#বিচ্ছেদ পর্ব ১৫
আশিক রায়নার দিকে তাকিয়ে আছে।
মেয়ের প্রশ্নের কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। রায়না খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন করেছে।
অথচ, আশিক সেই সহজ এবং স্বাভাবিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেনা।
রায়নাকে দুঃখ দিয়ে কিছু বলতে পারলো না আশিক। নরম গলায় শুধু বললো,
— হ্যাঁ মা, খুব ভালো হতো তাহলে। নিশ্চয় ভালো কিছুই হবে একদিন।
রায়নার চোখ দুটো উজ্জল হয়ে উঠলো।
আশিক রিয়ার বাসা থেকে বিকেলেই চলে এসেছিলো। দেশ ছাড়ার আগে জরুরী কাজ গুলো শেষ করার প্রয়োজন ছিলো।
রায়নার কথা গুলো ওর মাথায় ঘুরছে সেই দুপুর থেকেই। আশিক অনুভব করছে, মেয়েটা একটা পরিবার চায় । বাবা-মাকে নিয়ে একসাথে থাকতে পারার মতো সুখী পরিবার।
অন্য আর দশটা বাচ্চার মতো একটা খুবই সাধারণ চাওয়া। অথচ, কতো অসাধ্য মনে হচ্ছে আশিকের কাছে। কি করবে আশিক ?
যখন করার মতো সুযোগ ছিলো তখন হেলায় হারিয়েছে সুযোগ। আজ খুব মাকে মনে পড়ছে। মা যে কতোটা সঠিক ছিলেন আজ মর্মে মর্মে অনুভব করছে আশিক।
তখন যদি মায়ের কথা মেনে নিতো, আজ জীবনের স্বাদই অন্যরকম হতো !
মেয়ের কথা মনকে বিচলিত করছে বার বার।
আশিক নিজে খুব সুখী পরিবারের সন্তান।
তার বাবা-মা খুব পরিণত ছিলেন।
সন্তানদের জন্য সবরকম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন আশিকের বাবা। ওদের স্বচ্ছলতা ছিল কিন্তু অঢেল সম্পদ ছিলোনা। তাই কতো সময় বাবা-মাকে ওদের আরো একটু ভালো রাখার জন্য নিজেদের সাধ-আহ্লাদকে বিসর্জন দিতে হয়েছে হাসিমুখে। তারা যথাসাধ্য করেছেন ওদের তিন ভাই-বোনের জন্য।
এবার আশিকের পালা !
কি করবে আশিক ?
সে কি ফিরিয়ে দিতে পারবে তার সন্তানকে
সুখের চাবিটা ?
রিয়াকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে রায়না।
আশিক চলে গেছে। দুপুরে লাঞ্চের পর জরুরী কাজে বাইরে গিয়েছিল। পরে এসে রায়নার সঙ্গে আরো কিছু সময় কাটিয়ে চলে গেছে। কাল রায়নাকে ওদের ধানমন্ডির বাসায় নিয়ে যাবে। দুপুরে ওখানেই লাঞ্চ করবে রায়না।
রাতে ইভার বাসায় সবাই একসাথে হবে।
রিয়াকেও ইভা অনুরোধ করেছে বার বার তার বাসায় যাওয়ার জন্য।
পরশু আশিকের ফ্লাইট।
সময়টা দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল।
মাত্র তো সেদিন আসলো আশিক। এরই মধ্যে চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেলো।
মেয়েটার মন খারাপ মনে হচ্ছে। একবার রিয়ার কাছে জানতে চেয়েছে,
— মার্চ মাস আসতে কতো দেরী, মা ?
রিয়া বলেছে,
— আরো ৮/৯ মাস দেরী, কেনো?
