
কুমিল্লা, চাদপুরের কিছু অঞ্চলের মানুষ বেড়াতে খুবই পছন্দ করে।
অনেক দূর সম্পর্কের আত্বীয় বাড়িও তারা ছেলেমেয়ে নিয়ে অনায়াসে চলে যায়। আত্মীয়তার সম্পর্ককে তারা বেশ গুরুত্ব দেয়। মেহমানদারীতেও তারা বেশ সচেতন।
আমার শ্বাশুড়ির বাপের বাড়ি চাঁদপুর। কখনও যাওয়া হয়নি। শ্বশুড়বাড়ি বাড়ি থেকে প্রায়ই তাগাদা আসে সেখান বেড়াতে যাওয়ার জন্য। সময়ের অভাবে যাওয়া হয়না।
একবার ঈদে শ্বশুরবাড়ি গেছি, সবাই চেপে ধরলো, চল চাঁদপুর থেকে ঘুরে আসি। সবার অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হলো। আমার শালা শালি বেজায় খুশি হলো,যখন আমি রাজি হলাম।
একদিন সকাল বেলা নারায়ণগঞ্জ থেকে লঞ্চে রওনা হলাম চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে। আমার স্ত্রী গেল না, শালা শালি ভরসা।
সেখানে আমার মামাশ্বশুর থাকেন।
চাঁদপুর স্টেশনে নেমে ইলিশ মাছের আড়তে গেলাম। এতো ইলিশ মাছ বাপের জম্মে দেখিনি। অরিজিনাল পদ্মার ইলিশ দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না, অনেকগুলো মাছ কিনে ফেললাম।
মামা শ্বশুরের বাড়ি চাঁদপুর শহর থেকে একটু ভিতরে, গ্রামের দিকে। রাস্তাঘাট খারাপ। গাড়ি গ্রামে ঢুকে না,অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হলো। রাস্তা ভাংগা হেঁটে যেতে অসুবিধা। এক লোকের সাথে রাস্তায় পরিচয় হলো,সে আমাদের এগিয়ে নিতে এসেছে। সাথে মাছের ব্যাগ, নানা ফল ফলাদির পোটলা থাকায় আমাদের বেগ পেতে হচ্ছিল।
আমাকে পেয়ে মামা শ্বশুর বেজায় খুশি হলেন। তিনি বললেন, জামাই, ইলিশ মাছ বাদ, তোমাকে আমার পুকুরের টাটকা মাছ খাওয়াবো। মুখে লেগে থাকবে।
তক্ষুনি লোকজন পাঠালেন তাদের পুকুর থেকে মাছ ধরে আনার জন্য।
তিনি একজন বড় কৃষক। কোনকিছুই কিনে খেতে হয়না। আমাদের যথেষ্ট আপ্যায়ন করলেন। রাতে কুলি পিঠা বানানো হলো, এমন মজাদার পিঠা জীবনে খেয়েছি কিনা মনে করতে পারলাম না। সকাল বেলা মামা শ্বশুর ঘুরে ঘুরে গ্রাম দেখালেন। তাদের ক্ষেত খামার দেখলাম। সাথে আছেন সেই লোক যিনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।
কাজ থাকায় পরের দিন-ই আমাকে ঢাকায় ফিরতে হবে, তাদের শত অনুরোধ সত্ত্বেও আরেকটি দিন থাকা গেল না। আমার শালা শালি দু,একদিন থাকার জন্য রয়ে গেলো। মামা শ্বশুর সেই লোককে আমার সাথে দিলেন পথ এগিয়ে দেওয়ার জন্য। ফিরতি পথে ধন্যবাদ দিলাম এবং বললাম সম্ভব হলে আমাদের বাসায় বেড়িয়ে যেতে।
ছয় মাস পর, একটা কাজে বেরুনোর সময় দেখি সেই লোক তার বউ আর দুই বাচ্চা নিয়ে আমাদের বাসায় উপস্থিত। এসেই ভাইজান বলে আমাকে এমন করে জড়িয়ে ধরলো, মনে হল শত জনম আগে থেকেই তার সাথে আমার পরিচয় আছে।
শত হলেও শ্বশুরবাড়ির আত্বীয়, কাজ ফেলে ছুটলাম বাজার করতে।
রাতে খাওয়ার টেবিলে খাচ্ছি আর গল্প করছি, সেই লোক কথা প্রসঙ্গে বলল, অনেক দিন হয় সে খাসির মাংস খায় নি। পরের দিন বাজারে দৌড়ে গেলাম খাসির মাংস আনতে। শ্বশুরবাড়ির লোক বলে কথা!
সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম, রাতে বাসায় ফিরে দেখি সেই মেহমান তখনও আছে। এক সাথে খেতে বসেছি, সে আবার জানালো,তার অনেক দিনের শখ,হাঁসের মাংস দিয়ে চিতই পিঠা খাবে।
কি আর করা!
পরের দিন সকালে বাজারে গিয়ে দুটো হাঁস কিনে আনলাম।
রাতে বাসায় ফিরে দেখি আমার সেই মেহমান হাঁসের মাংস দিয়ে আরাম করে চিতই পিঠা খাচ্ছে। আমি ফ্রেশ হয়ে খেতে বসেছি, লক্ষ করলাম, গিন্নি নাক মুখ কুঁচকে আছে। আমি বললাম, ঘটনা কী?
গিন্নি তেজ দেখিয়ে বলল, হাঁসের লোম বাছতে গিয়ে আমি শেষ। আঙুল ব্যথা করছে। বাজারের নাম শুনলে পারো তো অজ্ঞান হয়ে যাও,নিজের পক্ষের আত্মীয় হলে ঠিকই বাজার করো,আমার পক্ষের আত্মীয় হলে আজকে কখনও বাজারে যেতে না। অন্য কাউকে পাঠাতে বাজার করতে।
আমি অবাক হয়ে বললাম,আমার পক্ষের আত্মীয় মানে? তোমার পক্ষের আত্মীয় বলেই এত খাতির করছি। গিন্নি আকাশ থেকে পরলো, আমার পক্ষের আত্মীয় ! তোমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো বলে আমি ভাবলাম তোমাদের ঘনিষ্ট কোন আত্মীয় হবে!
আমি হেসে বললাম, তোমার মামা বাড়ির আত্মীয় আর তুমি চিন না? হাউ ফানি! গিন্নি এবার সত্যি অবাক হলো, আমার মামা বাড়ির আত্মীয় আর আমি চিনিনা! এতো আমার মামা বাড়ির আত্মীয় নয়।
সে তক্ষুনি তার মামা বাড়ি ফোন দিল।
তার মামা জানালো,সেই লোক তাদের কোন আত্মীয় নয়,তবে মাঝে মাঝে ফাইফরমাশ খাটে। তাদের গ্রামের লোক। সে লোককে তার মামা কিছু টাকা দিয়ে পাঠিয়েছিল আমাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। এ পর্যন্তই ব্যাপার।
গিন্নি তিনদিন যাবৎ গাধার মতো খেটে এদের সেবা করছে আমার আত্মীয় ভেবে। আর আমি কামকাজ ফেলে আমার সব,চে অপছন্দের কাজ বাজার করছি শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় ভেবে!
কিন্ত এরা কীভাবে আমাদের বাসায় এলো?
গিন্নি গিয়ে সেই লোকের কাছে যা শুনলো,তা শুনে তার অজ্ঞান হবার জোগাড়! সেই লোক তাকে জানালো,আমার শালার কাছে থেকে সে ঠিকানা জেনে রেখেছিল। আমি ফিরতি পথে তাকে ধন্যবাদ দিয়েছি এবং তাকে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসার দাওয়াত দিয়েছি, নইলে তার ঠেকা পরে নাই কামকাজ ফেলে এখানে এসে পরে থাকার! অতি ভদ্রলোক বিধায় তিনি সেই দাওয়াত কবুল না করে পারেন নাই!
আমি স্ত্রীর ভয়ে দুইদিন বাসায় ফিরলাম না। প্রতিজ্ঞা করলাম, মরে গেলেও জীবনে কাউকে ধন্যবাদ দিবো না।
কখনোই না!
#হানিফ_ওয়াহিদ