস চলছে। পা’দুটো খানিকটা ফুলে যাওয়া ছাড়া তেমন কোনো শারিরীক সমস্যা নেই। তবুও রেগুলার চেকাপের জন্য হসপিটালে যাওয়া চাইই চাই। সাদাফের কড়া নির্দেশ। না মেনে উপায় নেই। রিকশায় বসেই বাম হাতে পরা ঘড়ির দিকে তাকাল শুভ্রব। কপাল কুঁচকে বলল,
—-” সাদাফ ভাই আজ ঢাকায় ফিরবে না। অফিসের ঝামেলাটা কাল নাগাদ শেষ হবে বলেও মনে হচ্ছে না। এই অবস্থায় বাসায় একা থাকা রিস্ক। সাদাফ ভাই আজ তোকে আমাদের বাসায় থাকতে বলেছে। বনানী ফেরার দরকার নেই।”
শুভ্রতার মাথাটা সকাল থেকেই ভীষণ ভার ভার লাগছে। ঘাড়ের কাছে কেমন ঝিমঝিম করছে। প্রেশারটা আবার ফল করছে কিনা কে জানে? শুভ্রতা হালকা গলায় বলল,
—-” পৃথা তো আছে। আমি তোমার সাথে গেলে ও একা থাকবে কিভাবে? ভয় পাবে না?”
শুভ্রব ডান চোখের ভ্রু খানিকটা উঁচু করে বলল,
—-” তো ওকেও আমাদের বাসায় চলে আসতে বল। এখন তিনটার মতো বাজে। একা ধানমন্ডি যাওয়া আহামরি কোনো ব্যাপার না। ফোন দিয়ে বলে দে, তাহলেই হয়।”
শুভ্রতা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে বসে রইলো। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। চারপাশের গাড়ির পে-পু শব্দগুলো ভীষণ অসহ্য বলে বোধ হচ্ছে। আচ্ছা? এই মানুষগুলো কি একটু নিশ্চুপ থাকতে পারে না? শুভ্রতার কাছে ক্ষমতা থাকলে পুরো পৃথিবীটাকেই মিউট করে রেখে দিত সে। কি দরকার অযথা এই শব্দের? হসপিটালে পৌঁছে শুভ্রতাকে ডক্টরের চেম্বারে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল শুভ্রব। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করল। খানিকবাদেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কর্তৃক পাওয়া বার্তায় চমকে উঠল শুভ্রব। কাঁপা দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকাল। তারপরই শরীরটা অবশ হয়ে এলো তার। গলা শুকিয়ে এলো। পায়ের নিচে থাকা মাটিটাও যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। ভারী শরীর নিয়ে বসে থাকা তনয়ার চোখদুটোও ছলছল করে উঠল। এতোগুলো মাস পর প্রিয় মানুষটিকে দেখতে পেয়ে বুকের ভেতর ব্যথাগুলো কামড়ে কামড়ে উঠতে লাগল। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল তনয়া, পারল না।
শুভ্রব পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। তিল পরিমাণও নড়ল না। শুভ্রবের মনে হচ্ছে, এখনই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে সে। এই এখনই সবকিছু মিথ্যে, দুঃস্বপ্ন বলে ভেঙে যাবে। এরই মধ্যে ডক্টরের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো শুভ্রতা। দরজার বাইরেই তনয়াকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠল শুভ্রতা। মনটা খুশিতে লাফিয়ে উঠল। কিন্তু পরমুহূর্তেই চুপসে গেল মুখ। পাশে ভাইয়ের অস্তিত্বের কথা মনে পড়তেই অদ্ভুত এক ভয়ে কাটা হয়ে গেল। শুভ্রবের রক্তশূন্য মুখটার দিকে তাকিয়ে নিজের কর্তব্য স্থির করতে পারল না শুভ্রতা। ভাইয়ের ডান হাতটা খামচে ধরে আকুতির স্বরে বলল,
—-” ভাইয়া চল।”
শুভ্রতার কথাটা শুভ্রবের কান পর্যন্ত পৌঁছাল না। সে বোবা দৃষ্টিতে একবার শুধু শুভ্রতার দিকে তাকাল। মাথাটা হঠাৎই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। চারপাশের কোনো শব্দ কান পর্যন্ত পৌঁছালেও মস্তিষ্কে আঘাত হানছে না। শুভ্রতা ভীত গলায় বলল,
—-” আমার শরীর খারাপ লাগছে ভাইয়া। জলদি বাসায় চল। প্লিজ।”
‘শরীর খারাপ লাগছে’ এই শব্দটুকু বুঝতে পেরেই নিজেকে সামলে নিলো শুভ্রব। সচেতন চোখে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আলতোভাবে শুভ্রতার বাহু আকড়ে ধরল। একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে খসখসে গলায় বলল,
—-” চল। বেশি খারাপ লাগছে না তো? ডাক্তার কি বলল?”
