#বিচ্ছেদ পর্ব ১০
আশিক বিমান বন্দর থেকে বেরিয়েই বড় করে শ্বাস নিল। আহ্ দেশ ! নিজের দেশ !
কতদিন দেশের আলো বাতাস দেখেনি। বুক ভরে শ্বাস নিতে পারেনি। বহুদিন হলো দেশ ছেড়েছে আশিক।
কিন্তু দেশকে খুব মিস করে সে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ওরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে গেল। ইভার বাসায় পৌঁছাতে লাগলো কয়েক মিনিট মাত্র।
আশিকের বুকের ভেতরটা ঢিব্ ঢিব্ করে উঠলো।
তার সন্তান.. তার নিজের সন্তান.. যার বয়স এখন প্রায় এগারো বছর , অথচ আশিক তার কাছে একদম অচেনা একজন মানুষ !
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস !
সব দোষ তার নিজের। জীবনের সবগুলো হিসেবেই সে গোলমাল করে ফেলেছে। তার ভুলের মাশুল এখন অনেকেই ভোগ করছে। সবচেয়ে দূর্ভাগা তার সন্তান।
তার ভুলগুলোকে ক্ষমা করে তার সন্তান তাকে গ্রহন করেছে এজন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছে আশিক।
গাড়ী ইভার বাসার সামনে এসে থামলো।
ইভার এ্যাপার্টমেন্ট দশ তলায়। কলিং বেল বাজাতেই ইভা হাসি মুখে দরজা খুলে দিল।
আশিক ছোট বোনকে জড়িয়ে ধরলো। ইভা ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। এ কান্না ভাইকে ফিরে পাওয়ার আনন্দের।
আশিকের চোখ এদিক ওদিক ঘুরছে।
ইভা বললো,ভাইয়া তুমি যাকে খুঁজছো,সে সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে।
আশিকের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো !
বাবার সামনে মেয়ে আসতে লজ্জা পাচ্ছে, ঠিক যেমন অচেনা মানুষের সামনে করে।
আশিক ড্রইং রুমে গিয়ে বসল।
রাশিক ওর ল্যাগেজ গুলো নিয়ে এখনো উপরে এসে পৌঁছায়নি। ইভা ভিতরের রুমে গেল রায়নাকে আনতে।
আশিক অপেক্ষা করছে।
দরজায় কারো ছায়া !
ছোট্ট দুটি হাত পর্দাটা ধরে উঁকি দিচ্ছে, একটা নিষ্পাপ মুখ। পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। কেবল উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া চোখ দেখা গেল।
বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো আশিকের !
সোফা থেকে উঠে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে আপ্লুত কন্ঠে ডাকলো, এসো মা, আমার জান পাখি। এসো আমার কাছে।
রায়না বাবার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরলো।
বেরিয়ে এলো পর্দার আড়াল থেকে।
আশিক মুগ্ধচোখে দেখলো তার সন্তানকে।
তার রক্ত…তার আত্মা…এখন তার সামনে।
যাকে দেখতে সে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ছুটে এসেছে।
হাঁটু গেড়ে বসলো রায়নার সামনে।
জড়িয়ে ধরলো বুকের সাথে গভীর আবেগে।
আশিকের চোখ জলে ভরে গেল।
রায়না খানিকটা লাজুকতা, খানিকটা আনন্দ নিয়ে আশিকের বুকের উষ্ণতা অনুভব করলো। বাবার বুকের উষ্ণতা !
বাবারা এভাবেই ভালবাসে বুঝি !
আশিকের মমতাগুলো কান্না হয়ে গলে গলে পড়তে লাগলো।আশিকের মনে হলো,যদি পাঁজড় ভেঙে
মেয়েটাকে বুকের ভেতর নিয়ে নিতে পারতো।
আশিক চোখ মুছে মেয়েকে নিয়ে সোফায় বসলো। জানতে চাইল রায়না কেমন আছে.. বাবাকে দেখে তার কেমন লাগছে ?