চুপ করেই ছিল রায়না। অনেকক্ষণ পর বলেছে,
— বাবা আবার মার্চে আসবে বলেছে।
রিয়া আর কোন প্রশ্ন করেনি।
রায়নাকে মানিয়ে নেয়ার সময় দিতে হবে।
এতোকাল একভাবে জীবন যাপন করেছে। বাবা না থাকার কষ্ট নিয়ে বড় হয়েছে। হঠাৎ জীবনে এতো বড় পাওয়া, সেটাও স্বপ্নের মতো।
আশিক চলে গেলে রায়না স্বপ্নের দিন গুলোর জন্য মন খারাপ করবে এটাই তো স্বাভাবিক।
রিয়ার খারাপ লাগছে।
কলিগরা কেউ কেউ আশিককে দেখেছে।
আফসোস করে বলেছে,
— কেন তোমরা আলাদা হয়েছিলে ? কতো ভালো হতো আজ একসঙ্গে থাকলে !
রিয়া ম্লান হেসে বলেছে,
—- মানুষ যদি তার ভবিষ্যৎ দেখতে পেতো, তাহলে জীবনে একটাও ভুল করতো না।
সত্যিই তাই!
রিয়া বা আশিক ওদের ভবিষ্যৎ জানতো না। তাই এতো বড় ভুল করেছিলো।
রায়না না থাকলে হয়তো এই ভুল আজ এতো বড় হয়ে দেখা দিতো না।
কিন্তু যেহেতু রায়না ওদের জীবন জুড়ে আছে, তাই ওদের আরো সচেতন হওয়া উচিৎ ছিল।
আচ্ছা,আশিক কি রায়নাকে একবারে নিয়ে যেতে চাইবে সিটিজেনশীপ হয়ে গেলে ?
রিয়া কিভাবে থাকবে রায়নাকে ছাড়া ?
আশিক অবশ্য একবারও বলেনি একেবারে নিয়ে যেতে চায়। রায়না আসা-যাওয়া করতে পারবে।ভবিষ্যৎ এ পড়াশোনার জন্য অবশ্যই আমেরিকা যাবে.. এরকমই তো বলেছিলো।
রায়না আরো কাছে সরে আসলো।
রিয়া মেয়েকে বুকের আরো কাছে টেনে নিলো।
আশিক মনে মনে খুব বিরক্ত।
নীলা আজ সারাদিনে অসংখ্যবার রিং করেছে। আশিক ফোন রিসিভ করেনি বিধায় অনবরত মেসেজ পাঠিয়েছে।
একবার ফোন রিসিভ করে বলে দিয়েছিলো, আমি আমোরিকা ফিরেই এটা নিয়ে কথা বলবো। দয়া করে আর আমাকে বিরক্ত করো না। কিন্তু নীলা তাকে সারাদিন টেক্স করে বিরক্ত করেছে।
রাতে খাবার টেবিলে রাশিককে নীলার ব্যাপারটা বললো।
রাশিক শুনে বললো,
— আমি তো জানতাম ঐ মহিলা খুব স্বার্থবাদী কিন্তু তাই বলে এতো নোংরা আর নির্লজ্জ প্রস্তাব ?
আশিক বললো,
—আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগেই। কাজেই এটা নিয়ে নতুন করে ভাবছিনা। সিটিজেনশীপের কাগজে সুপারিশ করার প্রশ্নই আসে না। অনেক হয়েছে, আর না। আমি এবার একটু শান্তি চাই।
ডিনার শেষ করে আশিক তার ব্যাগ গুছিয়ে ফেললো। কাল সারাদিন খুব ব্যস্ত সময় কাটবে।
মেয়েটাকে বুকে করে রাখবে কাল সারাদিন। আবার কবে আসতে পারবে নিশ্চিত না। মার্চে আসার চেষ্টা করবে।
আগামীকাল কোন কাজ রাখবে না আশিক।
সব কাজ শেষ করেছে আজকের মধ্যেই।
বাকী যাকিছু কাজ সব রাশিক সামলে নিবে।
অসম্ভব শান্ত এবং দায়িত্বশীল একজন ভাই পেয়েছে আশিক। ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেও টেনশন কমে যায় আশিকের।
প্রচন্ড আশাবাদী এবং ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন একজন মানুষ রাশিক।
ইভা প্রতিবার যাওয়ার সময় খাবার-দাবার নিয়ে খুব ঝামেলা করে।
যথারীতি এবারও শুটকিমাছ,আচার,মোরাব্বা,নাড়ু সহ আরো কি কি সব রেডী করেছে। কাল ওর বাসা থেকে রাশিক সেগুলো নিয়ে আসবে।
শেষ মূহুর্ত্যে খাবারগুলো বাগে ঢুকিয়ে দেবে।
আশিক একবার বলেছিলো, এতো ঝামেলা করার দরকার নেই। লাগবে না।
কিন্তু ইভার চোখ রাঙানিতে বেশী কিছু বলার সাহস হয়নি। ইভা ইদানিং মায়ের মতো শাসন করে।
ইভা কতো আদরের ছিলো ওদের।
সেই ইভা এখন সবাইকে নিয়ে কতো ভাবে.. শাসন করে। ওদের দু’ভাই এর কোন কষ্ট হলে চোখের জলে ভাসে।
বোনরা কি এমনই হয় ?
