#বিচ্ছেদ পর্ব ১১
আশিক রায়নার স্কুলের গেটের সামনে অপেক্ষা করছে। রায়নার ছুটি হবে সাড়ে এগারোটায়। রায়নাদের বাসা স্কুলের ভিতরেই। কিন্তু আশিক গাড়ী নিয়ে এসেছে রায়নাকে নিয়ে কফি গ্লোরী বা ক্যাপ্টেন’স এ গিয়ে আইসক্রিম খাওয়াবে বলে।
ইভাকে ফোন করে বলেছিল রিয়াকে জানাতে।
ইভার মুখেই শুনেছে রায়নার মনে দুঃখ যে অন্য বন্ধুদের মত তার বাবা তাকে কখনো গাড়ী নিয়ে নিতে আসেনা।
রায়না সাধারণত; টিফিনের সময় একবার আসে টিচার্চ রুমে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। আজও এসেছিল। তখন রিয়া মেয়েকে বলে দিয়েছে,আজ ছুটি হলে বাসায় যেওনা। মেইন গেটে চলে যেও। ওখানে তোমার বাবা থাকবেন। আশিককে ইভা জানিয়েছে,রায়না মেইন গেট দিয়ে বেরোবে।
কল কল করে বাচ্চা মেয়েগুলো বেরিয়ে আসছে। মধ্যদুপুরের প্রচন্ড গরমে আশিক
ঘেমে নেয়ে একাকার !
দেশে আসলে গরম আর জ্যাম.. এই দুটো কষ্ট একেবারেই সহৃ হয়না।
কিছু করার নেই। ঢাকা শহরের জ্যাম আর সেই সাথে গরমটা মনে হয় কোনদিনই কমবে না। দেশের মানুষ গরম আর জ্যামে কি ভয়াবহ কষ্টে দিন কাটায় ভেবে আশিকের মন খারাপ হলো।
ছোট ছোট মেয়েগুলি ঘেমে লাল হয়ে গেছে।
আহা.. কষ্ট হলো আশিকের বাচ্চাগুলোকে দেখে।
রায়না আসেনা কেনো এখনো ?
আশিক অস্থির হলো ভিতরে ভিতরে।
বাবা এই যে আমি !
রায়নার ডাকে ফিরে তাকালো আশিক।
রায়না তার হাত ধরে আছে।কি যে ভালো লাগলো আশিকের।
এখন আর ততোটা গরম লাগছে না। মেয়েটার কপালে অল্প অল্প ঘাম জমেছে,ঠিক যেমন আশিকের কপালে জমে।
মেয়েটা পুরোপুরি তার মতোই হয়েছে।
তার মেয়ে তো তার মতোই হবে !
পিঠে স্কুল ব্যাগ আর স্কুল ইউনির্ফমে রায়নাকে কি সুন্দর লাগছে।আশিক মেয়ের থেকে চোখ সরাতে পারছেনা।মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে এলো স্কুল গেইট থেকে। গাড়ীর সামনে এসে দরজা খুলে সেকেন্ড সিটে রায়নাকে বসিয়ে দিয়ে সিটবেল্ট বেঁধে দিল।
রায়না অবাক হয়ে বললো,বাবা এটা কি তোমার নিজের গাড়ী ?
আশিক বললো,হ্যাঁ মা এটা আমার নিজের গাড়ী। আর আমার গাড়ী মানে তোমারও গাড়ী। চলো আমরা আইসক্রিম খেতে যাই।
কোথায় যাবে মা ?
রায়নার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
কফি গ্লোরী !! কফি গ্লোরীতে যাব বাবা !
আশিক গাড়ী ঘুরিয়ে কফি গ্লোরীর দিকে রওনা হলো।
ওয়েটার এসে আইসক্রিমের অর্ডার নিয়ে গেল। আশিক রায়নাকে তার পছন্দমত অর্ডার দিতে বললো।
রায়না নিজের জন্য “বাটার স্কচ,স্ট্রবেরী স্পার্কেল উইথ চকলেট মিরাকেল” অর্ডার দিল।
জানতে চাইলো, বাবা তুমি কি নেবে ?