রায়না মিষ্টি করে হাসলো।
বললো,খুব ভাল লাগছে।
সেন্টার টেবিলের উপর রাখা মোবাইলের পাশেই আশিকের পাসপোর্টটা উলটে-পাল্টে দেখলো। বললো,তার খুব আমেরিকা বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে।
আশিক এক হাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি শুধু বেড়াতে যাবে না,তুমি আমেরিকায় থাকতে যাবে।
তোমার বাবা আমেরিকান নাগরিক।
তুমিও তাই হবে মা।
রায়না বললো,আমি তো মাকে ছেড়ে থাকতে পারিনা, বাবা।
মাও কি আমেরিকান হতে পারবে ?
আশিক কিছু বলতে পারলো না।কি বলবে ভেবেও পেলো না।
শুধু বললো, তোমার মা কেমন আছেন ?
রায়নার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, মা ভাল আছে।
মা সবসময় বলে, আমি নাকি পুরোপুরি আমার বাবার
মতো হয়েছি। বাবা, সত্যি কি তাই ?
আমি কি তোমার মতো ?
আশিক আবেগময় কন্ঠে বললো, অবশ্যই মা, তুমি সম্পূর্ণ আমার মতো। তোমার মা ঠিক বলেন।
আশিক খেয়াল করলো রায়না তাকে তুমি করে বলছে। এতো ভালো লাগলো আশিকের।
যেমন করে ইভার মেয়ে (তার একমাত্র ভাগ্নি) বলে মামুনকে,বাবা থোনো.. বাবা থোনো একতা খুব জুলুলী কতা।
মামুন খুব আগ্রহ করে জানতে চায়, কি জুলুলী কথা ছিলো মা ?
মামুনের মুখটা কচি কচি দুই হাতের মধ্যে নিয়ে মুখের কাছে মুখ নিয়ে, দানো বাবা…. মা কি কলেতে…
ইভার ফুটফুটে আড়াই বছরের মেয়ে নায়না।
সারাক্ষণ মামুনের সাথে লেপ্টে থাকে।
কতো কথা যে সে বলে মামুনের সঙ্গে !
মামুনও অসীম ধর্য্য আর আগ্রহের সাথে মেয়ের সব কথা শোনে এবং উত্তর দেয়।
তার মেয়েটাও কি এমন করবে কোনদিন তার সঙ্গে ? এতো আল্লাদ করবে সে তার বাবার সঙ্গে ?
তাদের পরিবারে মেয়েদের খুব আদরে-আহ্লাদে বড় করা হয়। তার একমাত্র বোন ইভা কি যে আদরের ছিল সবার!
বাবার চোখের মনি ছিল ইভা।
বাবা বলতেন, ‘মেয়েরা হলো ঘরের সৌন্দর্য্য।
যার ঘরে মেয়ে নেই, তার ঘরে কোন সৌন্দর্য্যেই নেই !’
আজ বাবা বেঁচে থাকলে আশিককে ক্ষমা করতেন না রায়নার সঙ্গে এমন করার জন্য। অথবা, এমনটা হতেই দিতেন না হয়তো।
মা এবং তারা দু’ভাইও ইভার আহ্লাদ সামলাতো।
আর আজ তার একমাত্র মেয়ে কতো অনাদরে পরিবার হীন হয়ে বড় হচ্ছে।
তবে রিয়া মা হিসাবে অনেক করেছে মেয়ের জন্য। হয়তো রিয়া না হলে এমন করে রায়না মানুষ হতোনা। মেয়েকে দেখে এবং কিছুক্ষণ কথা বলে আশিক বুঝতে পেরেছে,সে অত্যন্ত ম্যানার্ড এবং স্মার্ট।
আশিক মনে মনে খুব খুশী হলো।
রিয়ার কাছে আবারও কৃতজ্ঞ হলো আশিক।
রাতে ইভার বাসায় ডিনারের টেবিলে মেয়েকে পাশে বসিয়ে খাওয়ালো আশিক। মেয়েও তার মতোই ছোট মাছ,ইলিশ মাছ পছন্দ করে।
আশিক যত্ন করে মাছের কাঁটা বেছে মেয়েকে খাইয়ে দিল। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে এতো সুখ আশিক জানতো না !