ভাইদের কাছে কোন প্রত্যাশা ছাড়াই কতো ভালোবাসে, মায়া করে বোনেরা !
সব ছেলেদেরই বোন থাকা উচিৎ।
এতো মায়া মায়ের পরে একমাত্র বোনই করতে পারে।
অন্তত আশিকের তাই ধারনা।
ইভা সংসার জীবনে খুব সুখী।
মামুনের সঙ্গে ওর সমঝোতাটা খুব ভালো।
আশিক মনে মনে খুশী বোনকে সুখী দেখে।
রাশিকের বিয়েটা হয়ে গেলে শান্তি। এবার সম্ভব হলো না। আগামীবার আরেকটু বেশী সময় নিয়ে আসতে হবে।
আশিকের ল’ইয়ার সকালে ফোনে জানালো ডিভোর্সের জন্য যাবতীয় ফর্মালিটিজ সম্পন্ন। আশিক ফিরলেই ডিভোর্স সম্পন্ন হতে পারে।
আশিক খুশী হলো মনে মনে।
যাক, একটা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে সে। নীলাকে ডিভোর্স দেয়া নিয়ে আর কোন গ্লানি নেই আশিকের মনে। সামান্য যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেটাও দূর হয়েছে নীলার মেইল পাওয়ার পরে।
আশিক জীবনে এবার অন্তত একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে বলে মনে করছে।
আরো কিছু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে আশিককে। নিতেই হবে।
রিয়ার বাসায় পৌঁছে গেল দশটার মধ্যেই।
রায়না রেডী হয়েই ছিল।
নেমে এলো রহিমা খালার হাত ধরে।
মেয়েকে নিয়ে ধানমন্ডির দিকে গাড়ী ঘোরালো আশিক। আজ সারাদিন তারা তাদের নিজের বাড়ীতে সময় কাটাবে। আজকের দিন শুধু বাবা-মেয়ের দিন।
— জানো বাবা…তোমার সঙ্গে গাড়ীতে ঘুরতে আমার খুউব ভালো লাগে !
খুশী খুশী গলায় বললো রায়না।
আশিক ঘাড় ঘুরিয়ে এক ঝলক দেখলো মেয়েকে।
বাম হাতে রায়নার ছোট্ট হাতটা ধরলো পরম মমতায়। বললো,
— আমি জানি মা। এখন আমি তোমাকে পাশে বসিয়ে ড্রাইভ করছি.. তোমার ভালো লাগছে। একদিন তুমি আমাকে পাশে বসিয়ে ড্রাইভ করবে… সেদিন আমার খুব ভালো লাগবে।
খিল খিল করে হেসে উঠলো রায়না।
— সত্যি বাবা ? আমি ড্রাইভ করতে পারবো ?
—- অবশ্যই পারবে মা। আমি নিজে তোমাকে ড্রাইভিং শেখাবো।
রায়না আশিকের বাম হাতটা জড়িয়ে ধরে বললো,
—- Thank you baba. Love you baba !
—- Love you too ma বলতে বলতে পেস্ট্রি শপের সামনে গাড়ী থামালো আশিক।
মেয়ের হাত ধরে পেস্ট্রি শপে ঢুকলো।
রায়না বেশ অবাক।
আশিক মেয়ের পছন্দমতো কেক কিনলো।
তারপর আবার বাড়ীর পথ ধরলো।
আশিক নিজের রুমে ঢুকে অবাক হয়ে গেল !
রায়না রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে চোখ বন্ধ করে, রিয়ার মতো ভঙ্গিতে।
যেন অবিকল রিয়া !