শুভ্রতা জবাব দিল না। শুভ্রতার জবাবটা হয়তো তার কান পর্যন্ত পৌঁছালও না। আকুতিভরা দৃষ্টিতে প্রিয়তমাকে দেখে নিয়ে উল্টো পথে হাঁটা দিল। বহু আকাঙ্খিত মানুষটির সাথে একটা কথাও বলল না। ভালো থাকা, মন্দ থাকার প্রসঙ্গটাও তুলল না। একটা বারও কি সে কেমন আছে তা জিগ্যেস করা যেত না? পেছন থেকে নারীকন্ঠের তীক্ষ্ণ কান্নার স্বর ভেসে এলো। শুভ্রব থমকালো। বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে নিয়ে আবারও হাঁটা দিল নিজস্ব গন্তব্যে। নারীকণ্ঠের হৃদয়বিদারক কান্নাটা কানের কাছে বাজতে লাগল পুরোনো ক্যাসেটের মতো…. একের পর এক। করিডোরের মোড় ঘোরার সময় আড়চোখে তাকাল শুভ্রব। শেষবারের মতো চোখের তৃষ্ণাটা মিটিয়ে নেওয়া যে খুব জরুরি, খুব। তনয়া অাচ্ছন্নের মতো কাঁদছে। তার কান্নার শব্দে ছুটে এসেছে সুঠাম দেহী এক পুরুষ। চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ। বলিষ্ঠ হাতদুটো দিয়ে তনয়ার হাত চেপে ধরে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল আগুন্তক,
—-” আবারও ব্যথা করছে তনু? আর একটু অপেক্ষা করো। বেশি কষ্ট হচ্ছে?”
তনয়ার কান্নার বেগ বাড়ে। স্বামীর সামনে বসে পরপুরুষের জন্য চোখের জল ফেলা অন্যায়, মহাপাপ। কিন্তু, কি করবে তনয়া? মন কি আর মস্তিষ্কের কথা শুনে? একবার ভালোবেসে ফেললে পাপ পূণ্যের হিসেব কি রাখে এই মন। এইযে এই স্বামী নামক মানুষটাকে তনয়া এতো শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে, স্বামী হিসেবেও মানে কিন্তু ভালোবাসতে তো পারে না। ভালোবাসাটা তো শরীরে শরীরে হয় না! হয় মনের সাথে মনের। তনয়া এই লোকটিকে শরীর দিতে পারলেও মন দিতে পারে না, হাজার চেষ্টার পরও না। তনয়ার কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে। তনয়ার স্বামী, আরহান দিশেহারা হয়ে পড়ে। তনয়ার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,
—-” শান্ত হও প্লিজ। কাঁদলে তো আর ব্যথা কমবে না। একটু শান্ত হও। আরভিদ ডক্টরের সাথে কথা বলছে।”
তনয়ার কান্নার বেগ কমে আসে। ঘনঘন হেঁচকি তুলতে তুলতে চোখ বোজে। বেঁচে থাকাটা হঠাৎই ভীষণ অর্থহীন বলে বোধ হয়।