খেতে খেতে রায়না টুক টুক করে বাবার সঙ্গে গল্প করলো।
আশিক খুব মন দিয়ে সেসব গল্প শুনছিল।
ডিনার শেষ করে আশিক ব্যাগ থেকে আইপ্যাড বের করলো।
এ্যাপলের নতুন আইপ্যাডটা রায়নার হাতে দিতেই রায়না অবাক হয়ে বললো,এটা কি আমার জন্য ?
আশিক বললো,হ্যাঁ, সোনা এটা তোমার জন্য।
রায়না খুশীতে ঝলমল করে উঠলো।
আাইপ্যাডটা উল্টে-পাল্টে দেখে বললো,
আমার বন্ধুরা অবাক হয়ে যাবে।
আমেরিকান এ্যাপলের আইপ্যাড !
ওদের কারো এটা নেই।
ওরা সবাই রায়নার কথা শুনে হাসলো।
আশিক আইপ্যাডের পুরো সেটিং ঠিক করে কিছু গেইম ডাউন লোড করে দিল।
আর একটি জিনিস দেখালো রায়নাকে।
আশিকদের পুরো পরিবারের একটি চমৎকার এ্যালবাম আইপ্যাডে ইনস্টল করে দিল।
বললো,মা এটা তোমার পরিবার। তোমার শেঁকড়। এখানে তোমার দাদুভাই,দিদামনি,চাচ্চু,ফুপি,বাবা… সবাই আছে।
রায়নার সামনে অনেক চকলেট।সে ভেবে পাচ্ছেনা কি করবে।এত চকলেট সবই কি আমার ?
জানতে চাইল সে।
আশিক বললো,হ্যাঁ.. এই সব চকলেট তোমার ! এগুলো সব তুমি বাসায় নিয়ে যাবে।
রায়না খুশী হয়ে বললো,আমি আমার তিনটা বেস্ট ফ্রেন্ডকে শুধু আমেরিকান চকলেটস দিবো। আর কাউকে দিবো না।
আশিক সহ সবাই হেসে ফেললো।
রাত দশটা বাজে।
রায়নাকে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে।
রাশিক রায়নার জন্য তার বাবার আনা বড় বড় দুইটা স্যুটকেস গাড়ীতে উঠালো।
ওরা সবাই নীচে নেমে এলো।
রাশিক রায়নাকে গাড়ীতে নিয়ে বসলো।
আশিক হট্যৎ বললো,আমিও যাব।
রায়নার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, তুমি আমাদের বাসায় যাবে বাবা ?
আশিক খানিকটা বিব্রত হয়ে বললো,
তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি ?
ওরা কয়েক মিনিটেই রিয়ার বাসায় পৌঁছে গেল। রায়না বাবাকে বাই বললো।
আশিক মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো।
রাশিক ল্যাগেজ গুলো রিয়ার ছোট্ট ফ্লাটে পৌঁছে দিল। রিয়া বললো, কেমন আছো রাশিক ? এতো বড় বড় স্যুটকেস ?
রাশিক বললো, সব রায়নার জন্য। ভাইয়া এনেছে। ভাইয়া নিজেই এসেছে রায়নাকে পৌঁছে দিতে।
রিয়া চমকে উঠলো।
আশিক এখানে এসেছে ?
রায়নাকে রাশিক উপরে ওদের ফ্লাটে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেল।
আশিকের মনটা খারাপ হয়ে আছে।
দেশে এসেও মেয়েকে সম্পূর্ণ ভাবে কাছে ফিরে পেল না। আবার কালকের জন্য অপেক্ষা।
রায়নাকে কাল বিকেলে নন্দন পার্কে যাবে। সে কখনো যায়নি। তার মায়ের পক্ষে এতদূরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
তার সব বন্ধুরা নন্দন পার্কের গল্প করে, সে কেবল শোনে। তাই আগে নন্দনে যাবে।
আশিক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
এসবই তার বোকামীর ফল !