আশিক হাসলো,আমি তো এতো আইসক্রিমের নামই জানিনা মা। তবে ভ্যানিলা আইসক্রিম ভাল লাগে। তুমিই আমার জন্য অর্ডার দিয়ে দাও, জানপাখি।
রায়না হেসে উঠলো, ওকে.. বাবা আমি তোমার জন্য “ভ্যানিলা কুকি চিপস উইথ ম্যাংগো মিন্ট” অর্ডার করি ?
আশিক আদুরে গলায় বললো, তুমি যেটা দেবে, আমি সেটাই খাবো,মা।
আইসক্রিম চলে আসলো।
আশিক ও রায়না আইসক্রিম খেতে শুরু করলো। গল্প করতে করতে আইসক্রিম খেলো তারা। টুক টুক করে রায়না অনেক কথা বললো আশিকের সঙ্গে।
আশিক মনে মনে খুশী হলো, মেয়েটা একটু একটু করে সহজ হচ্ছে তার সঙ্গে।
রায়নাকে বাড়ী পৌঁছে দিলো আশিক।
গাড়ী থেকে নেমে রায়না আশিককে জড়িয়ে ধরে বললো,থ্যাঙ্কয়্যু বাবা। কফি গ্লোরিতে
আইসক্রিম খেতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আশিক মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরলো।
এতো অল্পেই এতো খুশী হয়ে যায় তার বাচ্চাটা ?
আশিক অনুভব করলো মেয়েটা এই ছোট ছোট আনন্দ গুলো না পেয়ে বড় হয়েছে,তাই এতো খুশী হয়েছে।
বললো,আবার যাব তুমি চাইলেই।
রায়না খুশী হলো।
রায়নাকে নামিয়ে দিয়ে আশিক বাসায় ফিরলো।
আগামীকাল শুক্রবার। ছুটির দিন।
কাল রায়নাকে নিয়ে নন্দন পার্কে যেতে হবে।
ইভারাও যাবে। একসঙ্গে সবাই মিলে যাবে।
বিকেলে রায়নার টেক্স পেলো, বাবা..মা যদি আমাদের সাথে যায়, তাহলে কি কোন সমস্যা হবে ? মা গেলে আমার খুব ভাল লাগবে।
আশিক ভেবে পাচ্ছে না, কি বলবে।
রিয়া যাবে ওদের সঙ্গে নন্দনে ?
নিশ্চয় রায়না বায়না ধরেছে।রায়নার জগতটা ওর মাকে ঘিরেই। রায়নার সব গল্পেই ওর মা থাকে।
আজও আইসক্রিম খাওয়ার সময় তার মা যে আইসক্রিম খেতে ভালবাসে সেকথা কয়েকবার বলেছে।
আশিক রিপলাই করলো,আমার কোন সমস্যা নাই। তোমার মা চাইলে যেতে পারেন।
রিয়া আশিকের পাঠানো স্যুটকেস দুটো খুলেছে। আশিক কত কিছু এনেছে মেয়ের জন্য ! রায়না খুশীতে ঝলমল করছে।
এত্তো কিছু ? সবকি কিছু তার ?
রায়না ভেবেই পাচ্ছেনা এতো কিছু একসাথে কেউ কাউকে গিফট করে নাকি ?
প্লে-স্টেশন, বারবি ডল, ড্রেস,প্রচুর বেবী টয়লেট্রি’জ, প্রচুর খেলনা। প্রচুর চকলেটস।
রায়নার আলোকিত মুখ দেখে রিয়া আবেগ তাড়িত হলো। এই জীবনে প্রথম কেউ এতো কিছু রায়নার জন্য পাঠিয়েছে। দুই স্যুটকেস ভর্তি জিনিস কেউ তো রায়নার জন্য কোনদিন কেনেনি।
কেনই বা কিনবে ?