_____________________
অন্ধকার ঘরটিতে থমথমে মুখে বসে আছে শুভ্রব। তনয়া গর্ভবতী! তনয়ার শরীরে অন্যকারো স্পর্শ! কথাগুলো মনে পড়তেই মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। বুকের ভেতর তুমুল ভাঙচুর হচ্ছে। পৃথিবীটা এতোটা নিষ্ঠুর না হলে কি চলতো না? তনয়া গর্ভবতী না হলে কি চলতো না? আজ এমন, আকস্মিক সাক্ষাৎটা না হলে কি চলতো না? শুভ্রব দু’হাতে নিজের চুল খামচে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। এতোদিনের সামলে রাখা ক্ষতটা আবারও জীবন্ত, রক্তাক্ত হয়ে উঠল। নিজেকে কেমন নিঃস্ব, মাতাল বলে বোধ হতে লাগল। কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন শুয়ে থেকে আবছা চোখে বিছানার এক কোণায় শুভ্রতাকে চোখে পড়ল তার। টলমলে চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। শুভ্রব ছাঁদের দিকে দৃষ্টি রেখে নিশ্চুপ শুয়ে রইল। চোখদুটো বোজে নিয়ে মৃদু গলায় প্রশ্ন করল,
—-” কাঁদছিস কেন?”
শুভ্রতার অভিমানী কন্ঠস্বর বিপুল অভিমান নিয়ে বলল,
—-” তুমিও তো কাঁদছ। তুমি কাঁদলে আমারও কান্না পায়, জানো না?”
শুভ্রব অবাক হয়ে বলল,
—-” আমি কাঁদছি?”
—-” কাঁদছোই তো। ওইযে চোখের কোণ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। দেখছ না?”
শুভ্রব ডানহাত বাড়িয়ে নিজের চোখের জল ছুঁল, সত্যিই জল গড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
—-” তনুজা গর্ভবতী। ওর সবটুকুতেই এখন অন্যকারো ছোঁয়া, তুই জানিস?”
শুভ্রতার কন্ঠস্বর মৃদু গলায় উত্তর দেয়,
—-” হ্যাঁ জানি।”
—-” আমার কষ্ট হচ্ছে শুভি। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমার কি এতোটা কষ্ট পাওয়া উচিত?”
শুভ্রতা থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে উদাস গলায় বলল শুভ্রব,
—-” গর্ভবতী তনুজাকে কি মিষ্টি দেখাচ্ছিল, দেখেছিস? ওর আর আমার অনেক স্বপ্ন ছিল শুভি। একসাথে ঘর বাঁধব। আমাদের ছোট্ট একটা মেয়ে থাকবে। ওর নাম হবে, তুশি। কি অদ্ভুত নাম তাই না? তনুজার এই অদ্ভুত নামগুলোই ভীষণ পছন্দ ছিল। কতশত অদ্ভুত কথা বলত সে। তারপর তারপর সেই কথার রেশ ধরে নিজেই খিলখিল করে হাসতো। ও ভীষণ হাসতে ভালোবাসত, ভীষণ! ”
কথাগুলো বলে মাদক হাসল শুভ্রব। হঠাৎই ভীষণ করুণ গলায় বলল,
—-” আজকে ওর শরীরে আমার অংশ থাকার কথা ছিল শুভি। আমি ওর সাথে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারছি না। আমার নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কি মারা যাচ্ছি শুভি?”