আশিকের বুকের ভেতরটা চিন্ চিন্ করে উঠলো।
ওরা একে অপরের থেকে দূরে সরতে চেয়েছিলো। কিন্তু বার বার রায়না ওদের মধ্যে অদ্ভুত এক যোগসূত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়ে যাচ্ছে !
বিয়ের পর একদিন রিয়া কথা প্রসঙ্গে বলেছিলো রকিং চেয়ার তার খুব পছন্দ।
এটা শোনার পরে আশিক রিয়ার জন্যই এই রকিং চেয়ারটা কিনেছিলো। সেদিন রিয়ার খুশী হয়ে ওঠার কথা পরিষ্কার মনে আছে।
বাচ্চা মেয়ের মতো করে আনন্দ প্রকাশ করেছিলো রিয়া। আশিককে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
—- তুমি এতো ভালো কেনো ?
রকিং চেয়ারে বসে রিয়া চোখ বন্ধ করে দুলতো। এভাবে খানিকক্ষণ দোল খেলে নাকি ওর ক্লান্তি-অবসাদ দূর হতো। ভাললাগার একটা অনুভূতি ওকে ঘিরে থাকতো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশিক ভাবলো, রিয়া কি এখনও দোল খায় কোন রকিং চেয়ারে ?
ওর জীবনের এই দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তি আর অবসাদ দূর করতে ?
রাতে খাবার পরে আশিক যখন ল্যাপটপে কাজ করতো তখন রিয়া রকিং চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে দুলতো আর টুকটাক গল্প করতো আশিকের সঙ্গে।
কি অদ্ভুত ব্যাপার আজ এতো বছর পরে সেই স্মৃতিগুলো ফিরিয়ে আনলো রায়না ?
সে অদ্ভুত ভাবে তার মায়ের মতো করেই রকিং চেয়ারে দুলছে !
আশিক মুগ্ধ হয়ে দৃশ্যটা দেখলো।
আশিক ওর নিজের রুমের ব্যালকুনিতে।
কফির মগ হাতে নিয়ে বসেছে। সকালে ওর ফ্লাইট। একটু ঘুমোন দরকার। কফি শেষ করেই আজ ঘুমোতে যাবে। কারণ একটা লম্বা বোরিং জার্নি ওকে করতে হবে।
আজ সারাদিন খুব আনন্দে কেটেছে।
দুপুরে তারা বাপ-বেটি একসঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছে। আজ রায়নাকে সে দাবা খেলা শিখিয়েছে। রায়না খুব এক্সাইটেড।
খুব আগ্রহ নিয়ে দাবা খেলা শিখলো।
পারিবারিক এলবাম গুলো দেখতে গিয়ে ওদের ছোটবেলার গল্প শুনতে চাইছিলো।
আশিকও বাবা-মায়ের সঙ্গে ওদের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন গল্প করতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছিল বার বার।
এসব গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ রায়না বলে উঠেছিল,
—- বাবা তোমার ছোটবেলাটা কত্তো সুন্দর ছিল !
আর আমার ছোটবেলাটা একদম বোরিং….
আশিক চমকে উঠেছিল মেয়ের কথা শুনে।
কথাটা ওর বুকে বিঁধে আছে এখনো।
রায়না ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট পায়। হয়তো প্রকাশ করেনা।
ইভার বাসায় রিয়া এসেছিল।
ওকে চিন্তিত মনে হলো। যদিও কথা তেমন একটা হয়নি।আশিক শুধু বলেছিল,
—- আমি আমেরিকা পৌঁছেই রায়নার কাগজ-পত্র নিয়ে ল’ইয়ারের সঙ্গে কথা বলে কাজ শুরু করবো।
রিয়া আচ্ছা বলে মাথা নেড়েছিল।
ইভা প্রচুর রান্না-বান্না করেছিল।
সবাই মিলে অনেক হৈ চৈ মজা করেছে। রায়না সবাইকে গান শুনিয়েছিলো। আশিক ওকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বসেছিল।
রিয়ার দিকে চোখ পড়তেই খেয়াল করেছিল,
রায়না যখন গান গাইছিল তখন রিয়ার চোখ দু’টো জলে টলটল করছিল।
লালনের গান শুনলে এমনিতেই মন কেমন করে আর রায়না কি দরদ দিয়ে গান করে !