রিয়ার ফ্লাটের সামনে দাড়িয়ে কষ্ট হয়েছিল আজ আশিকের।
রিয়া অনেক কষ্ট করে যাচ্ছে।ছোটা খাট মোটামুটি ধরনের ফ্লাট। রায়নার আরো ভাল ভাবে আরো আরাম-আয়েশে বড় হওয়ার কথা।
পরিস্থিতি আজ সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে। এর জন্য সে নিজেই দায়ী।
ভুল শুধরে নেয়ার সু্যোগটা সে গ্রহন করেনি।
রিয়ার মনোবলের প্রশংসা করলো মনে মনে।
রিয়া তার উপেক্ষার পর ঘুরে দাড়িয়েছে।
নিজের যোগ্যতা আর পরিচয়ে মেয়েকে মানুষ করছে কারো মুখাপেক্ষি না হয়ে। রিয়া এমনই।
তবে কি সে রিয়াকে চিনতে ভুল করেছিল ?
আজ রিয়া তার জীবনে থাকলে জীবন কি অন্যরকম হতো ?
প্রথমবার রিয়া ফিরলো না কিন্তু তার এতো ভয়ংকর এক্সিডেন্টের খবর শুনেও যখন আসলো না,তখন রাগে -অভিমানে সে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছিল।
ভেবেছিল,রিয়া ফোন করবে বা মুখোমুখি হবে। তখন কথা হবে সরাসরি।
কিন্তু রিয়া আসেনি।
সেই রাগে দ্বিতীয়বার সে রিয়ার কথা ভাবতেও চায়নি। নীলা তার জীবনে না আসলে কি মায়ের কথা মতো সে রিয়ার কথা ভাবতো ?
নাকি ভাবতো না ?
রিয়া কি অনেক বদলেছে ?
মনে হয় বদলেছে।আশিকের কি উচিৎ রিয়ার সঙ্গে দেখা করা ? কথা বলা ?
রিয়া যে তাদের সন্তানকে সুন্দর এবং সঠিক শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে মানুষ করছে, বাবাকে ঘৃনার পরিবর্তে ভালবাসাতে শিখিয়েছে, এজন্য রিয়ার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিৎ ?
আশিক মনে মনে ঠিক করলো, একদিন রিয়ার সঙ্গে দেখা করবে।
গাড়ীটা ধানমন্ডিতে ওদের এ্যাপার্টমেন্ট হাউসের নীচে এসে থামলো। বাসায় পৌঁছে গেছে। কতগুলো বছর পর আবার নিজের বাড়ীতে ফিরলো আশিক।
মা মারা যাওয়ার এক বছর পর এসেছিল। তারপর আর আসা হয়নি।
এবার এসে এত ফাঁকা লাগছে বলার না।
রাশিক এখনো বিয়ে করেনি।তবে পছন্দ আছে।
এবার এই এক মাসের মধ্যেই রাশিকের বিয়েটা দিতে হবে। রাশিক বেশী আয়োজন পছন্দ করেনা। দেখা যাক।
বাবার কথা মনে পড়লো।
বাড়ীতে মেয়েরা না থাকলে সেটা আর বাড়ী থাকে না। কোন সৌন্দর্য্য থাকেনা।
মা নেই, ইভা নেই…
খাঁ খাঁ করছে তাদের পুরো ফ্লাটটা।
পুরোন কাজের বুয়া, মার আমলের সেই এখনো দেখে শুনে গুছিয়ে রাখে সবকিছু।
আশিক শাওয়ার নিয়ে গরম কফি নিল এক মগ। রাশিক তার জন্য স্ট্রং ব্লাক কফি বানিয়েছে।
আশিকের পছন্দ ব্লাক কফি।
নীলাকে বহুবার বলেও শেখাতে পারেনি ব্লাক কফিটা বানাতে। নীলার আগ্রহ কম ছিল।
অফিস থেকে এসে নিজেকেই বানিয়ে খেতে হতো কফিটা। আজ খুব ভালো লাগছে রেডী ধোয়া উঠা কফিটা পেয়ে।
আশিক কফি নিয়ে নিজের রুমের সুন্দর গোছানো বারান্দায় চলো এলো।
কয়েকটা টবে কিছু গাছও আছে।
একটা বগেনভিলিয়া অনেক বড় হয়ে গ্রীল বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে গেছে।
একটা বেলী আর কিছু অর্কিড দেখা যাচ্ছে।
বেলী ফুল ফুটেছে নাকি ?
মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে অন্ধকার বারান্দায়।
আশিক কফির মগে চুমুক দিল।
বারান্দার টবে বেলী গাছটা রিয়া লাগিয়েছিল
না ? এটা নিশ্চয় রিয়ার লাগানো সেই বেলী গাছটা নয় ? দশ বছর আগের সেই গাছ এখন কোত্থেকে আসবে ?
হয়তো বেলীর টবে বার বার বেলীই লাগানো হয়। তবে বোগেনভিলিয়াটা রিয়ার হাতেরই।
গাছটা পুরনো হয়েছে অনেক।
রিয়াও এবাড়ী ছেড়ে চলে গেছে বহু বছর হলো।
তবে রিয়া দারুণ কফি বানাতো।
স্ট্রং ব্লাক কফি !
রাশিক খুব যত্নে রাখে বাড়ীর সবকিছু বোঝা যাচ্ছে। এসব দেখাশোনার জন্য আলাদা কাজের লোক রাখা আছে।
বাবা-মায়ের কোনকিছুই অযত্নে নষ্ট হতে দেয়নি।
ইভাও আসে তদারকির জন্য।
এবাড়ীতে রায়নার সঙ্গে অল্প কিছু মধুর স্মৃতি আছে। ওর তিন বছর বয়সে কয়েকবার এসেছিল। এই রুমে খেলনা চকলেট নিয়ে খেলতো আশিকের সাথে।
নীলাকে বিয়ে করে চলে গেলেও আশিক চেয়েছিল রায়নার সঙ্গে যোগাযোগটা রাখতে।
কিন্তু রিয়া কঠিন ভাবে প্রত্যাখান করেছিল তার চাওয়াকে। জানিয়েছিল,শখের বাবা হওয়ার দরকার নেই। আশিক অবশ্য জোর করতে পারেনি।
কি করে পারবে ?
আশিকের ভুল সিদ্ধান্তই তাকে দূর্বল করে রেখেছিল। তখন না বুঝলেও আজ বুঝতে পারে আশিক।
নীলার কাছ থেকে এমন আঘাত না পেলে কি সে রায়নার খোঁজ করতো না ?
নিশ্চয় করতো।
আশিক নিজেকে এতোটা অমানুষ ভাবতে পারেনা।যদিও তার সিদ্ধান্ত গুলো তার সম্পর্কে এরকম ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে।
আসলে রিয়ার সামনে জোর নিয়ে দাড়াবার মতো শক্তি তো তখন তার ছিলোনা।
রিয়া তার জীবনে রায়নাকে ছাড়া অন্য কোন কিছুকে গুরুত্ব দেয়নি।
রিয়ার মমতার কাছে হেরে গেছে আশিক।
রায়না বাসায় ফিরে আগে চেঞ্জ করে স্লিপিং স্যুট পরলো।তারপর মায়ের রুমে গিয়ে বললো,মা এতো বড় স্যুটকেস ভর্তি জিনিস সবই কি আমার ?
রিয়া আশিকের আনা জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
কি করেছে আশিক ?
এত কিছু আনার কি প্রয়োজন ছিল ?