শুভ্রতার আলতো কন্ঠ ভেসে এলো,
—-” মনে হচ্ছে না।”
শুভ্রব চোখ দুটো বোজে নিয়ে বলল,
—-” তুই কি বুঝিস? আমার সাথে হয়ে যাওয়া এই ভয়ানক অন্যায়টা কি তুই ধরতে পারিস? সমাজের এই অন্ধ নিয়ম, অন্ধ সংস্কৃতি যে আমাদের তিলে তিলে খুন করছে তা কি তুই বুঝতে পারছিস?”
—-” পারছি ভাইয়া।”
—-” আমি এই সমাজকে ঘৃণা করি। দে আর ডেম মার্ডারার।”
শুভ্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—-” তুই আবারও কাঁদছিস ভাইয়া। তুই কাঁদলে আমার কষ্ট হয়।”
শুভ্রব ধরা গলায় বলল,
—-” আমার বুকে প্রচন্ড ব্যথা করছে শুভি। আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি।”
শুভ্রতা কথার উত্তর দেওয়ার আগেই বন্ধ দরজায় করাঘাত পড়ল। শুভ্রব ঘোলা চোখে চারপাশে তাকাল। শুভ্রতা কোথাও নেই। কোথায় গেল মেয়েটা? শুভ্রব টলমল পায়ে দরজার লক খুলল। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রতা। চোখ-মুখ শুকনো। চোখের নিচে কালি। মেয়েটা হসপিটাল থেকে ফিরেই ভীষণ কাহিল হয়ে পড়েছে। চোখ দুটো কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই কেমন নিষ্প্রভ মলিন হয়ে পড়েছে। শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল শুভ্রব। শুভ্রতা হাতের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
—-” ফোন।”
শুভ্রব কপাল কুঁচকাল৷ হাত বাড়িয়ে ফোনটা কানে নিতে নিতে বলল,
—-” কে?”
শুভ্রতা উত্তর দিল না। শুভ্রব গম্ভীর মুখে বলল,
—-” হ্যালো।”
ওপাশে নীরবতা। মাঝে মাঝেই নীরব আর্তনাদ। শুভ্রবের বুকে মোচড় দিয়ে উঠল। যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় বলল,
—-” তনুজা! কেমন আছ?”
ওপাশ থেকে ফুঁপানোর শব্দ ভেসে এলো। শুভ্রব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—-” কাঁদছ কেন? কেঁদো না।”
—-” আমার সাথে একটা কথাও কেন বললে না তুমি? আমি কেমন আছি জানতে ইচ্ছে করল না?”
শুভ্রব নিজেকে শক্ত রেখে বলল,
—-” জানতে ইচ্ছে করল না তো।”
—-” তুমি রেগে আছো?”
শুভ্রব অবাক হয়ে বলল,
—-“রাগ করব কেন?”
তনয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—-” আর কয়েকঘন্টা পর আমার ডেলিভারি, জানো?”
—-” জানলাম।”
—-” আমি হয়ত আর বাঁচব না।”
—-” দূর! কি সব বলো। এমন কিছু হবে না।”
—-” তুমি আমার মৃত্যুকামনা করবে, প্লিজ? আমার কেন জানি মনে হয়, তোমার দোয়া কবুল হবে। আমার অপারেশন সাকসেসফুল না হওয়ার জন্য একটু দোয়া করবে গো?”
শুভ্রব হাসল। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে বলল,
—-” ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুকামনা করা যায় না তনুজা। দোয়া করি, অনেক বছর বাঁচো। তোমার স্বামী তোমাকে ভালোবাসে। অতীতটা ভুলে যাও, ভালো থাকবে।”
—-” তুমি ভালো আছ?”
—-” কেন থাকব না?”
—-” বিয়ে করছ না কেন?”
—-” আমার ইচ্ছে।”
—-” বিয়েটা করে নাও, প্লিজ।”
—-” খবরটা তুমি সহ্য করতে পারবে?”