আশিকের মন কেমন করছিল।
সকাল ন’টার মধ্যে এয়ারপোর্টে থাকতে হবে আশিককে। ওরা বেশ সকালেই বেরিয়ে পড়লো। রাশিক একটু দেরীতে অফিসে যাবে।
আশিককে এয়ারপোর্ট থেকে বিদায় দিয়ে ওখান থেকেই চলে যাবে।
রায়না অপেক্ষা করছিল।
আশিক ওদের বাসায় আসা মাত্রই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ কোন কথায় বলতে পারলো না আশিক।
ওর বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
কি করে থাকবে এই মায়াময় মেয়েটাকে ছেড়ে ?
রিয়া এখনো বাসায়। স্কুলে যায়নি।
মনে হয় সে যাওয়ার পরে যাবে।
আশিক বললো,
—- জানপাখি..মা, এবার আমি আসি? তুমি ভাল থেকো।
ওরা সবাই নীচে নেমে এলো।
আশিক রায়নার হাতটা আলতো করে ছেড়ে দিয়ে গাড়ীর দিকে পা বাড়ালো।
এতো কষ্ট হবে মেয়েকে ছেড়ে যেতে আগে বুঝতে পারেনি আশিক। ওর বুকের ভিতরটা ভেঙ্গে-চুরে যাচ্ছে।
হঠাৎ রায়না ছুটে এসে ওর হাত ধরে কেঁদে ফেললো, —- বাবা যেওনা, আমাকে ছেড়ে।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে…
আশিক এবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে লাগলো। ঝাপসা চোখে রায়নার দিকে তাকালো।
তার ছোট্ট মেয়েটা গভীর দুঃখ আর আসঙ্কা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
আশিকের খুব কষ্ট হতে লাগলো।
মেয়েটা হয়তো ভয় পাচ্ছে, বাবাকে না আবার হারিয়ে ফেলে !
আশিক রায়নার হাত শক্ত করে ধরে বললো,
— আবার আসবো মা। তোমাকে নিতে আসবো।
আশিক খুব ক্লান্ত। একা একা ১৪/১৫ ঘন্টার জার্নিতে কিছুই করার থাকেনা। মেয়ের জন্য মন কেমন করছিলো। গত একমাসে রায়নার সঙ্গে অনেক জায়গায় ঘুরেছে, প্রচুর ছবি তুলেছে । সেগুলো দেখলো কিছুক্ষণ। ছবি দেখে রায়নার জন্য আরো কষ্ট হচ্ছিল। দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে যখন রায়নাকে ফোন করেছিল। ওপাশ থেকে রায়নার উচ্ছ্বাসিত গলায় বাবা..বাবা.. ডাক শুনে চোখ ভিজে উঠেছিলো আশিকের।
মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছে আর দু’চোখ দিয়ে কেবলই জল পড়েছে আশিকের।
এক ইন্ডিয়ান মেয়ে অবাক হয়ে আশিকের নিঃশব্দ কান্না দেখছিলো।
এতো মায়া.. এতো ভালবাসা সন্তানের জন্য হয় আশিক জানতো না।
কিছুই ভালো লাগছে না আশিকের। শুধু রায়নাকে মনে পড়ছে। আমেরিকায় পৌঁছেই ফোন করেছিল রায়নাকে। কথা বলেছে মেয়ের সঙ্গে।
এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগে রিয়াকে যখন বলেছিলো, — আসি। ভালো থেকো তোমরা।
তখন রিয়া বলেছিলো পৌঁছে একটা খবর দিতে। আশিক অবাক হয়েছিলো। রিয়া তার পৌঁছানোর খবর পেয়ে নিশ্চিত হতে চাইছে।
তবে ভালো লেগেছিলো আশিকের রিয়ার এই জানতে চাওয়া।