রিয়া মাথা ঝাঁকালো, হ্যাঁ সোনা, এগুলো সবই তোমার জন্য এনেছে তোমার বাবা।
— মা আমরা কি এখনই এগুলো খুলে দেখবো ? জানতে চাইলো রায়না।
— না মা, এখন অনেক রাত। সকালে স্কুল আছে। আমরা আগামীকাল বিকেলে সবকিছু দেখবো।
রিয়া জবাব দিল।
— ওকে.. মা,গুড নাইট বলে রায়না ঘুমোবার জন্য বিছানায় গেল।
এ বাসায় দু’টি ছোট ছোট বেডরুম,একটা ড্রইং কাম ডাইনিং আর ছোট্ট কিচেন। রিয়ার বেডরুমের সাথে আছে ছোট্ট একটি বারান্দা।একটা এটাচ বাথ ও একটি কমন।
রায়না রিয়ার সঙ্গেই ঘুমায়।
মাকে জড়িয়ে না ধরলে রায়নার ঘুম আসেনা।
আজও মাকে জড়িয়েই শুয়ে আছে।
রিয়া একসময় অনুভব করলো রায়না ঘুমায়নি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে..
রিয়া খুবই অবাক হলো।
মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরে জানতে চাইলো, কি হয়েছে মা,কাঁদছো কেন ?
রায়না কিছুই বললো না।কেবলই ফোঁপাতে লাগলো।
রিয়া অপেক্ষা করতে লাগলো…
রিয়া খুবই দুঃচিন্তায় পড়ে গেল।
কি হয়েছে রায়নার ? কেন এভাবে কাঁদছে ?
আশিক কি কিছু বলেছে ?
ঘুমোবার আগেও তো মেয়েটা খুশী ছিল ?
তাহলে এখন কি হলো ?
রিয়া নরম গলায় বললো, আমার লক্ষ্মী মেয়েটা কাঁদছে কেন ?
আস্তে করে রায়না বললো, মা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমাকে ছাড়া একা একা মন খারাপ লেগেছে আজ।
রিয়া বললো,কেন বাবা তোমার সঙ্গে ছিল… তোমার খুশী থাকা উচিৎ ছিল।
রায়না মায়ের মুখে হাত বুলিয়ে বললো, বাবার সঙ্গে থাকতে খুব ভালো লাগছিল মা কিন্তু আমার তোমার জন্য মন কেমন করছিল।কালও তোমাকে ছাড়া একা একা বাবার সঙ্গে ঘুরতে কষ্ট হবে, মন কেমন করবে।
মা তুমিও চলো না কালকে আমাদের সঙ্গে !
রিয়া কোন কথা বলতে পারলো না।
কি বলবে মেয়েকে ?
একটা খুব সাধারণ চাওয়ার কথা বলেছে রায়না।
সব বাচ্চারাই বুঝি এমনটা চায়।
বাবা আর মাকে এক সাথে চায়।
কিন্তু রিয়া কিভাবে করবে সেটা ?
আশিকের সামনেই তো সে যায়নি।
দরকারও হয়নি।
রিয়া গভীর মমতায় মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
কেন এতে অপূর্ণতা জীবনে ?
ছোট্ট এই জীবনে কতো না পাওয়া জুড়ে থাকে।
সব তো পাওয়া হয়না সবার।
রিয়া-রায়নাও হয়নি।
তাই এতো কষ্ট রায়নার ছোট্ট বুকে !
রিয়ার মন বিষর্ন্ন হয়ে উঠলো।
রায়নার জন্য কষ্ট হতে লাগলো।
বাবাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দের মাঝেও সু্ক্ষ্ম এক বেদনা তাড়া করছে মেয়েটাকে।
রিয়া বারান্দায় এসে দাড়ালো।
মিষ্টি একটা গন্ধ এসে লাগলো নাকে।
বারাদন্দার টবে বেলী ফুল ফুটেছে।
সাদা ফুলের সুবাস ছড়িয়ে আছে অন্ধকার বারান্দায়।
রিয়া মনে মনে বললো,
রায়নার জীবনের অন্ধকারগুলো সাদা ফুলের সুবাসে ভরে যাক…
(চলবে…)
উপন্যাস : বিচ্ছেদ
.
বিচ্ছেদ পর্ব ১১-২০