তনয়া উত্তর দেয় না। শুভ্রব হেসে বলল,
—-” আমাকে আর কখনো ফোন দিও না তনুজা। সুখী হও। পৃথিবীর সবথেকে সুখী।”
কথাটা বলে ফোন কাটল শুভ্রব। শুভ্রতা স্থির দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। শুভ্রব হেসে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
—-” শরীর কেমন এখন? দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে এসে বোস।”
শুভ্রতা ধীর পায়ে ভাইয়ের বিছানার ওপর গিয়ে বসল। শুভ্রব টেবিলের ওপর থেকে টেবলেটের প্যাকেট নিয়ে দুটো টেবলেট পেটে চালান করে দিল। শুভ্রতা আৎকে উঠে বলল,
—-” কি খাচ্ছো?”
শুভ্রতার এমন প্রতিক্রিয়ায় বেশ মজা পেল শুভ্রব। হেসে ফেলে বলল,
—-” ভয় নেই। ঘুমের টেবলেট।”
—-” তুমি রোজ টেবলেট খাও ভাইয়া?”
—-” নাহ্। যখন ঘুম দরকার হয় তখন।”
শুভ্রতা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। শুভ্রব বালিশে মাথা রেখে চোখ বোজলো। মৃদু গলায় বলল,
—-” রুমে গিয়ে রেস্ট নে। শরীরটা ভালো নেই তোর।”
___________________
ঘড়িতে দুইটা বাজে। প্রচন্ড মাথাব্যথায় এপাশ ওপাশ করছে শুভ্রতা। পাশেই রাদিবা আহমেদ ঘুমোচ্ছেন। এই মাঝরাতে মাকে বিরক্ত করতে কেমন অস্বস্তি লাগছে শুভ্রতার। শুভ্রতা বিছানার হেড বোর্ডে ঠেস দিয়ে বসলো। সাদাফকে ভীষণ মনে পড়ছে তার। আচ্ছা? মেয়েরা কি বিয়ে হওয়ার পর একটু পর পর হয়ে যায়? বাপের বাড়িটা অজান্তেই কেমন কুটুম বাড়ি বনে যায়। এই যে, শুভ্রতা সারাটা দিন এই বাড়িতে ভূতের মতো ঘুরে বেড়াল। আত্মীয়দের মতো সমাদর পেল কিন্তু নিজস্বতা খুঁজে পেল না। যে শুভ্রতা এই একবছর আগেও মাঝরাতে ওঠে চেঁচামেচি জুড়ে দিতো আজ তার অসুস্থতায় মাকে ডাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। বারবার স্বামী নামক ছায়াটার কথা মনে পড়ছে। এসব কি আত্মিক দূরত্বের চিন্হ নয়? শুভ্রতার ভাবনার মাঝেই ফোন বাজল। স্ক্রিনে সাদাফের নামটা ভাসতেই খুশিতে ঝলমল করে উঠল তার মুখ। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ক্লান্ত গলায় বলে উঠল সাদাফ,
—-” তুতুনের আম্মুকে অনেক বেশি মিস করছি। ঘুম আসছে না। তুতুনের আম্মুও কি আমায় মিস করছে?”
শুভ্রতা মুচকি হেসে বলল,
—-” হুম। তুতুনের আব্বুর থেকেও বেশি মিস করছে।”
সাদাফ হাসলো। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—-” শরীর ঠিকঠাক? খেয়েছ রাতে?”
শুভ্রতা ঠোঁট উল্টে বলল,
—-” মাথাব্যথা করছে খুব। ঘুম পাচ্ছে না।”
সাদাফ উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
—-” মা কই? মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে বলো।”
—-” আম্মু ঘুমোচ্ছে। ডাকতে ইচ্ছে করছে না।”
সাদাফ হতাশ গলায় বলল,
—-” ওহ। পৃথাও নেই?”
—-” ওইটুকুন বাচ্চা মেয়েকে ঘুম ভাঙিয়ে আমার সেবা করাব? তুমিও না!”
সাদাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
—-” নিজের ওপরই মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার। অফিসের কাজ পড়ার কি আর সময় পেল না? ইরিটেটিং!”