পরবর্তী সাতদিন আশিকের খুব ঝামেলা এবং ব্যস্ততায় কাটলো। নীলা খুব চেষ্টা করছিলো এই মূহুর্ত্যে ডিভোর্স আটকে সিটিজেনশীপের কাগজে আশিকের সুপারিশ করিয়ে নিতে। তার জন্য সে বিভিন্ন ধরনের ছলনার আশ্রয় নেয়ার চেষ্টাও করেছিল।
কিন্তু আশিক আর কোন ভুল করতে চাইনি।
নতুন কোন ঝামেলায় নিজেকে আর জড়াতে চাইনি। তাই সে তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলো।
নীলার সঙ্গে ডিভোর্সটা হয়ে গেলো নির্বিঘ্নেই।
আশিক হালকা বোধ করছে।
জোর করে কোন সম্পর্ক টেনে নেয়া যায়না বেশীদূর। তাই সেই চেষ্টা করাও বৃথা।
নীলা আশিককে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। সে আমেরিকান সিটিজেন হয়ে দেখাবে আশিককে। আশিক জানে নীলা সেটা পারবে।স্বার্থের জন্য যারা নীচে নামতে পারে তারা তো সবই পারে। নীলা যা খুশী করুক।
আশিকের কোন আগ্রহ নেই।
আশিক চলে যাওয়ার পর থেকে রায়না খুব মন খারাপ করে থাকে। সারাক্ষণ অপেক্ষায় থাকে কখন তার বাবা ফোন করবে।
প্রথম ২/৩ দিন রিয়া কিছুই বলেনি।
সে নিজেও কষ্ট পাচ্ছিল রায়নার কষ্ট দেখে।
রায়না তার বাবাকে খুব মিস্ করছে।
এরকমটা হবে রিয়া আগেই আন্দাজ করেছিল।
সে রায়নাকে বুঝিয়েছে, এরকমই খারাপ লাগবে বাবার জন্য। কারণ প্রিয় মানুষকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হয়।
তবে রায়না যদি সবসময় মন খারাপ করে থাকে, তাহলে তার খুব কষ্ট হবে আর রায়নার বাবাও কষ্ট পাবে।
একথা শোনার পর থেকে রায়না ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে।ওর শরীরটাও আগের চেয়ে ভালো।
সে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে।
একদিন রাতে ঘুমোবার আগে হঠাৎ রায়না বললো,
—- মা আমি তোমার রকিং চেয়ারে বসে দোল খেয়েছি। খুব মজার।
রিয়া চমকে উঠলো রায়নার কথা শুনে।
চোখের সামনে ভেসে উঠলো রকিং চেয়ার নিয়ে আশিকের সাথে টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতি। রিয়ার পছন্দ বলে আশিক কিনেছিল ওর জন্য।
রিয়া অবসর পেলেই নিজের রুমে রকিং চেয়ারে বসে থাকতে ভালবাসতো।
আজও সেটা আছে আশিকের ঘরে ?
ওটা সরিয়ে ফেলেনি কেন ? রায়না ওটাতে বসেছে ?
রিয়ার খুব মন কেমন করে উঠলো !
আশিকের সঙ্গে খুব অল্প কয়েক বছর সংসার করেছিলো। সেই অল্প কয়েক বছরে অনেক মিষ্টি মিষ্টি স্মৃতি আছে ওদের।
আশিক প্রচন্ড রাগি হলেও খুব কেয়ারিং ছিলো।
রায়না ঘুমিয়ে পড়েছে।
আশিক মেইল করেছে।
রিয়া অবাক হলো। কারণ আশিক সাধারণত; রায়নাকে মেসেজ করে ম্যাসেঞ্জারে ।
আজ হঠাৎ তাকে মেইল কেনো করলো ?
রায়নার কাগজ-পত্র নিয়ে কোন জটিলতা?
সেজন্য মেইল করেছে ?
হতে পারে। রিয়া মেইল ওপেন করলো ।
আশিক মেইলটা করেছে রিয়াকেই।
ছোট্ট মেইল কয়েক লাইনের।
মেইল পড়ে রিয়া অবাক হয়ে গেল !
(চলবে)
#উপন্যাস_বিচ্ছেদ
#লেখক_মাশাওফি_আমিন
#কাকলী_প্রকাশনী
#প্রকাশকাল_গ্রন্থমেলা_২০১৮
মাশাওফি আমিন
১০.০৫.২০২১