এগুলো তো সাধারণত; বাবারা কেনে সন্তানদের জন্য।
রিয়ার বড় বোনের হাসবেন্ড যখন অফিসিয়াল কাজে দেশের বাইরে যায় তখন আসার সময়
সবার জন্য গিফট আনেন। রায়নার জন্যও একটা প্যাকেট থাকে সবসময়।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই রিয়ার বোনের জন্য এবং বাচ্চাদের জন্য বড় বড় স্যুটকেস ভর্তি জিনিস নিয়ে আসে।
একবার তখন রায়না খুব ছোট ছিল।
এরকম একটা প্যাকেট রায়নার জন্য এনেছিল। রায়না খুব খুশী গিফট পেয়ে।
কিন্তু যখন বোনের বাচ্চাদের জন্য আনা স্যুটকেস ভর্তি জিনিস তাদের সামনে তাদের বাবা খুলে দেখালো, তখন রায়না তার মায়ের কানে কানে বলেছিল,মা.. আমার বাবা কবে আসবে বড় স্যুটকেস নিয়ে ?
রিয়ার বুকের ভেতর হাজারটা ছুটির আঘাত লেগেছিল সেদিন।
রক্তক্ষরণ হয়েছিল খুব বুকের ভেতর !
রায়নার প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেনি সেদিন।
আজ চোখ ভিজে উঠলো রিয়ার।
রায়না আজ তার প্রশ্নের জবাব পেয়েছে।
সে তার বাবার পাঠানো উপহারের মাঝে খুশীতে ঝলমল করছে।
রিয়ার খুব ভাল লাগছে।
রায়নার আনন্দ দেখে ভাল লাগছে।
আজ রায়না তার বাবার সঙ্গে আইসক্রিম
খেতে যেতে পেরে কতো যে খুশী !
রায়নার আনন্দ রিয়াকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
রাতে ঘুমোতে এসে রায়না মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, মা.. আজ আমি খুব হ্যাপি !
রিয়া হাসলো, জানি সোনা।
রায়না বললো, কাল আরো বেশী হ্যাপি হবো মা, যখন আমি-তুমি আর বাবা একসঙ্গে বেড়াতে যাবো।
রিয়া চমকে উঠলো, একসঙ্গে মানে ? আমি কি তোমাদের সাথে যাচ্ছি ?
রায়না মাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে বললো, মা প্লিজ তুমি যাবে আমার সাথে !
প্লিজ মা ! আমি বাবাকে বলেছি। বাবা বলেছে, তুমি চাইলে অবশ্যই যেতে পারো আমার সঙ্গে।
রিয়া ভেবে পাচ্ছেনা কি বলবে ?
আশিকের সঙ্গে বাইরে যাওয়া ?
এতে বছর যার সঙ্গে কোন সম্পর্কই নেই, তার সঙ্গে একসাথে বাইরে যাওয়া ?
কিভাবে সম্ভব ?
আশিক তাকে প্রত্যাখান করেছিল সাত বছর আগে। সে বেদনা এখনো বুকের গভীরে জমাট বেঁধে আছে।
যদিও এই জীবনে একজন মানুষকেই রিয়া ভালবেসেছে, সে হলো আশিক।
বিচ্ছেদের যন্ত্রনার পাশাপাশি ভালবাসাও বুকের কোথাও একটা লুকিয়ে ছিল। তবে,
প্রত্যাখানের অপমান ঐ মূহুটাই অপমানিত করেছিল যে রিয়া একা বাঁচার প্রতিজ্ঞায় ঘুরে দাড়িয়েছিল।
রিয়া পেরেছিল ঘুরে দাড়াতে।
আশিককে বোঝাতে চেয়েছিল,তোমাকে ছাড়াই আমাদের সন্তানকে মানুষ করবো।
রিয়া করছেও তাই।
সময়ের পরিক্রমায় রিয়া অনেক বাস্তববাদী হয়ে উঠেছে। এখন কেন জানি আশিকের উপর সেই রাগটা আর নেই।
রায়না ছাড়া ওর জীবনে আর কোন কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়,কোন কিছুই প্রিয় নয়।
আশিককে ভালবেসেছিল।
নিজেদের ভুল বোঝাবুঝি আর ইগোর করণে ওদের ভালবাসা হারিয়ে গেছে। হারানো ভালবাসা ফিরে পাওয়ার সুযোগটা আশিক নষ্ট করেছিল। প্রথম কয়েক বছর রাগ হতো আশিকের উপর কিন্তু এখন রাগ হয়না। বরং আশিকের কথা ভেবে খারাপ লাগে….