শুভ্রতা খিলখিল করে হেসে উঠেও নিজেকে সামলে নিলো। মৃদু গলায় বলল,
—-” তোমার বউ প্রেগনেন্ট বলে কি সবাই কাজ-কাম ছেড়ে বসে থাকবে?”
—-” থাকা উচিত।”
শুভ্রতা হাসল। হঠাৎ করেই খেয়াল করল মাথা ব্যথাটা আগের থেকে অনেকটাই কমে এসেছে। মন জুড়ে শান্তি আর চোখ জুড়ে নেমে এসেছে ঘুম। সাদাফ চিন্তিত গলায় বলল,
—-” কাল যেভাবেই হোক ঢাকা ব্যাক করব। তুমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। এই অবস্থায় রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে।”
শুভ্রতা বালিশে মাথা রেখে আদুরে গলায় বলল,
—-” তুমি যদি ননস্টপ কথা বলতে থাকো তাহলে আমি ঘুমানোর চেষ্টা করতে পারি। রাজি?”
সাদাফ ভ্রু কুঁচকে বলল,
—-” ননস্টপ কথা বলতে হবে? কিন্তু আমি যে অতো কথা জানি না রে বাবা। আমার বাচ্চাকেও কম কথা বলা শেখাব। কম কথা বলা ব্রেইনের জন্য ভালো।”
—-” একদম না। বাচ্চা মানেই সারাদিন বকবক করবে। আগেই রেসট্রিকশন কেন দিচ্ছ?”
—-” এটা কোনো রেসট্রিকশন নাকি?”
—-” অবশ্যই রেসট্রিকশন। এই? আমার কি মনে হয় জানো? আমার মনে হয়, আমার ছেলে হবে। একদম তোমার মতো দেখতে হবে। তোমার মতো করে কথা বলবে। তোমার মতো করে ভ্রু কুঁচকাবে। তবে, তুমি যতটা কম কথা বলো। সে তোমার থেকে তিনগুণ বেশি কথা বলবে। ইশ! কি মিষ্টি লাগবে ওকে।”
সাদাফ হাসল। দুষ্টুমি করে বলল,
—-” আরে বাহ্। তুমি আমায় এত্তো খেয়াল করো?”
শুভ্রতা গর্বভরে বলল,
—-” খেয়াল করব না কেন? আমি তোমাকে এর থেকেও বেশি খেয়াল করি।”
—-” মাই গড্। তো, আর কি কি খেয়াল করলে? গোপনীয় কিছু খেয়াল করো নি তো আবার? না মানে, মুখ ফসকে যদি বলে টলে ফেলো। তোমার যা গ্যাং….”
শুভ্রতার মুখে রক্তিম ছায়া পড়ল। চাপা গলায় বলল,
—-” তুমি দিন দিন অনেক বেশি অসভ্য হয়ে যাচ্ছ।”
সাদাফ শব্দ করে হাসল। হাসি হাসি কন্ঠে বলল,
—-” আমি বউ পাগল হয়ে যাচ্ছি, অসভ্য হয়ে যাচ্ছি আর কিছু হচ্ছি না? ও হ্যাঁ, বাবাও তো হচ্ছি। আর কি কি হচ্ছি বলো তো? ওয়ান সেকেন্ড, আমি কাগজ নিয়ে বসছি। তুমি বলো আমি বরং নোট করে ফেলি। স্টার্ট!”
শুভ্রতা চাপা শাসনের গলায় বলল,
—-” আমি তোমার সাথে কথায় বলব না।”
—-” আচ্ছা বলো না। আমি বলছি, শুনো। তাতেই হবে।”
_____________________
পরের দিন বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল শুভ্রব। চোখ জোড়া উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা করছিল। ঠিক এই সময় পাশে এসে দাঁড়ালো পৃথা।বেশ নম্র গলায় বলল,
—-” কেমন আছেন?”