কি করছে আশিক তার নিজের জীবন নিয়ে।
সেটেল করতে পারলো না আজও।
রিয়া মনে করে এক জীবনে সব পাওয়া হয়না।
তাই আশিককে ওর পাওয়া হয়নি।
আশিক তার জীবনে নেই বলে তার বিরুদ্ধে নোংরা কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি কোনদিনই করেনি রিয়া। আশিকও করেনি। এটা হয়তো তাদের পারিবারিক শিক্ষার কারণেই। রিয়া কখনো আশিককে নিয়ে কারো কাছে বিরুপ মন্তব্য করেনা।
এবং রিয়া জানে আশিকও তাই।
রায়না নরম গলায় বললো,
মা.. তুমি যাবে তো ?
রিয়া মেয়ের মুখের দিকে চাইল।
কষ্ট হলো রিয়ার।
রিয়া বললো, ঠিক আছে , আমি যাব তোমার সঙ্গে।
ইয়ে..এএ.. মা তুমি কত্তো ভাল।
আমি কাল খুব হ্যাপি থাকবো মা।
রায়না খুশীতে উচ্ছ্বল হয়ে উঠলো।
রায়নারা নন্দন পার্কে এসে পৌঁছালো বিকাল
চারটায়। ইভা ফুপিরা এসেছে, ছোট চাচ্ছুও এসেছে। মামুন ফুফা তার অফিসের একটা বড় এসি মাইক্রো এনেছে। ওরা সবাই ওটাতে করেই একসাথে হৈ চৈ করে রওনা হয়েছিল।
আসার সময় খুব মজা হয়েছিল।
ফুপি গান শুরু করলো..
বাবা বললো,মা আমি তো শুনেছি তুমি খুব সুন্দর গান করো। তুমিও গান গাও।
রায়না গান করেছিল।
চাচ্চু, ফুপা, ফুপি আর সে পুরা রাস্তা গান করতে করতে এসেছে।
বাবা গান করেনি তবে তাল দিয়েছে।
মা চুপচাপ ছিল। তবে রায়না গান করেছে বলে মাকে খুশী খুশী মনে হচ্ছিল।
রায়নার খুব ভাল লাগছিল। তার ফুপি কতো ভাল। তাকে খুব আদর করে।
ফুপা তো তাকে ‘ইয়াং লেডী’ ডাকে !
আর চাচ্চু তাকে মামনি ডাকে।
মা ছোট থেকেই বলতো, এরা তোমার ব্লাড… এরাই তোমার পরিবার। এরা তোমাকে অনেক ভালবাসে।
আজ বাবাও তাই বলেছে।
বাবা গাড়ীতে উঠার সময় বলেছিল, জানপাখি.. আজ তুমি তোমার নিজের পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছো।
বাবা তাকে ‘জানপাখি’ বলে ডাকে।
রায়নার এতো ভাল লাগছিল।
সবাই তাকে কতো ভালবাসছে। তার দিকে কত্তো খেয়াল রাখছে।
পরিবার মানেই কি এমন ?
রায়না জানতো না।
এবার স্কুলে বন্ধুদের কাছে সেও তার পরিবারকে নিয়ে গল্প করবে।
যেদিন ক্লাসে পরিবার নিয়ে পড়াচ্ছিল সোস্যল সাইন্স টিচার। তখন পরিবার নিয়ে তিনি অনেক কথা বলছিলেন। মিস সবাইকে পরিবারের সাথে সবার মজার ঘটনা শেয়ার করতে বলেছিলেন।
সবাই করেছিল।
রায়না তার মায়ের সঙ্গে তার মজার ঘটনা শেয়ার করেছিল। তখন মিস বলেছিলেন,
— রায়না তোমার পুরো পরিবারের কথা বলো। বাবা-মা,চাচা-চাচাী,ফুপু,দাদা-দাদী সবার কথা বলো।
রায়না কিছু বলতে পারেনি সেদিন।
শুধু মিসকে বলেছিল,আমি তাদের কথা কিছু জানিনা মিস। আমি মায়ের সঙ্গে থাকি।
ক্লাসের সবাই হেসে উঠেছিল।
রায়নার চোখে জল এসে গিয়েছিল।
তখন ক্লাস টু-তে পড়তো।
মিস সবাইকে বকা দিয়েছিলেন।
রায়নার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন।
মন দিয়ে পড়াশোনা করো, রায়না।
মিসকে খুব পছন্দ করে রায়না।
এখনো ওর খোঁজ নেন মিস।
রায়নার ইচ্ছে করছে আরেক বার পরিবার নিয়ে ক্লাস হোক, তাহলে সে আজকের আনন্দের ঘটনাটা শেয়ার করে পারবে।
রায়না বাবার হাত ধরে পার্কের ভেতরে ঢুকলো। রায়নার খুব ভাল লাগছে।
বাবাকে বললো, আমরা কি সব রাইডে চড়বো বাবা ?
আশিক বললো, তুমি চাইলে অব্যশ্যই সব রাইডে চলবো।
রায়না আদুরে গলায় বললো, আমার তো সব রাইডে চড়তে ইচ্ছা করছে। কিন্তু আমি তো ২/১ টাতে একটু ভয় পাই বাবা !
আশিক গভীর মমতায় মেয়ে কে বললো,
আমি তোমাকে শক্ত করে ধরে থাকবো মা।
রায়না হাসলো,তাহলে আর ভয় লাগবে না বাবা।
চাচ্চু অনেক টিকেট কেটে আনলো।
রাইনা বাবার সাথে রোলার-কোস্টারে উঠলো।
এক পর্যায়ে ভয়ে রায়না বাবার হাত শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
আশিক দুই হাত দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলো মেয়েকে।
কোষ্টার উল্টা হয়ে ছুটতে লাগলো।
আশিকের মনে হলো,এরকম ভাবেই জীবনের উল্টো পথে অসহায় ভাবে সে তার কলিজার টুকরাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের সুখ খুঁজেছিল।
কতো নিষ্ঠুর বাবা সে !
কেন এমন করেছিল আশিক ?
নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলো বার বার।
আশিকের মনে হলো জীবনটা রোলার কোস্টারের মতোই। কখনো সোজা হয়ে আবার কখনোবা উল্টো হয়ে ছুটছে…
রায়না নিশ্চিন্তে বাবার বুকে মাথা রেখে ভয়টাকে জয় করার চেষ্টা করছে।
আশিক নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলো,
এতোকাল নিজের জন্য বাঁচতে চেয়েছে,কিন্ত এবার বাঁচবে শুধু তার মেয়ের জন্য।
রোলার কোস্টার থেমে গেল।
রায়না বাবার হাত ধরে নামলো।
এরপর আরো অনেক রাইডে উঠলো রায়না
কতো সব মজার মজার রাইড।
ট্রেনের ভুত গুলোর জন্য তার খুব মায়া হলো।
মা বললো,ভুতের পোষাক পরে যে দু’জন মানুষ সবাইকে ভয় দেখায়, এজন্য তাদেরকে টাকা দেয়া হয়।
এভাবেই সে অর্থ উপার্জন করে তারা পরিবারকে দেখাশোনা করে।
এতো গরমে এরকম পোষাক পরে থাকতে কত কষ্ট হয় ভুত বেশী লোকগুলোর। এটা ভেবে মন খারাপ হলো রায়নার।
তারা থ্রিডি মুভি দেখলো।
মা আর ফুপি খুব ভয় পেলো যখন সাপটা লম্বা হয়ে বেরিয়ে আসছে মনে হলো।
তারা হালকা চিৎকার করে উঠলো ভয়ে।
তাই দেখে রায়না,চাচ্চু আর ফুপা হেসে উঠলো।
রায়না ম্যাজিক কার্পেটে উঠলো চাচ্চুর সঙ্গে।
অনেক এক্সাইটিং। ভয় ভয় লাগছিল।
চাচ্চু তাকে শক্ত করে ধরেছিল।
ফুপিটা খুব ভীতু !
সবকিছুতেই ভয় পায়। রায়না হাসে ফুপির কান্ড দেখে। ফুপি রায়নাকে ভেংচি কেটে বললো,হাসিস কেন বুড়ি ? তোর বুঝি খুব সাহস ?