শুভ্রব মৃদু হেসে বলল,
—-” ভালো।”
—-” আমি যে আপনার দাদুর ঘরটাতে থাকি জানেন?”
—-” থাকেন নাকি? খেয়াল করি নি।”
—-” আপনি আশেপাশের কোনোকিছুই খেয়াল করেন না।”
শুভ্রব হেসে বলল,
—-” তা ঠিক।”
—-” আপনার দাদু হয়ত আমাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। মাঝরাত হলেই চটি পরে ঘরময় হাঁটাহাঁটি শুরু করেন।”
শুভ্রব স্বাভাবিক গলায় বলল,
—-” হয়তো নাইট ওয়াক করতে ইচ্ছে করে উনার। আপনি উনার হাঁটাহাঁটিতে মাইন্ড করবেন না, প্লিজ।”
পৃথা সরু চোখে তাকাল।
—-” আপনি কি আমার সাথে মশকরা করছেন?”
শুভ্রব অবাক হয়ে বলল,
—-” কই না তো! দাদু আপনাকে অতিরিক্ত বিরক্ত করলে, আপনি শুভ্রতার ঘরে ঘুমোতে পারেন। শুধু শুধু দাদুর প্রাইভেসি নষ্ট করার কি দরকার?”
পৃথা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—-” ভাবির সাথে আপনার মা ঘুমান। আমার অস্বস্তি লাগে।”
শুভ্রব ছোট্ট করে বলল,
—-” ওহ্ আচ্ছা।”
পৃথা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
—-” আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন?”
শুভ্রব নাকে-মুখে একরাশ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
—-” না।”
—-” থিওরিটেক্যালি আমিও বিশ্বাস করি না। কিন্তু ইন প্র্যাকটিস ভয়ে কাঁপা-কাঁপি করি।”
শুভ্রব বাঁকা হাসল। পৃথা অস্বস্তি নিয়ে বলল,
—-” আমি কি আপনাকে বিরক্ত করে ফেললাম? আসলে ভাবি ঘুমোচ্ছে। আন্টি কাজে ব্যস্ত। আমি আবার কথা না বলে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। ভেবেছিলাম ছাঁদে এসে একা একাই বকবক করব কিন্তু এখানে এসে আপনাকে পেয়ে গেলাম।”
শুভ্রব মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলল,
—-” সমস্যা নেই। আমি বিরক্ত হচ্ছি না।”
পৃথা মিষ্টি হেসে বলল,
—-” শুনে স্বস্তি পেলাম। এখন আর বিরক্ত করি না। ইনজয় ইউর স্মোকিং।”
শুভ্রব মৃদু হাসল। পৃথা ধীর পায়ে ছাঁদ থেকে নেমে যেতেই বুকের মাঝে দামামা বাজাতে লাগল। আজ তিন থেকে চারমাস পর কথা হলো দু’জনের। শুভ্রব সেই আগের মতো থাকলেও পৃথা সামলে নিয়েছে। নিজেকে গুটিয়ে না রেখে আগের মতোই প্রাণোবন্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। ফলাফলটা অজানা থাকলেও পুরোপুরি ব্যর্থও হয় নি পৃথা। কিন্তু আজকের কথোপকথনে পৃথার মনে আবারও প্রেমময় প্রজাপতিরা ডানা মেলল। প্রতিরোধের বাঁধ ভাঙল। এই লোকটির এই ‘ডোন্ট কেয়ার’ এটিটিউটাই ভীষণ ভালো লাগে পৃথার। কিন্তু তবুও পৃথা অটল, অবিচল। আর যায় হোক, এবার আর হ্যাংলো হতে রাজি নয় সে। সিঁড়ি বেয়ে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটিতে যেতে যেতে আবারও মনটাকে শক্ত ছাঁচে বেঁধে ফেলল পৃথা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করল।
#চলবে…..