রায়না আরো হেসে গড়িয়ে পড়লো।
ওরা একটা খাবারের দোকানে বসলো।
চিকেন বারকিকিউ আর কফি খেলো সবাই।
রাশিক, ইভা,মামুন ওরা সবাই রিয়াকে খুব টেককেয়ার করছে। রিয়া খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে আছে।
রায়নাকে ওর বাবা খাইয়ে দিচ্ছিল।
পুরো ঘোরাঘুরিতে প্রচুর ছবি তোলা হলো।
রায়না ছবি তোলার সময় বাবার বুকের কাছে গিয়ে দাড়ায়।
তার বাবাও তাকে কাছে টেনে নেয়।
সন্ধ্যার আগে আগে ওরা নন্দন পার্ক থেকে বেরিয়ে বাড়ীর পথ ধরলো..
রাতে বাসায় ফিরে রিয়া স্কুলের কিছু কাজ ছিল, সেগুলো শেষ করলো।
রায়না খুব টায়ার্ড ছিল।
গরম পানি দিয়ে শাওয়ার নিয়ে একটু তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
রিয়া সব শেষ করে রাতে এক কাপ চা খায়।
রহিমা খালা চা দিয়ে ঘুমোতে চলে গেল।
রিয়া চা নিয়ে ওর প্রিয় বারান্দায় চলে এলো।
আজ একটা অন্যরকম দিন ছিল।
বহুদিন পর আশিকের সঙ্গে দেখা হলো।
আশিক আগের মতই আছে।
একটুও বদলায়নি।
সরাসরি কথা হয়নি রিয়ার সঙ্গে।
তবে আজকে রায়নাকে তার পরিবার ফিরিয়ে দিতে পেরে খুব শান্তি লাগছিল রিয়ার।
যদিও,আজ সে ঐ পরিবারের কেউই নয়।
সে ওদের মাঝে থেকেও ওদের কেউ ছিলোনা।
কি অদ্ভুত মানুষের জীবন !
রিয়া এমন জীবন চায়নি,তবুও ওর জীবন
এমন হয়ে গেল।
আশিক মেয়ের প্রতি এই মমতা যদি সাত বছর আগে অনুভব করতো, তাহলে সব কিছু
কত অন্যরকম হতে পারতো।
আশিক নিজেও তো সুখী হয়নি।
রিয়া রুমে ফিরে এলো।
রায়না ঘুমাচ্ছে…
কি অপূর্ব এক প্রশান্তি ওর সমস্ত মুখে ছড়িয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে মেয়েটা হেসে উঠলো।
রিয়ার মন ভরে গেল।
পরবর্তী কয়েকদিন বিকেলে প্রতিদিন আশিক এসে রায়নাকে নিয়ে যেত। প্রতিদিনই রায়না মাকে সাথে যাওয়ার জন্য বায়না করতো।
রিয়া যায়নি। কেমন যেন এক অস্বস্তি লাগতো। তাই যায়নি। রায়নাকে বুঝিয়ে বলেছে। রায়না মুখে বলতো, ঠিক আছে মা।
কিন্তু ওর মুখটা দেখে রায়নার খুব কষ্ট হতো।
কেন এতো কষ্ট রায়নার ছোট্ট জীবনে ?
রায়না যা চায় তা মনে হয় সব বাচ্চারাই চায়।
বাবা-মাকে একসাথে চাওয়া,কাছে পাওয়া।
রায়নাও তাই চায়।
আশিক দেশে এসেছে দশদিন হয়ে গেছে।
আর বিশ দিন থাকবে আশিক।
আজ রায়নাকে নিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কে শপিং করতে যাবে।
আশিক গতকাল রাতে ইভার মাধ্যমে জানিয়েছে আজ যেন তাদের সঙ্গে রিয়া শপিং এ যায়। কারণ, রায়নার কিছু পোষাক কিনবে আশিক, যেখানে রিয়ার থাকাটা জরুরী মনে করছে সে।
বাচ্চা মেয়েদের পোষাক কেনার ব্যাপারে আশিকের কোন আইডিয়া নেই।
কাজেই রিয়া থাকলে ভালো হবে। তাছাড়া, রায়নার ব্যাপারে রিয়ার চেয়ে ভালো কেউ বুঝবে না।
রিয়া রায়নাকে নিয়ে রেডী হয়ে অপেক্ষা করছিল,আশিক গাড়ী নিয়ে আসলো।
ওরা যমুনার দিকে রওনা হলো।
যমুনায় গিয়ে রায়নার জন্য ড্রেস কেনার জন্য
আশিক প্রথমেই ফ্রি-ল্যান্ডে ঢুকলো।
আশিক সবসময়ই যেকোন কিছু কিনতে গেলে ব্র্যান্ডেরই পছন্দ করে। এখনো তেমনই আছে।
রিয়া খুব অস্বস্তি বোধ করছে।
এসব ব্র্যান্ডের দোকানে পোষাকের দাম যথেষ্ট বেশীই হয়। রায়নার খুব ওয়েষ্টার্ন পোষাক পছন্দ। এসব পোষাক আজকাল পাওয়াও যায় কিছু ভাল ব্র্যান্ডের দোকানে।যেমন,ফ্রিল্যান্ড, ইয়োলো,
এ্যাসটেসি,ইনফিনিটি,ব্লু…
রিয়ার পক্ষে এগুলো কিনে দেয়া কষ্টকর হয়।
তাই, সেভাবে রায়নাকে এসব ব্র্যান্ডের পোষাক কিনে দেয়া সম্ভব হয়না।
রায়নার পছন্দ থাকলেও মুখ ফুটে বলেনা রিয়াকে। অথচ,আজ বাবার হাত ধরে কনফিডেন্টলি ঘুরে ঘুরে পোষাক পছন্দ করছে। রায়নার চোখে-মুখে অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠেছে।
রিয়ার ভালো লাগলো দেখে।
সব শিশুরাই বোধহয় বাবাকে পাশে পেলে অনেক বেশী আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে !
একটা ড্রেস ট্রায়াল দিয়ে রিয়াকে দেখালো।
একটু দূরে দাড়িয়ে ছিল রিয়া। মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বললো।বাবা-মেয়ে দু’জনেই খুশী হয়ে উঠলো।
রিয়ার ভাল লাগলো।
ইয়োলো থেকেও সুন্দর একটা টপস কিনলো রায়না। রিয়া দু’একবার বলার চেষ্টা করলো,এতো কিছু এনেছেন তোমার বাবা। আবার এতো শপিং কেনো?
আশিক রায়নাকে বললো, মাকে বলো এটা হলো বাবার হাত ধরে কেনার আনন্দের শপিং।
ওরা খাবারের দোকানে বসলো। রিয়া শুধু কফি নেবে বললো। রায়না আইসক্রিম।
আশিক ব্লাক কফি অর্ডার করলো।
ওয়েটার আশিকের সামনে কফি রাখতে রাখতে বললো,স্যার আপনার ব্লাক কফি!
রিয়া ঝট্ করে তাকালো আশিকের দিকে।
ব্লাক কফি ! ব্লাক কফি !
আশিক এখনো ব্লাক কফি খায় !
সেটাই হওয়ার কথা।
আশিকের অনেক কিছুই আগের মতোই আছে।
একটা সময় ছিল যখন রিয়ার হাতের ব্লাক কফি ছাড়া আশিকের দিন শুরু হতো না।
আজ সেসব স্মৃতি !
রিয়ার হট্যৎ খুব জানতে ইচ্ছে করলো,বারান্দার সেই বোগেনভিলিয়া,সেই বেলী এখনো কি আছে.. যেখানে বসে আশিক দিনের শেষ কফিটা খেতো ?
নাকি রিয়ার হাতের লাগানো সেই বোগেনভিলিয়াও আজ ওর মতোই স্মৃতি হয়ে গেছে…?
রিয়া গরম কফির মগে চুমুক দিল।
( চলবে )
উপন্যাস : বিচ্ছেদ
বিচ্ছেদ পর্ব ১১-২০
https://kobitor.com/category/uponas/bissed/page/1/
.